You dont have javascript enabled! Please enable it!
কাজীপুর থানা রেইড
ভূমিকা
১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে ১ বার এবং ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ২ বার, মােট ৩ বার রেইড করে এ পুলিশ স্টেশনকে শত্রুমুক্ত করা হয়। সিরাজগঞ্জ জেলার কাজীপুর থানার কাজীপুর নামক স্থানে এ রেইড হয়। স্থানটি সিরাজগঞ্জ শহর থেকে আনুমানিক ৩০ কিলােমিটার দূরে অবস্থিত। সিরাজগঞ্জ জেলাকে শত্রুমুক্ত করার জন্য এবং শক্রর কার্যক্রমকে অবদমিত করার জন্য কাজীপুর থানার রেইড ছিল অত্যাবশ্যকীয়।
পটভূমি
মূলত এটি ছিল শত্রুর পুলিশ স্টেশনে হানা দিয়ে ধ্বংস করা, কিছু অস্ত্র ও গােলাবারুদ সংগ্রহ করা এবং শত্রুর প্রশাসনিক ভিত্তি নষ্ট করা। মুক্তিবাহিনীর পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী কাজীপুর থানাকে শত্রুমুক্ত করতে হলে কাজীপুর পুলিশ স্টেশন ধ্বংস করার প্রয়ােজন ছিল অনিবার্য। তাই পর পর ২ বার হানা দিয়ে। শত্রু ধ্বংসের চেষ্টা করা হয়। জায়গার বর্ণনা ও ভূমির রূপ বর্তমানে ঐ স্থান অস্তিত্বহীন, কারণ তা যমুনা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। যেহেতু অপারেশনের স্থানটি ছিল পুলিশ স্টেশন, সেহেতু এর আশপাশে পাকা ঘরবাড়ি ছিল। এ ছাড়া এলাকাটি ছিল উঁচুনিচু। সিরাজগঞ্জ জেলা থেকে কাজীপুর যেতে মাটির রাস্তাই প্রধান ছিল। এ থানার অদূরে যমুনা নদী প্রবাহিত ছিল, ফলে প্রাকৃতিক দিক বিচারে এ থানার স্থান একদিকে নিরাপদ ছিল। যুদ্ধের সংগঠন যুদ্ধের সংগঠন নিম্নরূপ: ক. পাকিস্তানি বাহিনী: ১ প্লাটুন (১২ বালুচ রেজিমেন্ট) ও ২০জন পুলিশ, অস্ত্র (২টি এলএমজি, ৪টি এসএমজি, ১৪টি চাইনিজ রাইফেল)। খ, মুক্তিবাহিনী: ২৫০জন, অস্ত্র (১৫টি চাইনিজ রাইফেল, ২টি এলএমজি, ৩০টি এসএলআর, ১৫টি রাইফেল, ৪টি জিএফ রাইফেল, ১টি আরসিএল, এ ছাড়া আরও ছােটো ছােটো বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র ছিল)। শত্রুপক্ষের অবস্থান। ঘটনাস্থলে শত্রুপক্ষের অবস্থান ছিল কাজীপুর থানা ক্যাম্প এবং সিরাজগঞ্জ পাকিস্তানি বাহিনী ক্যাম্প (পরবর্তী সময় সহযােগিতা করতে থানা এলাকায় যায়)। থানার চারদিকে বিভিন্ন বাংকারে শত্রুরা প্রতিরক্ষা অবস্থানে ছিল।
যুদ্ধের বর্ণনা
৬ অথবা ৭ সেপ্টেম্বর খ ম আক্তার, ফজলুল মতিন মুক্তা ও আব্দুল বারী। তালুকদারের ১টি গ্রুপ (প্রায় ১৫০জন) এবং সােহরাব হােসেন, আব্দুর রশিদ ও আবু সাঈদের (প্রায় ১০০জন) অন্য আরেকটি গ্রুপ রৌমারী পৌছায়। পরদিন উভয় গ্রুপসহ আমির হােসেন ভুলু (দলের অধিনায়ক) সিরাজগঞ্জ জেলার কাজীপুর থানা আক্রমণ করার জন্য রৌমারী ত্যাগ করে। ৮ সেপ্টেম্বর বাহাদুরাবাদ ঘাটে পৌছার মুখে দলটি বাধাগ্রস্ত হয়। তখন মানকার চরে কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে কামালপুরে প্রচণ্ড লড়াই চলছে। মুক্তিবাহিনীর ২টি গ্রুপে প্রায় ২৫০জন সদস্য ছিল। তখনকার দিনে বাহাদুরাবাদ ঘাট পার হয়ে যমুনা নদী দিয়ে সিরাজগঞ্জ জেলায় পৌছাতে হতাে। কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে কর্নেল তাহেরের লড়াই তীব্র হওয়ায় মুক্তিবাহিনী বুনিয়ার চর নামে একটা নিরাপদ জায়গায় অবস্থান নেয়। পরদিন ৯ সেপ্টেম্বর শেষ রাতের দিকে বাহাদুরাবাদ ঘাট পার হয়ে তারা যমুনা নদীতে পৌছে। উল্লেখ্য, যমুনা নদীটি ব্রহ্মপুত্র প্রধান নদের শাখাবিশেষ। পূর্ব বাহাদুরাবাদ ঘাট থেকে পশ্চিম পাড়ে গাইবান্ধা জেলার কামারজানী বাজার পর্যন্ত ২৫-৩০ মাইল দৈর্ঘ্য হবে। মাঝেমধ্যে চরে বসতবাড়ি ও কাশবনের ক্ষেত। এখানে অনায়াসে মুক্তিবাহিনী নিরাপদ অবস্থান নিতে পারে। ৯ সেপ্টেম্বর মুক্তিবাহিনী কাজীপুর থানাকে হানাদারমুক্ত করার জন্য তৈরি হয়। মুক্তিবাহিনীর পুরাে দল কান্তনগর নদীর ঘাটে পৌছায় রাত ৯টায়। মানুষ জানাজানির আগেই রাতে কাজীপুর থানা ভবন আক্রমণ করার জন্য তৈরি হয়ে নেয়। মধ্যরাতেই তুমুল বৃষ্টি শুরু হয়। বৃষ্টি শেষ হয় রাত ৩টার সময়। এমন সময় মুক্তিবাহিনী নৌকা থেকে বের হয়ে কাজীপুর থানার দিকে মার্চ করে। তাদের সঙ্গে ছিল প্রচুর ৭৪ এনার্গা গ্রেনেড, গােলাবারুদ ও মাইন।
এ রাস্তায় সন্ধ্যা রাতে মেছড়ার কাছে মাইন পোতা হয়। উদ্দেশ্য ছিল কাজীপুর থানায় পাকিস্তানি বাহিনী পরদিন ১০ সেপ্টেম্বের কনভয় নিয়ে আসার পথে মাইনের বিস্ফোরণের আঘাতে মারা পড়বে। মুক্তিবাহিনী থানার চারদিকে পাটক্ষেতে আশ্রয় নেন। থানার ওসি বাসায় অবস্থান করছিল। বাসার দুই ধারে বালির বস্ত র সাহায্যে পরিখা আর থানার চারধারে মজবুত বাংকার তৈরি করা হয়েছিল। টর্চলাইট হাতে এক সিপাহি এক বাংকার থেকে আরেক বাংকারে যাওয়ার সময় টর্চের আলােতে মুক্তিবাহিনীদের পাটক্ষেতে দেখে ফেলে। সে ‘মুক্তিবাহিনী মুক্তিবাহিনী’ বলে চিৎকার করে ওঠে। অমনি চারদিকের বাংকার থেকে গুলি শুরু হয়। মুক্তিবাহিনীও পাল্টা গুলি চালায়। দুই পক্ষের মধ্যে প্রায় ১ ঘণ্টা যাবৎ লড়াই চলে এবং তাতে মুক্তিবাহিনীর কেউ হতাহত হয় নি। প্রতিপক্ষের ৩জন মারা যায়। ধীরে ধীরে অন্ধকার কেটে ফর্সা হতে শুরু করে।
মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধপদ্ধতি ছিল হিট অ্যান্ড রান, তাই স্থায়ীভাবে থানা পতন করে এখানেই থাকা যুক্তিসংগত মনে না করে নৌকা নিয়ে পূর্ব চর পার হয়ে নিরাপদে চলে যায়। পরদিন পাকিস্তানি সেনারা কাজীপুর থানার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। আগের দিন অর্থাৎ ১০ সেপ্টেম্বর মুক্তিবাহিনী মেছড়ায় যে মাইন পুঁতে রেখেছিল, তার উপর বাংলাবাজার থেকে আগত ১টি পাটবােঝাই মহিষের গাড়ি ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বিস্ফোরণ ঘটে। মহিষসহ গাড়ােয়ান মারা যায়। পাকিস্তানি সেনারা আর কাজীপুর থানা ভবনে না গিয়ে সিরাজগঞ্জ সদরে চলে যায়। কাজীপুরের সিও অফিসের নিকটবর্তী কাজীপুর থানায় পাকিস্তানি বাহিনীর কিছু স্থায়ী বাংকার ছিল। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে মুক্তিবাহিনীর ২টি দল অত্যন্ত সফলতার সাথে এ বাংকারগুলাে আক্রমণ করে এবং পাকিস্তানি বাহিনীকে পালিয়ে যেতে বাধ্য করে।  খ ম আক্তার হােসেন, ফজলুল মতিন মুক্তা ও আব্দুস সাত্তার এ যুদ্ধে অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন এবং প্রায় ৭০জন মুক্তিযােদ্ধা এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। অস্ত্র ও গােলাবারুদের পরিমাণ কম হলেও মুক্তিযােদ্ধাদের মনােবল ছিল অপরিসীম। 
১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে বেলা ৩টার দিকে মুক্তিযােদ্ধা অধিনায়ক খ ম আক্তার ও ফজলুল মতিন মুক্তার নেতৃত্বে পূর্ব কাজীপুর এবং চরকাজীপুরে মুক্তিযােদ্ধারা অবস্থান নেন। এরপর মুক্তিযােদ্ধারা বাংকারের উদ্দেশ্যে ফায়ার করা শুরু করেন এবং পাকিস্তানি বাহিনীও পাল্টা ফায়ার করতে থাকে। উল্লেখ্য, বহুলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল বারী তালুকদার ও শামছুল ইসলামের কাছে ১টি করে এলএমজি ছিল। বিএলএফ অধিনায়ক ইসহাক আলীর গ্রুপের কাছে ১টি আরসিএল ছিল। যেহেতু পাকিস্তানি বাহিনী অবস্থান নিয়েছিল একটু উঁচু ভূমিতে, সেহেতু মুক্তিযােদ্ধাদের পক্ষে বিষয়টি একটু জটিল হয়ে দাড়ায়। কিন্তু তারা থেমে থাকেন নি। প্রায় ২-৩ ঘণ্টা ফায়ার চলে। ফায়ার চলাকালে মুক্তিযােদ্ধা আজিজ আহত এবং খ ম আক্তার হােসেনের গ্রুপের চান মিয়াসহ আরও ৫জন শহিদ হন। প্রায় সন্ধ্যা পর্যন্ত যুদ্ধ চলে। এরপর মুক্তিবাহিনীর অ্যামুনিশন শেষ হয়ে যাওয়ায় সেদিনের মতাে যুদ্ধ স্থগিত করা হয় এবং এ দিন বাংকার দখল করা সম্ভব হয় নি। পরদিন মুক্তিবাহিনী আবার বাংকার আক্রমণের পরিকল্পনা নেয়। কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনী আগেই সে সংবাদ জেনে যায় এবং মুক্তিযােদ্ধাদের কাছে গােলাবারুদ কম থাকায় পাকিস্তানি বাহিনী অচিরেই থানার দখল নেয়। পরবর্তী সময় পাকিস্তানি সেনারা আবার বেশিসংখ্যক সৈন্য নিয়ে থানা দখল করে।
৬ ডিসেম্বর সাড়ে ৩টায় মুক্তিবাহিনী আবার কাজীপুর আক্রমণ করে। উত্তর দিক খােলা রেখে বাকি তিন দিকে মুক্তিবাহিনী অবস্থান নেয়। লুৎফর রহমান (দুদু) ও খ ম আক্তারের নেতৃত্বে মুক্তিযােদ্ধাদের জিএফ রাইফেলের গুলিতে ৪-৫জনপাকিস্তানি সেনা মৃত্যুবরণ করে। প্রায় ২-৩ ঘণ্টা যুদ্ধ চলে। এর মধ্যে পাকিস্তানি যুদ্ধবিমান দেখে মুক্তিযােদ্ধারা পিছু হটতে শুরু করেন। পরদিন সেখান থেকে পাকিস্তানি বাহিনী চলে যায়। ৬ ডিসেম্বর লুৎফর রহমান (দুদু), খ ম আক্তার, ফজলুল মতিন মুক্তা, আব্দুল বারী, সােহরাব হােসেন, নজরুল ইসলাম ও মাে. রশিদের নেতৃত্বে এক সফল অভিযানে কাজীপুর থানা চিরতরে মুক্ত হয়। ২০-৩০জনের সমন্বয়ে মুক্তিবাহিনীর ১টি দল কাজীপুর থানার অস্ত্র, খাদ্য ও অন্যান্য সরঞ্জাম পাহারা দেয় এবং বাকি ১৫০জন সিরাজগঞ্জ অভিমুখে যাত্রা করে বাংলাবাজারে অবস্থান নেয়। খ ম আক্তার প্রথমে এবং যুদ্ধ শেষে লুৎফর রহমান (দুদু) থানার কার্যভার গ্রহণ করেন। সশস্ত্র বাহিনীর অবদান এ রেইডে সৈনিক মাে. আলী (বকুল) অংশগ্রহণ করে অসীম সাহসিকতার সাথে লড়ে বীরত্বের স্বাক্ষর রাখেন। বিশ্লেষণ/বিজয়ের কারণ ও পর্যালােচনা ক, মুক্তিযােদ্ধাদের অপরিসীম সাহসিকতার কারণে পাকিস্তানি বাহিনীর উপর যথেষ্ট চাপ সৃষ্টি করতে সক্ষম হন। যদিও প্রথম ও দ্বিতীয় রেইডে পাকিস্তানি বাহিনী সম্পূর্ণ পরাজিত হয় নি, তবু এ যুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধাদের ধৈর্যশীল পর্যায়ক্রমিক আক্রমণের কারণে সর্বশেষে পাকিস্তানি বাহিনী কাজীপুর থানা ছেড়ে সিরাজগঞ্জ চলে যেতে বাধ্য হয়।
মুক্তিযােদ্ধাদের অশেষ মনােবলের কারণে অস্ত্র ও গােলাবারুদের স্বল্পতা থাকা সত্ত্বেও তারা পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে তীব্র লড়াই করতে সমর্থ হন। নিজস্ব বাহিনীর সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে টিকে থাকতে এবং একাধিকবার রেইড করতে অনেকটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
শিক্ষণীয় বিষয়
ক, অসীম সাহসিকতা এবং যুদ্ধ করার উপযুক্ত কারণ যে-কোনাে বিজয়কে সহজ করে তুলতে পারে।
খ. যুদ্ধ জয়ের জন্য কঠিন মনােবল অবশ্যই প্রয়ােজন। গ, সংখ্যাগরিষ্ঠতা অনেক ক্ষেত্রে যুদ্ধ জয়ের গতিকে সহজ ও ত্বরান্বিত করে।
বেলকুচি থানা রেইড
ভূমিকা
সিরাজগঞ্জ জেলা সদর থেকে ১২-১৩ মাইল (১৯-২০ কিলােমিটার) দক্ষিণে তাঁত প্রসিদ্ধ এলাকা বেলকুচি থানা অবস্থিত। যমুনা নদীর ভাঙনের কারণে বেলকুচি থানার বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি অফিসগুলাে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গড়ে উঠেছে বাঁধের পাশ দিয়ে। এরই ফলস্বরূপ বেলকুচি থানা ভবন ও পুলিশ স্টেশন নদীর পাড়ে ওয়াপদা বাঁধের বাইরে বিরাট হাটসংলগ্ন জায়গায় অবস্থিত। পটভূমি ১০ সেপ্টেম্বর কাজীপুরে মুক্তিবাহিনী, সাথে পাকিস্তানি সেনাদের প্রচণ্ড লড়াই হয়। ফলে ১১ সেপ্টেম্বর স্বাভাবিকভাবেই পাকিস্তানি সেনারা কাজীপুর থানা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আর এ সুযােগে ৫০০জনের বিরাট মুক্তিবাহিনীর দল ঐ দিনই সিরাজগঞ্জ জেলা সদরের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে টাঙ্গাইল জেলার সিংগুলীর। চরে অবস্থান নেয়। সেখান থেকে আনুমানিক ৩০০জনের ১টি দল কাজীপুর থানায় রেইড পরিচালনা করে। জায়গার বর্ণনা ও ভূমির রূপ যমুনা নদীর ভাঙন থেকে বেলকুচি থানা রক্ষাকারী বাঁধের বাইরে পুলিশ স্টেশন এবং অন্যান্য সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অবস্থান ছিল। নদী ভাঙনের কারণে বর্তমানে ঐ পুলিশ স্টেশনের কোনাে অস্তিত্ব নেই। ঐ পুলিশ স্টেশনের অবস্থান এমন ছিল যে নদী ও স্থলপথে সেখানে পৌছানাে যেত।
যুদ্ধের সংগঠন
যুদ্ধের সংগঠন নিম্নরূপ:
ক. পাকিস্তানি বাহিনী: আনুমানিক ৩ প্লাটুন সৈন্য, অস্ত্র (অজানা)।।
খ, মুক্তিবাহিনী: আনুমানিক ৪ কোম্পানি (প্রায় ৫০০-৬০০জন, যার প্রায় ৩০০জন ঐ রেইডে অংশগ্রহণ করেন), অস্ত্র (২টি এসএলআর, ৪টি ৩০৩ রাইফেল, ১টি মেশিনগান কার্বাইন, ১টি চাইনিজ এমএমজি, ৪টি চাইনিজ এলএমজি, ১টি ব্রিটিশ এলএমজি)। শত্রুপক্ষের অবস্থান। পাকিস্তানি বাহিনীর ২০-২৫জন এবং পুলিশের ১৫-২০জনের ১টি দল বেলকুচি পুলিশ স্টশনে অবস্থান করে। তারা পুলিশ স্টেশনের চতুর্দিকে প্রতিরক্ষা অবস্থানে ছিল এবং আনুমানিক ৬-৮জনের ১টি টহল দল বাইরে ছিল, যার। সাথে মুক্তিবাহিনীর থানা এলাকা হানা দেওয়ার পূর্বেই সংঘর্ষ হয়। যুদ্ধের বর্ণনা। ১২ সেপ্টেম্বর সিংগুলীর চরের পশ্চিম দিকে নদীতে লঞ্চযােগে পাকিস্তানি বাহিনী। হিন্দু শরণার্থীর এক নৌকাবহরে আক্রমণ করে। গুলির শব্দ শুনে মুক্তিবাহিনীও চর থেকেই পাল্টা আঘাত হানে। অত্র অঞ্চলের মুক্তিবাহিনীর আমির হােসেন। ভুলু বাইনােকুলার দিয়ে দেখতে পান যাত্রীবিহীন ২০-২৫জন পাকিস্তানি বাহিনীর ১টি লঞ্চ। প্রায় ৩০-৪০ মিনিট দুই পক্ষের মধ্যে একটানা যুদ্ধ চলার পর পাকিস্তানি সেনাদের লঞ্চটি দ্রুত সিরাজগঞ্জ সদরের দিকে পালিয়ে যায়।
পরে জানা যায়, এ যুদ্ধে ৫-৬জন পাকিস্তানি সেনা মারা গিয়াছিল। এ ঘটনায়। মুক্তিবাহিনীর সাহস বৃদ্ধি পায় এবং বেলকুচি আক্রমণ করার জন্য সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সিরাজগঞ্জ ট্রাকশ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মাে. সাইদ আহম্মেদকে আদাচাকীতে (সমেশপুরের কাছে) তার গ্রামের বাড়িতে পাঠানাে হয়। বেলকুচি বা সােহাগপুরের সাপ্তাহিক হাট ছিল বুধবার। ঐ হাটে গিয়ে তেল-লবণ ক্রয়ের ফাকে থানার সবকিছু রেকি করে আসার জন্য সাইদ আহম্মদকে নির্দেশ দেওয়া হয়। আততায়ীর হাতে নিহত বেলকুচি থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি সােবাহান সাহেবের ছেলের সহযােগিতায় সাইদ আহমেদ রেকি করে রাত ৮টায় মুক্তিবাহিনীর নৌকায় ফিরে আসেন এবং আমির হােসেন ভুলুর সভাপতিত্বে রেকির উপর আলােচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। আলােচনায় অংশ নেন কোম্পানি অধিনায়ক খ ম আক্তার হােসেন, ডেপুটি অধিনায়ক ফজলুল মতিন মুক্তা, গ্রুপ  লিডার সােহরাব হােসেন, আব্দুল বারী (ইউপি চেয়ারম্যান বহুলী), গ্রুপ লিডার সাইদুল এবং আরও অনেকে। আলােচনা শেষে রেইড পার্টি তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে রেইড দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এক দল সদর থানা অফিসের পাশ দিয়ে, এক দল বাঁধ দিয়ে আরও দক্ষিণ দিকে সরে গিয়ে পরবর্তী সময় পুলিশ স্টেশনে পৌছে এবং অপর দল ভাটির টানে ৪-৫টি নৌকাবােঝাই হয়ে ১২ সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে ৪টার সময় বেলকুচি থানা আক্রমণ করে সদর থানা অফিসের পাশ দিয়ে যাওয়া দলের দায়িত্ব ছিল টেলিফোন সংযােগ লাইন বিচ্ছিন্ন করা, কিন্তু যথাস্থানে পৌছে তারা দেখতে পেলাে একটি বিল্ডিংয়ে (বর্তমানে বেলকুচি থানা টিএনওএর বাসভবন) রাজাকারদের মিটিং চলছে। তিন দিক থেকে আক্রমণ এলাকায় পৌছে মুক্তিবাহিনী ফায়ারিং শুরু করে। ফলে কিছুক্ষণের মধ্যেই পাকিস্তানি। মিলিশিয়া বাহিনী মুক্তিযােদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে ।
এ যুদ্ধে ডেপুটি লিডার আব্দুর রশিদ ও অন্য ১টি গ্রুপের কোম্পানি লিডার সাইদুর রহমান এবং উল্লাপাড়া থানার শামসুল হক গুরুতর আহত হন। তবে। কেউ শহিদ হন নি। ৪০-৫০জন পাকিস্তানি মিলিশিয়ার মধ্যে ৩-৪জন নিহত এবং ১৫জন মুক্তিবাহিনীর হাতে বন্দি হয়। বাকিরা পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। এসএমজি, মর্টার, চাইনিজ রাইফেল ও প্রচুর গােলাবারুদ আটক করে মুক্তিবাহিনী তাদের ঘাঁটিতে নিয়ে আসে। প্রচুর খাদ্যসামগ্রী হস্তগত হয়, যা । পরবর্তী সময় মুক্তিবাহিনীর কাজে লাগে। চলতে থাকে মুক্তিবাহিনীর জয়ের উৎসব। ‘হিট অ্যান্ড রান’ পদ্ধতি ছিল মুক্তিবাহিনীর কৌশল। পাকিস্তানি বাহিনী বেলকুচি পৌছার পূর্বেই মুক্তিবাহিনীর ডিঙি নৌকাগুলাে পাল তুলে ঢেউয়ের তালে পাড়ি জমায় সিংগুলির চরে । সশস্ত্র বাহিনীর অবদান এ যুদ্ধে আবু সাঈদ নামক ১জন সেনাসদস্য অংশগ্রহণ করেন, যিনি মূল রেইডের পূর্বে রেকি কার্য সম্পন্ন এবং রেইডে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। বিশ্লেষণ/বিজয়ের কারণ ও পর্যালােচনা ক, সুষ্ঠু এবং পাকিস্তানি বাহিনীর পর্যবেক্ষণ থেকে নিজেকে আড়াল করে রেকি কার্য সম্পাদন করে শত্রুর বিভিন্ন গতিবিধি ও অবস্থান জানা সম্ভব হয়েছিল। খ. কাজীপুর এলাকা শত্রুমুক্ত করার পর বেলকুচি পুলিশ স্টেশন রেইড মুক্তিবাহিনীকে তীব্র মনােবল ও সাহস জুগিয়েছে, ফলে হানা কার্যক্রম সাফল্য লাভ করেছে। সঠিক পরিকল্পনা (স্থলপথে দুই দিক থেকে এবং জলপথে এক দিক থেকে) এবং তার সফল প্রয়ােগ সফলতা এনে দিয়েছে।
শিক্ষণীয় বিষয়
ক. সফল হানা কার্য সম্পাদন করার জন্য বিস্তারিত ও সুষ্ঠু রেকি কার্য   সম্পাদনের প্রয়ােজন।
খ. তীব্র মনোেবল ও সাহসিকতা অত্যাবশ্যকীয় ।
গ. সঠিক পরিকল্পনা ও তার প্রয়ােগ নিশ্চিত হওয়া প্রয়ােজন।
উপসংহার
যুদ্ধের জন্য দরকার বিশ্লেষণ, অবস্থা যাচাই, সঠিক অস্ত্রের প্রয়ােগ, পরিকল্পনা অনুযায়ী পর্যবেক্ষণ, সঠিক অবস্থান গ্রহণ এবং শত্রুর দুর্বল মুহূর্তগুলাের আলােকপাতকরণ। এ যুদ্ধে আমির হােসেন ভুলু পর্যবেক্ষণ করেন, নির্ভুল। অবস্থান গ্রহণ করতে সাহায্য করেন এবং শত্রুপক্ষের অসতর্কতার সম্পূর্ণ ফায়দা তুলে অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে নিজেদের কার্যসম্পাদন করেন।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান -ষষ্ঠ খন্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!