ঘাটনা ব্রিজ অ্যামবুশ
ভূমিকা
১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের শেষ সপ্তাহে এ অ্যামবুশ করা হয় করতােয়া নদীর উপর ঘটনা ব্রিজটি উল্লাপাড়া সদর ইউনিয়নের এনায়েতপুর নামক এলাকায় অবস্থিত এ রেলসেতুটি সিরাজগঞ্জ-ঈশ্বরদীকে সংযুক্ত করেছে। করতােয়া নদীকে অতিক্রম করার জন্য রেললাইনের এ ব্রিজটির কোনাে বিকল্প ছিল না। তাই মুক্তিযােদ্ধারা ঈশ্বরদীকে সিরাজগঞ্জ থেকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য এ ব্রিজটিকে বেছে নেন। ঘটনা ব্রিজে পাকিস্তানি সেনাদের উপর অ্যামবুশ করার পরিকল্পনামাফিক মুক্তিবাহিনী ব্রিজের পশ্চিম প্রান্তে রেলওয়ে স্লিপার তুলে ফেলে। পাকিস্তানি সেনাদের চলাচলের উপর বাধা সৃষ্টি করে মুক্তিবাহিনী তাদের উপস্থিতিকে আরও জোরদার করে তুলতে সক্ষম হয়। পটভূমি সিরাজগঞ্জ এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনী আধিপত্য বিস্তারের উদ্দেশ্যে ঈশ্বরদী থেকে আরও সেনা ও রসদ আনার চেষ্টা চালাচ্ছিলাে। মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি বাহিনীর এ পরিকল্পনার কথা আগেই জানতে পেরেছিল। পাকিস্তানি বাহিনীর এ পরিকল্পনাকে নস্যাৎ করার জন্য তারা বেছে নেয় ঘটনা ব্রিজকে। যুদ্ধের সংগঠন যুদ্ধের সংগঠন নিম্নরূপ:
ক. পাকিস্তানি বাহিনী: ১ কোম্পানি সৈন্য (২৫ বালুচ রেজিমেন্ট), অস্ত্র (২টি মর্টার, ২টি এমজি, ১৬টি এলএমজি, ২টি আরএল, ১৮টি চাইনিজ রাইফেল)। খ, মুক্তিবাহিনী: ১ প্লাটুন সৈন্য, অস্ত্র (১টি চাইনিজ এলএমজি, ৩টি এসএমসি, ২৫টি রাইফেল)। পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থান পাকিস্তানি বাহিনী একটি রেলওয়ে ইঞ্জিনসহ ৩টি বগিতে করে প্রায় ১টি কোম্পানি নিয়ে ঈশ্বরদী থেকে সিরাজগঞ্জের দিকে অগ্রসর হয়। তারা ঘটনা ব্রিজের পশ্চিম প্রান্তে এসে রেললাইনের স্লিপার না থাকার কারণে থেমে যেতে বাধ্য হয়। এ অবস্থায় মুক্তিবাহিনী তাদের উপর হামলা চালায়।
যুদ্ধের বর্ণনা
মুক্তিবাহিনী উল্লাপাড়া থেকে বাঘাবাড়ি আসে এসডিও শহিদ এ কে এম শামসুদ্দীনের নির্দেশে নুকালি ব্রিজের উপর একটি অ্যামবুশ করার নির্দেশ দেওয়া হয় তাদের। ২টি জিপ, কিছু পুলিশ, আনসার সৈনিক, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ২জন সৈনিক এবং ছাত্র সংসদের কিছু ছাত্র এতে যােগদান করেন। তাদের হাতিয়ার ছিল কিছু রাইফেল, ১টি এলএমজি, ২টি এসএমজি ও কিছু বারুদ। এটা নিয়েই তারা অ্যামবুশ করার জন্য প্রস্তুত ছিল। মুক্তিবাহিনী বড়াল নদের তীরে অবস্থান গ্রহণ করে। পাকিস্তানি সেনাদের সেখানে ২টি ৬ ইঞ্চি আর্টিলারি গানও ছিল এবং তাদের সাথে ২টি ফেরি ছিল। মুক্তিযােদ্ধা মন্টুর রাইফেল থেকে অসাবধানতাবশত গুলি বের হয়, গুলির শব্দ শুনে পাকিস্তানি সেনারা রাস্তা বদলিয়ে অন্য পথে চলে যায়, যার ফলে অ্যামবুশ কার্যকর হয় না তখন মুক্তিবাহিনী সেখান থেকে উল্লাপাড়া ফেরত আসে। এ কথা শুনে লতিফ মির্জা সিদ্ধান্ত নেন যে, ঘটনা ব্রিজ রক্ষা করতে হবে তারা সবাই এসডিও শামসুদ্দীনের কাছে যান, যিনি পাবনা, নওগাঁ ও বগুড়ার মুক্তিবাহিনীকে বিভিন্ন তথ্য দিতেন। তিনি থানা ও ট্রেজারি থেকে আরও বেশি অস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রহ করতে বলেন। আর এ বাহিনীতে লতিফ মির্জার সাথে নিজাম সামাদ (রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জিএস), ফজলুল হক ও ব্যাংক ম্যানেজার মােস্তফা কামাল ছিলেন।
সেদিন ছিল ১৯৭১ সালের ২৪ এপ্রিল লুত্যর রহমান অরুণের দল (করপােরাল অরুণ, নম্বর ৬২৭০৭৭৭, ৩০ সিগন্যাল ব্যাটালিয়ন) ব্রিজের বামে এবং মুক্তা রহমান সাথে ৫জন আনসার সৈনিকসহ ব্রিজের ডানে অবস্থান নেন। জিএস সামাদকে উল্লাপাড়া রেল স্টেশন পর্যবেক্ষণের জন্য লুক আউটম্যানের দায়িত্ব দেওয়া হয় এবং বলা হয়, তিনি যেন ট্রেন এলে গামছা নাড়িয়ে সংকেত দেন। এ সময় নবম শ্রেণির ২জন সাহসী ছেলে রাইফেল নিয়ে তাদের সাথে যােগদান করে। গুলি করার সংকেত ছিল অরুণের হাতের তালি। প্রায় দুপুর ২টায় শক্রর ট্রেন আসে কোনাে সংকেত ছাড়াই। সেখানে ৪০জন অবাঙালি এবং ৩০জন পাকিস্তানি সৈনিক ব্রিজ পার হচ্ছিল। তাদের বেশ দুশ্চিন্তামুক্ত মনে হচ্ছিল। যখন পাকিস্তানি বাহিনী ব্রিজের অর্ধেক পার হয়, তখন অরুণের তালির সাথে সাথে সবাই ফায়ার শুরু করে। কিছু পাকিস্তানি সৈনিক বাচার জন্য নদীতে ঝাঁপ দেয়, কিন্তু অনেকেই সাঁতার জানত না বলে বেশির ভাগই মারা যায়।
মুক্তিবাহিনী তাদের স্বল্পসংখ্যক গােলাবারুদেই ফায়ার চালিয়ে যায়। এরই মধ্যে ট্রেন থেকে পাকিস্তানি বাহিনী মর্টার দিয়ে গােলাবর্ষণ শুরু করে। মুক্তিবাহিনী তখন এলএমজি ফায়ার শুরু করে। প্রায় ১ ঘণ্টার মতাে যুদ্ধ চলে। এ সময় মুক্তিবাহিনীর গুলি শেষ হয়ে যায় বলে তারা পিছু হটতে শুরু করে। পাকিস্তানি সেনারা তাদের আহত সৈনিকদের বাঁচাতে এগিয়ে আসে। ঠিক তখনই মুক্তিযােদ্ধারা রাইফেল দিয়ে গুলি করা শুরু করেন এবং তখন অন্যান্য পাকিস্তানি সেনারাও মারা পড়ে। বেলা প্রায় ৩টার দিকে পাকিস্তানিরা পালাতে শুরু করে। যাওয়ার পথে তারা উল্লাপাড়ায় অনেক ঘরবাড়ি আগুনে পুড়িয়ে দেয়। তথাপিও মুক্তিবাহিনীর এ মিশন সার্থক হওয়ায় গ্রামবাসীরা খুব খুশি হয়। এ যুদ্ধে কোনাে মুক্তিযােদ্ধা আহত কিংবা শহিদ হন নি। বিশ্লেষণ ও পর্যালােচনা মুক্তিবাহিনীর বিজয়ের কারণ ক. যদিও এ অ্যামবুশটি একটি সম্পূর্ণ অ্যামবুশ ছিল না, তবুও এর মাধ্যমে পাকিস্তানি বাহিনীর যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি হয় এবং গতিপথ। পরিবর্তন করতে বাধ্য করা হয়।
খ, মুক্তিযােদ্ধারা তাদের সামান্য অস্ত্র ও গােলাবারুদ নিয়ে শত্রুকে একটি সরু রেলসেতুর উপর আক্রমণ করে অনেকটা আকস্মিক অবস্থার মধ্যে ফেলে দেয়। গ, এলাকাবাসীর স্বতঃস্ফূর্ত ও সর্বাত্মক সহযােগিতার কারণে মুক্তিযােদ্ধারা তাদের জীবন বাজি রেখে পাকিস্তানি বাহিনীকে পিছু হটাতে সক্ষম হন। রেললাইনের স্লিপার তুলে ফেলার মাধ্যমে শত্রুকে ট্রেন থামাতে বাধ্য। করা হয় এবং এ সুযােগকে কাজে লাগিয়ে শত্রুকে ধ্বংস করার পরিকল্পনা করা হয়।
শিক্ষণীয় বিষয়
ক. রেললাইনের ব্রিজে অ্যামবুশ সাধারণত সব সময়ই কাক্ষিত বিজয় এনে দিতে সক্ষম হয়।
খ, জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত ও সর্বাত্মক সহযােগিতা যে-কোনাে জয়ের জন্য মুখ্য ভূমিকা পালন করে। উপসংহার। স্বল্পসংখ্যক জনবল ও অস্ত্র-গােলাবারুদ নিয়ে মুক্তিযােদ্ধারা সেদিন যে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন তা সত্যিই প্রশংসনীয় ও প্রেরণার উৎস। তরুণ মুক্তিযােদ্ধারা এ যুদ্ধে শুধু যে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন, তা নয়, তাদের তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তায় তারা সব পাকিস্তানি সেনাকে ধরাশায়ী করতে পেরেছিল।
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান -ষষ্ঠ খন্ড