ডাববাগানের (শহিদনগর) যুদ্ধ
ভূমিকা
কথিত আছে, ডাববাগানের যুদ্ধই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে মুক্তিযােদ্ধাদের প্রথম সম্মুখযুদ্ধ। ১০ এপ্রিল পর্যন্ত নগরবাড়ি যুদ্ধ শেষে ১৬জন ইপিআর সদস্য তৎকালীন নায়েব সুবেদার আলী আকবরের (ইপিআর) নেতৃত্বে নগরবাড়ি ঘাট থেকে প্রায় ১২ কিলােমিটার উত্তরে ঢাকা-বগুড়া রােডে ডাবাগান নামক স্থানে অবস্থান নেন। উদ্দেশ্য ছিল বগুড়া অভিমুখে পাকিস্তানি বাহিনীর অগ্রাভিযান প্রতিহত করা এবং সে মােতাবেক মুক্তিবাহিনীর এ দল ডাববাগানে প্রতিরক্ষা অবস্থান নেয়। অপর পক্ষে, নগরবাড়ি ফেরিঘাটে অবস্থানরত পাকিস্তানি বাহিনীও তাদের এ দেশীয় দোসরদের মাধ্যমে মুক্তিযােদ্ধাদের এ অবস্থান সম্পর্কে অবগত হয় এবং অগ্রাভিযানের প্রস্তুতি নিতে থাকে। ১৯ এপ্রিল প্রত্যুষে পাকিস্তানি বাহিনীর ২৩ ব্রিগেড নগরবাড়ি থেকে। বগুড়ার উদ্দেশ্যে অগ্রাভিযান শুরু করে এবং আনুমানিক ১১টায় শুরু হয়। ইতিহাসের রক্তক্ষয়ী ডাববাগানের যুদ্ধ। পটভূমি। পাকিস্তানি বাহিনী নগরবাড়ি ফেরিঘাট দখলের পর প্রথমে পাবনা অভিমুখে অগ্রাভিযান করে এবং ১০ এপ্রিল পাবনা দখল করে। অপর পক্ষে ১৬ ডিভিশনের অপর ব্রিগেড অর্থাৎ ২৩ পদাতিক ব্রিগেড অপেক্ষায় থাকে বগুড়া অভিমুখে অগ্রাভিযানের জন্য। নগরবাড়ি-পাবনা অক্ষে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের পর পাকিস্তানি বাহিনী নগরবাড়ি-বগুড়া অক্ষের প্রতি মনােনিবেশ করে। মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য ডাববাগান এলাকায় শত্রুকে প্রতিহত করে যুদ্ধে মনােবল বৃদ্ধি এবং নিজস্ব এলাকা শত্রুমুক্ত রাখার ব্যাপারে একটি শক্ত প্রতিরােধযুদ্ধ অনিবার্য হয়ে পড়ে। ইতােমধ্যে মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে এসে পৌছে ১টি এমজি, ৫টি এলএমজি, ২-৩টি মর্টার এবং ২টি রকেট লঞ্চার, ফলে সাংগঠনিক ও সামরিকভাবে মুক্তিযােদ্ধারা আগের থেকে অনেক শক্ত হয়। অপর পক্ষে মুক্তিযােদ্ধারা যাতে পুনরায় সংগঠিত হতে না পারে, এ প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে ডাববাগানে সংগঠিত মুক্তিযােদ্ধাদের ছত্রভঙ্গ করার জন্য পাকিস্তানি বাহিনী পরিকল্পনা করতে থাকে।
ভূমি পরিচিতি
বর্তমানে শহিদ নগর হিসেবে খ্যাত ডাববাগান এলাকা পাবনা শহর থেকে প্রায় ৫০ কিলােমিটার পূর্বে ঢাকা-বগুড়া মহাসড়কের উপর অবস্থিত। সাথিয়া থানা সদর থেকে ৯ কিলােমিটার পূর্বে বেড়া থানা সদর থেকে ১০ কিলােমিটার দক্ষিণে এ ডাবাগানের অবস্থান। এলাকাটি বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকার মতাে খােলামেলা, তবে ভূমি সামান্য নিচু এবং গ্রামগুলাে ভূমি থেকে ৬-৭ ফুট উচু। ঢাকা-বগুড়া মহাসড়ক ভূমি থেকে প্রায় ৮-৯ ফুট উচু। সে সময় রাস্তাটি ছিল সব রকম আবহাওয়ায় ব্যবহারযােগ্য একমুখী একটি পাকা রাস্তা। এ এলাকায় বর্ষা মৌসুমে আবাদযােগ্য জমি পানির নিচে থাকে। এলাকার আবহাওয়া বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকার মতােই এবং জমিতে আবাদি ফসলের ধরনও বাংলাদেশের অন্যান্য জায়গার মতাে। যুদ্ধের সংগঠন যুদ্ধের সংগঠন নিম্নরূপ: ক, পাকিস্তানি বাহিনী: ২৩ পদাতিক ব্রিগেড ও ২ ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারির নির্ধারিত পাকিস্তানি সেনারা এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে বলে জানা যায়। খ. মুক্তিবাহিনী: ৭ নম্বর সেক্টরের ১৬জন ইপিআর সদস্য, ৫০জন আনসার সদস্য, ১০০জনের বেশি ছাত্র-জনতা যুদ্ধের বিবরণ। ৯ এপ্রিল নগরবাড়ি পতনের পর নায়েব সুবেদার আলী আকবর ও তাঁর দলের জন্য নগরবাড়ি-বগুড়া অক্ষে পাকিস্তানি বাহিনীকে বাধা প্রদান অনিবার্য হয়ে পড়ে। তাই ১০ এপ্রিল থেকেই প্রস্তুতি চলতে থাকে, ডাববাগানের প্রতিরক্ষা।
অবস্থানের ইতােমধ্যে এ ক্ষুদ্র দলের সাথে যােগ দেয় প্রায় ৫০জন আনসার এবং প্রায় ১০০জন প্রশিক্ষণবিহীন ছাত্র-জনতার একটি স্থানীয় মুক্তিযােদ্ধার দল। জোগাড় হয় ১টি এমডি, ২-৩টি মটর, ২টি রকেট লঞ্চার, ৫টি এলএমজি এবং সাথে সামান্য কয়েকটি .৩০৩ রাইফেল ও কিছু ক্ষুদ্রান্ত্রের অ্যামুনিশন। স্থানীয় জনগণ ট্রেঞ্চ খনন থেকে শুরু করে খাবার সরবরাহ পর্যন্ত সব ধরনের সহায়তা প্রদান করে। পাকিস্তানি বাহিনী তাদের এদেশীয় দোসরদের মাধ্যমে মুক্তিযােদ্ধাদের যাবতীয় প্রস্তুতির খবর জানতে পারে এবং ডাববাগান আক্রমণের জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি নিতে থাকে। ২৯ এপ্রিল আনুমানিক ১১টার সময় পাকিস্তানি বাহিনী ১৭টি গাড়িযােগে ডাববাগান অভিমুখে অগ্রাভিযান শুরু করে। সে সময় মুক্তিযােদ্ধাদের অধিকাংশই বিশ্রাম ও অন্যান্য প্রশাসনিক কাজে ব্যস্ত ছিলেন। অর্থাৎ পাকিস্তানি বাহিনীর কনভয় যখন ডাববাগানে এসে উপস্থিত হয়, তখন কর্তব্যরত মুক্তিযােদ্ধারা ছাড়া অন্য সবাই অপ্রস্তুত ছিলেন। যদিও পাকিস্তানি বাহিনী হঠাৎ করে ঘটনাস্থলে পৌছে যায়, তবু ঘটনার আকস্মিকতা কাটিয়ে উঠে মুক্তিযােদ্ধারা অতি দ্রুত যার যার অবস্থানে অবস্থান গ্রহণ করার চেষ্টা করেন। শুরু হয় ব্যাপক সম্মুখযুদ্ধ। প্রথমেই মুক্তিযােদ্ধাদের রকেট লঞ্চারের আঘাতে পাকিস্তানি বাহিনীর ৪টি গাড়ি ধ্বংস হয় এবং নিহত হয় আনুমানিক ১০০জন পাকিস্তানি সৈন্য। ইতােমধ্যেই পাকিস্তানি সেনাদের গাড়ি মুক্তিবাহিনীর অবস্থান অতিক্রম করতে সক্ষম হয় এবং বাকি গাড়িগুলাে পিছনে সরে যেতে বাধ্য হয়। এরপর শুরু হয় মরণপণ যুদ্ধ।
পাকিস্তানি বাহিনী ডাববাগান থেকে প্রায় ৩ কিলােমিটার দক্ষিণে পিছিয়ে এসে সৈন্য সমাবেশ করে এবং যে ২টি গাড়ি মুক্তিযােদ্ধাদের অতিক্রম করেছিল, গাড়িতে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিযােদ্ধাদের পশ্চাদপসরণের রাস্তা বন্ধ করে দেয়। অতঃপর আর্টিলারি ফায়ার সহায়তায় পাকিস্তানি সেনারা রাস্তার পূর্ব ও পশ্চিম দিক থেকে মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থানের ডান ও বাম পার্শ্ব থেকে আক্রমণ করে। এ যুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধারা শেষ বুলেট থাকা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যান, ফলে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রচুর সৈন্য হতাহত হয়। পরিশেষে উন্নত অস্ত্র, প্রশিক্ষণ ও তুলনামূলক বেশি শক্তি এবং আর্টিলারি ফায়ার সমর্থনের চাপে মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য যুদ্ধে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে। ইতােমধ্যে মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে মূল যােদ্ধা কয়েকজন ইপিআর সদস্য শহিদ হন। ফলে স্বল্প প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত স্থানীয় মুক্তিযােদ্ধারা মনােবল হারিয়ে ফেলে এবং ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েন। পরিস্থিতির এহেন অবনতি দেখে অধিনায়ক নায়েব সুবেদার আলী আকবর অবশিষ্ট সহযােদ্ধাদের নিয়ে পশ্চাদপসরণে বাধ্য হন। এভাবেই ২৯ এপ্রিল সন্ধ্যার আঁধার নামতে নামতে ডাববাগানের পতন ঘটে। ১৬জন মুক্তিযােদ্ধা এবং ১১জন স্থানীয় জনসাধারণ এ যুদ্ধে শহিদ হন। শহিদদের স্মরণে জায়গাটির বর্তমান নাম হয়েছে শহিদ নগর এবং নির্মিত হয়েছে দৃষ্টিনন্দিত স্মৃতিসৌধ। এ যুদ্ধের মাধ্যমে মুক্তিযােদ্ধারা প্রমাণ করেন যে, পাকিস্তানি বাহিনী অপ্রতিরােধ্য নয়, শুরু হয় ঘুরে দাড়ানাের যুদ্ধ, যা চলে পরবর্তী ৮ মাস এবং সে যুদ্ধ এনে দেয় আমাদের মহান স্বাধীনতা।
বিশ্লেষণ ও পর্যালােচনা
মুক্তিবাহিনীর পরাজয়ের কারণ ক. প্রশিক্ষণ: উন্নত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে প্রশিক্ষণহীনতাই ছিল এ যুদ্ধে পরাজয়ের মূল কারণ। খ. অস্ত্র : পাকিস্তানি সেনাদের অত্যাধুনিক অস্ত্রের মুখে মুক্তিযােদ্ধাদের নিম্নমানের অস্ত্র ব্যবহার এ যুদ্ধে পরাজয়ের আরও একটি কারণ। গ. রাজাকারদের সহায়তা: মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থান সম্পর্কে পাকিস্তানি সেনাদের তথ্য প্রদানের মাধ্যমে রাজাকারদের সহায়তা করা এ যুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে বিবেচ্য। ঘ, আকস্মিকতা: অসময়ে অতর্কিত আক্রমণের আকস্মিকতা এ যুদ্ধে পরাজয়ের অতীব গুরুত্বপূর্ণ কারণ আর্টিলারির সহায়তা: পাকিস্তানি বাহিনীর আর্টিলারির ব্যবহার। মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থান ও মনােবল দুর্বল করে দেয়।
শিক্ষণীয় বিষয়
ডাববাগানের যুদ্ধ থেকে নিম্নলিখিত বিষয়গুলাে শিক্ষণীয়রূপে বিবেচিত:
ক. জনসমর্থন: এ যুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধারা যে অসীম সাহসের সাথে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে এক অসম যুদ্ধে লিপ্ত হন, তা শুধু সম্ভব হয়েছিল স্থানীয় জনগণের সর্বাত্মক সহযােগিতার কারণে সামান্য কয়েকজন মুক্তিযােদ্ধার পক্ষে মামুলি কয়েকটি হাতিয়ার নিয়ে শক্তিশালী ও উন্নত অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি সেনাদের মােকাবিলা করা কিছুতেই সম্ভব হতাে না, যদি জনসমর্থন না থাকতাে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মতাে একটি জনযুদ্ধ জনসমর্থন ছাড়া কখনাে চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের অন্যতম কারণ এইজন সমর্থন।
খ, মনােবল: মনােবল ছাড়া কোনাে যুদ্ধই সম্ভব নয়। ডাববাগানের যুদ্ধে এ মনােবলই ছিল যােদ্ধাদের প্রকৃত সম্পদ। এ কারণেই নগরবাড়ি ফেরিঘাট থেকে পশ্চাদপসরণের পর নতুন করে জনবল ও হাতিয়ার সংগ্রহ করে পুনরায় যুদ্ধ করা মুক্তিযােদ্ধাদের পক্ষে সম্ভব হয়েছিল। প্রশিক্ষণ ও প্রয়ােজনীয় হাতিয়ার: ডাববাগানের যুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধাদের জনবলের কমতি ছিল না। তবে তাদের প্রয়ােজনীয় কোনাে প্রশিক্ষণ ছিল না, ছিল না উন্নত হাতিয়ার, ফলে পাকিস্তানি বাহিনীকে মােকাবিলা করা মুক্তিযােদ্ধাদের পক্ষে সম্ভব হয় নি। তবু মনােবল ও জনসমর্থনের কারণে নিজেদের ক্ষয়ক্ষতি যাই হােক, পাকিস্তানি বাহিনীর ৪টি গাড়ি ও শতাধিক জনবল হতাহত করা সম্ভব হয়েছিল। উন্নত প্রশিক্ষণ ও প্রয়ােজনীয় হাতিয়ার থাকলে যুদ্ধের ফলাফল অবশ্যই মুক্তিযােদ্ধাদের পক্ষে থাকতাে। গােয়েন্দা তথ্য: পাকিস্তানি বাহিনী ডাববাগানে আগমনের সংবাদ মুক্তিযােদ্ধাদের পূর্বে জানা ছিল না। বিষয়টি সময়মতাে জানতে পারলে এ যুদ্ধের ফলাফল অন্য রকম হতে পারতাে। পক্ষান্তরে পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিযােদ্ধাদের যাবতীয় তথ্য পূর্বাহ্নেই জানতাে। এবং সে মােতাবেক তারা মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থানে অতর্কিত হামলা করতে সমর্থ হয়েছিল।
উপসংহার
সাঁথিয়া থানার মুক্তিযুদ্ধ শুধু জেলা নয়, সমগ্র বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় অধ্যায় রচনা করেছে। স্বাধীনতার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এ এলাকার জনগণ তাদের জীবন বাজি রেখে স্বাধীনতা অর্জনে উদ্বুদ্ধ হয়েছিল। সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের বিজয় অর্জনে অগ্রণী ভূমিকা পালনের ক্ষেত্রে ডাববাগানের যুদ্ধ আমাদের জাতীয় ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
ভদ্রঘাটের যুদ্ধ
ভূমিকা
১৯৭১ সালের জুন মাসের মাঝামাঝি সময় এ যুদ্ধ হয়। এটি সিরাজগঞ্জ জেলার দ্বিতীয় যুদ্ধ। ভদ্রঘাট সিরাজগঞ্জ জেলার কামারখন্দ থানায় অবস্থিত। সিরাজগঞ্জ থেকে দ্রঘাটের দূরত্ব আনুমানিক ১২ কিলােমিটার। ঘটনাস্থল ঢাকা-বগুড়া। রােড সংলগ্ন নকলা ফেরিঘাট (বর্তমানে ব্রিজ) নামক স্থানের পার্শ্ববর্তী।
পটভূমি
১৯৭১ সালের জুন মাসে কতিপয় সাহসী তরুণের নেতৃত্বে ভদ্রঘাট ইউনিয়ন কালিবাড়ি ভদ্রঘাট, তেনাছাটা দ্রঘাট ও ধামখােল গ্রামকে নিয়ে একটি অস্থায়ী যুদ্ধশিবির গঠিত হয়, যা পরে পলাশডাঙ্গা যুদ্ধশিবির নামে নামকরণ হয়। পরবর্তী সময় কতিপয় স্বার্থান্বেষী ও দুস্কৃতিকারীর সহযােগিতায় পাকিস্তানি বাহিনী এ সংঘবদ্ধ মুক্তিবাহিনীর উদ্দেশ্যকে বিফল করে দেওয়ার জন্য এ স্থানে আক্রমণ চালায় এবং তা প্রতিহত করতেই এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। মুক্তিবাহিনীর সংগঠন প্রাথমিক সংগঠনে ছিলেন সােহরাব আলী সরকার (তৎকালীন সিরাজগঞ্জ কলেজের ভিপি), মনিরুল কবির, ছাত্রনেতা আজিজ সরকার, শফিউল ইসলাম (শফি), লুত্যর রহমান (মাখন)। ক্যাম্প প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কিছুদিন পর এ ক্যাম্পে যােগ দেন মুক্তিযােদ্ধা লুৎফরর রহমান (অরুণ), যিনি তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে করপােরাল (নম্বর ৬২৭০৭৭৭, ৩০ সিগন্যাল ব্যাটালিয়ন) পদে নিযুক্ত ছিলেন এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের বালুঘাটের কুমরাইল প্রশিক্ষণ শিবিরে ক্যাম্পে ১ মাস প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। ক্যাম্প প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর পরই মােহাম্মদ আলী (বাঘা) যােগ দেন। তিনি ব্রিটিশ এলএমজি নিয়ে যুদ্ধ করেছেন (অসীম সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করতেন বলে সহযােদ্ধারা তাঁকে বাঘা বলে ডাকতেন)। এখানে উল্লেখ্য যে, লুৎফরর রহমান (অরুণ) ভারতে যাওয়ার পূর্বে কিছু অস্ত্র ও গােলাবারুদ (বাঘাবাড়ি থেকে আনা) সিরাজগঞ্জের চীলগাছা গ্রামে তকালীন ছাত্রনেতা শহিদ রফিকুল ইসলামের বাড়িতে লুকিয়ে রেখে গিয়েছিলেন। এ অস্ত্র ও গােলাবারুদ দিয়েই এ ক্যাম্পে মুক্তিযােদ্ধাদের প্রশিক্ষণ শুরু হয়। ধীরে ধীরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আরও অনেক বাঙালি এ ক্যাম্পে যােগ দিয়ে প্রশিক্ষণ নেয়া শুরু করেন।
এ খবর একসময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীদের কানে পৌছে যায়। জায়গার বর্ণনা ও ভূমির রূপ এ এলাকা অন্যান্য এলাকা থেকে একটু ভিন্নতর। গ্রামের উত্তর, পশ্চিম ও পূর্ব দিকে ইছামতি খাল এবং দক্ষিণ দিকে উঁচুনিচু এলাকা, ধানের জমি । অন্যান্য এলাকা থেকে এ এলাকা প্রাকৃতিকভাবে নিরাপদ ছিল (গাছপালা এবং খাল পরিবেষ্টিত)। সিরাজগঞ্জ শহরের নিকটবর্তী এবং প্রবেশপথ হওয়ায় এ ভূমির গুরুত্ব সব দিক দিয়ে বেশি ছিল । যুদ্ধের সংগঠন যুদ্ধের সংগঠন নিম্নরূপ: ক, পাকিস্তানি বাহিনী: ১ কোম্পানি (প্রায় ১৩৫জন), অস্ত্র (৩টি মর্টার, ৯টি জিএফ রাইফেল, ১৫টি এলএমজি, ১৮টি এসএমজি, ৮৫টি চাইনিজ রাইফেল)। খ, মুক্তিবাহিনী: ১৫০-২০০জন, অস্ত্র (১টি এলএমজি, ১টি চাইনিজ রাইফেল, ২০টি ৩০৩ রাইফেল, ১৫টি দোনলা বন্দুক)। শত্রুপক্ষের অবস্থান পাকিস্তানি বাহিনী সিরাজগঞ্জ জেলা ক্যাম্পে অবস্থান গ্রহণ করে। তাদের কাজ ছিল নিয়মিত টহল এবং শান্তি কমিটির সদস্যদের মাধ্যমে খবর সংগ্রহ করা। শান্তি কমিটির মাধ্যমে তারা জানতে পারে যে, দ্রঘাট এলাকায় একটি যুবশিবির স্থাপন করেছে এবং তারা ১৯৭১ সালের ১৭ জুন ভােরে ঐ শিবিরে আক্রমণ করে। যুদ্ধের বর্ণনা ১৯৭১ সালের ১৭ জুন ভােরের দিকে পাকিস্তানি বাহিনী এ ক্যাম্পে পরিকল্পিতভাবে অতর্কিত আক্রমণ চালায়। কিন্তু মুক্তিযােদ্ধারা ছিলেন সদা প্রস্তুত। পাকিস্তানি বাহিনীর আগমনের সংবাদ পেয়ে অধিনায়ক লুম্ফর রহমান (অরুণ) সবাইকে কিছু জরুরি নির্দেশ দিয়ে পূর্বে প্রস্তুতকৃত পরিখায় অবস্থান গ্রহণ করতে বলেন। মুক্তিযােদ্ধারা তেনাচাটা দ্রঘাট থেকে কালিবাড়ি পর্যন্ত বিভিন্ন জায়গায় অবস্থান নেন। কালিবাড়ির সামনে ছিল পাটক্ষেত এবং পিছনে অর্ধেক মাইল পর্যন্ত ছিল জলমগ্ন। মুক্তিযােদ্ধাদের ধারণা ছিল, এ স্থান থেকে শত্রুদের আক্রমণের আশঙ্কা খুব কম, যেহেতু জায়গাটা ছিল দুর্গম। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত পাকিস্তানি বাহিনী এ দিক থেকেই আক্রমণ করার জন্য এগিয়ে আসে।
অধিনায়ক গাজী লুৎফর রহমান (অরুণ) চাইনিজ রাইফেল দিয়ে ফায়ার শুরু করার চেষ্টা করেন, কিন্তু রাইফেলে সমস্যা দেওয়ায় তিনি তার এক সহকর্মীর কাছ থেকে একটি মাসকেট রাইফেল নেন এবং শক্র ১০০ গজের মধ্যে আসতেই তিনি আল্লাহর নাম নিয়ে শত্রুর উদ্দেশ্যে প্রথম গুলি করেন। এ হঠাৎ আক্রমণের জন্য শক্ররা প্রস্তুত ছিল না। ২-৩জন হানাদার সেনা গুলি। খেয়ে লুটিয়ে পড়ে এবং বাকিরা আড়ালে অবস্থান গ্রহণ করে। এ স্বল্প অস্ত্র দিয়েই কিছু সময় ধরে গুলিবিনিময় হয়। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দক্ষ সৈনিক না থাকার কারণে মুক্তিযােদ্ধাদের অস্ত্রে অনেক ধরনের সমস্যা দেখা দেয়, কিন্তু মুক্তিযােদ্ধাদের দৃঢ় মনােবল এবং ১জন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেনাসদস্য লুত্যর রহমানের (অরুণ) সহায়তায় এসব সমস্যা সমাধান করে যােদ্ধারা যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকেন। শত্রুপক্ষ সুবিধা করতে না পেরে শক্রর ১জন ওয়্যারলেস অপারেটর গাছে উঠে বার্তা পাঠানাের চেষ্টা করলে মুক্তিযােদ্ধাদের গুলিতে নিহত হয়। এরপর গােলাগুলি কিছু সময়ের জন্য থেমে যায়। মুক্তিযােদ্ধা মাে. কামাল। আমগাছে উঠতে যাওয়া এক শত্রুকে লক্ষ্য করে .২২ রাইফেল দিয়ে গুলি করে হত্যা করেন। তখন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শত্রুরা মুক্তিযােদ্ধাদের অস্ত্রের স্বল্পতা সম্পর্কে অবগত হয় এবং প্রবল গুলিবর্ষণ করে। সে মুহুর্তে ২ নম্বর ও ৩ নম্বর প্লাটুনের কোনাে সাহায্য না পেয়ে মুক্তিবাহিনী উপায়হীন হয়ে পড়ে।
ঠিক তখনই ২ নম্বর প্লাটুন থেকে ফায়ার দেওয়া শুরু হয়। পাকিস্তানি বাহিনী এ ফায়ারের অবস্থান বুঝতে না পেরে তারা আড়ালে অবস্থান নেয় এবং ফায়ার বন্ধ করে। তখন ১ নম্বর প্লাটুন অর্থাৎ লুৎফর রহমানের (অরুণ) গ্রুপ ফায়ার দিতে দিতে পিছু হটতে শুরু করে। এ যুদ্ধে প্রায় ১১জন পাকিস্তানি সেনা নিহত এবং ১৩জন আহত হয়। যেহেতু ২ নম্বর ও ৩ নম্বর পাটুন যুদ্ধের শুরুতে ১ নম্বর প্লাটুনকে সাহায্য করতে পারে নাই তাই ১ নম্বর প্লাটুন কালিবাড়ি থেকে পিছু হটে নিরাপদ আশ্রয়ে যায় এবং পাকিস্তানি সেনারা এ সুযােগ নিয়ে সে স্থানের শত শত ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয় এবং অনেক লুটপাট করে। এ গ্রামের মাতবর মছের। উদ্দীন সরকার এবং তার ২ ভাই মাদার বক্স সরকার ও আছের উদ্দীন সরকারকে পাকিস্তানি বাহিনী হত্যা করে। জগৎগাতী গ্রামে শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ও পাকিস্তানি বাহিনীর দোসর কুখ্যাত মজিবুর রহমানের সহায়তায় আরও একটি পরিবারের ৪জনকে পাকিস্তানি বাহিনী হত্যা করে। তারা হলেন আজাহার আলী, ফজর রহমান, মংগল হােসেন ও আবুল হােসেন ভূইয়া। তাদের অপরাধ ছিল যে, তারা মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য-সহযােগিতা করেছিলেন। সশস্ত্র বাহিনীর অবদান দ্রঘাটের যুদ্ধে প্রত্যেক অধিনায়ক সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য ছিলেন। নিমে বর্ণিত সদস্যরা বিভিন্ন কোম্পানি অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন: ক. ‘এ’ কোম্পানি অধিনায়ক ছিলেন ল্যান্স নায়েক মাে. আব্দুস সামাদ (ইঞ্জিনিয়ার্স)। খ. ‘বি’ কোম্পানি অধিনায়ক ছিলেন ল্যান্স নায়েক মাে. মােজাহার আলী (ইপিআর)।
গ. ‘সি’ কোম্পানি অধিনায়ক ছিলেন সৈনিক মাে. আবদুস সালাম (আর্টিলারি)।
ঘ. ‘ডি’ কোম্পানি অধিনায়ক ছিলেন সৈনিক মাে. খলিলুর রহমান। (ইপিআর)।
ঙ. ‘ই’ কোম্পানি অধিনায়ক ছিলেন পিসি আব্দুর রহমান (আনসার)। বিশ্লেষণ ও পর্যালােচনা মুক্তিযােদ্ধাদের ভূমিকা ক. মুক্তিযােদ্ধারা সর্বদা শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করতে প্রস্তুত ছিলেন। তাই শত্রুর আগমনের খবর পেয়ে দ্রুতগতিতে তারা প্রতিরক্ষা অবস্থানে গিয়ে স্থান নেন এবং শত্রুকে প্রাথমিকভাবে বাধা প্রদানে সমর্থ হন। খ. মুক্তিযােদ্ধারা এ যুদ্ধে অপরিসীম সাহসিকতা প্রদর্শন করতে সমর্থ হন। তার ফলে শত্রুকে ১০০ গজ দূরত্বে ফায়ার করে ঘায়েল করতে সমর্থ হন। মুক্তিযােদ্ধারা সঠিক কৌশল অবলম্বন করতে পেরেছিলেন তাই কোনােপ্রকার ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই তারা পালিয়ে যেতে সমর্থ হয়েছিলেন। তাদের মূলনীতি ছিল হিট অ্যান্ড রান।
শিক্ষণীয় বিষয়
ক. যে-কোনাে পরিস্থিতিতে সর্বদা শত্রুর মােকাবিলায় প্রস্তুত থাকতে হবে।
খ. অপরিসীম সাহসিকতা জয়ের জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে।
গ, সঠিক কৌশল সফলতা অর্জনে সহায়ক।
উপসংহার
বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ও সাহসিকতা যে যুদ্ধক্ষেত্রের প্রয়ােজনীয় বিষয় তা ভদ্রঘাটের যুদ্ধ পর্যালােচনায় স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়। দলের একমাত্র প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযােদ্ধা লুৎফর রহমান অরুণ তার যথাযথ কৌশল প্রয়ােগের মাধ্যমে সেদিন মুক্তিযােদ্ধাদের বিপদমুক্ত করতে পেরেছিলেন। ফলে সেদিন সুসংগঠিত পাকিস্তানি সেনাদের কবল থেকে মুক্তিযােদ্ধারা সহজেই আত্মরক্ষা করতে পেরেছিলেন।
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান -ষষ্ঠ খন্ড