নগরবাড়ি ফেরিঘাট প্রতিরােধ যুদ্ধ
ভূমিকা
মুক্তিযুদ্ধে পাবনার ইতিহাস অত্যন্ত গৌরবােজ্জ্বল। উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার বলে খ্যাত পাবনা জেলা দেশের উত্তর জনপদে পদ্মা ও যমুনা নদীর মিলনস্থলে অবস্থিত। এ জেলার আলােচ্য ৩টি থানা দক্ষিণে পদ্মা ও পূর্বে যমুনা নদীর তীরে অবস্থিত। এ ৩ থানার সংযােগস্থল নগরবাড়ি ফেরিঘাট ছিল সাময়িকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, উত্তরবঙ্গে প্রবেশের জন্য একমাত্র প্রবেশদ্বার। তাই সামরিক বিবেচনায় এ এলাকার গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে এ এলাকার মুক্তিপাগল জনগণের ভূমিকা আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাসে এক স্বর্ণোজ্জ্বল অধ্যায় হিসেবে জাতি স্মরণ রাখবে। পাবনার উল্লেখযােগ্য যুদ্ধের মধ্যে নগরবাড়ি ফেরিঘাট প্রতিরােধ যুদ্ধ ইতিহাস প্রসিদ্ধ হয়ে আছে।
পটভূমি
নগরবাড়ি ফেরিঘাট ছিল একটা গুরুত্বপূর্ণ নদীবন্দর ও যােগাযােগ কেন্দ্র। এটা ছিল রাজধানীর সাথে দেশের উত্তরাঞ্চলের সব জেলার যােগাযােগের একমাত্র মাধ্যম। সামরিক দিক থেকে এর গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। এ কারণে নগরবাড়ি ঘাট দখলে রাখা উভয় বাহিনীর জন্যই ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ২৭ মার্চ রাত ১২টায় পাবনা পতনের পর পাকিস্তানি বাহিনী যে তা পুনর্দখলের জন্য অবশ্যই চেষ্টা চালাবে, তাতে সদ্যমুক্ত পাবনার নেতৃত্বে যারা ছিলেন তাদের কোনাে সন্দেহ ছিল না। এ কারণে নাটোর থেকে পাবনা আগমনের পথ ২৮ মার্চেই মুক্তিযােদ্ধারা বন্ধ করে দেন। অতঃপর মুক্তিযােদ্ধারা ঢাকা থেকে এতদঞ্চলে। প্রবেশের প্রবেশদ্বার নগরবাড়ি ঘাটকে নিয়ে পরিকল্পনা করেন। সে মােতাবেক আনুমানিক ১০০ ইপিআর/আনসারের ১টি দলের সাথে ছাত্র-জনতার আরও ৩০০জন জনবল নিয়ে ২৮ মার্চ মুক্তিযােদ্ধারা নগরবাড়ি ঘাট এলাকায় যমুনা নদীর পশ্চিম তীর বরাবর অবস্থান নেন। স্বতঃস্ফূর্ত জনগণের অংশগ্রহণে এক রাতের মধ্যেই সমস্ত প্রতিরােধ অবস্থানের পরিখা খনন সম্পন্ন হয়। আসতে থাকে দূরদূরান্ত থেকে খাবার ও অন্যান্য রসদ সরবরাহ। এভাবেই চলতে থাকে। প্রতিরক্ষার প্রস্তুতি, জনবলও বৃদ্ধি পেতে থাকে, যা মুক্তিযােদ্ধাদের মনােবল করে তােলে আকাশচুম্বী। এভাবেই তারা শপথ নেয় যে-কোনাে মূল্যে নগরবাড়ি ফেরিঘাট নিজেদের দখলে রাখার জন্য।
ভূমির পরিচিতি
নগরবাড়ি ঘাট পাবনা জেলা শহর থেকে ৫২ কিলােমিটার পূর্বে যমুনা নদীর তীরে উত্তরবঙ্গের একটি গুরুত্বপূর্ণ নদীবন্দর ও যােগাযােগ কেন্দ্র। এ বন্দরের ২০ কিলােমিটার উত্তরে বেড়া থানা এবং ৩০ কিলােমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে সুজানগর থানা অবস্থিত। এলাকার ভূমি বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকার মতােই সমতল ও খােলামেলা। নদীর তীর নদীবক্ষ থেকে আনুমানিক ১০-১৫ ফুট উচু, তবে বর্ষা মৌসুমে নদীর পাড় অধিকাংশ সময়ই জলমগ্ন থাকে। নগরবাড়ি ঘাট থেকেই সূচনা হয়েছে এশিয়ান হাইওয়ে উত্তরবঙ্গ অংশ। এখান থেকে একটি রাস্তা চলে গেছে পাবনা হয়ে নাটোর, রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ, অন্যটি চলে। গেছে সিরাজগঞ্জ, বগুড়া হয়ে উত্তরাঞ্চলের অন্যান্য সব জেলায়। যুদ্ধের বর্ণনা তকালীন তরুণ বাঙালি অফিসার ক্যাপ্টেন শাহরিয়ার রশীদ খান পাকিস্তানি বাহিনীর সম্ভাব্য আক্রমণের সংবাদ পেয়ে নগরবাড়ি ঘাট এলাকায় চলে আসেন এবং ২৯ মার্চ সাহসিকতার সাথে দায়িত্ব গ্রহণ করে মুক্তিযােদ্ধাদের সাথে নিয়ে কাজীরহাট থেকে নগরবাড়ি ঘাট এলাকা পর্যন্ত প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করেন। ১ এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনী নগরবাড়ি ঘাট দখল করার জন্য ৩টি গানবােটসহ কয়েকটি লঞ্চযােগে অভিযান চালায়। নগরবাড়ি ঘাটে অবস্থানরত মুক্তিযােদ্ধাদের প্রবল বাধার মুখে শত্রুপক্ষ সেদিন আরিচাভিমুখে ফেরত যেতে বাধ্য হয়। এ ঘটনার পর ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে শত্রুপক্ষ নগরবাড়ি ঘাট দখলে পুনরায় হানা দেবে নিশ্চিত জেনে মুক্তিযােদ্ধারা নগরবাড়ি ফেরিঘাট প্রতিরক্ষায় ব্যাপক প্রস্তুতি নিতে থাকেন। এ সময় মুক্তিযােদ্ধাদের আশ্রয় বা প্রশিক্ষণকেন্দ্র। ছিল নাটাবাড়িয়ায় (বােখােলা কর্নেশন হাই স্কুল)।
৮ এপ্রিল বিকাল থেকে শুরু হয় নগরবাড়ি ফেরিঘাট এলাকায় শত্রুর বিমান আক্রমণ অতঃপর শেষ রাত থেকেই অর্থাৎ ৯ এপ্রিলের প্রথম প্রহরেই চলতে। থাকে আর্টিলারি বােম্বিং। খুব ভােরেই গানবােট সহযােগে ১৫টি লঞ্চ ও ৪টি বড়াে ফেরিসহ মূল বাহিনী আরিচা থেকে নগরবাড়ি অভিমুখে যমুনা নদী দিয়ে। অগ্রসর হতে থাকে। নগরবাড়ি ফেরিঘাট এলাকা থেকে তখনাে মুক্তিযােদ্ধারা। পাকিস্তানি সেনাদের উপর ৩০৩ রাইফেল দিয়েই গুলি ছুড়তে থাকেন। এ সময় আর্টিলারি গােলায় ৪জন ইপিআর সদস্য শহিদ হন। মুক্তিযােদ্ধাদের প্রতিরােধের মুখে নগরবাড়ি ঘাট থেকে ৫-৬ কিলােমিটার দক্ষিণে বর্তমানে নটাআলা ঘাট এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনী পদাতিক সৈন্য অবস্থান গ্রহণ করে। আর্টিলারি কভার নিয়ে নদী থেকে গানবােট এবং ভূমিতে পদাতিক সৈন্য। সহযােগে দক্ষিণ দিক থেকে নগরবাড়ি ঘাটের উপর পাকিস্তানি বাহিনী সাঁড়াশি আক্রমণ চালায়। এ অবস্থায় মুক্তিবাহিনী নগরবাড়ি ঘাট আর দখলে রাখতেপারে না এবং ঐ দিনই অর্থাৎ ৯ এপ্রিল নগরবাড়ি ফেরিঘাট পাকিস্তানি সৈন্যদের দখলে চলে যায়।
এর পর পাকিস্তানি বাহিনী ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল পাবনা দখল করে নেয়। এ যুদ্ধের পর নগরবাড়ি ঘাট থেকে পশ্চাদপসরণ করে অধিকাংশ মুক্তিযােদ্ধাই পায়ে হেঁটে ভারতে যান। তবে কিছু ইপিআর সদস্য পুনরায় সংগঠিত হয়ে নায়েব সুবেদার আলী আকবরের (ইপিআর) নেতৃত্বে সাঁথিয়া থানার ডাববাগানে নগরবাড়ি-বগুড়া রােডে পুনরায় শক্ত প্রতিরক্ষা অবস্থান নেয়। এখানেই সংগঠিত হয় ইতিহাস প্রসিদ্ধ মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সম্মুখযুদ্ধ অর্থাৎ ডাববাগানের যুদ্ধ । বিশ্লেষণ ও পর্যালােচনা মুক্তিবাহিনীর পরাজয়ের কারণ
ক, প্রশিক্ষণ: উন্নত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে। প্রশিক্ষণহীনতাই ছিল এ যুদ্ধে পরাজয়ের মূল কারণ।
খ, অস্ত্র: পাকিস্তানি সেনাদের অত্যাধুনিক অস্ত্রের মুখে মুক্তিযােদ্ধাদের নিম্নমানের অস্ত্র ব্যবহার এ যুদ্ধে পরাজয়ের আর একটি কারণ।
গ, রাজাকারদের সহায়তা: মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থান সম্পর্কে পাকিস্তানি সেনাদেরকে তথ্য প্রদানের মাধ্যমে রাজাকারদের সহায়তা করা এ যুদ্ধের পরাজয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে বিবেচ্য। উপসংহার। বেড়া থানার মুক্তিযুদ্ধ শুধু জেলা নয়, সমগ্র বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় অধ্যায় রচনা করেছে। স্বাধীনতার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এ এলাকার জনগণ তাদের জীবন বাজি রেখে স্বাধীনতা অর্জনে উদ্বুদ্ধ হয়েছিল। সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের বিজয় অর্জনে অগ্রণী ভূমিকা পালনের ক্ষেত্রে বেড়া থানার খণ্ডযুদ্ধ আমাদের জাতীয় ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
বাঘাবাড়ি যুদ্ধ
ভূমিকা
সিরাজগঞ্জ জেলায় পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যত প্রতিরােধের ঘটনা ঘটেছে তার মধ্যে বাঘাবাড়িতেই প্রথম যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ঢাকা থেকে নগরবাড়ি হয়ে সিরাজগঞ্জে প্রবেশপথে প্রথমেই আসে বাঘাবাড়ি ফেরি। তাই মুক্তিযােদ্ধারা সিরাজগঞ্জে প্রবেশপথ বাঘাবাড়িকে রক্ষা করার পরিকল্পনা করেন। এ সংকল্প নিয়ে মুক্তিযােদ্ধারা এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময় বাঘাবাড়ি এলাকায় প্রতিরক্ষা। অবস্থান গ্রহণ করেন। যুদ্ধের প্রথম দিকে মুক্তিযােদ্ধাদের সংঘটিত যুদ্ধের মধ্যে এটি একটি। যদিও মুক্তিযােদ্ধারা পাকিস্তানি বাহিনীকে শেষ পর্যন্ত বাঘাবাড়িতে আটকাতে পারেন নি, তবু পাকিস্তানি বাহিনীকে অনেক বেগ পেতে হয়েছে। মুক্তিযােদ্ধারা এ যুদ্ধের মাধ্যমে তাদের সাংগঠনিক দুর্বলতাকে বুঝতে সক্ষম হন। সর্বস্তরের মানুষ এ যুদ্ধে স্বতঃস্ফূতভাবে এগিয়ে আসে এবং মুক্তিযুদ্ধে। অংশগ্রহণ করে। পটভূমি সিরাজগঞ্জ জেলার সর্ব-দক্ষিণে পাবনা জেলাসংলগ্ন বাঘাবাড়ি এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর একমাত্র প্রবেশপথ। গােহালা নদীর উপর ফেরি দিয়ে পার হয়ে সিরাজগঞ্জ, বগুড়া ও উত্তরবঙ্গে প্রবেশ করতে হয়। মুক্তিযােদ্ধারা তাই এ প্রবেশপথে পাকিস্তানি বাহিনীকে প্রতিরােধ করার পরিকল্পনা করে। জায়গার বর্ণনা ও ভূমির রূপ বাঘাবাড়ি এলাকাটি শাহজাদপুর থানার শাকতলা নামক স্থানে গােহালা নদীর তীরে অবস্থিত। নদীটি পূর্ব-পশ্চিমে প্রবাহিত হয়ে দক্ষিণ দিকে বাঁক নিয়েছে। নদীর উভয় তীরে পায়ে চলার পথ আছে, যার সাহায্যে এলাকার জনসাধারণ চলাচল করে। নদীর দক্ষিণ পাড়ে বাঁধ এলাকা ঘেঁষে জনবসতি গড়ে উঠছে। নদীর পাড়ের পায়ে চলার পথ আশপাশের ধানক্ষেত থেকে প্রায় ৫ ফুট উঁচুতে অবস্থিত। ফেরিটি নদী পারাপারের একমাত্র মাধ্যম হিসেবে কাজ করে।
যুদ্ধের সংগঠন
যুদ্ধের সংগঠন নিম্নরূপ: ক. পাকিস্তানি বাহিনী: ২ ব্যাটালিয়ন (১৬ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট ও ১২ বালুচ রেজিমেন্ট) ও ১ আর্টিলারি ব্যাটারি। খ, মুক্তিবাহিনী: ৪০০জন মুক্তিযােদ্ধা, অস্ত্র (৩টি এলএমজি, ১টি আরএল, ৪টি স্টেনগান, ১টি দেশি কামান, ৬৭টি ৩০৩ রাইফেল, ১৪টি বন্দুক)। শত্রুপক্ষের অবস্থান। পাকিস্তানি বাহিনী নগরবাড়ি অতিক্রম করে বাঘাবাড়িতে এসে গােহালা নদী। অতিক্রম করার চেষ্টা চালায়। নদী অতিক্রম করার জন্য ফেরির দক্ষিণ পাড়ের রাস্তার উভয় পাশে অবস্থান নেয়। ২ ইঞ্চি মর্টার, মেশিনগান ও আর্টিলারি গান অগ্রভাগে স্থাপন করে। যুদ্ধের বর্ণনা তল্কালীন মহকুমা প্রশাসক শহিদ এ কে এম শামসুদ্দীনের নির্দেশমতাে ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময় প্রায় ১৫০জন মুক্তিযােদ্ধা বাঘাবাড়ি ঘাটে প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করে। এদের সাথে ছিল মুক্তিযােদ্ধা আব্দুল লতিফ মির্জা, মুক্তিযােদ্ধা গােলাম কিবরিয়া এবং মুক্তিযােদ্ধা সােহরাব আলী। পরের দিন ইপিআর, আনসার, পুলিশ ও ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট মিলে প্রায় ১০০জন যােদ্ধা বাঘাবাড়িতে এসে মুক্তিযােদ্ধাদের সাথে যােগ দেয়।
বাঘাবাড়িতে গােহালা নদীর উত্তর পাড়ে প্রায় ২ মাইল জুড়ে ২০০ গজ পর পর পাকা পরিখা খনন করে সেখানে প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করেন। তার পরের দিন এসডিও সাহেব আরও প্রায় ৫০জন ইপিআর, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং অবসরপ্রাপ্ত সৈনিকদের নিয়ে আসেন। নগরবাড়ি ঘাট রক্ষা করার জন্য। প্রায় ১০০জন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং ইপিআর বাহিনীর লােক নিয়ে। ছাত্রনেতা মােজাফফর হােসেন ও এসডিও শামসুদ্দীন সামনের দিকে অগ্রসর হন। কাশীনাথপুর পৌছালে তারা জানতে পারেন যে, নগরবাড়ির পতন ঘটেছে। তখন তারা কাশীনাথপুরে জঙ্গলের ভিতর ঘাঁটি স্থাপন করেন এবং ওখান থেকে ১০ মাইলের মধ্যে পাকিস্তানি সৈন্যদের ঘাঁটি আছে বলে শােনা গেল। এসডিও’র নেতৃত্বে ১০০জন মুক্তিযােদ্ধারা ৩ ভাগে বিভক্ত হয়ে পাকিস্তানি ঘাটি আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেন। এক দল আক্রমণ চালাবে, এক দল গাড়ি ধ্বংস করবে এবং এক দল ব্রিজ ধ্বংস করবে একই সময়। মুক্তিযােদ্ধারা এ আক্রমণ পরিচালনা করেন রাত ২টার সময়। একইসাথে ব্রিজ ধ্বংস, ৫টি ট্রাক ক্ষতিগ্রস্ত এবং ১৯জন পাকিস্তানি সেনা খতম করেন। পরদিন ভােরবেলা মুক্তিযােদ্ধারা কাশীনাথপুরে ফিরে আসেন। তাদের ১জন ইপিআর সদস্য গুলিবিদ্ধ হন এবং তাঁকে সিরাজগঞ্জ হাসপাতালে পাঠানাে হয়। ২৫ এপ্রিল। এসডিও সাহেব বাঘাবাড়ি ঘাট থেকে সিরাজগঞ্জ ফিরে যান। তিনি পরদিন আবার বাঘাবাড়ি ঘাটে ফিরে আসেন। ২৬ এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনী দুপুর ১টার দিকে হঠাৎ করে কাশীনাথপুর ক্যাম্প আক্রমণ করে। ১জন হাবিলদারকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল ঐ ক্যাম্পের। মুক্তিযােদ্ধরা তখন ক্যাম্পে বিশ্রাম নিচ্ছিলাে, ঠিক সে সময় হঠাৎ পাকিস্তানি বাহিনী মর্টার আক্রমণ চালায় চারদিক থেকে।৩০-৪০জন মুক্তিযােদ্ধা এখানে শহিদ হন, বাকিরা অস্ত্র ফেলে পালিয়ে যান। এখানে মুক্তিযােদ্ধাদের প্রচুর অস্ত্র হাতছাড়া হয়ে যায়।
পরদিন চারদিকে খোঁজ করে ২জন আহত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিক এবং ৮-১০জন মুক্তিযােদ্ধাদের নিয়ে বাঘাবাড়ি ঘাটে চলে আসেন। এখানে এসে মুক্তিযােদ্ধারা তাদের প্রতিরক্ষা অবস্থানকে আরও জোরদার করেন। অবস্থার পরিবর্তন না হওয়ায় আরও ২৩-২৪ দিন প্রতিরক্ষা অবস্থানে কাটাতে হয় মুক্তিযােদ্ধাদের। ২০ মে বাঘাবাড়িতে গােহালা নদীর অপর পাড়ে পাকিস্তানি। বাহিনী বাংকার করা শুরু করে। মুক্তিযােদ্ধারা তাদের দেশি কামান দিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের উপর আক্রমণ চালান, ৪ দিন ধরে পাকিস্তানি সেনাদের সাথে মুক্তিযােদ্ধাদের একটানা গুলিবিনিময় হয়। মুক্তিযােদ্ধারা তাদের সুরক্ষিত বাংকার থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর উপর গােলাবর্ষণ করতে থাকে। ৪ দিন গুলাবিনিময়ের পর পাকিস্তান বিমানবাহিনী মুক্তিযােদ্ধাদের উপর বিমান হামলা চালায়। ২৪ মে মুক্তিযােদ্ধারা বাঘাবাড়ি থেকে পিছু হটতে বাধ্য হন। সশস্ত্র বাহিনীর অবদান এ যুদ্ধে প্রশিক্ষণের জন্য সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। কেননা তখন পর্যন্ত মুক্তিযােদ্ধারা নিজেদের সম্পূর্ণভাবে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করতে সক্ষম হন নি। কাজেই সেনাবাহিনীর সদস্য এবং তদানীন্তন ইপিআর বাহিনীর সদস্যরা তাদের অস্ত্র ও গােলাবারুদ নিয়ে সম্পূর্ণরূপে এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং নতুন মুক্তিযােদ্ধাদের প্রশিক্ষণ প্রদান করেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য করপােরাল লুম্ফর রহমান (অরুণ) যিনি সেনাবাহিনীর সদস্য এবং ল্যান্স করপােরাল মুজাহারুল ইসলাম যিনি ইপিআর-এর সদস্য।
বিশ্লেষণ ও পর্যালােচনা
মুক্তিযােদ্ধাদের ভূমিকা ক, সিরাজগঞ্জের প্রবেশপথ হিসেবে বাঘাবাড়িতে মুক্তিযােদ্ধারা পাকিস্তানি বাহিনীকে কমপক্ষে ৪ দিনের জন্য ফেরি পারাপারে বাধা সৃষ্টি করেন। যার ফলে পাকিস্তানি বাহিনী তাদের অগ্রাভিযান পরিকল্পনা মােতাবেক অগ্রসর হতে পারে নি। যদিও মুক্তিযােদ্ধারা অস্ত্র ও গােলাবারুদের স্বল্পতার কারণে পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য হন তবু মুক্তিযােদ্ধাদের উপস্থিতি পাকিস্তানি বাহিনীকে যথেষ্ট চিন্তায় ফেলে দেয়। গ. এ যুদ্ধের মাধ্যমে মুক্তিযােদ্ধারা তাদের সাংগঠনিক অবকাঠামােকে আরও উন্নততর এবং অধিক অস্ত্র ও গােলাবারুদের প্রয়ােজনীয়তাকে অনুধাবন করতে সক্ষম হন। শিক্ষণীয় বিষয় ক, যে-কোনাে প্রতিরক্ষা অবস্থানের জন্য প্রাকৃতিক বাধাকে ব্যবহার করার মাধ্যমে কাঙিক্ষত ফলাফল আশা করা সম্ভব। ভূমির সঠিক ব্যবহার এবং যােদ্ধাদের সঠিক স্থানে প্রতিরক্ষা অবস্থানে। বসানাের মাধ্যমে শত্রুকে যথেষ্ট ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দেওয়া সম্ভব। গ, যে-কোনাে মুক্তিযুদ্ধের জন্য চাই জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত ও সর্বাত্মক সহযােগিতা। আত্মবিশ্বাস, কর্মপ্রেরণা ও মাতৃভূমির জন্য যে-কোনাে ত্যাগ স্বীকার করার জন্য প্রস্তুত থাকার মাধ্যমে মানুষ যে-কোনাে অসম্ভব কাজকে সম্ভব করতে সক্ষম হয়। উপসংহার। নদীর তীরে সংঘটিত এ যুদ্ধ ছিল অসীম সাহসিকতার প্রকৃত উদাহরণ । যদিও পাকিস্তানি বাহিনীর বিমান হামলায় টিকতে না পেরে মুক্তিযােদ্ধাদের পিছু হটতে। হয়েছিল, তথাপি বীরত্বে এ জয় অনস্বীকার্য। মুক্তিযােদ্ধাদের আত্মবিশ্বাস ও আত্মত্যাগ সবার মনােবলকে অনেকাংশে বাড়িয়ে তুলেছিল।
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান -ষষ্ঠ খন্ড