You dont have javascript enabled! Please enable it!
প্রতিরােধ যুদ্ধে পাবনা
পাবনার জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার স্থির করেছিলেন যে, শহর আক্রান্ত হলে তারা প্রতিরােধ করবেন। তাঁদের কাছ থেকে প্রেরণা ও উৎসাহ পেয়ে পুলিশ ব্যারাকের ১০০জন সশস্ত্র পুলিশও মনে মনে প্রতিরােধের জন্য তৈরি হয়েছিল। যতক্ষণ শক্তি আছে, ততক্ষণ এ শহরকে তারা পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে ছেড়ে দেবে না। যেটুকু শক্তি আছে, তাই নিয়েই ওদের বিরুদ্ধে লড়বে। ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ সৈন্যরা পুলিশ ব্যারাকে যায় এবং পুলিশদের অস্ত্রাগার তাদের হাতে ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দেয়। পুলিশরা এতে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন যে, জেলা প্রশাসক তাদের অস্ত্রাগার সামরিক কর্তৃপক্ষের কাছে ছেড়ে দিতে নিষেধ করেছেন। তার এ আদেশ কিছুতেই তারা অমান্য করতে পারবে না। এ নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে প্রথমে বাগ্‌বিতণ্ডা এবং পরে গুলিবর্ষণ চলে তখন বেলা শেষ হয়ে এসেছে। এ যুদ্ধে পাকিস্তানিদের ৩জন সৈন্য মারা যায়। কিন্তু এ শিক্ষা ওদের পক্ষে যথেষ্ট হয় নি। সে রাতে তারা নতুনভাবে আক্রমণ করার জন্য তােড়জোড় চালাতে থাকে ভাের যখন সাড়ে ৪টা, তখন ওরা নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করে অতর্কিতে পুলিশ ব্যারাকের উপর ঝাপিয়ে পড়ে। কিন্তু পুলিশও আগে থেকেই তৈরি হয়েছিল। সৈন্যরা যে আবার ফিরে এসে আক্রমণ করবে, সে বিষয়ে তারা নিশ্চিত ছিলেন।
এবার আর ব্যারাকে নয়, ব্যারাক ছেড়ে নিকটবর্তী বাড়িগুলাের ছাদে ও পথের মােড়ে মােড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের আড়াল নিয়ে তারা হামলাকারী শত্রুদের। জন্য বাঘের মতাে ওত পেতে বসে থাকেন। জেলখানার পুলিশও তাদের সঙ্গে। এসে যােগ দেন। এভাবে সারারাত তারা শত্রুর জন্য মৃত্যু-ফাদ সাজিয়ে বসে ছিলেন। ভাের সাড়ে ৪টার সময় দুই পক্ষে সংঘর্ষ ঘটে। সৈন্যদের পরিবর্তে পুলিশরাই প্রথম আক্রমণ করেন। অতর্কিতে চারদিক থেকে আক্রান্ত হয়ে সুশিক্ষিত সৈন্যরা হতভম্ব হয়ে যায়। এ সংঘর্ষে ২১জন সৈন্য নিহত হওয়ার পর বাকি সৈন্যরা প্রাণ নিয়ে পালায়। পুলিশদের মধ্যে ১জনও মারা যায় নি। ২৭ মার্চ পাবনা শহরের বুকে এ লড়াই শুরু হয়েছিল। ২৭-২৯ মার্চ পর্যন্ত লড়াই চলে। ২৬ ও ২৭ মার্চ ওরা শহরে কারফিউ জারি করেছিল। তা সত্ত্বেও ঐ অবস্থাতেই শহরের যুবক ও ছাত্ররা সারাদিন আর সারারাত প্রতিরােধের জন্য ভিতরে ভিতরে প্রস্তুতি চালিয়ে যাচ্ছিল। ঐ ১ দিনের মধ্যে তারা বেশ কিছু অস্ত্র হাত করে নিয়েছিল। সেদিন কারফিউ ভঙ্গকারীদের মধ্যে ৮-১০জন সৈন্যদের গুলিতে মারা যান। কিন্তু প্রতিরােধকারীদের মনােবল তাতে একটুও ভেঙে পড়ে নি। পাবনা শহরে প্রতিরােধের ব্যাপারে প্রথম থেকেই জেলা প্রশাসকের সক্রিয় ভূমিকা ছিল।
আওয়ামী লীগের নেতা আমজাদ এবং জেলা প্রশাসক মিলিটারির সতর্ক দৃষ্টি এড়িয়ে প্রতিরােধ গড়ে তােলার জন্য ভিতরে ভিতরে চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। তারা ২জন চর অঞ্চলের গ্রামে গ্রামে কৃষকদের মধ্যে ঘুরে বেড়িয়েছেন এবং প্রতিরােধের ব্যাপারে তাদের উদ্বুদ্ধ করে তুলেছেন জনগণ। ভিতরে ভিতরে তৈরি হয়েই ছিল। তাদের এ আহ্বানে উৎসাহিত হয়ে দলে দলে কৃষক এ হামলাকারী শত্রু খতম করে দেওয়ার জন্য শহরের দিকে ছুটে আসতে লাগল। ২৮ মার্চ ২৭জন সৈন্য টেলিফোন এক্সচেঞ্জ দখল করে পাহারা দিয়ে রাখে। চরের কৃষকেরা ছুটতে ছুটতে এসে তাদের ঘেরাও করে ফেলল। তাদের হাতে লাঠিসোটা, বর্শা-বল্লম, তীর-ধনুকসহ আরও কত রকমের হাতিয়ার। ব্যারাক থেকে সব পুলিশ এসে তাদের সঙ্গে যােগ দিয়েছেন। তা ছাড়া শহরের যুবক ও ছাত্ররা দলে দলে ছুটে এসে তাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়াল। শেষ পর্যন্ত জনতা প্রায় ১৫ হাজারে এসে দাড়াল। তাদের গগনবিদারী জয়ধ্বনিতে সারা শহর কেঁপে উঠল। থরথরিয়ে কেঁপে উঠল অবরুদ্ধ পাকিস্তানি সৈন্যদের মন। এবার দুই পক্ষে গুলিবর্ষণ চলল। সৈন্যদের হাতে মেশিনগান ও উন্নত ধরনের অস্ত্রশস্ত্র। পুলিশরা শুধু .৩০৩ রাইফেল নিয়েই লড়ছিল। জনতার মধ্যে যাদের হাতে বন্দুক ছিল, তারাও সৈন্যদের লক্ষ্য করে গুলি চালাচ্ছিল । সৈন্যরা টেলিফোন এক্সচেঞ্জের সুরক্ষিত আশ্রয় থেকে আড়ালে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করছিল। কাজেই সংখ্যায় কম হলেও তাদের খতম করে ফেলা সহজ কাজ ছিল না।
ওদের মেশিনগানের অবিরাম গুলিবর্ষণকে উপেক্ষা করে টেলিফোন এক্সচেঞ্জের উপর ঝাপিয়ে পড়া, জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডের মধ্যে ঝাপিয়ে পড়ার মতােই দুঃসাহসের কাজ সে কারণেই অনেকক্ষণ পর্যন্ত যুদ্ধ চলে। হাজার হাজার জনতা এ যুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে কোনাে কার্যকর সাহায্য করতে পারলেও তাদের আকাশ ফাটানাে জয়ধ্বনি পাকিস্তানি সৈন্যদের মনে ত্রাসের সঞ্চার করে তুলেছিল। তাই উন্নতমানের অস্ত্র হাতে থাকলেও তারা যথাযথ প্রয়ােগ করতে পারেনি। এমনিভাবে ঘণ্টা কয়েকের মধ্যে এক এক করে তাদের ২৭ জনই মারা যায়। টেলিফোন এক্সচেঞ্জ মুক্তিবাহিনীর হাতে এসে যায়। জয়ােল্লাসে মেতে ওঠে সারা শহরের মানুষ বুড়াে থেকে বাচ্চারা পর্যন্ত আনন্দধ্বনি করতে করতে ঘর ছেড়ে পথে নেমে আসে। যে-সব সৈন্য ট্রেজারি। ও শহরের অন্যান্য জায়গায় মােতায়েন ছিল, মুক্তিবাহিনীর প্রতি-আক্রমণের সূচনাতেই তাদের মধ্যে কিছুসংখ্যক নিহত হয়, বাকি সবাই পালিয়ে যায়। সারা শহরের পথে পথে জনতার জয়ের মিছিল চলে। শহর থেকে শত্রু সৈন্যরা নিহত ও বিতাড়িত হলেও শহর বিপদমুক্ত নয়। শহর থেকে মাইল চারেক দূরেই ইপসিক-এর অফিসে শত্রুর মূল ঘাঁটি। তাদের সংখ্যা ছিল ১৫০জনের মতাে। সংখ্যার দিক দিয়ে যাই হােক না কেন, অস্ত্রশস্ত্রের দিক দিয়ে যথেষ্ট শক্তিশালী। শহরকে বাঁচাতে হলে তাদের রাহুগ্রাস থেকে শহরকে মুক্ত করতে হবে।
এখানে উল্লেখযােগ্য যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম পর্যায়ে যারা উজ্জ্বল ভূমিকা গ্রহণ করে আসছে, পাবনা জেলায় সে ইপিআর বাহিনীর কোনাে অস্তিত্ব ছিল না, পুলিশই এখানকার একমাত্র সশস্ত্র যােদ্ধা কিন্তু অস্ত্রশস্ত্রের দিক দিয়ে তারা খুবই দুর্বল। হামলাকারী পাকিস্তানি সৈন্যদের মূল ঘাঁটি থেকে হটিয়ে দেওয়া তাদের পক্ষে দুঃসাধ্য। এ ক্ষেত্রেও জনতাই সামনে এগিয়ে আসে। পাবনা শহরের লড়াইয়ের খবরটা শহরের বাইরে বহুদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল। বাইরে গ্রামাঞ্চল থেকে বিভিন্ন কৃষক সমিতির লােকেরা শহরকে শক্রদের হাত থেকে মুক্ত করার জন্য সংগঠিতভাবে এগিয়ে আসছিল। তারা দলে দলে এসে শত্রুপক্ষের মূল ঘাটিকে ঘেরাও করে ফেলে। রাতের অন্ধকারে ঘটনাটি এত দ্রুত ঘটে গিয়েছিল যে, ওরা কৃষক-জনতার এ অবরােধ থেকে বেরিয়ে পড়ার মতাে সময় বা সুযােগ পায় নি।  পুলিশ এ আক্রমণে কৃষকদের সঙ্গে এসে যােগ দিয়েছিল। তারা শত্রুপক্ষের মেশিনগানের পাল্লার বাইরে দাঁড়িয়ে প্রতিরােধ দিয়ে চলছিল। অবরােধকারীদের পরিকল্পনা ছিল, তারা এভাবে দিনের পর দিন বাইরের সঙ্গে যােগাযােগের পথ বন্ধ করে দিয়ে ওদের না খাইয়ে মারবে। কৃষক-জনতার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় ২০ হাজারে এসে দাঁড়াল। মুক্তিবাহিনীর এ বিরাট সমাবেশের দিকে তাকিয়ে এবং তাদের উন্মত্ত গর্জন শুনে অবরুদ্ধ পাকিস্তানি সৈন্যরা এগিয়ে এসে আক্রমণ করতে সাহস পাচ্ছিল না। দুই পক্ষ পরস্পরের সঙ্গে কিছুটা দূরত্ব রক্ষা করে গুলিবিনিময় করে চলেছিল।
সময়ের সাথে সাথে অবরােধকারীদের সংখ্যা বেড়ে চলেছিল। ওদের দিকে তাকিয়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা এটা নিশ্চিতভাবে বুঝে নিয়েছিল যে, এ সুদৃঢ় প্রতিরােধব্যুহ ভেঙে বাইরে বেরিয়ে যাওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই তারা বেতারযােগে ঢাকার সামরিক কর্তৃপক্ষের কাছে সমস্ত অবস্থা জানায়। কিছুক্ষণ পরেই আকাশে জেট বিমানের গর্জন শােনা গেল। শব্দ শুনে চমকে উঠে সবাই উপরের দিকে তাকিয়ে দেখে যে, সে বিমান সমস্ত অঞ্চলটা প্রদক্ষিণ করে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছে। একটু বাদেই প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দ। জনতার ভিড় লক্ষ্য করে একের পর এক বােমা ফেলে চলেছে জেট বিমান। সঙ্গে সঙ্গে ভয়ার্ত চিৎকার আর ছুটোছুটি শুরু হয়ে গেল। শুধু বােমা ফেলা নয়, প্লেনটা মাঝে মাঝে বাজপাখির মতাে ছোঁ। মেরে নিচে নেমে আসছে। আর এক পশলা মেশিনগানের গুলিবর্ষণ করে যাচ্ছে। বােমারু বিমানের এ অতর্কিত আক্রমণে কিছুসংখ্যক লােক হতাহত হলো, জনতা ছত্রভঙ্গ হয়ে যেতে লাগল। অবরুদ্ধ পাকিস্তানি সেনারা এ সুযােগে অবরােধের বেড়া ভেঙে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে গেল। এভাবে শত্রু সৈন্যদের বিতাড়িত করে কৃষক-জনতা উল্লাসধ্বনি করতে করতে ফিরে এল। মুক্ত নগরী পাবনা উত্সবমুখর হয়ে উঠল। বিতাড়িত পাকিস্তানি সৈন্যরা তাদের ইপসিক-এর ঘাটি ছেড়ে প্রাণ নিয়ে পালাল বটে, কিন্তু শেষরক্ষা হলাে না। উদ্ভ্রান্ত ও দিশেহারা পলাতক সৈন্যদের পালানাের পথে পর পর ২ বার, প্রথমে দাশুড়িয়া পরে মুলাডুলিতে স্থানীয় মুক্তিযােদ্ধাদের আক্রমণের মুখে পড়তে হয়েছিল। এ দুই জায়গাতেই প্রচণ্ড সংঘর্ষ ঘটেছিল। সংঘর্ষের ফলে অবশিষ্ট পাকিস্তানি বাহিনীর প্রায় সবাইকেই প্রাণ দিতে হলাে, কেবল ৪জন প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যেতে পেরেছিল।
বিমানবন্দরের যুদ্ধ
ভূমিকা
পাবনা জেলার মধ্যে সর্বাধিক মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল ঈশ্বরদী থানায়। এলাকার ব্যস্ত তম বিমানবন্দর ঈশ্বরদী উত্তরাঞ্চলের সব এলাকার সাথে যােগাযােগের জন্য সহজতর প্রবেশপথ হওয়ায় পাকিস্তানি সেনাদের কাছে ঈশ্বরদী ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। ৭টি ইউনিয়নসহ ঈশ্বরদী শহর সম্পূর্ণ শত্রুমুক্ত হয় ১৯৭১ সালের ১৯ ডিসেম্বর। এর আগে এপ্রিল মাস থেকে শুরু করে স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে মুক্তিযােদ্ধা ও ছাত্র-জনতার সাথে সম্মুখযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে কয়েকবার। এতে শহিদ হয়েছেন ২৭জন মুক্তিযােদ্ধা, শত্রু সেনা মারা গেছে ৪০জন। ঈশ্বরদী এ অঞ্চলের বৃহত্তম রেলওয়ে জংশন হওয়ায় রণকৌশলগত দিক দিয়ে এটা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পটভূমি ঈশ্বরদীকে মুক্ত করার লড়াইয়ে অংশ নিয়েছিল মূলত ৪টি মুক্তিযোেদ্ধা গ্রুপ, এগুলাের নেতৃত্বে ছিলেন সিরাজুল ইসলাম মন্টু, সদরুল হক সুধা, মেজর রশীদ, মতিউর রহমান কচি, আনিছুর রহমান, হাছিন সরওয়ার, কামাল আহম্মদ, সামছুজ্জামান সেলিম প্রমুখ মুক্তিযােদ্ধা। ১১ ডিসেম্বর দুপুরে পাকশীঈশ্বরদী রাস্তার বেলুপাড়া সাঁকোর কাছে মুক্তিযােদ্ধারা অ্যামবুশ করেন ২৯জন। পাকিস্তানি সেনার বিরুদ্ধে। এখানে মুক্তিযােদ্ধারা বীরত্বপূর্ণ লড়াই করে ২৮জন পাকিস্তানি সৈন্যকে হত্যা করেন। অবশিষ্ট পাকিস্তানি সেনা ঈশ্বরদী গিয়ে পরে আরও অস্ত্র সৈন্যসহ ফিরে আসে। এর মধ্যে মুক্তিযােদ্ধারা নিহত সৈন্যদের অস্ত্রশস্ত্রগুলাে নিয়ে ওখান থেকে সরে যান। এমন সময় মিত্রবাহিনী আকাশপথে পাকশী হার্ডিঞ্জ ব্রিজে বােমা নিক্ষেপ করায় পাকিস্তানি সৈন্যরা আর অগ্রসর হতে পারে নি। মুজিব বাহিনী ও মুক্তিযােদ্ধাদের যৌথ উদ্যোগে পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে সরাসরি অপর একটি যুদ্ধ সংঘটিত হয় ৬ নভেম্বর খিদিরপুর গ্রামে ঐ যুদ্ধের নেতৃত্ব দেন ওয়াছব আলী (স্বাধীনতার পর দুস্কৃতিকারীদের গুলিতে শহিদ) ও আনিছুর রহমান  এখানে সাহসিকতাপূর্ণ লড়াই করেন ৩২জন মুক্তিযােদ্ধা।
যুদ্ধের সংগঠন
যুদ্ধের সংগঠন নিম্নরূপ:
ক. পাকিস্তানি বাহিনী: ১১ সদস্য বিশিষ্ট পাকিস্তানি বাহিনীর এয়ার  ডিফেন্সের ফোর্স ঈশ্বরদী বিমানবন্দর পাহারায় ছিল।
খ, মুক্তিবাহিনী: ১. ঐ সময় কোনাে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযােদ্ধা না থাকায় অল্প সামান্য অস্ত্রচালনাকারীসহ লাঠি, ফলা, বল্লম, তীর, ধনুক ও সামান্য আগ্নেয়াস্ত্রসহ (বন্দুক, রাইফেল) সর্বস্তরের ২ হাজারের ঊর্ধ্বে। ছাত্র-জনতা বিমানবন্দর দখলে অংশগ্রহণ করে।
অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্যদের সংখ্যা ছিল মাত্র ৬-৭জন। ৩. আরও অংশগ্রহণ করেছেন অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ ও আনসারসহ ৭
৮জন। যুদ্ধের বর্ণনা ২৬ মার্চ রাতে ঈশ্বরদীর সংগ্রাম পরিষদ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে, যুদ্ধের জন্য ঈশ্বরদী বিমানবন্দর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তাই বিমানবন্দর নিজেদের নিয়ন্ত্রণে। রাখা একান্ত দরকার ঐ রাতেই বিমানবন্দরে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থান, অস্ত্র, লােকবল, গােলাবারুদ, যানবাহনসহ বিভিন্ন বিষয়ে রেকি করা হয় এবং বিমানবন্দরের বেসরকারি বিমান চলাচল কর্মচারীদের সহায়তায় ২৭ মার্চ ভাের থেকে ঈশ্বরদী বিমানবন্দর দখল নেয়ার জন্য স্বাধীনতাকামী জনতাকে আহ্বান করা হয়। দুপুর ১২টার মধ্যে উল্লিখিত ছাত্র-জনতা অবসরপ্রাপ্ত সামরিক বাহিনীর সদস্য, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সদস্য ঈশ্বরদী পুরাতন বাস স্ট্যান্ডে। জমায়েত হয়। সংগ্রাম পরিষদের যুদ্ধের পরিকল্পনা অনুযায়ী সংগৃহীত যৎসামান্য আগ্নেয়াস্ত্র যেমন: বন্দুক, .৩০৩ রাইফেল, লাঠি, ফলা, বল্লম, তীর, ধনুক ইত্যাদি নিয়ে বিমানবন্দর অফিসের উত্তর দিকে পাকিস্তানি বাহিনীর সশস্ত্র সেনাদের প্রায় ২০০ গজের মধ্যে চতুর্দিক থেকে অবরােধ করে এবং মাইকে পাকিস্তানি বাহিনীকে আত্মসমর্পণ করার আহ্বান জানানাে হয়। লােকজনের দৃঢ়তা দেখেই পাকিস্তানি বাহিনীর ১১জন সদস্য সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র, ওয়্যারলেস সেট ও যানবাহনসহ সংগ্রাম পরিষদের কাছে আত্মসমর্পণ করে।
বিশ্লেষণ ও পর্যালােচনা
সংগ্রাম পরিষদ ও ছাত্র-জনতার পরিকল্পনা অনুযায়ী যখন চারদিক থেকে পাকিস্তানি সেনাদের ঘিরে ফেলা হয় তখন স্বাভাবিক কারণে ওদের মনােবল। ভেঙে যায় এবং আত্মসমর্পণ করে। এখানে ছাত্র-জনতার দৃঢ়তার কাছে তারা। হার মানে। মাত্র ১১জন পাকিস্তানি সেনার পক্ষে বিপুলসংখ্যক ছাত্র-জনতাকে প্রতিরােধ করা সম্ভব ছিল না। এ ছাড়া এ ১১জনের সব ধরনের রসদ সরবরাহ রাজশাহী-নির্ভর হওয়ায় তাদের পক্ষে একাকী রসদবিহীন লড়াই করে টিকে থাকা কখনােই সম্ভব ছিল না, বিধায় তারা আত্মসমর্পণ করে। উপসংহার। মহান মুক্তিযুদ্ধের বিনিময়ে আজ আমরা স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের নাগরিক। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও বিভিন্ন স্মৃতি সংগ্রহ এবং সংরক্ষণ করে রাখা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব, তারই একটি অংশ ঈশ্বরদী বিমানবন্দর যুদ্ধ।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান -ষষ্ঠ খন্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!