ছাতনীর গণহত্যা
ভূমিকা
১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনী নাটোর অঞ্চলের প্রতিটি শহর, বন্দর ও গ্রামকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে নিঃশেষ করার আদিম কৌশলে মেতে উঠেছিল। নিরীহনিরপরাধ বাঙালিকে একের পর এক হত্যা করে বিভীষিকাময় রাজ্য কায়েম করার উৎসাহে মেতে উঠেছিল। তারই সাক্ষী হয়ে আছে নাটোর জেলার লালপুরের যুদ্ধ। আর ছাতনী হলাে লালপুর থানাধীন একটি বিচ্ছিন্ন গ্রাম। ঐ গ্রামেই সংঘটিত হয়েছিল ইতিহাসের আরেকটি নারকীয় গণহত্যা।
পটভূমি
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের রাতে ঢাকায় সংঘটিত হয়ে যাওয়া গণহত্যার খবর থানার ওয়্যারলেস সেটের মাধ্যমে নাটোরের শীর্ষস্থানীয় নেতারা জানতে পারেন। মুহূর্তের মধ্যে শহরে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, পাকিস্তানি বাহিনীর বিরাট এক দল নাটোরের দিকে এগিয়ে আসছে। সেদিন এ অঞ্চলের জনগণের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছিল এক গণজোয়ারের। নাটোরের তৎকালীন আনসার অধিনায়ক টেলিফোনে জানতে পারেন যে, এক দল পাকিস্তানি সৈন্য নগরবাড়ি ঘাট পার হয়ে রাজশাহীর দিকে এগিয়ে আসছে। পর্যায়ক্রমে এ যাত্রাকে প্রতিহত করতেই সেদিন পাকিস্তানিদের সাথে সংঘটিত হয়েছিল বিভিন্ন খণ্ডযুদ্ধ। যুদ্ধে পাকিস্তানিরা মুক্তিবাহিনীর হাতে অনেক স্থানে ভীষণভাবে পর্যুদস্ত হয়। তাই প্রতিশােধ নিতে তারা স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় বিভিন্ন স্থান থেকে নিরীহ লােকজনকে ধরে এনে লালপুর থানার ছাতনী গ্রামে বর্বরােচিত ও নির্মম গণহত্যা চালিয়েছিল।
ভূমি পরিচিতি
নাটোর জেলার ছাতনী গ্রামটি জেলা সদর থেকে আনুমানিক ৬-৭ কিলােমিটার পশ্চিমে অবস্থিত। এর দক্ষিণে তেবাড়ি, উত্তরে বেলঘরিয়া। গ্রামটি ঘন গাছপালায় পরিবেষ্টিত ও সমতল। গ্রামের ভিতর দিয়ে ছাতনী-নাটোর পাকা সড়ক, যা সব ধরনের যানবাহন চলাচলে সাহায্য করে। গ্রামটির উত্তরে অনেক খােলা ভূমি রয়েছে যেখান দিয়ে সব ধরনের ট্যাংক ও ভারি যানবাহন চলাচলে সক্ষম। তবে বর্ষাকালে ঐ ভূমি পানিতে ডুবে থাকে, যা স্বাভাবিক চলাচলে অসুবিধার সৃষ্টি করে।
যুদ্ধের সংগঠন যুদ্ধের সংগঠন নিমরূপ:
পাকিস্তানি বাহিনী: নির্দিষ্টভাবে জানা যায় নি, তবে ধারণা করা হচ্ছে ১টি পাঞ্জাব রেজিমেন্ট কোম্পানি। শত্রুপক্ষের বিন্যাস নাটোরে যখন পাকিস্তানি বাহিনী বিভিন্ন স্থানে পরাজিত হচ্ছিল, তখন তারা মরিয়া হয়ে উঠেছিল বাঙালি জাতিকে দমন-পীড়নের মরণ খেলায়। আর এ সূত্র ধরেই পাঞ্জাব রেজিমেন্টের এক দল সৈনিক সেদিন জড়াে হয়েছিল নাটোর জেলার ছাতনী গ্রামে। সেদিন তাদের কুকীর্তির এক জঘন্যতম চিহ্ন, যা আজও মনে পড়লে শিউরে উঠতে হয়। তারা গ্রামের অধিকাংশ মানুষকে জড়াে করে হত্যা করে। গণহত্যার বিবরণ স্বাধীনতার আহ্বানে নাটোরের অন্যান্য অঞ্চলের মতাে ছাতনী গ্রামবাসীও। সমস্বরে শ্লোগান দিয়েছিল শােষকের মুখে লাথি মারাে, বাংলাদেশ স্বাধীন করাে।’ আর এটাতেই পাকিস্তানিদের জন্য ছাতনীর ধ্বংসও অনিবার্য হয়ে পড়ে। ছাতনীর হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শী এলাকাবাসীর কয়েকজন অশ্রুসজল কণ্ঠে সেদিনের মর্মদ কাহিনীর বর্ণনা দেন। তারা বলেন, স্বাধীনতা সংগ্রামের ২ মাস পর্যন্ত আমরা এদিক-সেদিক পালিয়ে ভালােই ছিলাম। হিন্দু পরিবেষ্টিত এলাকায় হিন্দুদের আমরা পাহারা দিয়ে রাখতাম।
কিন্তু এর মধ্যেও আমাদের অনেকবার লাঠিসোটা নিয়ে প্রস্তুত থাকতে হতাে, কে জানে কখন হয়ত নরপিশাচ অবাঙালি জল্লাদের গ্রামে ঢুকে পড়বে। কিছুদিন পর হায়েনার বংশধরেরা সশস্ত্রে ছাতনী গ্রামকে আক্রমণ করতে আসে। কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনী বিভ্রান্ত হয়ে পিছু হটে যায়। কিন্তু ধর্মের কুলাঙ্গার জল্লাদ হাফেজ আবুল রহমান এ পরাজয়কে অপমান হিসেবে মনে করে। তাই প্রতিশােধ নেয়ার ইচ্ছায় এ জল্লাদ পথ খুঁজতে থাকে সর্বক্ষণ। এমনই একদিন পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসররা বনবেলঘরিয়ার মসজিদ থেকে টেনে বের করলাে ১০৫ বছর বয়স্ক বৃদ্ধ সৈয়দ আলী মুন্সীকে।’ ছাতনীর কয়েকজন বয়ােবৃদ্ধ জানান, অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে ওরা সেদিন রাতে এসে ছাতনী দিঘির পাড়ে জড়াে হয়, রাত তখন প্রায় ২টা, ভাের ৫টার দিকে সমস্ত গ্রামকে তারা ঘিরে ফেলে এবং ঘরের ভিতরে ঢুকে সবাইকে বের করে হাত পিছনে বেঁধে নিয়ে যায়। শিশুদেরও সেদিন হত্যা করতে তারা ছাড়েনি।’ এভাবেই বর্বর পাকিস্তানি হায়েনার গােষ্ঠী নাটোরের ছাতনীকে সেদিন পুরুষশূন্য করে যায়।
উপসংহার
মুক্তিযুদ্ধে নাটোরবাসীর অবদান আজো অম্লান হয়ে আছে নাটোরবাসীর সম্মিলিত প্রয়াস এ অঞ্চলের যুদ্ধের গতি তথা মনােবলকে সুসংহত করেছে। কিন্তু এ অঞ্চলকে মুক্ত করতে নাটোরবাসীকে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। হারাতে হয় অসংখ্য জীবন। তারই সূত্র ধরে ছাতনীর গণহত্যা আজও স্মৃতিতে চিরভাস্বর হয়ে আছে।
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান -ষষ্ঠ খন্ড