You dont have javascript enabled! Please enable it! শাহাগােলা রেলসেতু ধ্বংস - রানীনগর থানা রেলওয়ে চকের ব্রিজে রেইড - সংগ্রামের নোটবুক
শাহাগােলা রেলসেতু ধ্বংস
ভূমিকা
স্বাধীনতা যুদ্ধে আত্রাইয়ের যুদ্ধ পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে বাঙালি মুক্তিকামী মানুষের এক মরণপণ লড়াই। পাকিস্তানি বাহিনী আত্রাইয়ের নিরীহ জনসাধারণের উপর কঠোর নির্যাতন করে এবং বিভিন্ন উদ্দেশ্য সাধনের জন্য পাকিস্তানি সেনারা আত্রাই থেকে শাহাগােলার দিকে অগ্রসর হয়। তখন মুক্তিবাহিনী দূর থেকে শাহাগােলা রেলসেতুর তারের সঙ্গে হাই এক্সপ্লোসিভ লাগিয়ে বিস্ফোরণ ঘটায়। পাকিস্তানি বাহিনী বিকট শব্দের আওয়াজ পেয়ে আত্রাই থেকে শাহাগােলা হয়ে রানীনগরের দিকে ট্রেনযােগে ছুটে আসে। পথিমধ্যে শাহাগােলা ব্রিজে এসে ট্রেনটি পড়ে গিয়ে পাকিস্তানি সেনারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ঈশ্বরদী থেকে পার্বতীপুর পর্যন্ত একমাত্র যােগাযােগ ব্যবস্থা রেলপথ। তাই যাতে পাকিস্তানি সেনারা সহজে যাতায়াত করতে না পারে, সে জন্য ব্রিজটি ধ্বংস করা হয়।
পটভূমি
আত্রাই হতে সান্তাহার পর্যন্ত ট্রেনযােগে পাকিস্তানি সেনারা টহল দিত। শাহাগােলা থেকে আত্রাইয়ের দূরত্ব ৮ কিলােমিটার। পাকিস্তানি সেনারা আত্রাইয়ে একটি ক্যাম্প গঠন করে এবং সেখান থেকে বিভিন্ন জায়গায় আধিপত্য বিস্তার করে। সান্তাহার থেকে আত্রাই যােগাযােগের একমাত্র ব্যবস্থা ছিল ট্রেন। তাদের এ যােগাযােগ ভেঙে দেওয়ার জন্য মুক্তিযােদ্ধারা পরিকল্পনা। করেন এবং শাহাগােলা ব্রিজকে ধ্বংস করার জন্য পরিকল্পনা করেন। মুক্তিবাহিনীর অবস্থান ছিল মির্জাপুর গ্রামে, পাকিস্তানি সেনাদের একটি বড়াে দল আত্রাই থেকে রানীনগরে আসার সংবাদ পেয়ে মুক্তিযােদ্ধারা ২৫ তারিখ রাতে নৌকাযােগে শাহাগােলা ব্রিজে আসেন। এ ব্রিজটিকে ধ্বংস করার জন্য পরিকল্পিতভাবে এক্সপ্লোসিভ ও কাটিং চার্জ লাগিয়ে মুক্তিযােদ্ধারা অদূরে অবস্থান গ্রহণ করেন।
ভূমির পরিচিতি
রেললাইনটি সমতল ভূমি থেকে ১০-১২ ফুট উঁচু। এ এলাকা বর্ষা মৌসুমে পানিতে পরিপূর্ণ থাকে। ব্রিজ থেকে ৩০০-৪০০ গজ দূরে উত্তর দিকে শাহাগােলা রেল স্টেশন। ব্রিজটির দৈর্ঘ্য আনুমানিক ৪০ ফুট।
যুদ্ধের সংগঠন
যুদ্ধের সংগঠন নিমরূপ: ক. পাকিস্তানি বাহিনী: পাকিস্তানি সেনা ১ কোম্পানি। খ. মুক্তিবাহিনী: আনুমানিক ২ পাটুন (অধিনায়ক মাে. আকতার হােসেন)। শত্রুপক্ষের বিন্যাস পাকিস্তানি বাহিনীর ১টি কোম্পানি আত্রাই পুরাতন রেল স্টেশনে ক্যাম্প স্থাপন করে। আত্রাই থেকে সান্তাহারের দিকে রেলযােগে টহল দিয়ে তারা স্থানীয় গ্রাম থেকে বাধ্যতামূলক রসদ সংগ্রহ করত। মুক্তিযােদ্ধাদের চলাফেরা দেখলেই তারা দ্রুত ব্যবস্থা নিত। যুদ্ধের বিবরণ মুক্তিযুদ্ধের সময় নওগাঁ জেলার বিভিন্ন যুদ্ধের মধ্যে শাহাগােলার যুদ্ধ। উল্লেখযােগ্য। এ যুদ্ধে ব্রিজটি ধ্বংস করা ছিল মুখ্য উদ্দেশ্য, কারণ আত্রাইশাহাগােলা যাতায়াতের জন্য পাকিস্তানি বাহিনীর একমাত্র পথই ছিল রেলপথ। শাহাগােলা ব্রিজ ধ্বংস করার উদ্দেশ্য নওগাঁ জেলা শহরের উকিল পাড়ার মাে. আকতার হােসেনের নেতৃত্বে মুক্তিযােদ্ধা মাে. এমদাদুর রহমান এবং সাথে মহাদেবপুর থানার হুমায়ুন আহমেদকে নিয়ে তারাটিয়া গ্রামে অবস্থান গ্রহণ করেন। সেখান থেকে পাকিস্তানি সেনাদের গতিবিধি লক্ষ্য রেখে সূর্যাস্তের পূর্বে হাই এক্সপ্লোসিভ ব্রিজের উত্তর পার্শ্বে গাডারে স্থাপন করে এবং দূর থেকে তারের মাধ্যমে বিস্ফোরণ ঘটান, ফলে ব্রিজের উত্তর পার্শ্বের গড়ার ভেঙে পড়ে। পাকিস্তানি সেনারা যখন আত্রাই থেকে সান্তাহার অভিমুখে ট্রেনযােগে যাত্রা শুরু করে তখন শাহাগােলা ব্রিজে পৌছা মাত্রই ইঞ্জিনের পিছনের ২টি বগি এবং সঙ্গে। ১টি গার্ড ব্রেকসহ ট্রেনটি ব্রিজের নীচে বিকট শব্দে পড়ে যায় এবং কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। পরবর্তী সময় পাকিস্তানি বাহিনী ব্রিজ মেরামত করে এলাকাবাসীর উপর কঠোর নির্যাতন করে।
বিশ্লেষণ ও পর্যালােচনা
মুক্তিবাহিনীর বিজয়ের কারণ ক. নিজস্ব এলাকা: রেললাইনটি সমতল ভূমি থেকে ১০-১২ ফুট উঁচু থাকা সত্ত্বেও এলাকাটি নিজস্ব ও সুপরিচিত হওয়ার ফলে পরিকল্পিতভাবে পাকিস্তানি বাহিনীর যাতায়াতের একমাত্র পথ শাহাগােলা ব্রিজ মুক্তিবাহিনী ধ্বংস করতে সক্ষম হয়েছিল। পারিপার্শ্বিক সহযােগিতা: এ ব্রিজ ধ্বংস করতে গিয়ে মুক্তিবাহিনী পারিপার্শ্বিক সহযােগিতা পেয়েছিল, বিধায় নিজস্ব গােপনীয়তা রক্ষা করে পরিকল্পনামাফিক ব্রিজটি ধ্বংস করতে সক্ষম হয়েছিল। গ, সঠিক লক্ষ্যবস্তু নির্ণয় এবং স্থান নির্বাচন: সঠিক লক্ষ্যবস্তু নির্ণয় এবং স্থান নির্বাচন যুদ্ধ জয়ের অন্যতম কারণ। ঘ, প্রত্যাহারের সুবিধা: শাহাগােলা ব্রিজটি ধ্বংসের কাজ সমাপ্ত করার পর যাতে নিজ বাহিনীর উপর আক্রমণ না হয়, সে জন্য অত্যন্ত গােপনীয়তার সাথে প্রত্যাবর্তন করতে সক্ষম হন। ঙ, কঠিন মনােবল: এ মুক্তিযুদ্ধ ছিল অস্তিত্বের লড়াই, যার কারণে প্রতিটি ক্ষেত্রেই মুক্তিযােদ্ধারা কঠিন মনােবল নিয়ে অগ্রসর হয়েছিলেন। শাহাগােলা ব্রিজটি ধ্বংসের ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছিল। চ, সঠিক ও সুষ্ঠু পরিকল্পনা: মুক্তিবাহিনী সঠিক ও সুষ্ঠু পরিকল্পনা গ্রহণ করতে সক্ষম হয়েছিল, যার কারণে পদে পদে বিজয় নিশ্চিত ও সহজ ছিল। পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয়ের কারণ ক, অপরিচিত এলাকা: পাকিস্তানি বাহিনীর আত্রাই থেকে শাহাগােলা পর্যন্ত যাতায়াতের জন্য একমাত্র পথ ছিল রেলপথ।
আর এ এলাকায় যাতায়াতের জন্য তারা পরিচিত ছিল না, যা তাদের পরাজয়ের কারণ। খ, বর্ষা মৌসুম: পাকিস্তানি বাহিনী পায়ে হেঁটে চলাফেরা করতে অভ্যস্ত ছিল না। এ কারণে বর্ষা মৌসুমে তাদের আক্রমণ পরিচালনা করার বিষয়টি সহজ ছিল না। গ. সঠিক পরিকল্পনার অভাব: সঠিক পরিকল্পনা ব্যতীত যুদ্ধে জয়লাভ করা যায় না। রাজাকারদের প্রতি বিশ্বাস: যুদ্ধের জন্য পাকিস্তানি বাহিনী স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে রাজাকারদের উপর নির্ভর করতাে। রাজাকারদের অনেক ভুল তথ্যের উপর নির্ভর ও বিশ্বাস করার ফলে তারা জয়লাভে ব্যর্থ হয়। শাহাগােলা যুদ্ধই তার অন্যতম প্রমাণ। ৬. ব্রিজের নিরাপত্তা বিধান না করা: নওগাঁ যাতায়াতের জন্য পাকিস্তানি বাহিনীর একমাত্র পথ ছিল নওগাঁ-শাহাগােলা রেলপথ। আর এ পথেই ছিল শাহাগােলা রেলসেতু। এটি একমাত্র পথ হওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তানি বাহিনী ব্রিজটির নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয় এবং পরাজয় নিশ্চিত হয়। শিক্ষণীয় বিষয় এ যুদ্ধের শিক্ষণীয় বিষয় নিম্নরূপ:
ক, স্থানীয় সহায়তা: স্থানীয় সহায়তা ছাড়া যে-কোনাে যুদ্ধে জয়লাভ করা কঠিন। শাহাগােলা ব্রিজ ধ্বংস করতে গিয়ে মুক্তিবাহিনী স্থানীয় জনসাধারণের পর্যাপ্ত সহযােগিতা পেয়েছিলেন।
খ, এলাকা পরিচিতি: মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য শাহাগােলা ব্রিজ এলাকা ছিল অত্যন্ত পরিচিত, যার ফলে ব্রিজ ধ্বংস করে পুনরায় নিরাপদে প্রত্যাবর্তন সহজতর হয়েছিল। গ, প্রতিপক্ষকে দুর্বল মনে না করা: যুদ্ধে প্রতিপক্ষকে দুর্বল মনে করা অনেক সময় পরাজয়ের মূল কারণ হয়ে দাড়ায়, যেমনটি ঘটেছিল পাকিস্তানি বাহিনীর সৈন্যদের বহনকারী ট্রেনটি শাহাগােলা ব্রিজে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে। ভেঙে না পড়া: শাহাগােলা যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর মনােবল ছিল অত্যন্ত তুঙ্গে। ফলে প্রতিকূল অবস্থায়ও তারা মনােবল হারায় নি। উ. মনােবল উচু রাখা: মনােবল উচু রাখার ব্যাপারে মুক্তিবাহিনী অত্যন্ত সজাগ ছিল এবং সর্বদা তারা দলবদ্ধ হয়ে অবস্থান করতাে। ব্রিজটি অনেক উঁচু স্থানে হওয়া সত্ত্বেও মুক্তিবাহিনী ব্রিজের কিছুটা দূরের অবস্থান থেকে এক্সপ্লোসিভ ও কাটিং চার্জ দিয়ে ব্রিজটিকে ধ্বংস করে।
রানীনগর থানা রেলওয়ে চকের ব্রিজে রেইড
ভূমিকা
স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনারা আত্রাই পুরাতন রেল স্টেশনে বড়াে ধরনের ক্যাম্প তৈরি করে এবং সেখান থেকে তারা রেলপথে শাহাগােলা পার হয়ে রানীনগর অভিমুখে প্রায়ই টহল দিত। রেলপথই ছিল পাকিস্তানি সেনাদের একমাত্র চলার পথ । মুক্তিবাহিনী যখন খবর পেল যে, পাকিস্তানি সেনারা ট্রেনপথেই চলাফেরা করে এবং বিভিন্ন উদ্দেশ্য সফল করে, তখন মুক্তিবাহিনী। পরিকল্পনামাফিক ব্রিজটিকে ধ্বংস করে দেয়, ফলে পাকিস্তানি সেনারা মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং তখন থেকেই উভয় পক্ষের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সম্মুখযুদ্ধ শুরু হয়।
পটভূমি
আত্রাই রানীনগর রেললাইনের শাহাগােলা ব্রিজটি মেরামতের পর পাকিস্তানি সেনারা পুনরায় সতর্কতার সাথে টহল জোরদার করে এবং এ এলাকাতে এক ক্যাম্প থেকে অন্য ক্যাম্পে যাওয়া-আসা শুরু করে। মুক্তিযােদ্ধারা তাদের রেলওয়ে চলাফেরা স্তব্ধ করার জন্য শাহাগােলা ব্রিজ দক্ষিণে ১,২০০ গজ দূরে চকের ব্রিজটি ধ্বংস করা অত্যাবশ্যক হয়ে পড়ে। শুরু হয় পরিকল্পনামাফিক। কাজ, এক সময় ব্রিজটি ধ্বংস করতে মুক্তিযােদ্ধারা সক্ষম হন। ভূমির পরিচিতি এ রেললাইনটি সমতল ভূমি থেকে ১০-১২ ফুট উঁচু, দুই পাশে খােলা জমি। চারদিকে ১,৫০০ গজের মধ্যে কোনাে বসতি নেই। কমবেশি সব মৌসুমে এখানে পানি থাকে। ব্রিজটির দৈর্ঘ্য ১০০ গজ। যুদ্ধের সংগঠন যুদ্ধের সংগঠন নিম্নরূপ: ক, পাকিস্তানি বাহিনী: পাকিস্তানি বাহিনীর ১টি রেজিমেন্ট এবং ১টি বালুচ রেজিমেন্ট। খ. মুক্তিবাহিনী: মুক্তিযােদ্ধা ২ সেকশন (অধিনায়ক মকবুল হােসেন)। শত্রুপক্ষের বিন্যাস নওগাঁ জেলার রানীনগর থানার আত্রাই ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর প্রধান ঘাঁটি।
তারা ক্রমান্বয়ে শক্তি বৃদ্ধি করে আত্রাই থেকে রেলপথে শাহাগােলা পার হয়ে রানীনগর পুরাে এলাকায় বিস্তারলাভ করে। ফলে আমাদের মুক্তিবাহিনীর সম্মুখে এক কঠিন চ্যালেঞ্জ এসে দাঁড়ায়। পাকিস্তানি বাহিনী শুধু তাদের শক্তি ও দাপটই দেখাচ্ছিল না, বরং নির্বিঘ্নে হত্যা, নির্যাতন, লুটপাট শুরু করে দেয়। এতে নিরীহ জনগণ গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যায়, তারা দ্রুত মুক্তিবাহিনীকে খবর দেয় এবং পাকিস্তানি বাহিনী সম্পর্কে বিস্তারিত জানায়। এর ফলে অসীম সাহসী অধিনায়ক মকবুল হােসেনের নেতৃত্বে আনুমানিক ২০-২৫ জন মুক্তিযােদ্ধাকে নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে সম্মুখযুদ্ধ হয়। এতে পাকিস্তানি বাহিনী মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং পরাজয় বরণ করতে বাধ্য হয়। বিশ্লেষণ ও পর্যালােচনা মুক্তিবাহিনীর বিজয়ের কারণ ক, দেশপ্রেম: মুক্তিবাহিনীর লড়াই ছিল অস্তিত্বের লড়াই। এ যথার্থ কারণই তাদের জুগিয়েছিল অফুরন্ত দেশপ্রেম। ফলে রানীনগর রেলওয়ে চকের ব্রিজ যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর জয়লাভ নিশ্চিত হয়েছিল। খ, মনােবল: রানীনগর যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী দৃঢ় মনােবলের পরিচয় দেয়। শুধু কঠোর মনােবলের কারণে এ রানীনগর যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীকে পিছু হটতে বাধ্য করে তথা মুক্তিবাহিনী যুদ্ধে জয় লাভ করতে সমর্থ হয়। গ, স্থানীয় সমর্থন: স্থানীয় সমর্থন এবং পারিপার্শ্বিক সহযােগিতা একটি যুদ্ধে যে কতটা প্রয়ােজন, রানীনগর যুদ্ধের ইতিহাস অবলােকন করলে তা সহজেই অনুমেয়।
মুক্তিযােদ্ধাদের স্থানীয় জনসাধারণ সহযােগিতা করেছে বলেই তারা রানীনগর যুদ্ধে জয়লাভ করতে সমর্থ হন। ঘ, সঠিক লক্ষ্যবস্তু নির্ণয় এবং সুষ্ঠু পরিকল্পনা: একটি যুদ্ধে জয়ের জন্য সঠিক লক্ষ্য নির্ণয় এবং সুষ্ঠু পরিকল্পনা করা অনিবার্য। রানীনগর যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর সঠিক লক্ষ্যবস্তু নির্ণয় এবং সুষ্ঠু পরিকল্পনা প্রণয়ন করার ফলে জয়লাভ করতে সমর্থ হয়। পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয়ের কারণ ক. অপরিচিত এলাকা: রানীনগর যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর জন্য এলাকাটি পরিচিত ছিল না, যা তাদের পরাজয়ের উল্লেখযােগ্য কারণ ছিল। খ. নৈতিক দুর্বলতা: এ যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর নৈতিক দুর্বলতা লক্ষ্য  করা যায়। গ, মুক্তিবাহিনীকে দুর্বল মনে করা: পাকিস্তানি বাহিনীর মুক্তিবাহিনীকে দুর্বল মনে করা ছিল তাদের পরাজয়ের অন্যতম কারণ। ঘ, স্থানীয় এলাকা সম্পর্কে ধারণা না থাকা: রানীনগর যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর এলাকা সম্পর্কে পরিচিতি ছিল কম। ব্রিজ এলাকা সম্পর্কে পরিচিত না থাকার কারণে পাকিস্তানি বাহিনীর এ যুদ্ধে পরাজয় ঘটে।৬. স্থানীয় সমর্থন না থাকা: মুক্তিবাহিনীকে স্থানীয় জনসাধারণ পর্যাপ্ত সহযােগিতা প্রদান করে। পক্ষান্তরে পাকিস্তানি বাহিনী কোনােপ্রকার। স্থানীয় সমর্থন না পেয়ে শুধু নিজস্ব সামর্থ্য দিয়ে যুদ্ধ করেছিল, যা তাদের পরাজয় বরণ করতে বাধ্য করে। অনেক সময় ভুল তথ্য দেওয়া: রানীনগর যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনী তাদের সহযােগী রাজাকারদের ভুল পরিকল্পনা ও তথ্যের উপর ভিত্তি করে চলাফেরা করতাে, যা পরাজয়ের অন্যতম কারণ।
শিক্ষণীয় বিষয়
ইতিহাসের প্রতিটি যুদ্ধই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কিছু শিক্ষণীয় বিষয় রেখে যায়, যা ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। তেমনি রানীনগর চকের ব্রিজ ধ্বংসের যুদ্ধে কিছু কিছু শিক্ষণীয় বিষয় ছিল, যা নিম্নরূপ: ক, স্থানীয় সহায়তা: স্থানীয় সহায়তা ছাড়া যে-কোনাে যুদ্ধে জয়লাভ করা কষ্টসাধ্য ব্যাপার। খ. এলাকা পরিচিতি: মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য রানীনগর ব্রিজ এলাকা ছিল অত্যন্ত পরিচিত, যার ফলে ব্রিজ ধ্বংস করে পুনরায় নিরাপদে প্রত্যাবর্তন করা সহজতর হয়েছিল। প্রতিপক্ষকে দুর্বল মনে না করা: যুদ্ধে প্রতিপক্ষকে দুর্বল মনে করা অনেক সময় পরাজয়ের মূল কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যেমনটি ঘটেছিল পাকিস্তানি বাহিনীর সৈন্যদের বহনকারী ট্রেনটি রানীনগর ব্রিজে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে। ঘ. ভেঙে না পড়া: রানীনগর যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর মনােবল ছিল অত্যন্ত। তুঙ্গে। ফলে প্রতিকূল অবস্থায়ও তারা মনােবল হারায় নি। মনােবল উঁচু রাখা: মনােবল উঁচু রাখার ব্যাপারে মুক্তিবাহিনী অত্যন্ত সজাগ ছিল এবং সর্বদা তারা দলবদ্ধ হয়ে অবস্থান করতাে। ব্রিজটি অনেক উঁচু স্থানে হওয়া সত্ত্বেও মুক্তিবাহিনী ব্রিজের কিছুটা দূরের অবস্থান থেকে এক্সপ্লোসিভ ও কাটিং চার্জ দিয়ে ব্রিজটিকে ধ্বংস করে।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান -ষষ্ঠ খন্ড