You dont have javascript enabled! Please enable it!
আড়ানী রেলসেতু আক্রমণ
ভূমিকা
স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় রাজশাহী সেক্টরের যুদ্ধ ছিল মূলত খণ্ড খণ্ড আক্রমণ এবং পাল্টা আক্রমণের মধ্যে সীমাবদ্ধ। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে মুক্তিবাহিনী শত্রুর উপর এ ধরনের আক্রমণ পরিচালনা করে। তন্মধ্যে আড়ানী রেলসেতু প্রতিরােধযুদ্ধ বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। কারণ এ প্রতিরােধযুদ্ধের মাধ্যমে শত্রুর যানবাহন, জনবল, রসদ ও গােলাবারুদের বড়াে ধরনের ক্ষতি করা সম্ভব হয়েছিল। নাটোর থেকে রাজশাহী পৌছুতে পাকিস্তানি বাহিনী যে রাস্তা ব্যবহার করতাে, আড়ানী রেলসেতু তার কাছেই অবস্থিত। সে কারণে আড়ানী রেলওয়ে ব্রিজ যুদ্ধ কৌশলগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। পটভূমি। রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় অবস্থিত পাকিস্তানি বাহিনী তাদের রসদ, গােলাবারুদ ও সরঞ্জামের জন্য ঈশ্বরদীর উপর বহুলাংশে নির্ভরশীল ছিল। এ সরবরাহের সিংহভাগই আসত রেলপথের মাধ্যমে, যার পরিপ্রেক্ষিতে ঈশ্বরদী ও রাজশাহীর মধ্যে প্রতিদিন একটি সামরিক সরঞ্জাম বহনকারী ট্রেন চলাচল। করতাে। পাকিস্তানি বাহিনীর এ সরবরাহ ব্যবস্থাকে নস্যাৎ করার জন্য পূর্বে কয়েকবার এ সামরিক ট্রেনকে ধ্বংস করার চেষ্টা করা হয়, কিন্তু সফলতা অর্জন সম্ভব হয় নি। অবশেষে আড়ানী রেলসেতু ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ঐ অপারেশন পরিচালনা করা হয়। ভূমি পরিচিতি চারঘাট থানা সদর থেকে প্রায় ১১ কিলােমিটার পূর্বে এবং পুঠিয়া থেকে প্রায় ৯ কিলােমিটার দক্ষিণ-পূর্বে আড়ানী অবস্থিত। সড়কপথে আড়ানীর সাথে বাগাতিপাড়া ও চারঘাটের যােগাযােগ বিদ্যমান। এ ছাড়া রেলপথের মাধ্যমে পশ্চিমে রাজশাহী এবং পূর্বে আব্দুলপুরের সাথে যােগাযােগ আছে। আড়ানী এলাকার রেলসেতুটি রেল স্টেশন থেকে ২ কিলােমিটার পশ্চিমে বড়াল নদের। উপর অবস্থিত। রেলসেতু এলাকার দক্ষিণ-পূর্ব ব্যতীত অন্যান্য দিকে বিস্তৃত খােলা ভূমি লক্ষ্য করা যায়। এলাকার ভূমি শুষ্ক মৌসুমে যে-কোনাে বড়াে ধরনের সৈন্য চলাচলে সহায়তা করে। এলাকার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত বড়াল নদ। বর্ষা মৌসুমে নৌচলাচলের উপযােগী থাকে।
যুদ্ধের সংগঠন
যুদ্ধের সংগঠন নিম্নরূপ: ক. পাকিস্তানি বাহিনী: রাজশাহী সেক্টরটির দায়িত্বে নিয়ােজিত ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১৬ ডিভিশন, যার সদর দপ্তর ছিল নাটোরে । ৩৪ ব্রিগেডের দায়িত্বে ছিলেন ব্রিগেডিয়ার নাঈম, যার দায়িত্ব ছিল পত্নীতলা, নবাবগঞ্জ ও ঈশ্বরদীকে রক্ষা করা। রাজশাহী এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের সৈন্যরা অবস্থান করছিল। কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল শাফকাত বালুচ। মুক্তিবাহিনী: অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল কাজী নুরুজ্জামান এবং ৭ নম্বর সেক্টরের মুক্তিবাহিনী। যুদ্ধের বিবরণ ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি দখলদার সেনাবাহিনীর অস্ত্রশস্ত্র ও রসদপত্র আনানেয়ার জন্য ঈশ্বরদী-রাজশাহী অঞ্চলে রেলপথ বিশেষ একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল। ৭ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক কর্নেল কাজী নুরুজ্জামান, সেকেন্ড-ইন-কমান্ড মেজর গিয়াস উদ্দিন আহম্মেদ চৌধুরী এবং সাব-সেক্টর-৪-এর অধিনায়ক মেজর আব্দুর রশীদ আড়ানী রেলসেতু আক্রমণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে রাতের বেলায় পর পর ২টি আক্রমণের পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়ে যায়। ১৯৭১ সালের ১ নভেম্বর প্রায় ৮০-৯০জন মুক্তিযােদ্ধা ৪টি এলএমজি, ৩০-৩৫টি সেল্ফ। লােডিং রাইফেল, ১০টি এসএমজি, .৩০৩ রাইফেল এবং প্রয়ােজনীয় পরিমাণ বিস্ফোরক নিয়ে পুনরায় ঐ ব্রিজ আক্রমণ করে। ঐ সময় ব্রিজ প্রহরায় নিযুক্ত পুলিশ ও আধা-সামরিক বাহিনীর সদস্যরা পালিয়ে যায়। পরে বিস্ফোরণের মাধ্যমে ব্রিজটি ধ্বংস করে দেওয়া হয়। বিশ্লেষণ ও পর্যালােচনা মুক্তিবাহিনীর বিজয়ের কারণ আড়ানীর যুদ্ধ পর্যালােচনা করে দেখা যায় যে, বাঙালিদের বিজয়ের কারণগুলাে ছিল নিম্নরূপ: ক, অদম্য মনােবল: আড়ানী রেলসেতু আক্রমণ পরিকল্পনা প্রাথমিকভাবে পর পর ২ বার ব্যর্থ হয়। এর পরও মুক্তিযােদ্ধারা মনােবল না হারিয়ে তৃতীয়বারের চেষ্টায় সফল হন।
মুক্তিযােদ্ধাদের অদম্য মনােবলের ফলেই এটা সম্ভব হয়েছিল। স্থানীয় সাহায্য: আড়ানীর যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী স্থানীয় অধিবাসী কর্তৃক পেয়েছিল ব্যাপক সাহায্য ও সহযােগিতা, যেটা একটা জয়ের জন্য। অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়।গ. স্থানীয় ভূমির সঙ্গে পরিচিতি: আড়ানীর যুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধারা এমন ভূমিতে যুদ্ধ করেছেন যা ছিল তাদের পূর্বপরিচিত। এ পরিচিতি তাদের সব কর্মকাণ্ডে সহায়তা করেছিল। এটাও মুক্তিযােদ্ধাদের জয়ের একটা বড়াে কারণ হিসেবে কাজ করেছিল। পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয়ের কারণ আড়ানীর যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর ব্যাপক পরাজয় হয়েছিল। যে-সব কারণে পাকিস্তানিরা পরাজিত হয়েছিল, তার মধ্যে উল্লেখযােগ্য কয়েকটি কারণ হচ্ছে: ক, মুক্তিবাহিনীকে দুর্বল মনে করা: পাকিস্তানিরা ছিল অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত; অন্যদিকে, বাঙালিরা ছিল নিরস্ত্র । তাই তাদের মনে একটা অহংকার জাগ্রত হয়েছিল বাঙালিদের বিরুদ্ধে কিন্তু শেষ পর্যন্ত এ দুর্বল নিরস্ত্র বাঙালিরাই তাদের পর্যুদস্ত করেছিল। খ. স্থানীয় এলাকা সম্পর্কে ধারণা না থাকা: পাকিস্তানিরা যুদ্ধ এলাকার বিন্যাস সম্পর্কে সম্যক অবহিত ছিল না। এলাকা ছিল তাদের অচেনা-অজানা, যা তাদের বিভিন্ন পরিকল্পনার ব্যাঘাত ঘটাত। এ কারণেও তাদের পরাজয় বরণ করতে হয়েছিল। স্থানীয় সমর্থন না থাকা: পাকিস্তানিদের ছিল না কোনাে স্থানীয়। সহযােগিতা। তাই তাদের যে-কোনাে ধরনের চলাচল ও পরিকল্পনা। মুক্তিবাহিনী আগেভাগেই জেনে যেত স্থানীয় লােকদের সহায়তায়, যা তাদের পরাজয়কে করেছিল নিশ্চিত। শিক্ষণীয় বিষয় আড়ানীর যুদ্ধে শিক্ষণীয় বিষয়গুলি ছিল নিমরূপ: ক. স্থানীয় সহায়তা: স্থানীয় সহায়তা ব্যতীত যুদ্ধে জয়লাভ করা খুবই দুরূহ ব্যাপার। পাকিস্তানিদের ছিল না কোনাে স্থানীয় সমর্থন; অন্যদিকে, মুক্তিবাহিনীর ছিল সব ধরনের স্থানীয় সাহায্য। তাই যুদ্ধে জয়লাভ সহজ হয়েছিল। খ. প্রতিপক্ষকে দুর্বল মনে না করা: যুদ্ধে প্রতিপক্ষকে দুর্বল মনে করা অনেক সময় পরাজয়ের কারণ হয়ে দেখা দেয়, যেমনটি ঘটেছিল। পাকিস্তানিদের আড়ানীর যুদ্ধে। সুতরাং, প্রতিপক্ষকে কখনাে দুর্বল মনে করা উচিত নয়।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ-রেহাইচরের যুদ্ধ
ভূমিকা
১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর উপর মিত্রবাহিনী সর্বাত্মক আক্রমণ শুরু করে। ঐ সময় ঢাকার দিকে দ্রুত অগ্রসরমাণ মিত্রবাহিনীকে প্রতিহত করার জন্য পাকিস্তানি বাহিনী তাদের অধিকাংশ সৈন্য মােতায়েন করে। ফলে পাকিস্তানি বাহিনী তীব্র সৈন্য সংকটে পড়ে এবং এর প্রভাব চাঁপাইনবাবগঞ্জেও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মুক্তিবাহিনী অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে ঐ। পরিস্থিতির সুযােগ গ্রহণ করে চাপাইনবাবগঞ্জকে শত্রুমুক্ত করে। পটভূমি স্বাধীনতা যুদ্ধের উষালগ্নে চাপাইনবাবগঞ্জের মুক্তিপাগল জনতা ১৯৭১ সালের। ১২ মার্চ বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে, যা ছিল ঐ ধরনের দ্বিতীয় ঘটনা। ২৫ মার্চের গণহত্যার পর পরই চাপাইনবাবগঞ্জের যুদ্ধ ক্রমান্বয়ে বিস্তার লাভ করতে থাকে। ২৬ মার্চ বিকালে চাপাইনবাবগঞ্জ শহরে কারফিউ জারি করা হয়। বাঙালি ইপিআর সদস্যদের নিরস্ত্র করার চেষ্টা করা হয় এবং সাধারণ জনগণকে সহায়তা না করার জন্য তাদের হুমকি দেওয়া হয়। ঢাকায় ইপিআর সদস্যদের হত্যার সংবাদ পেয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের বাঙালি ইপিআর সদস্যরা। সতর্ক হয়ে যান। পরবর্তী সময় পাকিস্তানি বাহিনীর হত্যার ষড়যন্ত্র এবং পাকিস্তানি সেনাদের রাজশাহী স্থানান্তরের পরিকল্পনা জানতে পেরে বাঙালি। ইপিআর সদস্যরা বিদ্রোহ করেন। জনগণের সহায়তায় তারা পরিস্থিতি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনেন এবং পাকিস্তানি ইপিআর সদস্যদের রাজশাহী পালিয়ে যেতে বাধ্য করে। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল শক্রর ৩টি যুদ্ধবিমান চাপাইনবাবগঞ্জ শহরে আক্রমণ চালায়। পাকিস্তানি সেনা বহনকারী ১০৬টি গাড়ির বহরে ২১ এপ্রিল কোনােরকম বাধা ছাড়াই শহরে প্রবেশ করলে চাপাইনবাবগঞ্জ পাকিস্তানি সেনাদের হাতে চলে যায়। পরবর্তী সময় শত্রুমুক্ত করার জন্য এ এলাকায় পাকিস্তানি সেনা ও মুক্তিবাহিনীর মধ্যে বেশ কয়েকটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়। চাপাইনবাবগঞ্জ-রেহাইচরের যুদ্ধ এ এলাকায় সংঘটিত যুদ্ধগুলাের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য।
ভূমি পরিচিত
একটি নকশা ছাড়া কোনাে তথ্য সংগ্রহে নেই। যুদ্ধের সংগঠন যুদ্ধের সংগঠন নিম্নরূপ: ক, পাকিস্তানি বাহিনী: ৩২ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট। চাপাইনবাবগঞ্জকে প্রতিরক্ষার জন্য ৩২ পাঞ্জাব রেজিমেন্টকে ১৯৭১ সালের জুলাই মাসে মােতায়েন করা হয়। বর্তমান বিবিজি-এর সদর দপ্তরে পাকিস্তানি রেজিমেন্টের দপ্তর ছিল। খ. মুক্তিবাহিনী: লােহাগড়া সাব-সেক্টরের অধিনায়ক মেজর গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী ও তার দল। যুদ্ধের বিবরণ সম্মিলিত বাহিনীর আক্রমণ শুরু হলে লেফটেন্যান্ট কর্নেল কাজী নুরুজ্জামান চাঁপাইনবাবগঞ্জে তিন দিক থেকে আক্রমণের পরিকল্পনা করেন। 
ক, ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের নেতৃত্বে ১টি দল সােনা মসজিদ শিবগঞ্জ অক্ষ বরাবর মহানন্দা নদী পার হয়ে শত্রুর অবস্থানে আক্রমণ
খ. লেফটেন্যান্ট রফিকের নেতৃত্বে আরেকটি দল রহনপুর-নাচোল আমনুরা হয়ে চাপাইনবাবগঞ্জে আক্রমণ করে।
গ. মেজর গিয়াসের উপর অর্পিত দায়িত্ব ছিল রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ সড়কে ব্লকিং পজিশন দখল করা।  যুদ্ধের ধারাবাহিকতা বলতে গেলে বলতে হয়, ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর চরবাগডাংগার মুক্তিযােদ্ধারা চাপাইনবাবগঞ্জের দিকে অগ্রসর হন। ১০ মাইল। পথ অতিক্রম করার পর তাঁরা মহানন্দা নদীর পাশে সাহেবঘাটে পেীছেন। নদীর ঠিক অপর পার্শ্বে অবস্থিত নামােশংকরবাটি গ্রাম। নামােশংকরবাটিতে কোনাে পাকিস্তানিদের আস্তানা আছে কিনা, জানার জন্য মুক্তিযােদ্ধারা এলএমজি ফায়ার শুরু করেন। বিপরীত দিক থেকে কোনাে সাড়া না পেয়ে মুক্তিযােদ্ধারা সে। অবস্থান থেকে দেড় কিলােমিটার পশ্চিমে মােহনপুর ঘাটে চলে যান। সেখানে পেীছে তারা জানতে পারেন যে, নদীর অপর পার্শ্বে পারমােহনপুরে পাকিস্তানিদের প্রতিরক্ষা অবস্থান রয়েছে। তারা সেখানে দুপুর পর্যন্ত অপেক্ষা করে সুবেদার ইসমাইলের কভারিং ফায়ারের সহায়তায় নদী অতিক্রম করেন। নদী অতিক্রম করে সংঘটিত হয়ে তারা পারমােহনপুরে ফায়ার শুরু করেন। মটার ফায়ারের কারণে শত্রুরা তাদের অবস্থান ত্যাগ করে এবং মুক্তিবাহিনী এলাকাটি দখল করে নেয়। পরবর্তী সময় জানা যায় যে, ঐ অবস্থানটি রাজাকাররা দখল করে রেখেছিল। পরে সেখান থেকে মুক্তিবাহিনী টিকরামপুরে স্থান পরিবর্তন করে।
একই দিনে ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর আনুমানিক ৩০জন মুক্তিযােদ্ধা নিয়ে। মেহেদীপুর থেকে চাপাইনবাবগঞ্জে রওনা দেন। পথিমধ্যে তারা ১৯৭১ সালের ১১ ডিসেম্বর শিবগঞ্জে রাজাকারদের বন্দি করেন এবং দলটি দুপুর ১১টার সময় বারােঘরিয়ায় পৌছায়। ১২ ডিসেম্বরেও মুক্তিবাহিনী ঐ অবস্থানে ছিল। লেফটেন্যান্ট কাইউম এবং লেফটেন্যান্ট আউয়াল এখানে ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীরের সাথে একত্র হন। টিকরামপুরে অবস্থিত মুক্তিযােদ্ধারা রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের সংযােগ রাস্তা কেটে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। যদিও আগস্ট মাসে হরিপুরের ব্রিজটি ধ্বংস করার পর পরবর্তী সময় পাকিস্তানি সেনারা সেখানে একটি কাঠের ব্রিজ পুনরায় তৈরি করে। আনুমানিক ৫টার সময় মুক্তিবাহিনী রাজারামপুরে পৌছায়।  ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর ভারতীয় আর্টিলারি ফায়ার সহায়তা পাওয়ার জন্য। বারােঘরিয়ায় অপেক্ষা করেন কিন্তু তা কখনােই পৌছায় নি। ফলে ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর ১৩-১৪ ডিসেম্বর রাতে আর্টিলারি ফায়ার সহায়তা ছাড়াই চাঁপাইনবাবগঞ্জ আক্রমণের পরিকল্পনা করেন। তিনি তার দল নিয়ে ১২ ডিসেম্বর বারােঘরিয়ায় থেকে যান এবং বাকি সবাই ঐ দিনই মহানন্দা নদী পার। হন। ১৯৭১ সালের ১৩ ডিসেম্বর যুদ্ধ তীব্রতর হয়। মুক্তিবাহিনী সব দিক থেকে চাপাইনবাবগঞ্জ আক্রমণ করে। পাকিস্তানি সেনারা ভীত হয়ে ঐ অবস্থান খালি করতে থাকে।
১৯৭১ সালের ১৩ ডিসেম্বর ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর তার দলকে কয়েকটি উপদলে বিভক্ত করেন এবং আকন্দবাড়িয়া ঘাট দিয়ে মহানন্দা পার হয়ে টিকরামপুরে পৌছেন। রাতের আহারের পর তিনি সৈন্যদের ভবিষ্যৎ অপারেশন সম্পর্কে ধারণা দেন। ১৪ ডিসেম্বর সকাল ৬টায় তিনি তার দলসহ রেহাইচরের পাশে অবস্থান নেন। আনুমানিক সাড়ে ৮টার সময় তিনি ৬০জন মুক্তিযােদ্ধাকে নিয়ে নদীর পাড় দিয়ে রেহাইচরের দিকে অগ্রসর হন। দ্রুত পর্যবেক্ষণের পর তিনি অবস্থানটিতে আক্রমণ করেন। যখন তিনি বাংকার চার্জে ছিলেন, তখন। হঠাৎ একটি ঘর থেকে শত্রুর বুলেট তাকে আঘাত করে এবং তিনি শহিদ হন। কিন্তু প্রচণ্ড গােলাগুলির কারণে সেদিন তার মৃতদেহ উদ্ধার করা যায় নি। পরে তার মৃতদেহ ১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর উদ্ধার করা হয়। বিশ্লেষণ ও পর্যালােচনা মুক্তিবাহিনীর বিজয়ের কারণ মুক্তিবাহিনীর বিজয়ের পিছনে নিম্নলিখিত কারণগুলাে উল্লেখ করা যায়: 
ক. কভারিং পার্টির অবস্থান সঠিক ছিল: সুবেদার ইসমাইলের নেতৃত্বে কভারিং পার্টির অবস্থান সঠিক ছিল বলেই ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীরের নেতত্বাধীন দলটি মহানন্দা নদী অতিক্রম করতে কোনােপ্রকার অসুবিধার সম্মুখীন হয় নি। তা ছাড়া কভারিং পার্টিতে যে ২টি এলএমজি ছিল, সেগুলাের অবস্থানও সঠিক ছিল।
খ, মর্টারের যথার্থ অবস্থান: ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীরের নেতৃত্বাধীন দলটির সাথে যে মর্টার ছিল, সেগুলাের অবস্থান সঠিক ছিল। মর্টারের সঠিক নিশানায় পারমােহনপুর থেকে শত্রুরা পালিয়ে জীবন বাঁচাতে বাধ্য হয়। মর্টারের রণকৌশলও সঠিক ছিল। ক্ষিপ্রতা: ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীরের নেতৃত্বাধীন দলটি ছিল ক্ষিপ্রতার এক অনন্য প্রতীক। ভারতীয় আর্টিলারির ফায়ার সহায়তা না পেয়েও তারা পিছু হটে যায়নি বরং আরও বেশি ক্ষিপ্রতার সাথে শত্রুকে মােকাবিলা করে পরাস্ত করে। ঘ. উচ্চ মনােবল: মুক্তিকামী এ মুক্তিযােদ্ধাদের মনােবল ছিল দৃঢ়। তাদের এ উচ্চ মনােবলই বিজয়ের স্তম্ভ হিসেবে কাজ করেছে। পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয়ের কারণ পাকিস্তানি বাহিনী নিমলিখিত কারণগুলাের জন্য পরাজিত হয়েছে বলে ধারণা করা হয়: ক. সঠিক টহল প্রদান না করা: পাকিস্তানি বাহিনীর টহলব্যবস্থা সঠিক ছিল না। তারা খামখেয়ালি ও অমনােযােগের সাথে এ দায়িত্ব পালন করেছিল। এ কারণেই তারা নিজেরা নিজেদের আক্রমণে জীবন হারায়। এলএমজি’র অবস্থান সঠিক ছিল না: পাকিস্তানি বাহিনীর এলএমজি’র অবস্থান সঠিক ছিল না। তাদের রণকৌশলও ছিল নিম্নমানের এ কারণেই তারা ব্রিজের কাছে পয়েন্ট ব্ল্যাংক রেঞ্জের মধ্যেও মুক্তিবাহিনীকে ঘায়েল করতে পারে নি।
হীন মনােবল: বিভিন্ন মারণাস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি বাহিনীর মনােবল ছিল হীন, এ কারণেই এলএমজি ও রাইফেলসজ্জিত হয়েও জীবন রক্ষার্থে তারা নদীতে ঝাপিয়ে পড়ে। জীবনকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য ১১জন বন্দি হয় এবং জীবন বিসর্জন দিতে কার্পণ্য করে। সঠিক গােয়েন্দা তথ্য: পাকিস্তানি বাহিনীর প্রতিটি অবস্থান এবং কর্ম পরিকল্পনা সম্পর্কে স্থানীয় জনগণের মাধ্যমে আগেভাগেই মুক্তিবাহিনী জানতে পারতাে। ফলে মুক্তিবাহিনী পূর্ব থেকেই প্রস্তুত থাকার সুযােগ পেত। শিক্ষণীয় বিষয় হরিপুর-আমনুরা যুদ্ধ থেকে নিম্নলিখিত শিক্ষণীয় বিষয়গুলাে উল্লেখ করা যেতে পারে:
ক. যুদ্ধের যথার্থতা: মুক্তিবাহিনী স্বাধীকার আদায়ের জন্য, পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্তির জন্য স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল, পক্ষান্তরে পাকিস্তানিদের নৈতিক কোনাে কারণ না থাকায় ফলাফল হয়েছিল মুক্তিযােদ্ধাদের পক্ষে।
খ. স্থানীয় সহায়তা: যুদ্ধে জয়লাভের জন্য স্থানীয় জনগণের সার্বিক সহায়তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পাকিস্তানিদের কোনাে স্থানীয় সহায়তা না থাকায় মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে জয়লাভ করা সম্ভব হয় নি। গ. গেরিলা রণকৌশল: মুক্তিবাহিনী গেরিলা রণকৌশলের মাধ্যমে সুপ্রশিক্ষিত পাকিস্তানি সেনাদের বিভিন্ন ঘাঁটি ধ্বংস এবং ক্ষতিসাধন করতে সমর্থ হয়। মুক্তিবাহিনীর এ গেরিলা রণকৌশল স্বাধীনতা যুদ্ধে। অত্যন্ত কার্যকর প্রমাণিত হয়।
উপসংহার
১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে চাঁপাইনবাবগঞ্জে যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল, তা মুক্তিবাহিনীর জন্য দেশপ্রেম ও নির্ভীক যােদ্ধার স্বাক্ষর রাখে। ভারতের কোনােপ্রকার উল্লেখযােগ্য সাহায্য ছাড়াই মুক্তিবাহিনী এ অঞ্চল থেকে পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাজিত করে। চাপাইনবাবগঞ্জে যে-সব যুদ্ধ সংঘটিত হয়, তা পরবর্তী সময় পুরাে দেশের স্বাধীনতা লাভে সাহায্য করে। পাকিস্তানি বাহিনীর নিচু মনােবল, উদ্ধৃঙ্খল জীবনযাপনই নিশ্চিত করেছে মুক্তিবাহিনীর বিজয়, যা এসেছে অনেকগুলাে সাহসী এবং সত্যিকার দেশপ্রেমিকের তাজা প্রাণের বিনিময়ে। চাপাইনবাবগঞ্জ বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরকে তার বুকে ধারণ করে আজ গর্বের সাথে স্মরণ করে স্বাধীনতা যুদ্ধের স্মৃতিময় গর্বিত দিনগুলাের কথা।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান -ষষ্ঠ খন্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!