You dont have javascript enabled! Please enable it!
আত্রাইয়ের যুদ্ধ (অ্যাম্বুশ)
ভূমিকা
আত্রাই একটি নিচু এলাকা। এ এলাকার ভিতর দিয়েই প্রবাহিত হয়েছে আত্রাই নদী, যা নওগাঁর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে নাটোর ও সিংড়া হয়ে পদ্মা নদীর সাথে সংযুক্ত হয়েছে। বর্ষায় এ নদী খুব হিংস্র রূপ ধারণ করে। তবে শুষ্ক মৌসুমে অনেকটাই শান্ত। এ নদীর সাথেই ছােটো ছােটো খালের মাধ্যমে গ্রামগুলাের সংযােগ ঘটেছে। নদীর পাড় উঁচু হওয়ায় বসতিও বেশি। তা ছাড়া কোথাও নদীর পাড়ে জঙ্গল রয়েছে। বর্ষায় নদীর বিস্তৃতি ৩০০-৪০০ গজ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। তবে শুষ্ক মৌসুমে এর বিস্তৃতি ১০০-২০০ গজের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে এ গ্রামগুলাের প্রধান বাহন নৌকা।
পটভূমি
১৯৭১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী ১১টি দেশি নৌকাযােগে বান্দাইখাড়া গ্রামের উপর বর্বর আক্রমণ চালায়। গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়িতে তারা অগ্নিসংযােগ করে। লুটপাট করে নিরীহ জনসাধারণের সম্পত্তি এবং হত্যা করে অসংখ্য সাধারণ গ্রামবাসীকে এ সময় তারা আটক করে প্রায় ৫০জন যুবক-যুবতীকে পাকিস্তানি হানাদারদের এ নির্মম হত্যাযজ্ঞের খবর পেয়ে নওগাঁ জেলার মুক্তিযােদ্ধারা শিকারপুর ইউনিয়নের রঘুনাথপুর গ্রামে সংঘবদ্ধ হন। এবং পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বর আক্রমণের উচিত শিক্ষাদানের জন্য সুপরিকল্পিত পরিকল্পনা করে।
ভূমির পরিচিতি
আত্রাই এলাকাটি থানা থেকে পশ্চিম দিকে প্রায় ১৫ কিলােমিটার দূরে অবস্থিত। আত্রাই নদীর দক্ষিণ পাশে বান্দাইখাড়া গ্রাম অবস্থিত। এর দক্ষিণে বাগমারা থানা, উত্তরে নওগাঁ থানা, পশ্চিমে মান্দা থানা এবং পূর্বে বাহুল্যা তারানগর গ্রাম। আত্রাই নদীর দক্ষিণ পাড়ে তারানগর এবং উত্তর পাড়ে বাহুল্যা গ্রাম অবস্থিত। এলাকাটি অপেক্ষাকৃত নিচু এলাকা। এখানে বছরে একবার ইরি ধানের চাষ হয়। নদীর উভয় পার্শ্বে সরিষার চাষ হয়। বর্ষা মৌসুমে নৌকার মাধ্যমে এবং শুষ্ক মৌসুমে পায়ে হেঁটে চলাফেরা করতে হয়।
যুদ্ধের সংগঠন
যুদ্ধের সংগঠন নিমরূপ:
ক. পাকিস্তানি বাহিনী: ৩ প্লাটুন পাকিস্তানি সেনা, ২ প্লাটুন রাজাকার (শান্তি কমিটির সদস্য), নৌকা: ১১টি।
খ. মুক্তিবাহিনী: ৪ প্লাটুন মুক্তিযােদ্ধা, হালকা অস্ত্র (রাইফেল, এসএমজি)। শত্রুপক্ষের বিন্যাস পাকিস্তানি বাহিনীর মূল ঘাঁটি ছিল আত্রাই পুরাতন রেল স্টেশন। সেখান থেকে পাকিস্তানি বাহিনী নদীপথে নৌকায় চড়ে বান্দাইখাড়া গ্রামে গিয়ে আক্রমণ এবং যুবক-যুবতীদের অমানুষিক নির্যাতন করতাে। যুদ্ধের বিবরণ মুক্তিযােদ্ধারা ২টি দলে বিভক্ত হয়ে অ্যামবুশ কার্যকর করার পরিকল্পনা করেন। পরিকল্পনা মােতাবেক অধিনায়ক আব্দুল মালেকের নেতৃত্বে ১৯জনের ১টি দল। আত্রাই নদী পার হয়ে তারানগর গ্রামে অ্যামবুশ পাতে। অপর দলটি মুক্তিযােদ্ধা আবু রেজার (বিশু) নেতৃত্বে বান্দাইখাড়া গ্রামকে বামে রেখে আত্রাই নদীর উত্তর তীরে ৫০০ গজ পশ্চিমে ধনপাড়া গ্রামে অবস্থান নেয়। আত্রাই নদীর দক্ষিণে। বান্দাইখাড়া গ্রাম থেকে ১ কিলােমিটার পূর্বে তারানগর গ্রামের অবস্থান। ১৯৭১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর বান্দাইখাড়া গ্রামের হত্যাযজ্ঞের পর। পাকিস্তানি সেনারা ১১টি নৌকাযােগে পূর্ব দিকে আত্রাই অভিমুখে যাত্রা করে। দুপুর আনুমানিক ১২টা ১৫ মিনিটে পাকিস্তানি সেনারা প্রথম নৌকাটি অধিনায়ক আব্দুল মালেকের পাতা ফাঁদে প্রবেশ করে। ক্রমান্বয়ে ২টি নৌকা ফাঁদে প্রবেশ করার পর আব্দুল মালেক তৃতীয় নৌকায় প্রথম আঘাত হানেন।
মাত্র ১০ গজ দূরে লুকিয়ে থাকা মুক্তিযােদ্ধারা সফল আক্রমণ চালিয়ে ৬টি নৌকা নদীতে ডুবিয়ে দেন। অবশিষ্ট নৌকা থেকে পাকিস্তানি বাহিনী বাহুল্যা গ্রামে নেমে আব্দুল মালেকের উপর পাল্টা গুলিবর্ষণ করে। প্রায় ১ ঘন্টা ১০ মিনিট পাল্টাপাল্টি গুলিবর্ষণের পর গােলাবারুদ শেষ হয়ে গেলে আব্দুল মালেকের। অ্যামবুশ পার্টি পিছু হটে গজমতখালি বিল অতিক্রম করে। বান্দাইখাড়া গ্রাম হয়ে রাত ৩টার সময় তাঁর দল রঘুনাথপুর গ্রামে ফেরত আসে। বিশ্লেষণ ও পর্যালােচনা। মুক্তিবাহিনীর সফলতার কারণ ক. মনােবল: আত্রাইয়ের যুদ্ধ ছিল স্বাধীনতার প্রশ্নে যুদ্ধ। এ যথার্থ কারণই তাদের জুগিয়েছিল অত্যন্ত উচু মনােবল। এ যুদ্ধে মুক্তিকামী বাঙালিরা অত্যন্ত উঁচু মনােবল নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর উপর ঝাপিয়ে পড়েছিল বিধায় জয়লাভ করতে সক্ষম হয়। সঠিক পরিকল্পনা: আত্রাইয়ের যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ করার ফলে সহজে তারা সফলতা লাভে সক্ষম হয়।
গ, ফাদের স্থান নির্ধারণ: এ যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর ফাদ পরিকল্পনার জন্য। সঠিক স্থান নির্ধারণ করা ছিল সফলতার অন্যতম কারণ।
ঘ, সুপরিকল্পিত অ্যামবুশ পরিচালনা: মুক্তিবাহিনী সুপরিকল্পিতভাবে ফাদ পরিচালনা করতে সক্ষম হয়েছিল, ফলে এ যুদ্ধে জয়লাভ করা সহজ হয়। পরিচিত এলাকা: যে-কোনাে যুদ্ধে অংশগ্রহণের পূর্বে সে এলাকা। সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা থাকা অত্যাবশ্যক। পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয়ের কারণ
ক. অপরিকল্পিত চলাফেরা: এ যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনী এলােমেলােভাবে চলাফেরা করতাে, যা মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ পরিকল্পনায় সহায়ক ছিল। ফলে পাকিস্তানি বাহিনীর জয়লাভ করা কঠিন হয়ে পড়ে।
খ. অপরিচিত এলাকা: পাকিস্তানি বাহিনীর জন্য এলাকাটি ছিল অপরিচিত। অপরিচিত এলাকায় যুদ্ধ করে জয়লাভ করা সহজতর ছিল না, যা তাদের পরাজয়ের অন্যতম কারণ।
গ, নিম্নমানের যােগাযােগ ব্যবস্থা: এ যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর যােগাযােগ ব্যবস্থা তেমন উন্নত ছিল না, এটাই ছিল তাদের পরাজয়ের কারণ।
ঘ, রাজাকারদের ভূমিকা: আত্রাইয়ের যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনী রাজাকারদের ইন্ধনে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে চলাফেরা করতাে। এসব তথ্য নির্ভুল ছিল না, ফলে তাদের পরাজয় নিশ্চিত হয়। ঙ. নদীপথে নিরাপত্তাবিধান না থাকা: আত্রাই এলাকায় নদীপথ পাকিস্তানি বাহিনীর জন্য সহায়ক ছিল না। নদীপথে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ হতে পারে, এ সম্পর্কেও তারা জ্ঞাত ছিল না। চ, পাল্টা আক্রমণের সুযােগ না পাওয়া: পাকিস্তানি বাহিনী নদীপথে চলাচলে তেমন অভ্যস্ত না থাকায় পাল্টা আক্রমণের কোনাে সুযােগ পায়নি। ফলে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের ফলে তারা সহজেই পরাজয়বরণ করে।
শিক্ষণীয় বিষয় ইতিহাসের প্রতিটি যুদ্ধই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কিছু শিক্ষণীয় বিষয় রেখে যায় যা ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। তেমনি আত্রাই যুদ্ধের কিছু কিছু শিক্ষণীয় বিষয় ছিল, যা নিচে দেওয়া হলাে: ক, স্থানীয় সহায়তা: আত্রাইয়ের যুদ্ধে স্থানীয় জনসাধারণ মুক্তিবাহিনীকে সর্বাত্মক সহযােগিতা প্রদান করেছে।
খ. এলাকা পরিচিতি: মুক্তিবাহিনীর জন্য এলাকাটি ছিল অত্যন্ত পরিচিত, যা তাদের যুদ্ধে জয়লাভের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
গ, প্রতিপক্ষকে দুর্বল মনে করা: যুদ্ধে প্রতিপক্ষকে দুর্বল মনে করা অনেক সময় পরাজয়ের মূল কারণ হয়ে দেখা দেয়। তেমনটিই ঘটেছিল। পাকিস্তানি বাহিনীর জন্য আত্রাইয়ের যুদ্ধে। ঘ. ভেঙে না পড়া: আত্রাইয়ের যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর মনােবল ছিল অত্যন্ত উচু। ফলে প্রতিকূল অবস্থায়ও তারা মনােবল হারায়নি।
উপসংহার
মুক্তিযুদ্ধের বিনিময়ে আজ আমরা স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের নাগরিক। এ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এবং বিভিন্ন স্মৃতি সংগ্রহ করে রাখা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। আত্রাইয়ের যুদ্ধ ইতিহাস সকলকে সেই স্মৃতিই স্মরণ করিয়ে দিবে বলে আমাদের বিশ্বাস।
ভানপুর ট্রেন অপারেশন
ভূমিকা
স্বাধীনতা যুদ্ধে রাজশাহীর ভানপুর (বাইনপুর) ট্রেন অপারেশন ছিল পাকিস্তানি। বাহিনীর বিরুদ্ধে বাঙালি মুক্তিকামী মানুষের এক মরণপণ লড়াই। রাজশাহী ও আমনুরার মধ্যে রেলপথের যােগাযােগ বন্ধ করতে এ অপারেশন পরিচালিত হয়েছিল। দেশের অসংখ্য ছাত্র তাদের দেশমাতৃকার জন্য যে শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে যুদ্ধ করেছে, তারই একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ ভানপুর ট্রেন অপারেশন। মুক্তিবাহিনী ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে রাজশাহী এলাকায় যে-সব চোরাগােপ্তা হানা ও ফাদ পরিচালনা করে, তাদের মধ্যে ভানপুর ট্রেন অপারেশন উল্লেখযােগ্য। পটভূমি রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় অবস্থিত পাকিস্তানি বাহিনী তাদের জনবল, রসদ, গােলাবারুদ এবং অন্যান্য সরঞ্জাম আনা-নেয়ার জন্য রাজশাহী-আমনুরা। রেলপথ নিয়মিত ব্যবহার করতাে। এ সংবাদ মুক্তিপাগল ছাত্র-জনতা জেনে। ফেলে। তারা পাকিস্তানিদের এ সরবরাহব্যবস্থা নস্যাৎ করতে মরিয়া হয়ে ওঠে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজের কয়েকজন ছাত্র মিলে এ দুঃসাহসী অভিযান পরিচালনা করার পরিকল্পনা করে এবং সে জন্য তারা ভানপুর অভিযান পরিচালনার স্থান হিসেবে বেছে নেয়। ভূমির পরিচিতি রাজশাহী জেলা সদরের শহরতলী থেকে প্রায় ১১ কিলােমিটার উত্তর-পশ্চিমে রাজশাহী-আমনুরা রেললাইনের দুই পাশে ভানপুরের অবস্থান। এলাকার দক্ষিণ-পশ্চিমে বিশালাকারে পাতিখােলা বিল অবস্থিত। পূর্ব দিকেও বেশ কিছু বড়াে বড়াে জলাশয় বিদ্যমান। সড়কপথে ভানপুরের সাথে দক্ষিণে রাজশাহী এবং উত্তর-পশ্চিমে আমনুরার যােগাযােগ আছে। এলাকাটি ঘিরে মাঝারি আকারের খােলা ভূমি লক্ষণীয় বিষয়।
এলাকার ভূমি শুধু শুষ্ক মৌসুমে মাঝারি আকারের সৈন্য চলাচলে সহায়তা করে। বর্ষা মৌসুমে খােলা ভূমিতে পানি জমে যা চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি করে। যুদ্ধের সংগঠন যুদ্ধের সংগঠন নিম্নরূপ: ক. পাকিস্তানি বাহিনী: ১৬ পদাতিক ডিভিশন, ২৩ পদাতিক ব্রিগেড, ৩৪ পদাতিক ব্রিগেড, ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট (রাজশাহী), ২০৫ পদাতিক ব্রিগেড। মুক্তিবাহিনী: অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল নুরুজ্জামান এবং ৭ নম্বর সেক্টরের মুক্তিবাহিনী। শত্রুপক্ষের বিন্যাস রাজশাহী সেক্টরটির দায়িত্বে নিয়ােজিত ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১৬  ডিভিশন, যার সদর দপ্তর ছিল নাটোরে। ৩৪ ব্রিগেডের দায়িত্বে ছিলেন। ব্রিগেডিয়ার নাঈম, যার দায়িত্ব ছিল পত্নীতলা, নবাবগঞ্জ ও ঈশ্বরদীকে রক্ষা করা। রাজশাহী উপশহর এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর সেনানিবাস ছিল। এখানে ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের সৈন্যরা অবস্থান করছিল। কমান্ডিং অফিসার ছিলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাফকাত বালুচ।
যুদ্ধের বিবরণ
রাজশাহীতে সংঘটিত মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন অপারেশনের মধ্যে ভানপুর ট্রেন অপারেশন একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অভিযান। ভানপুর রাজশাহী শহরের কাছেই মাত্র কয়েক মাইল দূরে শিতলাই স্টেশনের সন্নিকটে। মুক্তিযােদ্ধারা জানতে পারেন যে, প্রতিদিন রাতে একটি স্পেশাল ট্রেন রাজশাহী-আমনুরার মধ্যে সৈন্য ও রসদ সরবরাহ নিয়ে যাতায়াত করে। মুক্তিযােদ্ধারা এ ট্রেনকে আঘাত হানার সিদ্ধান্ত নেন। মেডিক্যাল কলেজের তৎকালীন ছাত্র রওশন, রশিদ, মতিন ও হারুন ১৯৭১ সালের ১০ অক্টোবর রাতে ভানপুর পৌছালেন।
তারা সুকৌশলে ঠিক লাইনের নিচে পর পর ৪টি ট্যাংকবিধ্বংসী মাইন পুঁতলেন। সময়মতাে সেগুলাে যাতে বিস্ফোরণ ঘটানাে যায় সে জন্য পুলিং সুইচের সঙ্গে লম্বা দড়ি বাঁধলেন। অন্ধকার আর নিস্তব্ধতার মধ্যে ৪জন মুক্তিযােদ্ধা রেললাইনের পানি নিষ্কাশনের নালায় শুয়ে থাকলেন। সেদিন ট্রেন আসতে অনেক বিলম্ব হচ্ছিল। ৪জন সাহসী মুক্তিযােদ্ধা ধৈর্যের সাথে অপেক্ষা। করতে থাকলেন। রাত ৩টা নাগাদ ট্রেন আসার শব্দ শােনা গেল। সঠিক নির্দেশনার জন্য একটি টেলিফোন পােস্টের সােজাসুজি মাইনগুলাে পুঁতে রাখা। হয়েছিল। টেলিফোন পােস্টের সােজাসুজি ট্রেনটি আসতেই মুক্তিযােদ্ধারা প্রাণপণে দড়িতে টান দিলেন। বিকট শব্দে ফেটে গেল মাইনগুলাে। ইঞ্জিনটা শূন্যে লাফিয়ে উঠলাে। সাথে শােনা গেল পাকিস্তানি সেনাদের আর্তনাদ। অপারেশন সফল হলাে। অপারেশনে ইঞ্জিন ও ট্রেন লাইনচ্যুত হয়েছিল। পরে জানা গেল যে, ঐ অপারেশনে ৩২জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়েছিল। আহত হয়েছিল আরও অনেকে। রাজশাহী শহরের কাছেই সেদিন মুক্তিযােদ্ধারা একটি সম্পূর্ণ ট্রেন লাইনচ্যুত করে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন। বিশ্লেষণ ও পর্যালােচনা মুক্তিবাহিনীর বিজয়ের কারণ ভানপুর ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে, পাকিস্তানিরা শেষ পর্যন্ত হয়েছিল পরাজিত এবং বাঙালি মুক্তিযােদ্ধারা হয়েছিল বিজয়ী। বাঙালিদের বিজয়ের কারণগুলাে ছিল নিম্নরূপ:
ক, স্থান নির্বাচন; এ অপারেশনের জন্য ভানপুরকে নির্বাচন করা ছিল খুবই যুক্তিযুক্ত। একদিকে বিশালাকার বিল, অন্যদিকে বড়াে বড়াে জলাশয় শক্রর চলাচলকে সীমিত করবে ভেবেই আদর্শ ফঁাদের স্থান হিসেবে ভানপুরকে নির্বাচন করা হয়েছিল। সে জন্য মুক্তিবাহিনীর অভিযান হয়েছিল সম্পূর্ণ সফল। খ. স্থানীয় সাহায্য; ভানপুরের যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী স্থানীয় অধিবাসী কর্তৃক পেয়েছিল ব্যাপক সাহায্য ও সহযােগিতা যেটা জয়ের জন্য অন্যতম। কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়। গ. আকস্মিকতা: মুক্তিযােদ্ধারা এ অপারেশনে সম্পূর্ণভাবে আকস্মিকতা অর্জন করেছিল। পাকিস্তানিরা কোনােভাবেই বুঝতে পারেনি যে, ভানপুরে মুক্তিবাহিনী কর্তৃক এ ধরনের অপারেশনের পরিকল্পনা করা হয়েছে। আর এভাবেই মুক্তিবাহিনীর বিজয় হয়েছিল অনেকটা নিশ্চিত।
পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয়ের কারণ যে-সব কারণে পাকিস্তানিরা পরাজিত হয়েছিল, তার মধ্যে উল্লেখযােগ্য কয়েকটি কারণ হচ্ছে: মুক্তিবাহিনীকে দুর্বল মনে করা: পাকিস্তানিরা ছিল অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত, অন্যদিকে বাঙালিরা ছিল নিরস্ত্র। তাই তাদের মনে। একটা অহংকার জাগ্রত হয়েছিল বাঙালিদের বিরুদ্ধে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এ দুর্বল নিরস্ত্র বাঙালিরাই তাদের করেছিল পর্যুদস্ত। বাঙালিদের ছিল অটুট অফুরন্ত মনােবল, যার স্রোতে ভেসে গিয়েছিল পাকিস্তানিদের সব অহমিকা। স্থানীয় এলাকা সম্পর্কে ধারণা না থাকা: পাকিস্তানিরা যুদ্ধ এলাকার বিন্যাস সম্পর্কে সম্যক অবহিত ছিল না। এলাকা ছিল তাদের অচেনা ও অজানা, যা তাদের বিভিন্ন পরিকল্পনার ব্যাঘাত ঘটাত। এ কারণেও তাদের পরাজয় বরণ করতে হয়েছিল । স্থানীয় সমর্থন না থাকা: পাকিস্তানিদের ছিল না কোনাে স্থানীয়। সহযােগিতা। কিছুসংখ্যক স্বাধীনতাবিরােধী রাজাকার ব্যতীত সবাই। ছিল তাদের বিপক্ষে। তাই তাদের কোনাে স্থানীয় সমর্থন না থাকায় তাদের যে-কোনাে ধরনের চলাচল ও পরিকল্পনা মুক্তিবাহিনী আগেভাগেই জেনে যেতাে স্থানীয় লােকদের সহায়তায়, যা তাদের। পরাজয়কে করেছিল নিশ্চিত। শিক্ষণীয় বিষয়। ভানপুর ট্রেন অপারেশনের শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে: 
ক. স্থানীয় সহায়তা: স্থানীয় সহায়তা ব্যতীত যুদ্ধে জয়লাভ করা খুবই দুরূহ ব্যাপার। পাকিস্তানিদের ছিল না কোনাে স্থানীয় সমর্থন; অন্যদিকে, মুক্তিবাহিনীর ছিল স্থানীয় সাহায্য। তাই যুদ্ধে জয়লাভ সহজ হয়েছিল।
খ, এলাকা পরিচিতি: পাকিস্তানিদের ভানপুর এলাকা সম্পর্কে ধারণা ছিল কম। অন্যদিকে, মুক্তিযােদ্ধারা এর প্রতিটি স্থান বিস্তারিত চিনতেন। ফলে তাদের পক্ষে যুদ্ধে জয়লাভ সহজতর হয়েছিল।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান -ষষ্ঠ খন্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!