চাঁপাইনবাবগঞ্জ-হরিপুর আমনুরার যুদ্ধ (রেইড)
ভূমিকা
বর্তমান চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে রাজশাহী জেলার একটি মহকুমা ছিল। ৭ নম্বর সেক্টরের অন্তর্গত এ জেলায় মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তানি বাহিনীর মধ্যে অনেক খণ্ডযুদ্ধ সংঘটিত হয়। এসব যুদ্ধে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর কোনাে বড়াে ধরনের সাহায্য ছাড়াই মুক্তিবাহিনী শত্রুপক্ষকে পরাস্ত করতে সমর্থ হয়। পটভূমি। স্বাধীনতা যুদ্ধের উষালগ্নে চাপাইনবাবগঞ্জের মুক্তিপাগল জনতা ১৯৭১ সালের ১২ মার্চ বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন, যা ছিল ঐ সময় এ ধরনের দ্বিতীয় ঘটনা। ২৫ মার্চের গণহত্যার পর পরই চাপাইনবাবগঞ্জে ক্রমান্বয়ে মুক্তিযুদ্ধ বিস্তার লাভ করতে থাকে। ২৬ মার্চ বিকালে চাপাইনবাবগঞ্জ শহরে কারফিউ জারি করা হয়। বাঙালি ইপিআর সদস্যদের নিরস্ত্র করার চেষ্টা করা হয় এবং সাধারণ জনগণকে সহায়তা না করার জন্য তাদের হুমকি দেওয়া হয়। ঢাকায় ইপিআর সদস্যদের হত্যার সংবাদ পেয়ে চাপাইনবাবগঞ্জের বাঙালি ইপিআর সদস্যরা সতর্ক হয়ে যায়। পরবর্তী সময় পাকিস্তানি বাহিনীর হত্যাষড়যন্ত্র এবং রাজশাহী স্থানান্তরের পরিকল্পনা জানতে পেরে বাঙালি ইপিআর সদস্যরা বিদ্রোহ করেন। জনগণের সহায়তায় তারা পরিস্থিতি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনেন এবং পাকিস্তানি ইপিআর সদস্যদের রাজশাহী পালিয়ে যেতে বাধ্য করেন। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল শত্রুর ৩টি যুদ্ধবিমান চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরে আক্রমণ চালায়। পাকিস্তানি সেনা বহনকারী ১০৬টি গাড়ির বহর ২১ এপ্রিল। কোনােরকম বাধা ছাড়াই শহরে প্রবেশ করলে চাপাইনবাবগঞ্জ পাকিস্তানি সেনাদের হাতে চলে যায়। পরবর্তী সময় শত্রুমুক্ত করার জন্য এ এলাকায় পাকিস্তানি সেনা ও মুক্তিবাহিনীর মধ্যে বেশ কয়েকটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়। হরিপুর-আমনুরার যুদ্ধ এমনই একটি উল্লেখযােগ্য যুদ্ধ, যা ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসে সংঘটিত হয়।
ভূমির পরিচিতি
একটি নকশা ছাড়া কোনাে তথ্য সংগ্রহে নেই। যুদ্ধের সংগঠন। যুদ্ধের সংগঠন নিম্নরূপ: ক, পাকিস্তানি বাহিনী: ৩২ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট। খ, মুক্তিবাহিনী: লােহাগড়া সাব-সেক্টর অধিনায়ক মেজর গিয়াস উদ্দিন চৌধুরীসহ ৩৫জন এবং তার অধীনস্ত ২টি দল, সুবেদার ইসমাঈলের নেতৃত্বে ২০জনের ১টি দল এবং নায়েব সুবেদার আমান উল্লাহর নেতৃত্বে ৩১জনের ১টি দল। শত্রুপক্ষের বিন্যাস। ব্রিগেডিয়ার নাইমের নেতৃত্বাধীন ৩৪ পদাতিক ব্রিগেড রাজশাহী, নবাবগঞ্জ ও নাটোর এলাকায় অবস্থান নেয়। জনবলের স্বল্পতার কারণে পাকিস্তানি বাহিনী চাপাইনবাবগঞ্জের প্রতিরক্ষার জন্য পর্যাপ্ত জনবল নিয়ােগ করতে পারেনি। ৫, ২৫ ও ৩২ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট বিভিন্ন সময় চাঁপাইনবাবগঞ্জে অবস্থান নিয়েছিল। যুদ্ধের বিবরণ ১৯৭১ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তানি সৈন্যরা যখন তাদের স্বাধীনতা দিবস উদযাপনে ব্যস্ত ছিল, ঠিক তখনই শত্রুর উপর আক্রমণের পরিকল্পনা করা হয়। মেজর গিয়াস ঐ দিন ৭টায় পাকিস্তানি অবস্থানের উপর হামলার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি ৮৫জন মুক্তিযােদ্ধাকে ৩টি দলে বিভক্ত করে এ আক্রমণ পরিকল্পনা করেন। বিভিন্ন দলের কাজগুলাে ছিল নিম্নরূপ: ক. সুবেদার ইসমাঈলের দল ২০জন মুক্তিযােদ্ধা নিয়ে গঠিত ছিল। তার দলকে ১৯৭১ সালের ১৪ আগস্ট চাপাইনবাবগঞ্জে রাত ১০টা-১১টা। পর্যন্ত মর্টার ফায়ারের দায়িত্ব দেওয়া হয়। খ. দ্বিতীয় দলটি ৩৫জন মুক্তিযােদ্ধা নিয়ে গঠিত ছিল এবং নেতৃত্ব দেন। সুবেদার আমিরুজ্জামান। মেজর গিয়াসও এ দলের সাথে ছিলেন। এ দলের কাজ ছিল হরিপুরের ব্রিজ ধ্বংস করা এবং শত্রুকে হত্যা করা যাতে চাপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহীর মধ্যে যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
তৃতীয় দলের নেতৃত্ব দেন নায়েব সুবেদার আমান উল্লাহ, যা ৩১জন সদস্য দিয়ে গঠিত ছিল। তাঁর দায়িত্ব ছিল বিদিরপুর রেলসেতু ধ্বংস করা প্রধান ঘটনাবলি নিম্নরূপ: ক. ১৯৭১ সালের ১৪ আগস্ট ফরিদপুর বিওপি থেকে দলগুলাে সকাল ৯টায় যাত্রা শুরু করে। ফরিদপুর বিওপি পদ্মা ও মহানন্দার মধ্যখানে অবস্থিত। তাদের গন্তব্যস্থলে পৌছাতে ১৭ মাইল পাড়ি দিতে হয়। দলগুলাে সন্ধ্যা হওয়ার আগেই টার্গেট এলাকার ৩ কিলােমিটারের মধ্যে পৌছে যায় । রাত ৯টার সময় মেজর গিয়াস তাঁর প্রথম ও দ্বিতীয় দলকে হরিপুর ব্রিজের ৬০০ গজের কাছাকাছি যাওয়ার আদেশ দেন। তৃতীয় দলটিকে ২টি নৌকায় করে বিদিরপুর রেলসেতুর কাছে পাঠানাে হয়। দ্বিতীয় দলটি ধীরে ধীরে হরিপুর ব্রিজের দিকে প্রথম দলের ফায়ার সহায়তায় এগোতে থাকে। যখন দলটি ব্রিজের কাছে পৌছে, তখন শক্র তাদের চিহ্নিত করে এলএমজি ও রাইফেল ফায়ার শুরু করে। তৎক্ষণাৎ দলগুলাে শত্রুর অবস্থানের উপর ঝাপিয়ে পড়ে এবং কয়েক মিনিটের মধ্যে ব্রিজটি দখল করে নেয়। এ আক্রমণে ২জন শত্রু মারা যায়, ২জন নদীতে লাফ দেয়, ১জন আহত হয় এবং বাকি ১১জন বন্দি হয়। মুক্তিবাহিনীর ১জন আহত এবং আরেকজন শাহাদতবরণ করেন। ব্রিজ দখল করার পর প্রথম দলটি দ্রুত চাপাইনবাবগঞ্জের দিকে এগিয়ে যায়। তারা শহর থেকে মাত্র ১ কিলােমিটার দূরত্বে একটি জায়গা নির্বাচন করে শত্রুর অবস্থানের উপর মর্টার ফায়ার শুরু করে। এ সময় পাকিস্তানি সৈন্য, রাজাকার এবং তাদের মিত্ররা তাদের স্বাধীনতা দিবস উদ্যাপন করছিল। তারা মুক্তিবাহিনীর আকস্মিক বােমা হামলায় পলায়ন শুরু করে। তৃতীয় দলটি বিদিরপুর রেলসেতুতে পৌছার পূর্বেই শত্রু তাদের চিহ্নিত করে এবং শক্রর তীব্র ফায়ারের সম্মুখীন হয়। দ্বিতীয় দলটি হরিপুরের ব্রিজটি ধ্বংস করার জন্য যখন ২৪০ পাউন্ড বিস্ফোরক লাগাচ্ছিল, তখন শত্রু ব্রিজটির উপর টহলরত অবস্থায় মেশিনগান ফায়ার দিচ্ছিল।
মেজর গিয়াস সবকিছু ঠিকমতাে লাগানাে হয়েছে কি না, তা তত্ত্বাবধান করছিলেন। ইতােমধ্যে প্রথম দলের কিছু মুক্তিযােদ্ধা তাদের সাথে যােগ দেন। ১৫ আগস্ট রাত ১২টা ৫ মিনিটে ব্রিজ ধ্বংস করা হয়। ধ্বংস করার। পর মুক্তিযােদ্ধারা ব্রিজের ক্ষতি পর্যবেক্ষণ করার জন্য ছুটে যান। এ সময়ের মধ্যে তৃতীয় দলটি তাদের সাথে যােগাযােগ করে। জ, শত্রুপক্ষ মুক্তিবাহিনীর কার্যবিধি পর্যবেক্ষণ করার জন্য আমনুরা ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে ২টি টহল দল পাঠায়। তবে ভুল বােঝাবুঝির কারণে একটি টহল দল অপর দলটিকে শত্রুর টহল দল ভেবে একে-অপরের উপর ফায়ার করে। এ সংঘর্ষের ফলে ৬জন সাথে সাথে মারা যায়।
বিশ্লেষণ ও পর্যালােচনা
মুক্তিবাহিনীর বিজয়ের কারণ মুক্তিবাহিনীর বিজয়ের পিছনে নিম্নলিখিত কারণগুলাে উল্লেখ করা যায়: ক. আকস্মিক আক্রমণ: মুক্তিবাহিনী ছিল দৃঢ় মনােবলসম্পন্ন। তাই তারা ১৭ মাইল পথ পাড়ি দিয়ে শত্রুর উপর ঝাপিয়ে পড়ে। তাদের এ আকস্মিক আক্রমণ শত্রুদের হতবিহ্বল করে ফেলে। পলায়নের রাস্তা তাদের জন্য খােলা ছিল না। মর্টারের যথার্থ অবস্থান: এ যুদ্ধে তাদের ৩টি মর্টার নিয়ে যে দলটি ছিল তাদের রণকৌশলগত অবস্থানই এ বিজয়ের কারণ । শত্রুর উপর। সঠিক সময় তারা ফায়ার করতে সক্ষম হয়। তাদের লক্ষ্য ছিল শক্রকে ধ্বংস করা। তাই রণকৌশলগত সব ব্যাপারে তারা ছিল খুবই সজাগ। ১ কিলােমিটার দূর থেকে নিপুণ নিশানায় তারা শত্রুকে ঘায়েল করে। গ, বিস্ফোরকদ্রব্যের সঠিক ব্যবহার: মুক্তিবাহিনীর এ দলটির বিস্ফোরকদ্রব্য ব্যবহারের নিপুণ কৌশলের জন্যই হরিপুর ব্রিজ ধ্বংস হয়। ফলে শত্রুরা তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে ব্যর্থ হয়। বিস্ফোরক। ব্যবহার করে ব্রিজ ধ্বংস করাতে পাকিস্তানি বাহিনীর মনােবল দুর্বল হয়ে যায়। কেননা, শক্রর মর্টার ও মেশিনগান ফায়ারকে বিন্দুমাত্র। পাত্তা না দিয়ে তারা বিস্ফোরক স্থাপন করছিল। তাই বিস্ফোরকের যথার্থ ব্যবহারও মুক্তিবাহিনীর বিজয়কে অনেকাংশে ত্বরান্বিত করেছিল। ঘ, এলএমজি’র অবস্থান: মুক্তিবাহিনীর এলএমজি’র অবস্থান ছিল সঠিক ও রণকৌশল ছিল উন্নত কভারিং ফায়ার প্রদানের সাথে সাথে লিপ ফ্রগ মেথডে তারা শত্রুর দিকে অগ্রসর হয় এবং শক্রর অবস্থান দখল করে নেয়। এলএমজি’র সঠিক অবস্থান ও রণকৌশল সঠিক প্রয়ােগই এ বিজয়ের অন্যতম কারণ। ঙ. সুদক্ষ নেতৃত্ব: মেজর গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী, সুবেদার ইসমাঈল ও নায়েব সুবেদার আমান উল্লাহ ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ নেতা, যাঁরা। দেশমাতৃকার জন্য নিজেদের জীবন বিসর্জন করতে সদাপ্রস্তুত ছিলেন। তারা সঠিক নেতৃত্বদানের মাধ্যমে পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাজিত করে সুদক্ষ নেতৃত্বের সাক্ষ্য বহন করেন। পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয়ের কারণ পাকিস্তানি বাহিনী নিমলিখিত কারণগুলাের জন্য পরাজিত হয়েছে বলে ধারণা করা যায়:
ক. সঠিক টহল প্রদান না করা: পাকিস্তানি বাহিনীর টহলব্যবস্থা সঠিক ছিল না। তারা খামখেয়ালি এবং অমনােযােগের সাথে এ দায়িত্ব পালন করেছিল। এ কারণেই তারা নিজেদের জীবন হারায়। এলএমজি’র অবস্থা সঠিক ছিল না: পাকিস্তানি বাহিনীর এলএমজি’র অবস্থান সঠিক ছিল না। তাদের রণকৌশলও ছিল নিম্নমানের। এ কারণেই তারা ব্রিজের কাছে পয়েন্ট ব্ল্যাংক রেঞ্জের মধ্যেও মুক্তিবাহিনীকে ঘায়েল করতে পারে নি। হীন মনােবল: বিভিন্ন মারণাস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি বাহিনীর মনােবল ছিল হীন, এ কারণেই এলএমজি ও রাইফেলসজ্জিত হয়েও জীবন রক্ষার্থে তারা নদীতে ঝাপিয়ে পড়ে। জীবনকে বাচিয়ে রাখার জন্য।
১১জন বন্দি হয় এবং অস্ত্র বিসর্জন দিতে কার্পণ্য করে নি। শিক্ষণীয় বিষয় হরিপুর-আমনুরা যুদ্ধ থেকে নিম্নলিখিত শিক্ষণীয় বিষয়গুলাে উল্লেখ করা যেতে পারে: ক, যুদ্ধের যথার্থতা: মুক্তিবাহিনী স্বাধিকার আদায়ের জন্য পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্তির জন্য স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল, পক্ষান্তরে পাকিস্তানি সৈন্যদের নৈতিক কোনাে কারণ না থাকায় ফলাফল হয়েছিল মুক্তিযােদ্ধাদের পক্ষে। স্থানীয় সহায়তা: যুদ্ধে জয়লাভের জন্য স্থানীয় জনগণের সার্বিক সহায়তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পাকিস্তানি সৈন্যদের কোনাে স্থানীয় সহায়তা না থাকায় মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে জয়লাভ করা সম্ভব হয়নি। গেরিলা রণকৌশল: মুক্তিবাহিনী গেরিলা রণকৌশলের মাধ্যমে সুপ্রশিক্ষত পাকিস্তানি সেনাদের বিভিন্ন ঘাঁটি ধ্বংস এবং ক্ষতিসাধন করতে সমর্থ হয়। মুক্তিবাহিনীর এ গেরিলা রণকৌশল স্বাধীনতা যুদ্ধে অত্যন্ত কার্যকর প্রমাণিত হয়। উপসংহার। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে চাঁপাইনবাবগঞ্জে যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল, তা মুক্তিবাহিনীর জন্য দেশপ্রেম ও নির্ভীকতার স্বাক্ষর রাখে। ভারতের কোনােপ্রকার উল্লেখযােগ্য সাহায্য ছাড়াই মুক্তিবাহিনী এ অঞ্চল থেকে পাকিস্তানি বাহিনীকে হটিয়ে দিতে সক্ষম হয়।
সাপাহারের যুদ্ধ
ভূমিকা
সাপাহার যুদ্ধের স্থানটি বাজার এলাকা হওয়ায় স্থানটি পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে ছিল উঁচু। এ এলাকায় ছিল কিছু মাটির ঘর। তা ছাড়া সাপাহার-পত্নীতলামহাদেবপুর প্রধান সড়কটি উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত। এ রাস্তার উত্তর পাশে আমবাগান, দক্ষিণে সিঅ্যান্ডবি রেস্ট হাউজ এবং পশ্চিম পাশে পুকুর দিয়ে।
পটভূমি
পাকিস্তানি বাহিনীর মূল শক্ত ঘাঁটি ছিল সাপাহার পাইলট স্কুল। সেখান থেকে তারা খঞ্জনপুর, নতপুর, আইহাই, আগ্রাদিগুন ও হাপুনিয়ার দিকে টহলের মাধ্যমে আধিপত্য বিস্তার করে এবং খঞ্জনপুর, নতপুর এলাকায় ছােটো ছােটো ক্যাম্প গঠন করে। মুক্তিযােদ্ধারা এ খবর পেয়ে তাদের টহল দলের উপর আক্রমণ করে তাদের ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং খঞ্জনপুর ব্রিজ ধ্বংস করে। এর পর। থেকেই উভয় পক্ষের মধ্যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শুরু হয়। ভূমির পরিচিতি সাপাহার নওগাঁ জেলা শহর থেকে ৬০ কিলােমিটার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত। সাপাহারের পশ্চিমে ভারত, উত্তরে ভারত সীমান্ত, উত্তর-পূর্বে বগুড়া জেলা এবং দক্ষিণে চাপাইনবাবগঞ্জ জেলা (তৎকালীন রাজশাহী জেলা)। সাপাহার ছিল পােরশা থানার অন্তর্ভুক্ত। সাপাহার থানাটি খােলা ভূমি, যার চারদিকে গাছপালা দ্বারা পরিবেষ্টিত। এ এলাকায় শুষ্ক মৌসুমে পানির অভাবে চাষাবাদ হয় না, শুধু বর্ষা মৌসুমে আমন ধানের চাষ করা হয়। ঐ সময় রাস্তাঘাট কাচা ছিল। স্থানীয়। লােকজন পায়ে হেঁটে অথবা গরুর গাড়ির মাধ্যমে চলাফেরা করতাে। এ থানার উল্লেখযােগ্য মহাসড়ক সাপাহার থেকে নওগাঁ পর্যন্ত। যুদ্ধের সংগঠন যুদ্ধের সংগঠন নিমরূপ: ক. পাকিস্তানি বাহিনী: ৪ কোম্পানি। খ. মুক্তিবাহিনী: ক্যাপ্টেন ইদ্রিসের নেতৃত্বে ১ কোম্পানি। শত্রুপক্ষের বিন্যাস। পাকিস্তানি বাহিনী বালুচ ও পাঞ্জাব রেজিমেন্টের সর্বমােট ৪ কোম্পানি নিয়ে গঠিত ছিল। পাকিস্তানি সেনারা খঞ্জনপুর থেকে টহল দল নিয়ে বের হলে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি সেনাদের সাথে সম্মুখযুদ্ধে লিপ্ত হয়। মুক্তিযােদ্ধাদের চাপে পাকিস্তানি সেনারা খঞ্জনপুর টিকতে না পেরে সাপাহার মূল ঘাটিতে ফিরে আসে। পুনরায় পাকিস্তানি সেনারা সাপাহার-আগ্রাদিগুনের দিকে অগ্রসর হলে আবারও মুক্তিবাহিনী কর্তৃক বাধাগ্রস্ত এবং উভয় পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়।
যুদ্ধের বিবরণ
সাপাহারের যুদ্ধের বিবরণ নিম্নরূপ: ক, পাকিস্তানি প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা: পাকিস্তানি বাহিনীর ১টি করে কোম্পানি যথাক্রমে এলাকা, আমবাগান, পুকুর পাড়, পাইলট স্কুল ও সিঅ্যান্ডবি রেস্ট হাউজে অবস্থান গ্রহণ করে এবং চতুর্মুখী প্রতিরক্ষা অবস্থান নেয়। মুক্তিযােদ্ধাদের আক্রমণ পরিকল্পনা: ক্যাপ্টেন ইদ্রিসের নেতৃত্বে মুক্তিযােদ্ধারা সংগঠিত হয়ে ১৩ সেপ্টেম্বর রাতে সাপাহারকে শত্রুমুক্ত করার লক্ষ্যে আক্রমণ পরিকল্পনা করেন। মুক্তিবাহিনীর নিমলিখিত ৩টি প্লাটুনকে পাকিস্তানি হানাদারদের ৩টি অবস্থানের উপর আক্রমণ রচনা করার দায়িত্ব প্রদান করা হয়। ১. ক্যাপ্টেন ইদ্রিসের প্লাটুন: এলাকা আমবাগান। ২. হাবিলদার আলী আহম্মেদের প্লাটুন: এলাকা পুকুর পাড়। ৩. হাবিলদার আলী আকবরের প্লাটুন: এলাকা সিঅ্যান্ডবি রেস্ট হাউজ। গ, ক্যাপ্টেন ইদ্রিস তাঁর প্লাটুনটি নিয়ে পােরশা-পত্নীতলা সড়কের পূর্ব পাশে আমবাগানে অবস্থিত শত্রুর অবস্থান থেকে আনুমানিক ৩০০৪০০ গজ দূরে ৪৫ ডিগ্রিতে অবস্থান নেন। হাবিলদার আলী। আকবরের দলটি সিঅ্যান্ডবি রেস্ট হাউজের পূর্বে শক্রর অবস্থান থেকে। প্রায় ৩০০-৪০০ গজ দূরে অবস্থান গ্রহণ করে এবং হাবিলদার আলী। আহম্মেদের প্লাটুন পুকুর পাড় থেকে উত্তরে সাপাহার-নওগাঁ রাস্তার অপর পারে অবস্থান নেয়। ঘ, ১৩ সেপ্টেম্বর রাত ৩টায় মুক্তিবাহিনী শত্রু অবস্থানের উপর প্রচণ্ড গুলিবর্ষণ শুরু করে। এ গুলিবর্ষণ থেমে থেমে ভাের ৫টা পর্যন্ত স্থায়ী হয়।
তারপর মুক্তিবাহিনী ত্রিমুখী আক্রমণ রচনা করে। ঙ. যুদ্ধের পরিসমাপ্তি: দিনের আলাের সাথে সাথে পাকিস্তানি বাহিনী তাদের অবস্থান থেকে প্রতি-আক্রমণ রচনা করলে মুক্তিবাহিনী অল্প। সময়ের জন্য তাদের অবস্থানে থামতে বাধ্য হয়। মুক্তিযােদ্ধাদের এ ত্রিমুখী আক্রমণের খবর পেয়ে পত্নীতলায় অবস্থানরত পাকিস্তানি। বাহিনী সাপাহারে অবস্থানরত তাদের সঙ্গীদের শক্তি বৃদ্ধির লক্ষ্যে সকাল ৬টায় পত্নীতলা-সাপাহার পথ ধরে সাপাহারে চলে আসে। ফলে মুক্তিযােদ্ধাদের পক্ষে পাল্টা আঘাত হানা সম্ভব না হওয়ায় তারা। পিছু হটে আসে। এভাবেই অসমাপ্ত থেকে যায় সাপাহারের যুদ্ধ । বিশ্লেষণ ও পর্যালােচনা পাকিস্তানি বাহিনীর বিজয়ের কারণ
ক, পাকিস্তানি বাহিনী অধিক শক্তিশালী: মুক্তিযােদ্ধাদের চেয়ে পাকিস্তানি বাহিনী অস্ত্র ও জনবলে বেশি থাকায় বিজয় লাভ করে।
খ. চতুর্মুখী প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা: এ যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনী চতুর্মুখী প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা প্রণয়ন করে, ফলে তারা মুক্তিবাহিনীকে পরাজিত করতে সক্ষম হয়। গ. স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের সঠিক ব্যবহার: পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক অধিক পরিমাণে ভারি ও স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ব্যবহার করার ফলে তারা জয়লাভ করতে সক্ষম হয়। ঘ, পত্নীতলা-সাপাহার সড়ক খােলা রাখা: পাকিস্তানি বাহিনীর নিজেদের শক্তি বৃদ্ধির জন্য পত্নীতলা-সাপাহার মহাসড়ক খােলা রাখার ফলে প্রচুর পরিমাণে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়, যা এ যুদ্ধ জয়ের অন্যতম কারণ। মুক্তিবাহিনীর পরাজয়ের কারণ
ক. মুক্তিবাহিনী অস্ত্র ও জনবল সব দিক থেকেই পাকিস্তানি বাহিনীর চেয়ে দুর্বল ছিল। পাকিস্তানি বাহিনীর প্রতিরক্ষা ছিল অত্যন্ত শক্ত ও চতুর্মুখী। সমস্ত স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ছিল ফায়ার পরিধির মধ্যে। পত্নীতলা-সাপাহার রাস্তায় কোনােপ্রকার প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে ব্যর্থ হওয়ায়। ঘ, রণকৌশলগত সীমিত জ্ঞান। শিক্ষণীয় বিষয় এ যুদ্ধের শিক্ষণীয় বিষয়গুলাে নিমরূপ: ক, দেশপ্রেম: সাপাহারের যুদ্ধের বৃহৎ শক্রর (৪টি কোম্পানি) বিরুদ্ধে অল্পসংখ্যক (১টি কোম্পানি) মুক্তিবাহিনী যেভাবে লড়েছে, এতে তাদের গভীর দেশপ্রেমের পরিচয় মেলে। খ. শক্রর শক্তিকে খাটো করে দেখা: যে-কোনাে যুদ্ধে শত্রুর শক্তিকে কখনাে খাটো করে দেখা উচিত নয়। গ, শক্তি বৃদ্ধির জন্য রাস্তা খােলা রাখা: পাকিস্তানি বাহিনী তাদের শক্তি বৃদ্ধির জন্য পত্নীতলা-সাপাহার রাস্তা খােলা রাখার ফলে মুক্তিবাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়। ঘ. চতুর্মুখী প্রতিরক্ষা: পাকিস্তানি বাহিনীর সুদৃঢ় প্রতিরক্ষা অবস্থানে | থাকায় তুলনামূলক ক্ষতি কম হয় এবং মুক্তিবাহিনী কাঙিক্ষত ফল লাভে ব্যর্থ হয়। উপসংহার। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও স্মৃতি সংগ্রহ এবং সংরক্ষণ করে রাখা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। তারই সূত্র ধরে লেখা মুক্তিযুদ্ধের নওগাঁ জেলার সাপাহার যুদ্ধের ইতিহাস। এ যুদ্ধের ইতিহাস পাঠে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম কিছুটা হলেও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হবে বলে আশা করা যায়।
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান -ষষ্ঠ খন্ড