You dont have javascript enabled! Please enable it!
দত্তপাড়ার হত্যাযজ্ঞ ও বনপাড়া মিশনের গণহত্যা
ভূমিকা
১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধিকার আন্দোলন এক দিনের নয় বরং তা ছিল। বাঙালি জাতির দীর্ঘ ৯ মাসের কঠোর সংগ্রামের ফসল। সমগ্র বাংলাদেশের ন্যায় নাটোরেও ঘটে যাওয়া অসংখ্য রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের কথা আমাদের অনেকেরই জানা আছে। নাটোরের মুক্তিবাহিনীতে নিয়মিত সৈনিক ছাড়াও হাজার হাজার অনিয়মিত সৈনিক ছিলেন, যারা দেশপ্রেমের তাগিদে মুক্তিযুদ্ধে যােগ দিয়েছিলেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন অসামরিক স্বেচ্ছাসেবক, কলেজবিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, কলকারখানার শ্রমিক, কৃষক এবং নাটোরের সর্বস্তরের মেহনতি মানুষ। এঁদের সবাইকে নিয়েই সেদিন মূলত গঠিত হয়েছিল মুক্তিবাহিনী। একদিকে পাকিস্তানিদের দত্তপাড়া ও বনপাড়া মিশনে গণহত্যার বীভৎস চিত্র এবং নিরস্ত্র জনগণকে নিধনের কাপুরুষােচিত হিংস্রতা; অন্যদিকে, দখলদার শত্রুর বিরুদ্ধে অবিস্মরণীয় লড়াইয়ের গৌরবময় অধ্যায় নাটোরের ইতিহাসকে করেছে মহীয়ান। স্বজন হারানাের বেদনার মধ্যে সেদিন অভ্যুদয় ঘটেছিল জাতীয় বীরদের, যাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে মুক্ত হয়েছিল নাটোর।
পটভূমি
নাটোরবাসীর মাঝে যে দেশপ্রেম ও একতা ছিল, তা মূলত সবারই জানা। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে প্রতিটি আন্দোলন তথা গণজোয়ারে নাটোরবাসীর অবদান অত্যন্ত স্পষ্ট। শুরুতেই পাকিস্তানিরা তাদের যুদ্ধকে আরও বেগবান ও সংগঠিত করার লক্ষ্যে সমগ্র বাংলাদেশে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়তে লাগলাে শক্তি বৃদ্ধির জন্য। মূলত এ সূত্র ধরেই পাকিস্তানি বাহিনী রাজশাহী ও আশপাশের এলাকায় তাদের শক্তি বৃদ্ধির জন্য বেশ কিছু সৈন্যসামন্ত, অস্ত্রশস্ত্র, রসদ ইত্যাদি নিয়ে যাত্রা করে নাটোরের পথ দিয়ে। কিন্তু তাদের এ চলাচলে বাদ সাধে নাটোরের কতিপয় দুঃসাহসী মুক্তিকামী জনতা তারা সেদিন বিভিন্ন খণ্ডযুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তানিদের জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করেছিল। সংগত কারণেই তাদের মনে। প্রতিশােধের আগুন জ্বলছিল। পাকিস্তানি বাহিনী মূলত নাটোরের সব অভিযানকে প্রতিহত করতে এবং নিজস্ব ক্ষয়ক্ষতির প্রতিশােধ নিতে গিয়েই স্থানীয় দালালদের সহায়তায় দত্তপাড়া ও বনপাড়া মিশনে চালিয়েছিল ইতিহাসের এক জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড।
ভূমি পরিচিতি
নাটোরের সদর থানার আওতাধীন দত্তপাড়া এলাকাটি জেলা শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলােমিটার দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত। দত্তপাড়ার পূর্বে আহমেদপুর ও বনপাড়া অবস্থিত। দত্তপাড়া এলাকাটি নাটোরের অন্যান্য এলাকার মতােই উঁচু ও সমতল। বনপাড়া নাটোর জেলা সদর থেকে প্রায় ২০ কিলােমিটার দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত। এর দক্ষিণে ঈশ্বরদী ও লালপুর থানা, পূর্বে বাগাতিপাড়া ও উত্তরে নাটোর জেলা শহর অবস্থিত। শুষ্ক মৌসুমে অত্র অঞ্চলে যে-কোনাে ভারি। যানবাহন অনায়াসে চলাচল করতে পারে। বর্ষা মৌসুমে খােলা ভূমিতে পানি জমে যা, স্বাভাবিক চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি করে। যুদ্ধের সংগঠন যুদ্ধের সংগঠন নিমরূপ:
পাকিস্তানি বাহিনী: ২টি পাঞ্জাব রেজিমেন্ট কোম্পানি। শত্রুপক্ষের বিন্যাস দত্তপাড়া ও বনপাড়া মিশনে হত্যাকাণ্ড মূলত ঘটিয়েছিল পাকিস্তানি পাঞ্জাব রেজিমেন্টের সৈন্যরা। নাটোরের বিভিন্ন স্থানে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে তারা যখন হেরে যাচ্ছিল, তখন তারা দয়ারামপুর বাজারে একটি স্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করে এবং পরবর্তী সময় সেখান থেকে পর্যায়ক্রমে ঐ এলাকায় তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যেত। তাদের অযাচিত নির্যাতনে যখন সাধারণ মানুষ অতিষ্ঠ, তখন কিছু নিরীহ বাঙালি প্রাণভয়ে স্থান নিয়েছিল বনপাড়ার তৎকালীন ক্যাথলিক মিশনে। তারপর সেখান থেকে ঐ বাঙালিদের ধরে নিয়ে দত্তপাড়ার নিকটবর্তী ছাতিয়ানতলা নামক স্থানে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল।
যুদ্ধের বিবরণ
বনপাড়ায় ছিল রােমান ক্যাথলিক মিশন। নাটোর থেকে মিশনের দূরত্ব প্রায় ১৩ মাইল। নাটোর হয়ে পাবনা যাওয়ার পথেই পড়ে এ রােমান ক্যাথলিক মিশনটি। ১৯৭১ সালের ২ মে অত্যাচারিত, লাঞ্ছিত, নিরুপায় একদল নারীপুরুষ ও শিশুরা বনপাড়া রােমান ক্যাথলিক মিশনে আশ্রয় নিয়েছিল। আশ্রয়গ্রহণকারীদের উদ্দেশ্য ছিল এক রাত সেখানে কাটিয়ে পরদিন প্রাণ বাঁচাতে ভারতের দিকে যাত্রা করবে, কিন্তু তাদের সে আশা পূরণ হওয়ার আগেই তারা সেদিন ঢলে পড়লাে মৃত্যুর কোলে। পাঞ্জাব রেজিমেন্টের কুখ্যাত মেজর শেরওয়ানী তার দলবল নিয়ে ৩ মে হাজির হলাে ঐ মিশনে। দালালদের মাধ্যমে তারা আগেই আশ্রয়গ্রহণকারীদের খবর পেয়েছিল। উক্ত মেজরের সঙ্গে ছিল জল্লাদ হাফেজ আব্দুর রহমান, যে স্থানীয় ধর্মীয় নেতা হিসেবে সমধিক পরিচিত। ৯ মাস ধরে আব্দুর রহমান লুণ্ঠন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযােগ, হত্যাসহ এমন কোনাে কুকাজ নেই যার সঙ্গে সে জড়িত ছিল না। ঘটনার দিন মেজর শেরওয়ানী বলে উঠলাে, “তােমরা ভারতের দালালি করছে। পাকিস্তানের শত্রুদের আশ্রয় দিয়েছে। কাজেই বিনা বাধায় আশ্রিত সবাইকে আমাদের হাতে তুলে না দিলে বলপ্রয়ােগ করতে বাধ্য হবাে।” ততক্ষণে হানাদাররা মিশনের চারদিক ঘিরে ফেলে। মিশনের ধর্মযাজকদ্বয় মেজর সাহেবকে বুঝিয়ে শান্ত করার আপ্রাণ চেষ্টা করলেন। তারা সহায়-সম্বলহীন আশ্রিতদের প্রাণ ভিক্ষা চাইলেন। শেষ পর্যন্ত কেবল নারী ও শিশুদের রেহাই দেওয়ার অনুরােধ জানালেন। কিন্তু তাতেও পাকিস্তানি বাহিনী রাজি হলাে না। অবশেষে পাকিস্তানি সেনা ও তাদের সহযােগীরা গির্জার ভিতরে প্রবেশ করে। মিশনের দোতলার দক্ষিণাংশে ছিল ছাত্রীনিবাস।
যেখানে ঠাই নিয়েছিল সর্বস্ব হারানাে অসংখ্য নারী-পুরুষ। কিন্তু পরবর্তী সময় ওদের কাউকে বাঁচতে দেওয়া হয় নি। পাকিস্তানি সেনারা মিশনের ভিতর ঢােকার পর আশ্রিতরা ভয়েশঙ্কায় ছুটোছুটি করতে লাগলাে। কান্নার রােল পড়ে গেল মিশনের চতুর্দিকে। দিগ্‌বিদিক হারানাে পুরুষদের বাঁচাও-বাচাও চিঙ্কার, শিশু ও নারীদের অসহনীয় আর্তচিৎকার সমগ্র মিশন এলাকাকে করে তুলেছিল যন্ত্রণাকাতর। এ ভয়াল যন্ত্রণাকাতর দৃশ্যে ফাদাররা ঝরঝর করে কেদে আবারও মেজর শেরওয়ানীর কাছে আশ্রিতদের প্রাণ ভিক্ষা চাইলেন। কিন্তু বৃথা সে আবেদন। অসহায় নারী-পুরুষ ও শিশুদের উপর বুলেট, লাথি, রাইফেলের বাট আর বেয়নেটের খোচায় আশ্রিতদের প্রায় মুমূর্ষ অবস্থায় বেঁধে ফেললাে। এ সময় ২০জনের মতাে পুরুষ মিশনের দেয়াল টপকে পালানাের চেষ্টা করেন। কিন্তু দেয়ালের চারদিকেই হানাদাররা প্রস্তুত ছিল। তারা তাদের সবাইকে ধরে। বেয়নেটের আঘাতে রক্তাক্ত করলাে। অতঃপর বন্দিদের নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনী। রওনা হয়ে গেল অজানা গন্তব্যে। এ সময় মিশনের ছাত্রাবাসের উত্তরাংশে লুকিয়ে থাকা ৩জন শিক্ষক এবং রান্নাঘরের প্যাকিং বাক্সের মধ্যে লুকিয়ে থাকা অপর ২জন সিস্টার প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন।
পরবর্তী সময় এ অমানুষিক পৈশাচিক দৃশ্যে ফাদার গ্যাবলিবের মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে যায়। ফাদার পিনস গােটা ৯ মাসই মিশনে ছিলেন। পাকিস্তানি সৈন্যরা তার উপর খুবই নাখােশ ছিল। পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ব্রিগেডিয়ার নাঈম তাঁকে একবার নাটোরে ডেকে পাঠিয়ে বলেছিল, “আপনি মুক্তিবাহিনীকে আমাদের ধ্বংস সাধনে সাহায্য করছেন। ভবিষ্যতে কোনাে রাষ্ট্রদ্রোহীকে মিশনে আশ্রয় দিলে আপনাকে হত্যা করা হবে এবং আপনার গােটা মিশনকে মাটির সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া হবে।” ফাদার পিনস চুপ করে সব শুনছিলেন। এ হুশিয়ারির পরও তিনি গােটা মুক্তিযুদ্ধের সময় নির্যাতিত, সহায়-সম্বলহীন, অসংখ্য নারী-পুরুষ ও শিশুকে তার মিশনে আশ্রয় দিয়েছিলেন এবং অনেককে নিরাপদে ভারতে চলে যেতে সাহায্য করেছিলেন।  ১৯৭১ সালের ২০ মে পাকিস্তানি সৈন্যরা বনপাড়া এলাকার চতুর্দিকে। বিক্ষিপ্তভাবে গােলাগুলি চালাতে থাকে। এতে কিছুসংখ্যক স্থানীয় লােক মারা। যায়, তার পর থেকে নরপশুরা ঐ গ্রামের আশপাশে অপারেশন চালাতে থাকে।
এতে কিছুসংখ্যক স্থানীয় লােক মারা যায়। যার দরুন বনপাড়া এলাকার বিভিন্ন গ্রাম থেকে অমুসলমানরা পালিয়ে আসে মিশন হাসপাতালে। মিশন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ যত্নসহকারে তাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করতে থাকে। তখন অবশ্য পাকিস্তানি সেনারা নাটোর শহরে এবং রাজশাহীতে চলে গিয়েছিল। কিন্তু স্থানীয় দুস্কৃতিকারীরা হিন্দুদের প্রতি অন্যায় আচরণ, ব্যাপক ক্ষতিসাধন এবং তাদের পরিত্যক্ত বাড়িঘর লুট করে। তখন থেকেই ২-১জন করে অমুসলমান ওপার বাংলায় পালিয়ে যেতে থাকে। ২ মে রাতে অমুসলমানরা ওপার বাংলায় চলে যাবে বলে স্থির করেছিল। কিন্তু অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের কারণে সেদিন তারা যেতে পারে নি। ৩ মে বিকাল সাড়ে ৩টার সময় মিশনের ফাদার হঠাৎ লক্ষ্য করলেন যে, মিশন হাসপাতালের চারদিকে পাকিস্তানিরা ঘিরে ফেলেছে। তার কিছুক্ষণ আগে বনপাড়াসংলগ্ন অন্যান্য গ্রাম থেকে খ্রিষ্টান পুরুষদেরও ধরে নিয়ে আসা হয়। ঐ অভিযান পরিচালনা করেছিল মেজর শেরওয়ানী। পরে ফাদারের সুপারিশে সব খ্রিষ্টানদের নরপশুরা ছেড়ে দেয়। তারপর তারা মিশনের অফিস, স্কুল ও মহিলা হােস্টেল তল্লাশি করে মুক্তিবাহিনী ও হিন্দুদের খুঁজতে থাকে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর সর্বমােট ৮৬জনকে ধরে নিয়ে যায় হত্যা করার জন্য। পথিমধ্যে ১জন বৃদ্ধকে রেহাই দিয়ে অন্যান্য বন্দিদের নির্মমভাবে প্রহার করতে করতে নিয়ে যায় তাদের নির্দিষ্ট স্থানে।
পরবর্তী সময় ঐ ৮৫জনকে দত্তপাড়া ব্রিজের কাছে হত্যা করা হয়। ৪ মে নাটোরবাসীর কাছে আরেক বিভীষিকাময় রাত উপস্থিত হয়। ঐ দিন রাত ১২টার দিকে পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকার আ, রহমান নাটোর শহর থেকে ৫-৬ মাইল দূরে অবস্থিত আমহাটি, ভবানি, ছাতনী ও পণ্ডিত গ্রামকে ঘিরে ফেলে এবং ঐ এলাকাগুলাের ঘরে-ঘরে তল্লাশি চালিয়ে হিন্দু-মুসলমান পুরুষদের নির্বিচারে ধরে নিয়ে ছাতনী সুইস গেটের কাছে একত্র করে নির্মমভাবে হত্যা করে অসংখ্য বাঙালিকে। এ হত্যাযজ্ঞ পরদিন সকাল ৯টা পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।
উপসংহার
স্বাধীনতার ইতিহাস পর্যালােচনায় দেখা যায় যে, নাটোরবাসী অনেক তিক্ততার স্বাদ গ্রহণ করেছে, তাদের সম্মুখীন হতে হয়েছে বনপাড়া ও দত্তপাড়ার মতাে অনেক করুণ ও নির্মম গণহত্যা। সংগত কারণেই স্বাধীনতা অর্জনে বনপাড়া ও দত্তপাড়ার গণহত্যার ইতিহাস আজও চির অম্লান হয়ে আছে। বাংলাদেশ মূলত ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতা লাভ করলেও নাটোর পুরােপুরি মুক্ত হতে সময় নিয়েছিল আরও কিছুদিন। ২০ ডিসেম্বর নাটোর সম্পূর্ণ মুক্ত হয় পাকিস্তানিদের কবল থেকে তাই স্বাধীনতা যুদ্ধে নাটোরবাসীর আত্মত্যাগ আজও চিরস্মরণীয় হয়ে। আছে।
গােপালপুরের গণহত্যা
ভূমিকা
গােপালপুরের গণহত্যা ইতিহাসের এক জঘন্যতম অধ্যায়। সেদিন নাটোরের মাটি রঞ্জিত হয়েছিল অসংখ্য শহিদের পবিত্র রক্তে। আকাশে-বাতাসে ধ্বনিত হয়েছিল অসংখ্য মায়ের সন্তান হারানাের বুকফাটা আর্তনাদ, স্বামী-স্ত্রীহারা অনেকের করুণ আকুতি। সম্ভ্রমহারা অগণিত মা-বােনের চোখের লােনা জ্বলে ভিজে গিয়েছিল গােপালপুরের মাটি  আর তাই গােপালপুরের নির্মম গণহত্যা, বর্তমানে যার নাম হয়েছে ‘শহিদ সাগর’, আজও নাটোরবাসীর গর্বিত স্মৃতিতে অম্লান হয়ে আছে। পটভূমি। স্বাধীনতা যুদ্ধ ছিল মূলত দেশের আপামর জনসাধারণের সক্রিয় প্রয়াস। লালপুর-ওয়ালিয়ার খণ্ডযুদ্ধে হানাদাররা চরমভাবে পর্যুদস্ত হয়। এর প্রতিরােধ নিতে তারা বেপরােয়া হয়ে ওঠে। শুধু অপেক্ষায় ছিল যথাযথ সুযােগের। এমনই একপর্যায়ে পাকিস্তানিরা গােপালপুরের চিনিকলে আক্রমণ করে হত্যা করেছিল মিলের শত শত নিরীহ ও নিরপরাধ শ্রমিক, যার অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়েছিল সারা নাটোরে প্রতিবাদী হয়ে উঠেছিল সেদিন সমগ্র নাটোরবাসী। প্রতিশােধস্পৃহা জাগিয়ে তুললাে নাটোরের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা প্রত্যেকেরই মনে। আর তাই পর্যায়ক্রমে সবার সম্মিলিত প্রতিরােধের মাধ্যমেই সেদিন মুক্ত হয়েছিল নাটোর। ভূমির পরিচিতি গােপালপুর এলাকাটি লালপুর থানাধীন নাটোর জেলা শহর থেকে আনুমানিক ৩৫ কিলােমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত এর উত্তরে লালপুর থানার ওয়ালিয়া, পূর্বে দুরদরিয়া অবস্থিত। এলাকাটি বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকার মতােই খােলা ও সমতল। তবে এলাকাটি নাটোরের অন্যান্য এলাকার থেকে কিছুটা উচু বিধায় বর্ষা মৌসুমেও ঐ এলাকায় চলাচল করা যায়। এখানকার উল্লেখযােগ্য ভূমিচিহ্নের মধ্যে রয়েছে লালপুর-ওয়ালিয়া পাকা সড়ক, যা সব ধরনের যানবাহন চলাচলের উপযােগী। নাটোর-ঈশ্বরদী রেললাইন, যা গােপালপুরের। উপর দিয়ে চলে গিয়েছে এবং তা লালপুরের সাথে নাটোর জেলা শহরকে যুক্ত করেছে। যুদ্ধের সংগঠন যুদ্ধের সংগঠন নিম্নরূপ:
পাকিস্তানি বাহিনী: সুনির্দিষ্টভাবে জানা যায় নি, তবে স্থানীয় মুক্তিযােদ্ধাদের ভাষ্য অনুযায়ী ২২ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট প্লাটুন।
শত্রুপক্ষের বিন্যাস পাকিস্তানি বাহিনী ঈশ্বরদী-নাটোর হয়ে যখন রাজশাহীর দিকে অগ্রসর হচ্ছিল তখন লালপুরের ওয়ালিয়ায় তারা প্রথম বাধাপ্রাপ্ত হয়। মুক্তিবাহিনীর কাছে পরাজিত হয়ে তারা বর্বরােচিতভাবে একের পর এক নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করেছিল। এমনই একপর্যায়ে যখন তারা গােপালপুরের চিনিকলের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল, তখন তাদের গােপালপুর রেলগেটে স্থানীয় মুক্তিবাহিনীর। ব্যারিকেডের মুখােমুখি হতে হয়। পরবর্তী সময় তারা ভারি অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে। ঐ ব্যারিকেড ভেঙে চিনিকলের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে।
যুদ্ধের বিবরণ
বাঙালির গৌরবময় ইতিহাসেরই একটি মর্মান্তিক খণ্ডচিত্র হলাে নর্থবেঙ্গল সুগার মিলসের অভ্যন্তরে ঘটে যাওয়া বর্বর পাকিস্তানি বাহিনীর নারকীয় হত্যাযজ্ঞ, যা তকালীন গােপাল সাগর, বর্তমান প্রজন্মের কাছে তা ‘শহিদ সাগর’ নামে পরিচিত। ১৯৭১ সালের ৩০ মার্চ গােপালপুরের ৪ কিলােমিটার উত্তরে ময়না গ্রামে পাকিস্তানি সেনাদের সাথে স্থানীয় অধিবাসীদের এক ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। পরদিন পাকিস্তানি সেনাদের মেজর রাজা খান চুপিসারে পালানাের সময় স্থানীয় জনগণ তাকে গুলি করে হত্যা করে। এ ছাড়া ঈশ্বরদী বিমানবন্দরে যেন পাকিস্তানি সেনা অবতরণ করতে না পারে, সে জন্য স্থানীয় মুক্তিকামী জনগণ। মিলের বুলডােজারসহ অন্যান্য যানবাহনের সহায়তায় বিমানবন্দরের রানওয়ে ভেঙে অকেজো করে দেয়। উপরি-উক্ত ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তখন। গােপালপুরের সর্বত্রই থমথমে অবস্থা বিরাজ করছিল, তবু এলাকার আখচাষিদের স্বার্থে জাতীয় প্রতিষ্ঠানটি চালু রাখার জন্য এবং পরবর্তী সময় পাকিস্তানি ক্যাম্প অধিনায়ক মেজর শেরওয়ানীর অনুরােধে মিলের সবাই যার যার দায়িত্বে যােগদান করেন। সেদিন ছিল ৫ মে, বুধবার। চারদিকের নিস্তব্ধ অবস্থার মধ্যেই মিলের কাজকর্ম যথারীতি চালু ছিল।
তখন সময় সকাল ১০টা। হাতে লালসালু কাপড়ের ব্যাজ পরা কিছু রাজাকারের সহায়তায় পাকিস্তানি বাহিনীর ১টি দল অতর্কিত মিল ক্যাম্পাসের ভিতরে প্রবেশ করে এবং তকালীন মিলের প্রশাসক লেফটেন্যান্ট আনােয়ারুল আজিমকে ডেকে বাংলাের সামনে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে এবং একপর্যায়ে মিলের অন্যান্য কর্মকর্তা ও শ্রমিক-কর্মচারীকে ডেকে বর্তমান অতিথি ভবনসংলগ্ন পুকুরের (শহিদ সাগর) সামনে একত্র করতে বলেন। পরবর্তী সময় সবাইকে সমবেত করার পর নানা বিষয়ে লেফটেন্যান্ট আনােয়ারুল আজিমের সঙ্গে পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তাদের বাগ্‌বিতণ্ডা চলতে থাকে। তারা ময়নার যুদ্ধ এবং পরদিন লালপুরে পাকিস্তানি সেনা অফিসার হত্যার বিষয়ে উল্লিখিত শ্রমিক, কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের দোষারােপ করে এবং উপস্থিত প্রায় শতাধিক শ্রমিককে লাইনে। দাড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ারে হত্যার নির্দেশ দেয়। এহেন পরিস্থিতিতে মিলের প্রশাসক লেফটেন্যান্ট আনােয়ারুল আজিম বারবার তাদের নির্দোষ দাবি করেন। পাকিস্তানি সেনারা তাঁর কথায় কোনাে কর্ণপাত করে নি। পাকিস্তানিরা সেদিন মিলের ম্যানেজারসহ সবাইকে ব্রাশ ফায়ারে নির্মভাবে হত্যা করে ঐ পুকুর পাড়েই ফেলে রেখে যায়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পরই উল্লিখিত শহিদদের স্মরণে গণহত্যার স্থলে অর্থাৎ মিলের অতিথি ভবনসংলগ্ন পুকুরটির নামকরণ করা হয় ‘শহিদ সাগর’। গােপালপুর সুগার মিলের ব্যবস্থাপনায় শহিদ আনােয়ারুল আজিমের স্ত্রী মিসেস শামসুন্নাহার আজিম কর্তৃক ‘শহিদ সাগর নামে একটি শহিদ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়। জানা যায় যে, শহিদ সাগর নামকরণের পূর্ব পর্যন্ত ঐ পুকুরটি ‘গােপাল সাগর’ হিসেবে পরিচিত ছিল। শিক্ষণীয় বিষয় ইতিহাসের প্রতিটি যুদ্ধই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কিছু না কিছু শিক্ষণীয় বিষয়।
রেখে যায়, যা পরবর্তী সময় যে-কোনাে যুদ্ধ পরিকল্পনায় সহায়তা করে। তেমনি গোপালপুরের গণহত্যায়ও কিছু শিক্ষণীয় বিষয় ছিল, যা নিমরূপ: ক. স্থানীয় সহায়তা: স্থানীয় সহায়তা ব্যতীত যুদ্ধে জয়লাভ করা খুবই দুরূহ ব্যাপার। গােপালপুরে ছিল স্থানীয় রাজাকারদের পূর্ণ সমর্থন; অন্যদিকে, মুক্তিবাহিনী ছিল অসংগঠিত। তাই অবলীলায় তারা এ গণহত্যা চালিয়েছিল। খ. অন্ধবিশ্বাস: যে-কোনাে ক্ষেত্রেই অন্ধবিশ্বাস মােটেও যুক্তিসংগত নয় । বিশেষ করে যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুপক্ষকে বিশ্বাস করার প্রশ্নই ওঠে না। গােপালপুরের গণহত্যা যার এক জ্বলন্ত উদাহরণ। উদাসীনতা: স্থানীয় পাকিস্তানি ক্যাম্পের অধিনায়কের কথায়। বাঙালিদের কাজে যােগদান করাটা ছিল প্রথম ভুল। দ্বিতীয় এবং সবচেয়ে বড়াে ভুল হলাে আচমকা যে-কোনাে আক্রমণ প্রতিহত করার ব্যবস্থা না করে এবং সর্বোপরি সামগ্রিক নিরাপত্তার দিক বিবেচনা করেই সম্পূর্ণ অবিবেচকের মতাে কাজে যােগদান করা। এ ক্ষেত্রে বাঙালিদের চরম উদাসীনতার কারণেই পাকিস্তানিরা একটি সফল গণহত্যা চালাতে সক্ষম হয়েছিল।
উপসংহার
কিছুটা বিলম্বে হলেও ১৯৭১ সালের ২০ ডিসেম্বর নাটোর পুরােপুরি পাকিস্তানি হানাদার মুক্ত হয়। কেননা, নাটোরে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ কিছুটা দেরিতে হয়। ইতিহাস বিশ্লেষণে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, শুধু কথায় বিশ্বাস করে এবং নিজস্ব নিরাপত্তার ক্ষেত্রে চরম উদাসীনতার কারণে গােপালপুরের  চিনিকলে সেদিন পাকিস্তানি বাহিনী নির্মমভাবে হত্যা করেছিল অসংখ্য নিরীহ শ্রমিককে।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান -ষষ্ঠ খন্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!