লালপুরের যুদ্ধ (অ্যামবুশ)
ভূমিকা
১৯৭১ সালে মাতৃভূমির স্বাধীনতার ডাকে সারা দেশের ন্যায় নাটোরের সর্বস্তরের সাধারণ মানুষও সাড়া দিয়েছিল। লালপুরে সংঘটিত বিভিন্ন খণ্ডযুদ্ধে নাটোরবাসীর সক্রিয় অংশগ্রহণ নাটোর জেলার মুক্তিকে আরও ত্বরান্বিত করে। ইতিহাসের মহাঘাতক মানবতার শত্রু পাকিস্তানি বাহিনী নাটোর অঞ্চলের জনপদের প্রতিটি শহর, বন্দর ও গ্রামকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে নিঃশেষ করে । নিরীহ-নিরপরাধ বাঙালিকে একের পর এক হত্যা করে এক বিভীষিকাময় রাজ্য কায়েম করার উৎসবে মেতে উঠেছিল। তারই সাক্ষী হয়ে আছে নাটোর জেলার লালপুরের বিভিন্ন খণ্ডযুদ্ধ ঢাকা থেকে রাজশাহীর উদ্দেশ্যে নিজস্ব শক্তি ও জনবল বৃদ্ধির লক্ষ্যে পাকিস্তানি বাহিনীর অধিকাংশ চলাচলকে সেদিন থামিয়ে দিয়েছিল লালপুরের স্থানীয় মুক্তিবাহিনী বিভিন্ন খণ্ডযুদ্ধের মাধ্যমে। পটভূমি নাটোরের সর্বস্তরের মানুষ তৎকালীন টাউনপার্ক বর্তমানে জেলার কেন্দ্রীয় মসজিদসংলগ্ন এলাকায় এক স্বতঃস্ফূর্ত সমাবেশ করে মুক্তিকামী জনতা পাকিস্তানি হানাদারদের সম্ভাব্য যে-কোনাে আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরােধ গড়ে তােলার শপথ নেয় আর এ লক্ষ্যেই লাঠি, তীর, ধনুক, বল্লম, বর্শাসহ এক বিশাল মিছিল বের করে পুরাে শহর প্রদক্ষিণ করে। ঐ দিনই সকালে নওগাঁ থেকে ইপিআর-এর উইং অধিনায়ক মেজর নাজমুল হক নাটোর জেলার তৎকালীন আনসার অধিনায়ককে টেলিফোনে জানান যে, একদল পাকিস্তানি সৈন্য নগরবাড়ি ঘাট পার হয়ে রাজশাহীর দিকে আসছে।
আর এ যাত্রাকে প্রতিহত করতেই মূলত সেদিন সংঘটিত হয়েছিল লালপুর-ওয়ালিয়া তথা ময়নার খণ্ডযুদ্ধ। ভূমির পরিচিতি লালপুর থানা নাটোর জেলা শহর থেকে আনুমানিক ৪০ কিলােমিটার দক্ষিণপশ্চিমে অবস্থিত। লালপুরের পশ্চিমে পাবনা জেলার ঈশ্বরদী, উত্তরে বাগাতিপাড়া, পূর্বে বড়াইগ্রাম, পশ্চিমে রাজশাহী জেলার চারঘাট ও বাঘা থানা অবস্থিত। লালপুর থানার বিস্তৃত খােলা ভূমি হালকা গাছপালায় পরিবেষ্টিত। এলাকার ভূমি শুষ্ক মৌসুমেও যে-কোনাে ধরনের সৈন্য চলাচলে সহায়তা করে। এলাকার রাস্তাঘাটের মধ্যে লালপুর-গােপালপুর-দুরদুরিয়া পাকা সড়ক, যা সব ধরনের যানবাহন চলাচলের উপযােগী। যুদ্ধের সংগঠন যুদ্ধের সংগঠন নিম্নরূপ: ক, পাকিস্তানি বাহিনী: মেজর রাজা, সাথে ১টি পাকিস্তানি গােলন্দাজ কোম্পানি। | খ, মুক্তিবাহিনী: ১টি আনসার কোম্পানি এবং সাথে স্থানীয় মুক্তিবাহিনী । শত্রুপক্ষের বিন্যাস লালপুরের যুদ্ধে শত্রুপক্ষের বিন্যাস বিভিন্ন খণ্ডযুদ্ধের বর্ণনায় এবং পাশাপাশি নকশার সাহয্যেও উল্লেখ করা হলাে। যুদ্ধের বিবরণ ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ লালপুরে পাকিস্তানি বাহিনী প্রথম অনুপ্রবেশের চেষ্টা করে। সেদিন স্থানীয় বীর বাঙালি কর্তৃক বাধাপ্রাপ্ত ও অবরােধের মুখে পড়তে হয় হানাদারদের। প্রথম রক্তপাত মূলত নাটোরে সেদিনই হয়। পাকিস্তানি সেনারা হয় সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ। আর এ জন্য দিনটি লালপুরবাসীর জন্য আরও স্মরণীয় হয়ে আছে। ময়নার খণ্ডযুদ্ধে সেদিন পাকিস্তানিদের ২২টি জিপ, ২২টি পিকআপ, ৩৩টি ট্রাকসহ প্রায় শতাধিক সৈন্যের ১টি পাকিস্তানি কনভয়ের সব পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। ঐ যুদ্ধ চলে লাগাতার ১১ ঘন্টা এবং এতে প্রায় ১১জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়।
প্রতিরােধ বাহিনীর লােক মারা যায় ৪১জন এবং আহত হয় শতাধিক। রাতে পাকিস্তানি সেনারা ২টি ট্রাক ফেলে পালাতে সক্ষম হয়। কিন্তু পালানাের সময় রেখে যায় মেজর রাজাসহ ৩জন সৈনিককে। পরদিন ভিন্ন মাঠ ও গাঁয়ের পথে তাদের খোঁজ মিলে। তারা ছিল ক্ষুধার্ত, ক্লান্ত ও অবসন্ন। নারী বেশ ধরে খুঁজছিল আত্মরক্ষার পথ। কিন্তু পরে তাদের গুলি। করে হত্যা করা হয়। এরপর লালপুরের বিলমাড়িয়ায় একটি পুরাতন পরিত্যক্ত স্থানে গণহত্যা চালানাে হয়। মে মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে গােটা জুন মাস এখানে ৩ বার গণহত্যা চালানাে হয়। কত লােক যে ঐ গণহত্যায় মারা যায়, তার কোনাে সঠিক হিসেব কারাে জানা নেই। কারণ তখন এলাকাটি ছিল সম্পূর্ণরূপে বিরানভূমি। গণহত্যার মুহূর্ত থেকেই এলাকার মানুষ নিভৃত পল্লীতে গিয়ে আত্মগােপন করেছিল। স্থানীয় মুক্তিযােদ্ধা ও গ্রামবাসীদের গণসাক্ষাৎকারে জানা যায় যে, স্থানীয় হাটের মসজিদসংলগ্ন মাঠে লাশের স্তুপ সেদিন পড়ে থাকে। ৮-১০ দিন ধরে ঐ লাশগুলাে টানাটানি করে শেয়াল-কুকুরে। গ্রামবাসীর মধ্যে যারা ছিল সাহসী, তারাই প্রথম গণহত্যার শেষ গােধূলি বেলায় নিজেদের ২১টি লাশ শনাক্ত করে নিতে সমর্থ হয়। ২৬ মার্চ সকাল ১০টার দিকে নওগাঁর ইপিআরএর উইং অধিনায়ক মেজর নাজমুল হক টেলিফোনে লালপুরের আনসার অধিনায়ককে জানান যে, নগরবাড়ি ঘাট থেকে একদল পাকিস্তানি সৈন্য রাজশাহীর দিকে এগিয়ে আসছে, যার ফল হবে মুক্তিবাহিনীর জন্য অত্যন্ত ভয়াবহ।
যে-কোনাে অবস্থায় তখন এদের প্রতিহত করা অপরিহার্য। সাথে সাথে আনসার অধিনায়ক আফসার মিয়া, আতাহার আলী, জাহিদুল হাকিম ও আব্দুর রশিদের সঙ্গে এ ব্যাপারে আলােচনা শেষে সিদ্ধান্ত নেন যে, যে-কোনাে মূল্যেই তাদের মােকাবিলা করতে হবে। হয় বাঁচা, নয় মরা। বিষয়টি মেজর নাজমুল হককে অবহিত করে ঐ দিনই সন্ধ্যার সময় পাবনা অভিমুখে রওনা হলেন। আনসাররা। পাবনা থেকে যে রাস্তাটি রাজশাহীর দিকে গিয়েছে, তার কাছেই মুলাডুলি। ঐ খানেই বৃষ্টির মতাে ওদের দিকে গুলি ছুড়তে থাকে আনসাররা, যা পাকিস্তানিরা মােটেই আশা করেনি। তাই আনসারদের গুলির সামনে টিকতে না পেরে তারা পিছিয়ে গিয়ে অন্য পথে রাজশাহীর দিকে এগােতে থাকে। এ সময় আনসার অধিনায়ক মাে. ইউসুফ এ মর্মে মতামত দেন যে, পাকিস্তানি বাহিনী নিশ্চয়ই গােপালপুর-বনপাড়া রাস্তা ধরে অগ্রসর হচ্ছে। সবাই ইউসুফের কথায়। একমত পােষণ করে দ্রুত বনপাড়ার দিকে এগিয়ে যায়। রাত ১০টায় আনসার বাহিনী বনপাড়া পৌছে যায় এবং সাথে সাথে খবর পাওয়া যায় যে, পাকিস্তানি বাহিনী গােপালপুর হয়ে রাজশাহীর দিকে এগিয়ে আসছে। আর তাই কালবিলম্ব করে আনসারদের গােপালপুরের দিকে অগ্রসর হতে আদেশ দেওয়া হয়। ৫-৬ মাইল যাওয়ার পর ওয়ালিয়ায় দ্বিতীয়বারের মতাে আনসাররা। পাকিস্তানি বাহিনীর মুখােমুখি হয়।
প্রকৃতপক্ষে সমস্ত রাত এবং পরের দিন পর্যন্ত তাদের সাথে মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধ চলে। সন্ধ্যার দিকে হঠাৎ পাকিস্তানি বাহিনী কভারিং ফায়ারের মাধ্যমে পিছু হটতে শুরু করে। ঐ সময় অধিনায়ক ইউসুফ, মেহের আলী, মােজাম্মেল সাত্তার (প্রাক্তন সৈনিক) এঁদের পরামর্শ অনুযায়ী ইউসুফের কমান্ডে ১টি আনসার প্লাটুন ভিন্ন পথ ধরে দ্রুত গতিতে রওনা করে, যাতে করে পাকিস্তানি বাহিনীর আগেই গােপালপুর রেল স্টেশনে পৌছানাে যায়। পাকিস্তানি বাহিনী পৌছানাের আগেই তারা গােপালপুর রেল স্টেশনে পজিশন নেয়। স্থানীয় জনসাধারণের সাহায্যে রেলের ওয়াগন দিয়ে রাস্তায় ব্যারিকেড সৃষ্টি করা হয়। এ ব্যারিকেডের খবর এবং আনসারদের অবস্থান পাকিস্তানি বাহিনী আন্দাজও করতে পারেনি। কিছুক্ষণের মধ্যেই পাকিস্তানি বাহিনী গােপালপুর স্টেশনের কাছে পৌছে ব্যারিকেড দেখতে পেয়ে সৈনিকদের নামিয়ে দেয় ঐ ব্যারিকেড সরানাের জন্য। এ সুযােগেই আনসার বাহিনী অকস্মাৎ তাদের উপর গুলি চালানাে শুরু করে। গােলাগুলির শব্দ পেয়ে স্থানীয় জনসাধারণ তুমুল উদ্দীপনায় যার যা আছে তাই নিয়ে আনসারদের সঙ্গে যােগ দেয়। ঘণ্টা খানেক যুদ্ধের পর পাকিস্তানি বাহিনীর ২২জন সৈন্য সেদিন নিহত হয়। বিশ্লেষণ ও পর্যালােচনা মুক্তিবাহিনীর বিজয়ের কারণ লালপুরের বিভিন্ন ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে, লালপুরের ওয়ালিয়ায় ময়নার খণ্ডযুদ্ধে বাঙালিদের বিজয়ের কারণগুলাে ছিল নিমরূপ:
ক, যুদ্ধের যথার্থতা: মুক্তিবাহিনীর জন্য ১৯৭১ সালের যুদ্ধ ছিল স্বাধীনতার প্রশ্নে বাঁচা-মরার লড়াই। আর এ যথার্থ কারণই তাদের জুগিয়েছিল অফুরন্ত মনােবল। অন্যদিকে, নৈতিকতায় দুর্বল পাকিস্তানিরা ছিল মূলত ভীতু। এ ছাড়া তাদের যুদ্ধ করার কোনাে যথাযথ কারণও ছিল না। আর এ যথার্থ কারণই দিয়েছিল মুক্তিযােদ্ধাদের বিজয়। সমর্থন লাভ: লালপুরের খণ্ডযুদ্ধে মুক্তিবাহিনী স্থানীয় অধিবাসী কর্তৃক পেয়েছিল ব্যাপক সাহায্য ও সহযােগিতা, যেটা পরবর্তী সময় যুদ্ধ জয়ের জন্য অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়। স্থানীয় লােকজন। পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থান সম্পর্কে জেনে মুক্তিবাহিনীকে গােপনে অবহিত করত। এ ছাড়া খাবার, বাসস্থান, সরঞ্জামাদি ইত্যাদি যাবতীয় প্রশাসনিক সমর্থন দিয়েও স্থানীয় জনগণ সেদিন সাহায্য করে। গ, এলাকার জ্ঞান: লালপুরের যুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধারা এমন ভূমিতে যুদ্ধ করেছে, যা তাদের পূর্বপরিচিত। স্থানীয় রাস্তাঘাট, নদী, সবই ছিল তাদের জানা। এ পরিচিতি তাদের সব কর্মকাণ্ডে সহায়তা করেছিল। পরিবর্তিত আবহাওয়া: মুক্তিবাহিনী এখানকার অত্যাসন্ন পরিবর্তিত যে-কোনাে প্রতিকূল আবহাওয়ার সাথে ছিল সুপরিচিত। অন্যদিকে, একটা নতুন স্থানে পাকিস্তানিদের আবহাওয়ার সাথে পরিচিত হতে সময় লেগেছিল, যা মুক্তিযােদ্ধাদের জয়কে করেছিল সহজতর । উ. গােপনীয়তা: মুক্তিবাহিনীর ছিল সঠিক গুপ্তবার্তা প্রবাহ। যে-কোনাে স্থান থেকে পাকিস্তানি বাহিনী কোথাও রওনা হলে মুক্তিবাহিনী দ্রুত সংবাদ পেত এবং সে অনুযায়ী তাদের উপর আক্রমণ পরিচালনা করত। এভাবে অনেক যুদ্ধেই বাঙালিদের চরম গােপনীয়তার কারণে পাকিস্তানি বাহিনীর ধ্বংস অনিবার্য হয়ে যায়। পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয়ের কারণ লালপুরের বিভিন্ন খণ্ডযুদ্ধে পাকিস্তানিরা ব্যাপকহারে পরাজিত হয়েছিল, যদিও তারা অসংখ্য বাঙালিকে হত্যা করেছিল। যে-সব কারণে পাকিস্তানিরা পরাজিত হয়েছিল, তার মধ্যে উল্লেখযােগ্য কয়েকটি নিমরূপ:
ক. বাঙালিদেরকে দুর্বল ও হেয় মনে করা: পাকিস্তানিরা ছিল প্রশিক্ষিত এবং অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত; অন্যদিকে, বাঙালিরা ছিল প্রায় নিরস্ত্র। স্বভাবতই তাদের মনে একটা অহংকারবােধ ছিল। কিন্তু অদম্য, দুঃসাহসী, অটুট, অফুরন্ত মনােবলাই পাকিস্তানিদের সব অহমিকা সেদিন ভেঙে চুরমার করে দেয়। এলাকার জ্ঞান: পাকিস্তানিরা লালপুর এলাকার বিন্যাস সম্পর্কে অবহিত ছিল না। কাজেই স্থানীয় এলাকার অপরিচিতি স্বভাবতই তাদের বিভিন্ন পরিকল্পনায় ব্যাঘাত ঘটায়।
গ. স্থানীয় সমর্থন না থাকা: পাকিস্তানিদের ছিল না কোনাে স্থানীয় সহযােগিতা। কিছুসংখ্যক স্বাধীনতাবিরােধী রাজাকার ব্যতীত সবাই ছিল তাদের বিপক্ষে। স্থানীয় লােকজনের সহায়তায় তাদের যেকোনাে ধরনের চলাচল ও পরিকল্পনা মুক্তিবাহিনী আগেভাগেই জেনে যেত। শিক্ষণীয় বিষয় লালপুর যুদ্ধের শিক্ষণীয় বিষয়গুলি নিম্নরূপ: ক, স্থানীয় সহায়তা যুদ্ধে জয়লাভের অন্যতম কারণ। পাকিস্তানিদের ছিল। কোনাে স্থানীয় সমর্থন, অন্যদিকে মুক্তিবাহিনীর ছিল সর্বপ্রকার স্থানীয় সহায়তা। তাই যুদ্ধে জয়লাভ বাঙালিদের জন্য সহজতর হয়েছিল। মনােবল তথা সাহসিকতাই যে-কোনাে যুদ্ধ জয়লাভের ভিত্তি। আর এ জন্য দরকার সঠিক নেতৃত্ব কাজেই যুদ্ধে জয়লাভের জন্য প্রয়ােজন সাহসী বীর সেনানীর দল এবং পাশাপাশি সুসংগঠিত নেতৃত্ব। যে-কোনাে যুদ্ধে যাত্রার পূর্বে সে এলাকা সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা থাকা অত্যাবশ্যক। অন্যথায় যুদ্ধে জয়লাভ অত্যন্ত কষ্টসাধ্য বিষয় হয়ে দাড়ায়। পাকিস্তানিদের লালপুর এলাকা সম্পর্কে সঠিক ধারণার অভাবই মুক্তিযােদ্ধাদের জয়লাভকে নিশ্চিত করেছিল। যুদ্ধে প্রতিপক্ষকে দুর্বল মনে করা অনেক সময় পরাজয়ের কারণ হয়ে দেখা দেয়। যেমনটি ঘটেছিল পাকিস্তানিদের জন্য লালপুরের বিভিন্ন খণ্ডযুদ্ধে। তারা মুক্তিকামী বাঙালিদের দুর্বল মনে করে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু মুক্তিবাহিনী সেদিন তাদেরকে পরাজিত করেছিল।
উপসংহার
লালপুরের খণ্ডযুদ্ধ বাংলাদেশের অন্যতম এক গৌরবােজ্জ্বল অধ্যায়, যার বিনিময়ে বাঙালিরা পকিস্তানি সৈন্যদের নাটোরে ধরাশায়ী করেছিল। এ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও বিভিন্ন স্মৃতি সংগ্রহ এবং সংরক্ষণ করে রাখা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। গুটিকয়েক কাটা রাইফেলের সাহায্যে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেশীয় অস্ত্র (যেমন: রামদা, চাপাতি, বর্শা, বল্লম ইত্যাদি) দ্বারা নিরীহ বাঙালি সেদিন অবিশ্বাস্যভাবেই ঝাপিয়ে পড়েছিল পাকিস্তানি সৈন্যদের উপর। নাটোরবাসীর অদম্য উৎসাহ, উদ্দীপনা, সাহসিকতা ও অদম্য মনােবলই মুক্তিযােদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ করেছিল যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে কাজেই মুক্তিযুদ্ধে লালপুর-ওয়ালিয়া তথা নাটোরবাসীর অবদান আজও অমলিন হয়ে আছে।
বেলপুকুরিয়া রেলক্রসিংয়ের প্রতিরােধ যুদ্ধ (অ্যামবুশ)
ভূমিকা স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় রাজশাহী সেক্টরের যুদ্ধ ছিল মূলত খণ্ড খণ্ড আক্রমণ এবং পাল্টা আক্রমণের মধ্যে সীমাবদ্ধ। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে মুক্তিবাহিনী শত্রুর উপর যে ধরনের আক্রমণ পরিচালনা করে, তন্মধ্যে বেলপুকুরিয়ার প্রতিরােধ যুদ্ধ বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। কারণ, এ প্রতিরােধ যুদ্ধের মাধ্যমে শত্রুর যানবাহন, জনবল, রসদ ও গােলাবারুদের বড়াে ধরনের ক্ষতি করা হয়েছিল। নাটোর থেকে রাজশাহী পৌছতে পাকিস্তানি বাহিনী যে রাস্তা ব্যবহার করতাে, বেলপুকুরিয়ার অবস্থান সে প্রধান সড়কের উপর ছিল। রাজশাহী পৌছতে এ প্রধান সড়কের কোনাে বিকল্প খুঁজে পাওয়া ছিল খুবই মুশকিল। সে কারণে বেলপুকুরিয়ার যুদ্ধ কৌশলগত দিক থেকে ছিল গুরুত্বপূর্ণ। পটভূমি পাকিস্তানি বাহিনী যাতে নাটোর থেকে রাজশাহীতে নির্বিঘ্নে পৌছতে না পারে সে কারণে মুক্তিবাহিনী নাটোর ও রাজশাহীর মাঝামাঝি স্থানে অবস্থিত বেলপুকুরিয়াতে প্রতিরােধ গড়ে তােলে। ভূমির পরিচিতি নাটোর-রাজশাহী মহাসড়কের উপর বেলপুকুরিয়া অবস্থিত। এটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রায় ৯ কিলােমিটার পূর্বে অবস্থিত। বেলপুকুরিয়া-নাটোর এবং বেলপুকুরিয়া-রাজশাহী মহাসড়ক সব ঋতুতে সব ধরনের যানবাহন চলাচলের উপযােগী। এলাকার উত্তরে বিস্তৃত খােলা ভূমি লক্ষ্য করা যায় । রেলপথে বেলপুকুরিয়ার সাথে পশ্চিমে রাজশাহী এবং দক্ষিণ-পূর্বে আব্দুলপুরের যােগাযােগ আছে তবে নিকটস্থ রেল স্টেশন হলাে সারদায়। এলাকার ভূমি শুস্ক মৌসুমেও যে-কোনাে বড়াে ধরনের সেনাবাহিনী চলাচলে উপযােগী। যুদ্ধের সংগঠন যুদ্ধের সংগঠন নিমরূপ: ক, পাকিস্তানি বাহিনী: ১৬ পদাতিক ডিভিশন। এর অধীন ছিল ২৩ পদাতিক ব্রিগেড, ৩৪ পদাতিক ব্রিগেড, ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট (রাজশাহী), ২০৫ পদাতিক ব্রিগেড।। খ, মুক্তিবাহিনী: অধিনায়ক লে. কর্নেল নুরুজ্জামান এবং ৭ নম্বর সেক্টরের মুক্তিবাহিনী।
যুদ্ধের বিবরণ
ইউসুফপুর ইপিআর ক্যাম্পের হাবিলদার আকবর হােসেন মাত্র ২৫জনের ১টি ক্ষুদ্র দল নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীকে বাধা দেওয়ার জন্য বেলপুকুরিয়া রেলক্রসিংয়ে প্রতিরক্ষা গড়ে তুলেছিলেন। ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল ক্ষুদ্র দলটি ৩টি উপদলে বিভক্ত হয়ে প্রতিরক্ষা অবস্থানে গিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। পাকিস্তানি বাহিনীর ৭টি গাড়ি সামনে এবং কিছু দূরত্বে প্রায় ৫০টি গাড়ির কনভয় ছিল। যথাসময় অ্যামবুশ শুরু হওয়ায় প্রথম গাড়ির বহর থেকে অধিনায়কসহ অনেক পাকিস্তানি সৈন্য মারা যায়। তাদের বাকি সৈন্যরা পিছু হটতে থাকে এবং এলােপাতাড়ি গুলি নিক্ষেপ করে। এতে বেশ কয়েকজন মুক্তিযােদ্ধা শহিদ হন। অ্যামবুশ দলের অধিনায়ক ইপিআর হাবিলদার মো. আকবর হােসেন শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত যুদ্ধ করতে থাকেন। ক্রমেই মুক্তিযােদ্ধাদের গােলাবারুদ কমে আসছিল। পিছন দিক দিয়ে হানাদাররা ঘিরে ফেলার কারণে প্রায় ২ ঘণ্টা যুদ্ধের পর মোেট ১২জন মুক্তিযােদ্ধা শহিদ হন। দুপুর ২টা-আড়াইটার দিকে যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর পাকিস্তানি বাহিনী ধীরগতিতে কাটাখালী বাজার অতিক্রম করে কিন্তু শিল্প এলাকা ধ্বংসের সম্মুখীন হতে পারে বলে কাটাখালীতে কোনাে প্রতিবন্ধক তৈরি করা হয় নি। বিকাল ৪টার দিকে পাকিস্তানি বাহিনী এ দুর্বলতার সুযোেগ নিয়ে হিংস্র হায়েনার মতাে যাত্রাপথের আশপাশের ঘরবাড়ি, যানবাহন জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেয়। বিশ্লেষণ ও পর্যালােচনা মুক্তিবাহিনীর বিজয়ের কারণ বেলপুকুরিয়ার ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে, যদিও পাকিস্তানিরা অনেক নিরীহ বাঙালিদের হত্যা করেছিল, কিন্তু তারা শেষ পর্যন্ত হয়েছিল পরাজিত এবং মুক্তিযােদ্ধারা বিজয়ী হয়েছিলেন। বাঙালিদের বিজয়ের কারণগুলাে ছিল নিম্নরূপ: ক. নিজেদের দুর্বল মনে না করা: ১জন হাবিলদারের নেতৃত্বে মাত্র ২৫জনের ১টি দল প্রায় ব্রিগেড সমান পাকিস্তানি বাহিনীর অগ্রযাত্রাকে কিছু সময়ের জন্য হলেও সেদিন রুখে দিয়েছিল।
পাকিস্তানি সৈন্যদের ছিল আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র । অন্যদিকে, মুক্তিবাহিনীর ছিল না তেমন। কোনাে অস্ত্র অথবা গােলাবারুদের পর্যাপ্ততা। তথাপি নিজেদের দুর্বল। মনে না করে সেদিন মুক্তিযােদ্ধারা এমন অসম প্রয়াস নিতে সমর্থ। হয়েছিলেন। স্থানীয় সাহায্য: বেলপুকুরিয়ার যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী স্থানীয় অধিবাসী কর্তৃক পেয়েছিল ব্যাপক সাহায্য ও সহযােগিতা, যেটা একটা জয়ের। জন্য অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়। স্থানীয় লােকজন পাকিস্তানি বাহিনীর চলাচল সম্পর্কে জেনে মুক্তিবাহিনীকে গােপনে অবহিত করতাে এবং তারা পাকিস্তানি বাহিনীর উপর আক্রমণ করতাে। এভাবে স্থানীয় সাহায্য পাওয়ার ফলে মুক্তিবাহিনীর বিজয় নিশ্চিত হয়েছিল। স্থানীয় ভূমির সঙ্গে পরিচিতি: বেলপুকুরিয়ার যুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধারা এমন ভূমিতে যুদ্ধ করেছে, যা ছিল তাদের পূর্বপরিচিত। এ পরিচিতি তাঁদের সব কর্মকাণ্ডে সহায়তা করেছিল। অন্যদিকে, পাকিস্তানিদের কাছে। এটা ছিল একটা অপরিচিত ভূমি, যেখানে যুদ্ধ করতে স্বভাবতই তাদের অসুবিধা হয়েছিল। এটাও মুক্তিযােদ্ধাদের জয়ের একটা বড়াে কারণ হিসেবে কাজ করেছিল। ঘ, গুপ্তবার্তা প্রবাহ: মুক্তিবাহিনীর ছিল সঠিক গুপ্তবার্তা প্রবাহ। যে-কোনাে স্থান থেকে পাকিস্তানি বাহিনী কোথাও রওনা হলে মুক্তিবাহিনী দ্রুত সংবাদ পেত এবং সে অনুযায়ী তাদের উপর ঝাপিয়ে পড়ত। এভাবেই অনেক ক্ষতি হয়েছিল পাকিস্তানিদের, ফলে মুক্তিবাহিনীর বিজয় হয়েছিল ত্বরান্বিত। পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয়ের কারণ বেলপুকুরিয়ার যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর ব্যাপক পরাজয় হয়েছিল। যে সমস্ত কারণে পাকিস্তানিরা পরাজিত হয়েছিল তার মধ্যে উল্লেখযােগ্য কয়েকটি কারণ হচ্ছে :
ক. মুক্তিবাহিনীকে দুর্বল মনে করা: পাকিস্তানিরা ছিল অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত; অন্যদিকে, বাঙালিরা ছিল নিরস্ত্র । তাই তাদের মনে একটা অহংকার জাগ্রত হয়েছিল বাঙালিদের বিরুদ্ধে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এ দুর্বল নিরস্ত্র বাঙালিরাই তাদের করেছিল পর্যদস্ত। বাঙালিদের ছিল অটুট, অফুরন্ত মনােবল, যার স্রোতে ভেসে গিয়েছিল পাকিস্ত নিদের অহমিকা। স্থানীয় এলাকা সম্পর্কে ধারণা না থাকা: পাকিস্তানিরা যুদ্ধ এলাকার বিন্যাস সম্পর্কে সম্যক অবহিত ছিল না। এলাকা ছিল তাদের অচেনা-অজানা, যা তাদের বিভিন্ন পরিকল্পনায় ব্যাঘাত ঘটাত। এ কারণেও তাদের পরাজয় বরণ করতে হয়েছিল। স্থানীয় সমর্থন না থাকা: পাকিস্তানিদের ছিল না কোনাে স্থানীয় সহযােগিতা। কিছুসংখ্যক স্বাধীনতাবিরােধী রাজাকার ব্যতীত সবাই ছিল তাদের বিপক্ষে। তাই তাদের কোনাে স্থানীয় সমর্থন না থাকায় তাদের যে-কোনাে ধরনের চলাচল, পরিকল্পনা মুক্তিবাহিনী আগেভাগেই জেনে যেত স্থানীয় লােকদের সহায়তায়, যা তাদের পরাজয়কে করেছিল নিশ্চিত।
শিক্ষণীয় বিষয় ইতিহাসের প্রতিটি যুদ্ধই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কিছু না কিছু শিক্ষণীয় বিষয় রেখে যায়, যা ভবিষ্যতের পরিকল্পনায় সহায়তা করে। তেমনি বেলপুকুরিয়ার যুদ্ধেও কিছু কিছু শিক্ষণীয় বিষয় ছিল, যা নিমরূপ: ক, স্থানীয় সহায়তা: স্থানীয় সহায়তা ব্যতীত যুদ্ধে জয়লাভ করা খুবই দুরূহ ব্যাপার। পাকিস্তানিদের ছিল না কোনাে স্থানীয় সমর্থন; অন্যদিকে, মুক্তিবাহিনীর ছিল সর্বপ্রকার স্থানীয় সাহায্য। তাই যুদ্ধে জয়লাভ সহজ হয়েছিল। এলাকা পরিচিতি: কোথাও যুদ্ধে যাত্রার পূর্বে সে এলাকা সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা থাকা অত্যাবশ্যক অন্যথায় যুদ্ধে জয়লাভ কষ্টসাধ্য। পাকিস্তানিদের বেলপুকুরিয়া এলাকা সম্পর্কে ধারণা ছিল কম। অন্যদিকে, মুক্তিযােদ্ধারা এর প্রতিটি স্থান বিস্তারিত চিনতেন, ফলে তাদের পক্ষে যুদ্ধে জয়লাভ সহজতর হয়েছিল। প্রতিপক্ষকে দুর্বল মনে না করা: যুদ্ধে প্রতিপক্ষকে দুর্বল মনে করা অনেক সময় পরাজয়ের কারণ হয়ে দেখা দেয়, যেমনটি ঘটেছিল। পাকিস্তানিদের জন্য বেলপুকুরিয়ার যুদ্ধে। বাঙালি সন্তানরা তাদের সর্বস্ব দিয়ে আক্রমণ করে পাকিস্তানি বাহিনীর অগ্রযাত্রাকে কিছু সময়ের জন্য হলেও সেদিন রুখে দিয়েছিল। সুতরাং, প্রতিপক্ষকে কখনােই দুর্বল মনে করা উচিত নয়।
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান -ষষ্ঠ খন্ড