You dont have javascript enabled! Please enable it!
পাবনা জেলার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
১৮২৮ খ্রিস্টাব্দের ১৬ অক্টোবর ৩১২৪ নং সরকারি আদেশে রাজশাহী জেলার পাবনা, ক্ষেতুপাড়া, মথুরা, শাহজাদপুর ও বগুড়া জেলার রায়গঞ্জ এবং যশাের জেলার ধরমপুর, মধুপুর, কুমারখালী ও পাংশা এই ৯টি থানার সমন্বয়ে পাবনা জেলা গঠিত হয়। ১৮২৮ সালের ২১ নভেম্বর খােকশা থানা পাবনা জেলার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পরে যশাের জেলার থানাসমূহ পৃথক হয়ে যায়। ১৮৮১-এর ২৭ মার্চ পাংশা থানা ফরিদপুর জেলায় এবং ১৮৫৯ সালে কুষ্টিয়া থানা নদীয়া জেলার অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সময় ভারতভুক্ত নদীয়া জেলার পাকিস্তানভুক্ত অংশ নিয়ে কুষ্টিয়া জেলা গঠিত হয়। ১৮৫৫ সালের ১২ জানুয়ারি ময়মনসিংহ জেলা থেকে সিরাজগঞ্জ থানা পৃথক হয়ে পাবনা জেলাভুক্ত হয়। ১৮৪৬ সালে চাটমােহর থানা এবং ১৯১৩ সালে। চাটমােহর ও রায়গঞ্জের অংশ বিশেষ নিয়ে তাড়াশ থানা গঠিত হয়। ১৯০৩-এ দুলাই ও সাড়া থানা গঠিত হয়। ১৯২৯ সালের ১০ মে সাড়া থানা ঈশ্বরদীর টেংরী মৌজায় এনে ঈশ্বরদী নামকরণ করা হয়। একইভাবে দুলাই থানা সুজানগর, মথুরা থানা বেড়া এবং ক্ষেতুপাড়া থানা সাথিয়া থানায় রুপান্তরিত হয়। ১৯৮১ সালের ১৯ আগস্ট চাটমােহর ও ফরিদপুর থানার অংশ বিশেষ নিয়ে ভাঙ্গড় থানা গঠিত হয়। ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে পাবনা জেলার জন্ম হলেও রাজশাহী জেলার কালেকটরের অধীনে থাকে এবং মালদহের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট পাবনা জেলার জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে কাজ চালান। ১৮২৯ সালে সার্কিট কোর্ট বিলুপ্ত করে রেভিনিউ কমিশনারের পদ করে পাবনা জেলা রাজশাহীর রেভিনিউ কমিশনারের অধীনে দেয়া হয়।
জেলা জজ ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেটগণ  রেভিনিউ কমিশনারের অধীনে কাজ করতেন। ১৮৩২ সালে পাবনার জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেটকে ডেপুটি কালেক্টরের ক্ষমতা দেয়া হয়। লর্ড ক্যানিং-এর আমলে ১৮৫৯ সালে পাবনা জেলাকে সম্পূর্ণভাবে আলাদা করে পাবনার জন্য একজন ম্যাজিস্ট্রেট বা কালেক্টরেট নিযুক্ত করা হয়। ১৮৬৬ সালে সিরাজগঞ্জ মহকুমা স্থাপিত হয়। ১৮৩৭ সালে সেশন জজের পদ সৃষ্টি হলে পাবনা রাজশাহী দায়রা জজের অধীনে আসে। ১৮৭৯ সালে পাবনার জজ আদালত প্রতিষ্ঠার পর পাবনা ও বগুড়া জেলা তার অধীনে আসে। ১ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৪ সালে সিরাজগঞ্জ | মহকুমা জেলায় রূপান্তরিত হয়। বর্তমানে পাবনা জেলারূপে গঠিত এলাকাটি প্রাচীন যুগে পূর্ব ভারতের বঙ্গ ও পুবর্ধন প্রদেশদ্বারের অংশ ছিল। প্রাচীন বাংলার এ অংশে বসবাসকারী  বিভিন্ন উপজাতির রাজনৈতিক ইতিহাস সম্বন্ধে বৈদিক সাহিত্যে কোনাে বিবরণ
পাওয়া যায় না। অবশ্য বাংলার এই জনপদে বসতিস্থাপনকারী কিছুসংখ্যক উপজাতি যেমন, পুঞ, বঙ্গ ইত্যাদির উল্লেখ কখনও কখনও মেলে। বৈদিক ধর্মগ্রন্থ কিংবা দর্শনেও কোনাে রাজার উল্লেখ নেই। অবশ্য এটা আমরা জানতে পারি যে, এ অঞ্চলটি বেদ রচয়িতাদের নিকট অপরিচিত থাকলেও পরবর্তী ধর্মগ্রন্থ সংহিতা ও ব্রাহ্মণসমূহ সংকলনের সময়ে ধীরে ধীরে প্রসিদ্ধি অর্জন। করতে থাকে। বােধায়ন ধর্মসূত্র অনুসারে, এই সকল লােক বসতি অধ্যুষিত এলাকা সম্পূর্ণরূপে আর্য সংস্কৃতি বহির্ভূত বলে অভিহিত হতাে। এমনকি, এদের মধ্যে সাময়িকভাবে বসবাসকারী যে কোনাে আর্য-সম্প্রদায়ভুক্ত ব্যক্তিকেও প্রায়শ্চিত্তমূলক অনুষ্ঠানাদি পালন করতে হতাে। রামায়ণে অবশ্য পু ও বঙ্গদের ভিন্ন চিত্র দেওয়া হয়েছে।
তারা তখন আর অস্পৃশ্য বর্বররূপে আখ্যায়িত হতাে এই মহাকাব্যে তাদের পূর্বাঞ্চলের লােকদের তালিকায় উল্লেখ করা হয়েছে এবং তাতে বলা হয়েছে যে, তারা অযােধ্যার উচ্চবংশজাত ও অভিজাতদের সঙ্গে নিবিড় রাজনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল। মহাভারত, হরিবংশ এবং এসকল গ্রন্থের পরবর্তী পুরাণসমূহে পুঞদের একজন রাজা বাসুদেবের উল্লেখ পাওয়া যায়। কিংবদন্তীতে তাকে একজন শক্তিশালী রাজা রূপে বর্ণনা করা হয়েছে। তিনি বাংলার অধিকাংশ অঞ্চল যথা পুণ্ড, বঙ্গ প্রমুখ শাসন করেন এবং পুক উপ-নামে অভিহিত হন। ভীম কর্তৃক বাসুদেব পরাজিত হয়েছিলেন বলে। কথিত আছে, অন্যদিকে সুদেব নামে তাঁর জনৈক পুত্র কৃষ্ণ কর্তৃক নিহত হয়েছিলেন।  বৈদিক গ্রন্থাবলী, মহাকাব্য এবং ধর্মসূত্রে বর্ণিত কিংবদন্তী কাহিনীসমূহ কার্যত প্রাচীন বাংলার এ অঞ্চলে (যাতে পাবনা জেলা অন্তর্ভুক্ত ছিল) কোনােরূপ সামঞ্জস্যপূর্ণ সময়ানুক্রমিক ইতিহাস সৃষ্টিতে সাহায্য করে না অবশ্য জৈন ও বৌদ্ধধর্ম সংক্রান্ত কিংবদন্তীর ইতিহাসে পুণ্ড্রবর্ধনের সঙ্গে বিখ্যাত মৌর্যদের অশােক চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য সম্পর্কের কথা দৃঢ়ভাবে উল্লেখিত হয়েছে। তাতে উল্লেখ আছে তাদের রাজত্বকালে (খ্রিস্টপূর্ব ৩২৪ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ২৩২ অব্দ) এই জেলার প্রায় সম্পূর্ণ এলাকা মৌর্য সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। উত্তর বাংলার বহু জায়গায় বেশ কিছু সংখ্যক অশােক স্তম্ভের আবিষ্কার এবং ১৯৩১ সালে বগুড়ার মহাস্থানগড়ে একটি পুরােনাে ব্রাহ্মী উত্তীর্ণ লিপির সন্ধান লাভ থেকে এ অঞ্চলে যে মৌর্যদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা প্রমাণিত হয়।
প্রসিদ্ধ জৈন ধর্মগুরু ভদ্রবাহু কল্পসূত্র সম্পাদনা করেছিলেন বলে সাধারণত অনুমান করা হয়ে থাকে। ইনি ছিলেন এ অঞ্চলের অধিবাসী এবং তাঁকে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের (খ্রিস্টপূর্ব ৩২৪ খ্রিস্টপূর্ব ২৯৮) সমসাময়িক বলে ধারণা করা হয়। দিব্যাবদানে লিপিবদ্ধ কিংবদন্তী থেকে আমরা জানতে পারি যে, অশােকের (খ্রিস্টপূর্ব ২৯৮ খ্রিস্টপূর্ব ২৩২) রাজত্বকালে বাংলার এ অংশে নিগ্রন্থবাদী নামে জৈন ধর্মের একটি সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব ছিল। অশােকাবদানে উল্লেখ রয়েছে যে, বৌদ্ধ ধর্মের বিরুদ্ধাচরণ করার জন্য অশােক পুণ্ড্রবর্ধনের বহু সন্ন্যাসীকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেন। উপরােল্লিখিত অশােকীয় ব্রাহ্মী উত্তীর্ণ লিপি হচ্ছে একটি রাজকীয় অনুশাসন লিপি এবং এতে প্রচারকের (যিনি ছিলেন সম্রাট অশােক স্বয়ং) গভীর সহানুভূতি প্রকাশ পেয়েছে তার প্রজাসাধারণের জন্যে। মৌর্যদের পতনের পর পাবনা জেলাসহ বাংলার এতদঞ্চলের রাজনৈতিক অবস্থার ইতিহাস অজ্ঞতার অন্ধকারে চাপা পড়ে আছে। চতুর্থ শতক থেকে অবশ্য নির্দিষ্টভাবে তারিখযুক্ত উল্কীর্ণ লিপি সংক্রান্ত দলিলপত্রাদি এ অঞ্চলের ইতিহাস সম্বন্ধে অবহিত হতে আমাদের বেশ কিছুটা সাহায্য করে।
গণআন্দোলন ও অসহযােগ আন্দোলনে বৃহত্তর পাবনা
ব্রিটিশবিরােধী আন্দোলন, জমিদার প্রথা বিরােধী আন্দোলন, নানা পর্বের শ্রমিককৃষক বিদ্রোহ, সাম্প্রদায়িকতা-বিরােধী ও প্রগতিশীল আন্দোলনের নেতৃত্বে পাবনা কখনাে পিছিয়ে থাকে নি। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭০ এর স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলনে এই শহর বা থানার মানুষের রয়েছে সাহসী ভূমিকা। ১৯৪৮ সালেই এখানে ভাষা আন্দোলন ও সাম্প্রদায়িকতা-বিরােধী আন্দোলন গড়ে ওঠে। ১৯৫২ সালে তা ব্যাপক ও বিস্তৃত আকারে বিকাশ লাভ করে। এ আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে বহু বীর সন্তান প্রতিক্রিয়াশীল পাকিস্তানি শােষকগােষ্ঠীর অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হন ও জেল-জুলুম ভােগ করেন। ১৯৬২ থেকে ১৯৬৮ সময়সীমার ভেতরে স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলন এখানে এক বিস্ফোরণমুখী প্রেক্ষাপট তৈরি করে। বিক্ষুব্ধ জনতা শহরের একমাত্র বন্দুকের দোকান লুট করে তা দিয়ে সশস্ত্র মুসলিম লীগের বাহিনী ও পুলিশের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়। এ সময়ে পাকিস্তানি দালাল ক্যাপ্টেন জায়েদীর সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে দিনভর সংঘর্ষ ও গুলি বিনিময় হয়। অবশ্য শেষাবধি কার্ফ জারি করে এবং সেনাবাহিনী নামিয়ে ছাত্র-জনতার এই সশস্ত্র বিদ্রোহ।
সাময়িকভাবে দমন করা হয়। ১৯৭০ সালের জাতীয় নির্বাচনে পাবনাবাসী বিপুলভাবে স্বাধিকার আদায়ের ৬-দফা ও ১১-দফা আন্দোলনের পক্ষে রায়। দেন। নির্বাচনে বিজয়ী হয় আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা। পাবনা জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হলাে এর  প্রস্তুতি পর্ব। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণের পর সমগ্র জেলায় অসহযােগের যে জোয়ার উঠেছিলাে তখন থেকে শুরু করে ১০ এপ্রিল। দ্বিতীয় পর্যায়ে এ জেলায় পাকসেনাদের আগমন এবং তাদের সাথে মুখােমুখি যুদ্ধে হাজারাে মানুষের অংশগ্রহণের ফলে সংঘটিত রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ও বৃহত্তর যুদ্ধের আয়ােজনের বিবরণ ইত্যাদি নিয়েই প্রস্তুতি পর্ব। রাস্তায় রাস্তায় তৈরি হলাে ব্যারিকেড। শুরু হলাে প্রশিক্ষণের পালা। পঁচিশ বছরের শােষণের প্রতীক চাঁদ-তারা খচিত পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে ফেলা হলাে প্রতিটি ভবনের শীর্ষ থেকে পরিবর্তে পপত্ করে উড়তে লাগল লাল বৃত্তে বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা। পাবনার জনসাধারণ সেদিন যার ঘরে যে অস্ত্র ছিলাে তাই নিয়েই শুরু করেছিলাে যুদ্ধের মহড়া। শপথ নিয়েছিলাে পাকিস্তানি দানবীয় পশুশক্তিকে বাংলার মাটি থেকে চিরতরে উত্থাত এবং দেশের মাটিকে শক্রর কবল থেকে মুক্ত করার । উদ্দীপনার এক ঢেউ বয়ে গিয়েছিল জেলার এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে। পাবনা জেলার শহর, বন্দর-গ্রামে সেদিন গড়ে উঠেছিলাে। প্রবল প্রতিরােধ বৃহত্তর পাবনার ৯টি থানার প্রত্যন্ত অঞ্চলেও শুরু হয়েছিলাে আসন্ন যুদ্ধের প্রস্তুতি।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান -ষষ্ঠ খন্ড

 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!