প্রতিরােধ যুদ্ধে রাজশাহী
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক ভাষণ দেওয়ার পর থেকে দেশটি প্রকৃতপক্ষে তার নির্দেশেই চলছিল। তিনি অসহযােগ আন্দোলনের কর্মসূচি ঘােষণা করলেন। রাজশাহীর। জনগণও এ অসহযােগ আন্দোলনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী রাজশাহীর অসহযােগ আন্দোলন দমন করার জন্য ৯ মার্চ রাজশাহীতে কারফিউ জারি করে। আওয়ামী লীগের নেতা এ এইচ এম কামারুজ্জামান ও ন্যাপ নেতা আতাউর রহমান এ কারফিউ জারির তীব্র নিন্দা করে বিবৃতি প্রদান করেন। ১১ মার্চ জননেতা কামারুজ্জামান ভুবনমােহন পার্কে এক জনসভায় পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে জোরালাে বক্তৃতা দেন। ঐ সভাতেই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের বক্তৃতার টেপও বাজানাে হয়। রাজশাহীতে প্রথম মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র লড়াই শুরু হয়েছিল ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ। ১জন পাঞ্জাবি ক্যাপ্টেনের নেতৃত্বে কয়েকজন সৈন্য রহনপুর ইপিআর ক্যাম্পে বাঙালি সৈন্যদের নিরস্ত্র করতে গেলে বাঙালি সৈন্যরা পাঞ্জাবি সৈন্যদের লক্ষ্য করে গুলি ছােড়ে। পরদিন ২৪ মার্চ ১জন ক্যাপ্টেনের নেতৃত্বে কয়েকজন সৈন্য ঘটনা তদন্ত করতে গেলে বাঙালি হাবিলদার আক্কাস পাঞ্জাবি ক্যাপ্টেনকে গুলি করে হত্যা করেন। ২৩ মার্চ প্রতিরােধ ও ২৪ মার্চ পাঞ্জাবি ক্যাপ্টেনকে। হত্যার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেন মুক্তিকামী বাঙালি ইপিআর সদস্যরা। এর পর ২৬ মার্চের ঘটনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এদিন সকালে বিদেশি রেডিও’র সংবাদে রাজশাহী জেলার চারঘাট থানার মীরগঞ্জ প্লাটুন সদর দপ্তরের ইপিআর-এর নায়েব সুবেদার সিরাজ উদ্দিন লস্কর জানতে পারেন, ২৫ মার্চ রাতে ঢাকার ইপিআর সদর দপ্তর পিলখানা ও রাজারবাগ পুলিশ সদর দপ্তরে পাকিস্তান সেনাবাহিনী হামলা চালিয়ে বহু বাঙালি ইপিআর ও পুলিশকে হত্যা করেছে। সুবেদার লস্কর এ খবর শুনে অস্থির হয়ে ওঠেন।
চারঘাট কোম্পানি সদর দপ্তরে কোম্পানি অধিনায়ক সুবেদার হাসান আলীর সঙ্গে আলােচনা করলে তিনি বিরক্তি বােধ করে। ঐ সুবেদার ছিলেন পাকিস্তানপন্থি। এদিকে কোম্পানি অধিনায়ককে উপেক্ষা করে ২৬ মার্চের রাতে গােপনে তিনি লােক মারফত চিলমারী ও আলায়পুর বিওপিতে খবর পাঠান যে, বাঙালি সৈনিকেরা যেন কৌশলে অবাঙালিদের নিরস্ত্র করে ফেলে। সিরাজ উদ্দিন লস্কর মীরগঞ্জ বর্ডার আউট পােস্টে বাংলাদেশের পতাকাও উড়িয়েছিলেন। সুবেদার সিরাজ উদ্দিন লস্কর তার এলাকার বর্ডার আউট পােস্টে নিয়ােজিত সব অবাঙালি ইপিআর সদস্যদের কান্নাকাটির শব্দ শুনে। পাকিস্তানপন্থি কোম্পানি অধিনায়ক সুবেদার হাসান আলীকে অস্ত্র ত্যাগ করার নির্দেশ দেন। এ নির্দেশ মানতে না চাইলে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত সিরাজ। উদ্দিন ক্ষিপ্রগতিতে ছুটে গিয়ে কোম্পানি অধিনায়কের পিস্তলটি ছিনিয়ে নেন এবং অধিনায়কসহ ধৃত সব অবাঙালি ইপিআর সদস্যকে চারঘাট থানা হাজতে পাঠিয়ে দেন।
এ ঘটনার পর নায়েব সুবেদার সিরাজ উদ্দিন সারদা পুলিশ ট্রেনিং কলেজের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সব ঘটনা জানান। পুলিশ ট্রেনিং কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল মি, বড়ুয়া ও অন্যান্য কর্মকর্তা সিপাহিদের এ বিদ্রোহে পূর্ণ সহযােগিতা করেন। ট্রেনিং কলেজের কর্মকর্তাদের সম্মতিতে অস্ত্রাগারের তালা ভেঙে ফেলা হয়। সারদা পুলিশ ট্রেনিং কলেজের অল্প দূরেই অবস্থিত তত্ত্বালীন। আইয়ুব ক্যাডেট কলেজের ক্যাপ্টেন আব্দুর রশীদ তাদের সঙ্গে যােগ দেন। এভাবে এ অঞ্চলে গড়ে ওঠে পুলিশ, ইপিআর, আনসার ও ছাত্র-জনতার ঐক্যবদ্ধ এক বিরাট মুক্তিবাহিনী। পাকিস্তানি বাহিনী যাতে রাজশাহী শহরের দিকে যেতে না পারে, সে জন্য তারা আড়ানী ব্রিজের কাছে অবস্থান নেন। ৩১ মার্চ এ সম্মিলিত বাহিনীর একটি অংশ রাজশাহী এসে পৌছায় এবং বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় অবস্থান নেয়। সে সময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনাে পাকিস্তানি সৈন্য ছিল না। এ অবস্থায় সম্মিলিত বাঙালি বাহিনীকে সহযােগিতা করার জন্য ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীরা এগিয়ে আসেন। সে সময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হুসাইন। সিরাজ উদ্দিন লস্কর কয়েকজন সঙ্গীসহ উপাচার্যের বাসায় যান এবং তাকে মুক্তিবাহিনীর জন্য খাদ্য সংগ্রহে সহযােগিতা করার অনুরােধ করেন, কিন্তু ভিসি সাজ্জাদ হুসাইন তাদের অনুরােধ প্রত্যাখ্যান করেন। এ ঘটনায় মুক্তিবাহিনী। অপেক্ষা করতে থাকে প্রতিশােধ নেয়ার জন্য। তারা অপেক্ষা করছিল ক্যাপ্টেন সাহেবের অনুমতির জন্য। ক্যাপ্টেনের অনুমতি ছাড়া ভাইস চ্যান্সেলরের বাড়িতে কিছু ঘটানাে ঠিক হবে না। এমন সময় ভিসি সাজ্জাদ হুসাইনের বাসার একজন চাকর দ্রুত এসে খবর দিলাে যে, ভিসি সাহেব সেনানিবাসে ফোন করে মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের কথা জানিয়েছে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী কিছুক্ষণের মধ্যে এসে পড়বে।
আপনারা তার আগেই স্থান ত্যাগ করুন। এ অবস্থায় মুক্তিবাহিনীর সবাই বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার পূর্ব পাশে হর্টিকালচার খামারের কাছে একটা ইটের ভাটায় আশ্রয় নেয়। ভিসি সাজ্জাদ হুসাইনের ডাকে তখন থেকেই পাকিস্তানি বাহিনী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আস্তানা গাড়ে রাতের অন্ধকারে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি সৈন্যদের খোঁজে তালাইমারী পেরিয়ে রাজশাহী শহরে প্রবেশ করে। তাদের একটা গ্রুপ বরকুটি পাড়ার এক বাড়ির ছাদে এলএমজি নিয়ে পজিশন নেয়, আরেকটা অংশ পজিশন নেয় রানীবাজারে বাটার মােড়ে এ সময় পাকিস্তানি সৈন্যদের ১টি লরি সেনানিবাসের দিক থেকে রানীবাজারে এসে পৌছুতেই অপেক্ষমাণ মুক্তিবাহিনীর পক্ষ থেকে লরিটিকে লক্ষ্য করে ব্রাশ ফায়ার করা হয়। পাকিস্তানি সেনারা দ্রুত লরিটি ঘুরিয়ে নিয়ে। পালিয়ে যায়। শহরে ছাত্র ও যুবসমাজ আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল সবাই।
মুক্তিবাহিনীর সহায়তায় এগিয়ে আসে। শহরে মাইকযােগে ঘােষণা দেওয়া হয়, রাজশাহী শহর এখন হানাদারমুক্ত। ক্যাপ্টেন গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী এ সময় রাজশাহী কোর্টের উত্তর দিকে এসে পৌঁছান। তিনি ৫৪ ইপিআর কোম্পানি, পুলিশ ও আনসারসহ পশ্চিম দিক থেকে শহরে প্রবেশ করেন। ক্যাপ্টেন গিয়াস পূর্ব দিক থেকে আসা সম্মিলিত বাহিনী এবং তার সাথে আসা সবাইকে তার। কমান্ডের অধীন নিয়ে নেন। ৪ এপ্রিল ক্যাপ্টেন গিয়াস মুক্তিবাহিনীর ১টি গ্রুপকে সেরিকালচার ইনস্টিটিউটের পাশে রেললাইনের উত্তরে পজিশন নিতে বললেন ইতােমধ্যে গােলাবারুদ কমে যাওয়ায় সিরাজ উদ্দিন লস্কর একটি জিপগাড়ি নিয়ে ছুটে গেলেন তার পুরাতন কর্মস্থল চারঘাটে। ৩ এপ্রিল থেকে পাকিস্তান বিমানবাহিনীর স্যাবর জেট বিমান রাজশাহী শহরে, শহরতলী ও সেনানিবাসের চারপাশে আকাশ থেকে বােমা ফেলছিল এবং গুলিবর্ষণ করছিল সেনানিবাসের আটকে পড়া পাকিস্তানি সৈন্যদের মনােবল বাড়ানাের জন্য এবং মুক্তিবাহিনী যাতে সেনানিবাসে সরাসরি হামলা চালাতে না পারে, সে জন্য বিমান থেকে এলােপাতাড়ি গুলি চালাচ্ছিল। এ সময় ক্যাপ্টেন গিয়াস খবর পেলেন, সেনানিবাস থেকে পাকিস্তানি বাহিনী নিকটস্থ অবাঙালি কলােনিতে রাইফেল। সরবরাহ করেছে। এসব রাইফেল পেয়ে অবাঙালিরাও পজিশন নিয়েছে। ক্যাপ্টেন নির্দেশ দিলেন ঐ রাতেই ওদের নিরস্ত্র করতে হবে। নায়েব সুবেদার। লস্করের নেতৃত্বে ১জন নায়েক, কয়েকজন সিপাহি এবং কয়েকজন বাঙালি ও সাওতাল যুবক এ অভিযানে অংশ নিলেন। অবাঙালিদের কাছে অস্ত্র সরবরাহ করা হয়েছে, তা সত্য বলে প্রমাণিত হলাে, যখন তারা সম্মিলিত বাহিনীর উপর গুলি চালাতে শুরু করলাে। উভয় পক্ষের মধ্যে গােলাগুলি শুরু হওয়ার।
অল্পক্ষণের মধ্যেই অবাঙালিরা পরাজিত হলাে। মর্টারের গােলাবর্ষণও করা হলাে। কিন্তু পাকিস্তানি সৈন্যরা তখন নীরব। কারণ, তারা তখন বুঝেছিল যে চারদিক থেকে ঘেরাও হয়ে গেছে। ক্যাপ্টেন গিয়াসের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী শত্রু ছাউনির মাত্র ৩০০-৪০০ গজের মধ্যে পৌছে যায়। কিন্তু শত্রু ছাউনি সেনানিবাস এমনভাবে কাটাতারের বেড়া দিয়ে ঘেরা ছিল যে তা পার হয়ে। ভিতরে প্রবেশ করা সম্ভব ছিল না। তা ছাড়া তারা সেনানিবাসের চারপাশে মাইন পুঁতে রেখেছিল। ২৬ মার্চ পাকিস্তানি সৈন্যরা রাজশাহীর পুলিশ লাইন দখল করার জন্য। পুলিশ লাইনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে পুলিশ লাইনের ভিতর থেকে পুলিশরা সৈন্যদের উপর গুলিবর্ষণ করতে থাকে। উভয় পক্ষের মধ্যে গােলাগুলি শুরু হয়ে যায়। এ সময় পার্শ্ববর্তী এলাকার জনগণ পুলিশের সাহায্যে এগিয়ে আসে। গুলিবিনিময়ের সময় পাকিস্তানি সৈন্যদের গুলিতে কয়েকজন সাধারণ মানুষ শহিদ হন। পুলিশ ও স্বেচ্ছাসেবকদের ইস্পাতকঠিন প্রতিরােধের মুখে পাকিস্তানি সৈন্যরা সেদিনের মতাে পুলিশ লাইন দখলের আশা ত্যাগ করে দূর থেকে পুলিশ লাইনের উপর নজর রাখতে থাকে।
২৭ মার্চ সকালে পুলিশ ও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের এক বৈঠকে উভয় পক্ষই একমত হন যে, কেউ কাউকে আক্রমণ করবে না। এ অবস্থায় আপাতত গােলাগুলি বন্ধ রেখে সৈন্যরা সেনানিবাসে ফিরে যায়। কিন্তু পাকিস্তানি সৈন্যরা তাদের কথা রাখেনি। দুপুরের মধ্যেই তারা আগের চেয়ে আরও আধুনিক ও ভারি অস্ত্র নিয়ে এসে পুলিশ লাইন ও ইপিআর ক্যাম্প টার্গেট করে অবস্থান নিলাে দুপুর আড়াইটার দিকে শহর কাপিয়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা পুলিশ লাইন ও ইপিআর ক্যাম্পে মর্টার শেলিং শুরু করলাে শুরু হলাে অবিশ্রান্ত মেশিনগানের গুলি নিরস্ত্র মানুষ আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে উঠলাে। পুলিশ লাইনের চত্বরে রক্তের বন্যা বয়ে গেল বারুদের গন্ধে সারা শহরের বাতাস ভারি হয়ে গেল। এসপি শাহ আব্দুল মজিদ নিজে উপস্থিত থেকে পাকিস্তানি। সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে তখন রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের নেতৃত্ব দেন। মরিয়া হয়ে পুলিশ বাহিনী যুদ্ধ করলেও পাকিস্তানি সৈন্যদের আধুনিক, ভারি ও শক্তিশালী অস্ত্রের মুখে কতক্ষণ আর টিকে থাকতে পারে! সেনাবাহিনীর মর্টার আর মেশিনগানের গুলিতে পুলিশ লাইন বিধ্বস্ত হলাে। ইপিআর ক্যাম্পেও একই ঘটনা ঘটলাে। বাঙালিরা পরবর্তী যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়ার জন্য পিছিয়ে গেল, কিন্তু আত্মসমর্পণ করে নি।
এপ্রিলের প্রথম দিকে রাজশাহীর দিকে ধাবমান পাকিস্তানি সৈন্যদের বিরাট এক বহর সামনে যা কিছু পেয়েছে, তা-ই ধ্বংস করেছে, জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে সব কিছু ছারখার করে দিয়েছে। রাজশাহী শহর থেকে ১৪ মাইল দূরে ঝলমলিয়া হাটে এ বহর যখন পৌছায়, তখন হাট চলছিল। পাকিস্তানি বাহিনী সেখানে। পৌছানাের কয়েক মিনিটের মধ্যে তাদের দ্বারা সবকিছু ছারখার হয়ে দাউদাউ করে আগুন জ্বলে ওঠে। ২ কোটি টাকার সম্পদ ভস্মীভূত হয়। অসংখ্য মানুষের লাশ হাট এলাকা ও পার্শ্ববর্তী স্থানে পড়ে থাকতে দেখা যায়। কিন্তু বিশাল সেনাবাহিনী একেবারে নির্বিঘ্নে রাজশাহী চলে আসতে পারে নি। বীর। মুক্তিযােদ্ধারা অসম অস্ত্র নিয়েও পদে পদে তাদের বাধা দিয়েছেন আর শহিদ হয়েছেন। বিড়ালদহ মাজারের কাছে কিছুক্ষণের জন্য হলেও এ বিশাল বহরকে মুক্তিযােদ্ধারা থামিয়ে দিয়েছিল। তারপর বানেশ্বরে বাধা পেল পাকিস্তানি। বাহিনী। কাটাখালীতেও রুখে দাঁড়ালাে বাঙালিরা। যুদ্ধের স্ট্র্যাটেজি অনুযায়ী সৈন্যরা পিছে এসে অবস্থান নিয়েছে ঠিকই, কিন্তু তারা লড়াই করতে করতেই পিছিয়েছে। প্রতি ইঞ্চি অগ্রসর থেকে পাকিস্তানি বাহিনীকে অসংখ্য গুলি ছুড়তে হয়েছে। কয়েক’শ গাড়ির বহর থেকে সামরিক জান্তারা রাস্তার দুই পাশে। অসংখ্য মানুষকে হত্যা করে এবং রাস্তার দুই পাশের গ্রামগুলােয় আগুন জ্বালিয়ে দেয়। ১৩ এপ্রিল দিবাগত রাতে পাকিস্তানি বাহিনীর বিশাল বহর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে আস্তানা গাড়লাে। ভাগ্যের পরিহাস, শহীদের নামে নির্মিত শহিদ শামসুজ্জোহা হলে জল্লাদরা হত্যাকাণ্ডের নীলনকশা প্রণয়নের আখড়া স্থাপন করলাে। রাতেই শুরু হলাে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড। এক হিসাবে দেখা গেছে।
যে, ঐ রাতে রাজশাহী শহরের কেবল রানীনগর মহল্লাতেই ১৫০জন মানুষকে হত্যা করেছিল হানাদার সৈন্যরা। পাকিস্তানি বাহিনীর বিশাল বহর রাজশাহী। প্রবেশ করে ব্যাপকভাবে গােলাবর্ষণ করতে থাকে। মর্টার শেলিং ও রকেট আক্রমণ শুরু হয়। এ সময় মুক্তিযােদ্ধারা পিছিয়ে যেতে বাধ্য হন। ৩ ইঞ্চি। মর্টার থেকে অগ্রসরমাণ শত্রুর উপর গােলাবর্ষণ শুরু হলাে। সারারাত দুই। পক্ষের লড়াই চলে (১২ এপ্রিল রাত) এবং কাছে সারদা ক্যাডেট কলেজের অধ্যাপক এ বি সিদ্দিকীসহ বেশ কয়েকজন মুক্তিযােদ্ধা সে যুদ্ধে শহিদ হন। পরবর্তীতে তাকে বীরবিক্রম (মরণােত্তর) উপাধিতে ভূষিত করা হয়। এর পর ১২ এপ্রিল ভােরের দিকে পাকিস্তানি বাহিনী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পৌছে যায়। ১২-১৪ এপ্রিল রাত ২টার দিকে বৃষ্টির মতাে গুলিবর্ষণ শুরু হয় এবং শক্রর গােলন্দাজ বাহিনী বিপুলভাবে গােলাবর্ষণ শুরু করে। যতই ভাের হতে থাকে, আমাদের লােকদের সাথে ওয়্যারলেস ও টেলিফোন যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ভাের সাড়ে ৫টার দিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১ ব্রিগেড সৈন্য মুক্তিযােদ্ধাদের উপর ঝাপিয়ে পড়ে এমতাবস্থায় প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে টিকতে। পেরে মুক্তিবাহিনী নবাবগঞ্জের দিকে পিছু হটে।
প্রতিরােধ যুদ্ধে নাটোর
১৯৭১ সালের ২৮-২৯ মার্চ ওয়ালিয়া (লালপুর) থানায় সংঘটিত হয় প্রথম প্রতিরােধ হাজার হাজার জনতার প্রতিরােধে পাকিস্তানি বাহিনীর গুলিতে বেশ কিছু মুক্তিযােদ্ধা শহিদ হন। এ যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর গােলন্দাজ ইউনিটের নেতৃত্ব দেন মেজর রাজা। মেজর রাজাসহ ৩জন অফিসার ও শতাধিক পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। এ পাকিস্তানি গ্রুপকে সহায়তা করার জন্য রাজশাহী সেনানিবাস থেকে আরেকটি গ্রুপ রওনা হলে নন্দনগাছি ও চারঘাট এলাকায় প্রতিরােধের মুখে পড়ে পাকিস্তানি সেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। তাদের। ৩০-৩৫জনের ১টি দল গ্রামের ভিতর দিয়ে পুঠিয়ার দিকে অগ্রসর হওয়ার সংবাদ পেয়ে নাটোরের অ্যাডভােকেট সাজেদুর রহমান খানের নেতৃত্বে পুঠিয়ার ভিতর ভাগে সম্মুখযুদ্ধ হয়।
ঐ যুদ্ধে সরাসরি গুলিতে প্রায় ১৭-১৮জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। পাকিস্তানি বাহিনীর প্রায় ১৬-১৭জন পরে স্থানীয় জনগণের গণপিটুনিতে মারা যায়। মুক্তিযােদ্ধা হাজি উমর সরাসরি গুলিতে শহিদ হন। ২৯ মার্চ নাটোর সংগ্রাম কমিটি ও ছাত্রদের ইস্পাতদৃঢ় সংগ্রামী আকাক্ষা ও হাতিয়ার প্রাপ্তির দুর্দমনীয় ইচ্ছার কাছে এবং হাজার হাজার জনতার থানা অবরােধের সামনে উপস্থিত নেতাদের চাপে পড়ে জনরােষ ঠেকাতে মহকুমা প্রশাসকের আদেশে থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বাধ্য হয়ে অস্ত্রাগারের তালা খুলে দিয়ে। উপস্থিত ছাত্র ও সগ্রাম বাহিনীর নেতাদের কাছে ২৫০টি রাইফেল ও গােলাবারুদ হস্তান্তর করেন, যা সেখানেই প্রশিক্ষণদানকারী আনসার অধিনায়ক অবসরপ্রাপ্ত সামরিক সদস্য, ইপিআর, পুলিশ বাহিনীর কাছে এবং এনএস কলেজের পুরাতন ছাত্রাবাসে প্রশিক্ষণ গ্রহণকারী ছাত্রদের মধ্যে তাৎক্ষণিকভাবে বিতরণ করা হয়। অন্যদিকে, মুক্তিপাগল জনতা রেলগেটে এবং নাটোররাজশাহী রােডে ব্যারিকেড সৃষ্টি করে। পাকিস্তানি বাহিনীর সম্ভাব্য আক্রমণে ৩০ মার্চ আনসার ও সদ্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জয় বাংলা বাহিনীর ১টি দল নাটোর। মহাসড়ক রােডে ভােকেশনাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের মধ্যে প্রশিক্ষণ দান করে। ১ এপ্রিল সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে, নাটোর রেলগেটের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে অবাঙালি পাড়ায় পাকিস্তানি বাহিনী অবস্থান নিয়েছে। এ সংবাদ দাবানলের মতাে ছড়িয়ে পড়ে। এতে জনতা ও ছাত্র লাঠি, তীর বন্দুক, রামদা দিয়ে অবরােধ ও আক্রমণ পরিচালনা করলে উদ্ধৃঙ্খল জনতার হাতে কিছু অবাঙালি নিহত হয় এবং তাদের ঘরবাড়িসহ মালামাল লুট হয়ে যায়।
অবাঙালি পাড়ায় পাকিস্তানি বাহিনীর কোনাে সদস্য ধরা না পড়লেও ২টি ওয়্যারলেস পাওয়া যায়। সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ক্যাম্প স্থাপন করে নিরাপত্তা ও আহারাদির ব্যবস্থা করা হয়। এরই মধ্যে একদল সুযােগসন্ধানী অবাঙালি ধরার অজুহাতে শহরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটিয়ে লুটতরাজ করার পাঁয়তারা চালাতে থাকে। এ নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড রােধের অভিপ্রায়ে সর্বদলীয় শান্তি কমিটি গঠন করে প্রাক্তন চাখানার দোতলায় কন্ট্রোলরুম স্থাপন। করা হয় এবং সেখান থেকে এর নেতৃত্ব দেন বাবু শংকর গােবিন্দ চৌধুরী, আনিসুর রহমান, সাজেদুর রহমান, খন্দকার আবু আলী, দুদু চৌধুরী, আবদুর রহমান প্রমুখ। উল্লেখ্য যে, ৮ মার্চ থেকে নাটোরের ছাত্রনেতারা এনএম কলেজের পুরাতন ছাত্রাবাসের (বর্তমানে রানী ভবানী মহিলা কলেজ) মাঠে জয় বাংলা বাহিনী গঠন করে গােপনে ইউওটিসি-এর কাঠের রাইফেল দিয়ে প্রশিক্ষণ কাজ শুরু করেছিল। অতঃপর ২ এপ্রিল স্বাধীন বাংলা সংগ্রাম কমিটির সিদ্ধান্ত। মােতাবেক (পূর্বোক্ত আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ সংগ্রাম কমিটি) জয় বাংলা বাহিনী গঠন এবং ব্যাপক ভিত্তিতে প্রশিক্ষণদানের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে আনসার অধিনায়ক ইউসুফ মােজাম্মেল, মেহের আলী, জামশেদ এবং তৎকালীন নাটোরের মহাকুমা খাদ্য নিয়ন্ত্রক (যিনি সাবেক সৈনিক ছিলেন এবং নাটোর শহর অবরুদ্ধ হওয়ার পর পূর্বোক্ত কার্যকলাপের জন্য পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে কর্তব্যরত অবস্থায় শহিদ হন) নাজির উদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে ৭ দিনব্যাপী প্রশিক্ষণ কার্যক্রম এনএস কলেজের পুরাতন ছাত্রাবাস মাঠে শুরু হয়। এ প্রশিক্ষণ ব্যাচের প্রথম দফায় ৬০জন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
এদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য মুজিবুর রহমান রেজা, গােলাম রাব্বানী, সেলিম চৌধুরী, কামরুল ইসলাম, মুজিবুর রহমান সেন্টু, আলাউদ্দিন, টিপু চৌধুরী, আব্দুল। জব্বার, আব্দুল মজিদ, কাইয়ুম, রাজ্জাক, হেপী, অনাদী শেখর দত্ত এবং আরও অনেকে এ ধারাবাহিকতায় নাটোর শহর অবরুদ্ধ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এ প্রশিক্ষণ কার্যক্রম অব্যাহত ছিল। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযােদ্ধাদের খাওয়া ও থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এভাবে নাটোরবাসী মিছিল, মিটিং, প্রশিক্ষণ গ্রহণ বা প্রদানের মাধ্যমে হানাদারমুক্ত সদ্য স্বাধীন দেশের নাগরিকের মতাে পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত করার সার্বক্ষণিক প্রস্তুতি নিয়ে দিনাতিপাত করতে থাকে।
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান -ষষ্ঠ খন্ড