প্রতিরােধ যুদ্ধে চাঁপাইনবাবগঞ্জ
চাপাইনবাবগঞ্জ জেলা ১৯৭১ সালে রাজশাহী জেলার একটি মহকুমা ছিল। মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তান সৈন্যদের মধ্যে অনেক খণ্ডযুদ্ধ সংঘটিত হয়। এসব যুদ্ধে ভারতের কোনাে বড় ধরনের সাহায্য ছাড়াই মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি সৈন্যদের পিছু হটতে এবং পালিয়ে যেতে বাধ্য করে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ ছিল ৭ নম্বর সেক্টরে। একটি বিশেষ লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, নবাবগঞ্জে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয় ১৯৭১ সালের ১২ মার্চ, যা ছিল এ ধরনের দ্বিতীয় ঘটনা। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের গণহত্যার পর চাঁপাইনবাবগঞ্জে ক্রমান্বয়ে যুদ্ধ সংঘটিত হতে শুরু করে। ২৬ মার্চ বিকালে শহরে কারফিউ জারি করা হয়। ইপিআর-এর ৬ নম্বর শাখার কর্তৃপক্ষ এ শাখার বাঙালি ইপিআর সদস্যদের নিরস্ত্র করার চেষ্টা করে। বাঙালি ইপিআর সদস্যরা বিপদ আঁচ করতে পেরে নিজেদের নিরস্ত্র হওয়া থেকে বিরত রাখে। ২৬ মার্চে বাঙালি ইপিআর সদস্যদের হুমকি দেওয়া হয় যাতে তারা সাধারণ জনগণকে সহায়তা না করে। ঢাকায় ইপিআর সদস্যদের হত্যার সংবাদ পাওয়ার পর চাঁপাইনবাবগঞ্জের বাঙালি ইপিআর সদস্যরা সতর্ক হয়ে যান। পরবর্তী সময় তারা পাকিস্তানি সৈন্য কর্তৃক তাদের হত্যার পরিকল্পনা এবং পাকিস্তানি সৈন্যদের রাজশাহী স্থানান্তরের পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে পেরে বাঙালি ইপিআর সদস্যরা বিদ্রোহ করেন এবং জনগণের সহায়তায় পরিস্থিতি তাদের নিয়ন্ত্রণে আনেন। পাকিস্তানি ইপিআর সৈন্যরা রাজশাহীতে পালিয়ে যায় এবং চাপাইনবাবগঞ্জ পাকিস্তানি আগ্রাসন থেকে মুক্ত থাকে ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের শেষ পর্যন্ত ১৭ এপ্রিল চাপাইনবাবগঞ্জ পুনরায় হুমকির সম্মুখীন হয়, যখন শত্রুর ৩টি জেট বিমান শহরের উপর আক্রমণ করে। পাকিস্তানি সৈন্যদের বহনকারী ১০৬টি গাড়ির। বহর ২১ এপ্রিল চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরে কোনােরকম বাধা ছাড়াই প্রবেশ করে। এভাবে চাপাইনবাবগঞ্জ পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে চলে যায়।
বাগাতিপাড়ার যুদ্ধ
ভূমিকা
নাটোরে সংঘটিত খণ্ডযুদ্ধগুলাের ধারাবাহিকতায় যখন পাকিস্তানি বাহিনী রাজশাহী এবং এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলােয় তাদের ক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে পর্যায়ক্রমে নাটোর জেলার পাশ দিয়ে যেতে থাকে, তখনই স্থানীয় মুক্তিবাহিনী ও সাধারণ জনগণ তাদের সর্বস্ব দিয়ে পাকিস্তানিদের উপর ঝাপিয়ে পড়ে। সে সময়ের মুক্তিপাগল দুঃসাহসী নাটোরবাসী অনেক পাকিস্তানিকে হত্যা করে ছিনিয়ে নিয়েছিল তাদের অস্ত্র, গােলাবারুদসহ যাবতীয় সব সামগ্রী। এরই পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তী সময় পাকিস্তানিরা নাটোরের অন্যান্য অঞ্চলের ন্যায় বাগাতিপাড়ায়ও চালিয়েছিল তাদের নারকীয় তাণ্ডবলীলা। পটভূমি নাটোরে পাকিস্তানিদের উপর বাঙালিদের যাবতীয় আচমকা আক্রমণ প্রতিরােধ। করতে এবং অত্র অঞ্চলে তাদের প্রভাব বিস্তারের লক্ষ্যেই দয়ারামপুরে তারা একটি ক্যাম্প স্থাপন করে। মূলত এখান থেকেই অত্র অঞ্চলে শুরু হয় পাকিস্তানিদের পরবর্তী সকল কার্যক্রম। পাকিস্তানিরা তাদের স্থানীয় দালালদের সহায়তায় বাগাতিপাড়ায় একের পর এক বর্বর হত্যাকাণ্ড, লুণ্ঠন ও ধর্ষণসহ নানারকমের অপকর্ম চালাতে থাকে স্থানীয় জনগণ যখন পাকিস্তানিদের অত্যাচারে জর্জরিত ছিল, তখনই স্থানীয় মুক্তিবাহিনী নৈতিকতার বিবেচনায় সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, পাকিস্তানিদের ঐ অঞ্চল থেকে তাড়ানাের । তারই সূত্র। ধরে কোনাে এক হাটের দিনে আচমকা মুক্তিবাহিনী অত্যন্ত সুপরিকল্পিত ও সুসংগঠিতভাবে পাকিস্তানি ক্যাম্পে আক্রমণ করে এবং রাজাকার ও পাকিস্তানি বাহিনীর অনেক সদস্যকে হত্যা করে।
ভূমি পরিচিতি
নাটোরের বাগাতিপাড়া থানাটি নাটোর জেলা সদর থেকে ১৫ কিলােমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত। এর দক্ষিণে লালপুর এবং পূর্বে নাটোর সদর। বাগাতিপাড়া থানায় বিস্তৃত খােলা ভূমি লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, হালকা গাছপালা দ্বারা ঐ অঞ্চলটি পরিবেষ্টিত। এলাকার ভূমিতে শুষ্ক মৌসুমে যেকোনাে বড়াে ধরনের সৈন্য চলাচলে সক্ষম। এলাকার রাস্তাঘাটের মধ্যে। বাগাতিপাড়া-বগুড়া পাকাসড়ক, যা সব ধরনের যানবাহন চলাচলের উপযােগী। বর্ষা মৌসুমে ঐ খােলা ভূমিতে পানি জমে থাকে, যা স্বাভাবিক চলাচলে বিয়ের সৃষ্টি করে।
যুদ্ধের সংগঠন
যুদ্ধের সংগঠন নিম্নরূপ: ক, পাকিস্তানি বাহিনী: ২টি পাঞ্জাব রেজিমেন্টাল কোম্পানি। খ. মুক্তিবাহিনী: ১টি আনসার কোম্পানি এবং অগণিত অপ্রশিক্ষিত স্থানীয় জনগণ। শত্রুপক্ষের বিন্যাস। পাকিস্তানি বাহিনীর পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ১টি দল রাজশাহী সেনানিবাস অভিমুখে যাত্রা করলে বাগাতিপাড়ার বড়াল নদের তীরে লােকমানপুর রেল স্টেশনে যাওয়ার পথে গালিমপুরে মুক্তিকামী স্থানীয় জনতা ও আনসার কর্তৃক বাধাপ্রাপ্ত হয়ে সরাসরি আক্রমণের মুখে পতিত হয়। এ আক্রমণে পরাজিত হওয়ার পর স্থানীয় শান্তি কমিটির সহায়তায় বাগাতিপাড়ার (বর্তমানে কাদিরাবাদ সেনানিবাসসংলগ্ন) দয়ারামপুর বাজারে তাদের ক্যাম্প স্থাপন করে। সেখান থেকেই পরবর্তী সময় তারা বাগাতিপাড়ার বিভিন্ন স্থানে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করেছিল। যুদ্ধের বিবরণ ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের স্বাধীনতা আন্দোলনের ঘােষণার পর বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকার ন্যায় নাটোরেও গঠিত হয় মুক্তিযােদ্ধা সংগ্রাম পরিষদ। এ পরিষদ তকালীন অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আনসার ও উৎসাহিত যুবকদের স্থানীয়ভাবে রাইফেল প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পাকিস্তানি বাহিনীর পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ১টি দল রাজশাহী সেনানিবাস অভিমুখে যাত্রা করে বাগাতিপাড়া থানার অন্তর্বর্তী বড়াল নদের তীর দিয়ে লােকমানপুর রেল স্টেশনের পথে যাওয়ার সময় গালিমপুর বিলের কাছে মুক্তিযােদ্ধাদের সরাসরি আক্রমণের মুখে পতিত হয়। ঐ আক্রমণের মুখে আল-বদর, রাজাকারসহ পাকিস্তান বাহিনীর ৪জন সদস্য পালিয়ে যাওয়ার সময় গালিমপুর মসজিদের কাছে ধরা পড়ে এবং তাদের সেখানে হত্যা করা হয়। পাকিস্তানি হানাদারদের গণকবর বাগাতিপাড়া থানার পশ্চিম পাশে নদের অপর প্রান্তে অবস্থিত। গালিমপুর বিলের আক্রমণে পশ্চাদপসরণরত কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা অত্র থানার জামনগর ইউনিয়নের স্বাধীনতাকামী জনতার হাতে ধৃত ও নিহত হয়। পরবর্তী সময় পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিযােদ্ধাদের আক্রমণে দিশেহারা হয়ে স্থানীয় দালালদের সহায়তায় বাগাতিপাড়া থানায় রাজাকারদের নিয়ে একটি অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করে, যার প্রধান কার্যালয় স্থাপিত হয় বর্তমানে কাদিরাবাদ সেনানিবাসসংলগ্ন দয়ারামপুর বাজারে। ঐ ক্যাম্পে রাজাকারদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ বাঙালিরা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযােদ্ধাদের জানালে কাজীপাড়া (ভারত) অপারেশনাল ক্যাম্পের তত্ত্বাবধানে নাটোর এলাকার মুক্তিযােদ্ধাদের ১টি দল সম্ভবত ২২ সেপ্টেম্বর কোনাে এক হাটের দিনে পাকিস্তানি বাহিনীর দোসরদের ক্যাম্পে আচমকা আক্রমণ করে তা দখল ও ভস্মীভূত করে। ঐ আক্রমণে কয়েকজন মুক্তিযােদ্ধা আহত হলেও কেউ মারা যায় নি। ঈশ্বরদীতে অবাঙালিদের (বিহারি) আবাসস্থল ও রেলওয়ে জংশন ছিল।
সেখান থেকে পশ্চিমাঞ্চলের রেলওয়ের মাধ্যমে পাকিস্তানি হানাদারদের চলাচল ও রসদ সরবরাহ করা হতাে। এ সরবরাহ বন্ধ করতে অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে অত্র থানার প্রবেশপথে মাড়িয়ার নেংটিপাড়া নামক স্থানে স্থলমাইন দ্বারা ঈশ্বরদী থেকে রাজশাহীগামী পাকিস্তানি সৈন্য বহনকারী একটি ট্রেন উড়িয়ে দেওয়া হয়। এতে রেললাইনসহ ৪টি বগি বিধ্বস্ত হয় এবং পাকিস্তানি বাহিনীর অনেক সদস্য হতাহত হয়। প্রতিশােধের আগুনে পাকিস্তানি বাহিনী দিশেহারা হয়ে মাড়িয়া গ্রামে আচমকা আক্রমণ চালায়, কিন্তু সেখানে কোনাে মানুষকে না পেয়ে প্রায় শতাধিক বাড়িতে অগ্নিসংযােগ করে ঐ গ্রামকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়। সান্তাহারে অবাঙালিদের বিশাল আবাসস্থলে পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের স্থানীয় দোসররা অত্যাচারের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। তাই রেলওয়ে যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন করার জন্য ধুলাউড়া ব্রিজে আক্রমণ করা হয়। এতে ব্রিজের আংশিক ক্ষতি সাধিত হয়।
ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে নওসেরা গ্রামের কলকুঠী নামক স্থানে ইংরেজদের এক পরিত্যক্ত বাড়িতে পাকিস্তানি বাহিনী পরবর্তী সময় তাদের আরেকটি ক্যাম্প স্থাপন করে। যেখান থেকে বাগাতিপাড়ায় ব্যাপক আক্রমণের প্রস্তুতিকালে ১০ ডিসেম্বর আচমকা মুক্তিবাহিনীর দ্বিমুখী আক্রমণে পাকিস্তানি সৈন্যরা দিশেহারা হয়ে থানায় আশ্রয় নেয়। ১৩ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী থানা আক্রমণ করলে পাকিস্তানি বাহিনী কিছু মালামাল ও রসদ রেখে নাটোর সদরে পলায়ন করে। ১৪ ডিসেম্বর থানায় স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে বাগাতিপাড়া থানা পাকিস্তানি হানাদারদের দখলমুক্ত হয়। বিশ্লেষণ ও পর্যালােচনা মুক্তিবাহিনীর বিজয়ের কারণ বাগাতিপাড়ায় সংঘটিত অধিকাংশ খণ্ডযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর ব্যাপক ক্ষতি হয়। পর্যালােচনা করে দেখা যায় যে, বাঙালিদের বিজয়ের কারণগুলাে ছিল নিম্নরূপ:
ক, স্থানীয় সাহায্য: বাগাতিপাড়ার যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী স্থানীয় অধিবাসী কর্তৃক পেয়েছিল ব্যাপক সাহায্য ও সহযােগিতা, যা পরবর্তী সময় একটা যুদ্ধ জয়ের জন্য অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়। স্থানীয় লােকজন পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থান সম্পর্কে জেনে মুক্তিবাহিনীকে গােপনে অবহিত করত এবং তারা সে অনুযায়ী পাকিস্তানি বাহিনীর উপর আচমকা আক্রমণ করে। এভাবে স্থানীয় সাহায্য পাওয়ার ফলে বাগাতিপাড়ায় মুক্তিবাহিনীর বিজয় নিশ্চিত হয়েছিল। যুদ্ধের যথার্থতা: ১৯৭১ সালের যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর লড়াই ছিল সময়ের প্রয়ােজনে অস্তিত্বের লড়াই। স্বাধীনতার প্রশ্নে যুদ্ধে তাদের ছিল অফুরন্ত মনােবল। অন্যদিকে, পাকিস্তানিরা ছিল নৈতিকতার দিক দিয়ে। দুর্বল এবং যুদ্ধ করার তেমন যথার্থ কারণও ছিল না। গ, আবহাওয়ার প্রভাব: মুক্তিবাহিনী এখানকার আবহাওয়ার সাথে পরিচিত ছিল। তারা জানতাে, কখন কী ধরনের আবহাওয়া অত্যাসন্ন। অন্যদিকে, পাকিস্তানিরা নতুন স্থানে ঐ অঞ্চলের আবহাওয়ার সাথে পরিচিত হতে তাদের অনেক সময় লেগেছিল। তাই মুক্তিযােদ্ধাদের জয় হয়েছিল সহজতর। বৃষ্টি ও অন্ধকার রাতেও মুক্তিবাহিনী অনেক অপারেশন সফলতার সাথে করতে পেরেছে। স্থানীয় এলাকার পরিচিতি: বাগাতিপাড়ার যুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধারা এমন ভূমিতে যুদ্ধ করেছে, যা ছিল তাদের পূর্বপরিচিত। স্থানীয় রাস্তাঘাট, নদী সবই ছিল তাদের পরিচিত। আর এ পরিচিতিই পরবর্তী সময় তাদের যাবতীয় সব কর্মকাণ্ডে সহায়তা করেছিল। ঙ, গােপনীয়তা: অনেক স্থানে মুক্তিবাহিনীর ছিল সঠিক ও সুসংগঠিত গুপ্তবার্তা প্রবাহ। যে-কোনাে স্থান থেকে পাকিস্তানিরা কোথাও যাত্রা করলে তা মুক্তিবাহিনী দ্রুত সংবাদ পেত এবং সে অনুযায়ী তাদের উপর ঝাপিয়ে পড়ত। এভাবে পাকিস্তানিদের অনেক ধ্বংস সাধিত হয়েছে বাঙালিদের হাতে। কাজেই গােপনীয়তা বজায় রাখা যে কোনাে যুদ্ধের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ এক শর্ত। পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয়ের কারণ। বাগাতিপাড়ার বিভিন্ন খণ্ডযুদ্ধে পাকিস্তানিরা ব্যাপকহারে পরাজিত হয়েছিল। এর মধ্যে উল্লেখযােগ্য কয়েকটি কারণ হচ্ছে নিম্নরূপ: ক. মুক্তিবাহিনীকে দুর্বল মনে করা: পাকিস্তানিরা ছিল অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত, অন্যদিকে বাঙালিরা ছিল প্রায় নিরস্ত্র । তাই স্বভাবতই তাদের মনে একটা অহমিকাবােধ কাজ করেছিল। কিন্তু পরবর্তী সময় বাঙালিদের অফুরন্ত মনােবলের স্রোতে ভেসে গিয়েছিল পাকিস্তানিদের সব অহংকার।
খ, স্থানীয় সমর্থন না থাকা: পাকিস্তানিদের তেমন কোনাে স্থানীয় সহযােগিতা ছিল না। কিছুসংখ্যক স্বাধীনতাবিরােধী রাজাকার ব্যতীত সবাই ছিল তাদের বিপক্ষে। তাই সংগত কারণে তাদের যে-কোনাে ধরনের চলাচল ও পরিকল্পনা মুক্তিবাহিনী আগে থেকেই জেনে যেত। অপরিচিত এলাকা: পাকিস্তানি সৈন্যরা বাগাতিপাড়া এলাকার বিন্যাস সম্পর্কে অবহিত ছিল না। ঐ এলাকা ছিল তাদের প্রায় অচেনা ও অজানা, যা তাদের বিভিন্ন পরিকল্পনায় ব্যাঘাত ঘটাত। শিক্ষণীয় বিষয় প্রতিটি যুদ্ধই কিছু না কিছু শিক্ষণীয় বিষয় রেখে যায়, যা ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় সহায়তা করে। বাগাতিপাড়ার খণ্ডযুদ্ধে শিক্ষণীয় বিষয়গুলাে ছিল নিম্নরূপ: ক, নৈতিকতা: মুক্তিবাহিনী একটি যথাযথ মৌলিক কারণে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল, পক্ষান্তরে পাকিস্তানিদের ছিল না তেমন কোনাে নৈতিক কারণ কাজেই ফলাফলও হয়েছিল মুক্তিযােদ্ধাদের পক্ষে। খ. সমর্থন লাভ: স্থানীয় সমর্থন ব্যতীত যুদ্ধে জয়লাভ করা খুবই দুরূহ ব্যাপার। পাকিস্তানিদের তেমন কোনাে স্থানীয় সমর্থন ছিল না; অন্যদিকে, মুক্তিবাহিনীর ছিল সর্বপ্রকার স্থানীয় সমর্থন, কাজেই যুদ্ধে তাদের জয়লাভ হয়েছিল সহজতর।। গ. অহংকারবােধ: যুদ্ধে প্রতিপক্ষকে দুর্বল মনে করা অনেক সময় পরাজয়ের কারণ হয়ে দেখা দেয়। যেমনটি ঘটেছিল পাকিস্তানিদের জন্য বাগাতিপাড়ায় খণ্ডযুদ্ধে। তারা মুক্তিকামী বাঙালিদের দুর্বল মনে করে তাদের নিজস্ব নিরাপত্তার কোনাে ব্যবস্থা না করে ঐ এলাকায় চলাচল শুরু করে। যার দরুন বীর বাঙালিরা সেদিন তাদের সর্বস্ব দিয়ে পাকিস্তানি সৈন্যদের উপর ঝাপিয়ে পড়ে। কাজেই সংগত কারণে তাদের সব অহমিকাবােধকে বাঙালিরা সেদিন চিরতরে নিঃশেষ করে দেন। উপসংহার মুক্তিযুদ্ধে নাটোরবাসীর অবদান অনস্বীকার্য। তারা শুধু নাটোরকেই মুক্ত করে নি বরং ঢাকা থেকে রাজশাহীগামী পাকিস্তানিদের অনেক বড়াে বড়াে যাতায়াতকে দুঃসাহসের সাথে প্রতিহত করেছে। নাটোরের অন্যান্য স্থানের ন্যায় বাগাতিপাড়ার অগণিত মানুষকেও হারাতে হয়েছিল অসংখ্য প্রাণ এবং অনেকে। হয়েছিল আহত। তাদের স্মৃতির প্রতি আমাদের অগণিত শ্রদ্ধা।
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান -ষষ্ঠ খন্ড