বৃহত্তর রাজশাহী জেলার গণআন্দোলন ও অসহযােগ আন্দোলনের ইতিহাস
১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশন শুরু হওয়ার পর ২৫ ফেব্রুয়ারি ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উর্দু ও ইংরেজির সঙ্গে বাংলাকেও সরকারি ভাষা করার প্রস্তাব করেন। তিনি বলেন “পাকিস্তানের ৬ কোটি ৯০ লক্ষ অধিবাসীর মধ্যে বাংলা ভাষাভাষীর সংখ্যা ৪ কোটি ৪০ লক্ষ। সংখ্যাগরিষ্ঠের কথিত ভাষাই রাষ্ট্রের ভাষা হওয়া উচিত।” তার এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হয় এবং ঢাকায় সংবাদ পৌছার সঙ্গে সঙ্গে যেমন ছাত্র-জনতা প্রতিবাদে ফেটে পড়ে তেমনি রাজশাহীর সংগ্রামী ছাত্র-জনতাও বলিষ্ঠ প্রতিবাদে সােচ্চার হয়। ১১ মার্চ প্রদেশব্যাপী পূর্ণ হরতালের ডাক দেওয়া হয়। কিন্তু তার পূর্বেই অর্থাৎ গণপরিষদের ঘটনার পরপরই রাজশাহীতে প্রচণ্ড বিক্ষোভ দেখা দেয়। রাজশাহীতে ২৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৮ সালে স্কুল ও কলেজের ছাত্ররা ব্যাপকভাবে ধর্মঘট পালন করেন। গণপরিষদের অধিবেশনের পূর্বে ভাষা সম্পর্কে পূর্ব বাংলার মনােভাব ব্যক্ত করার উদ্দেশ্যে এই ধর্মঘট পালন করা হয়। এদিন বেলা ১১টায় ভুবনমােহন পার্কে ছাত্রদের সভা হয়। কাজী জহুরুল। হক সভাপতিত্ব করেন। পূর্ব বাংলার রাষ্ট্রভাষারূপে বাংলার দাবি সমর্থন করে। কয়েকজন ছাত্র বক্তৃতা করেন তাতে নিমলিখিত প্রস্তাবসমূহ গৃহীত হয় :
১. বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করতে হবে। ২. নৌ-বিভাগে পূর্ব বাংলার যুবকদের বাংলা ভাষায় পরীক্ষা দিতে হবে।
৩. বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম করতে হবে। ৪. পাকিস্তানের মুদ্রা ও ডাক টিকেটে বাংলা ভাষার স্থান চাই।। এ সম্পর্কে বহু ছাত্রের স্বাক্ষরযুক্ত স্মারকপত্র গণপরিষদের সভাপতি পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানাের ব্যবস্থা করা হয়। ২৭ ফেব্রুয়ারি রাজশাহীর নওগাঁয় গণপরিষদে প্রদত্ত লিয়াকত আলী খান ও খাজা নাজিমুদ্দিনের বক্তৃতার প্রতিবাদ করে সিরাজুদ্দিন সাহেবের সভাপতিত্বে বিরাট সভা হয়। নবি উদ্দিন, মুসলিম ছাত্র লীগের সম্পাদক সমিরুদ্দিন, মুসলিম লীগ সম্পাদক ইব্রাহিম চৌধুরী, যুবলীগের আতাউর রহমান বক্তৃতা করেন। নবি উদ্দিন বলেন, বাংলা ভাষাকে অবহেলা করার অর্থ পাকিস্তানের মৃত্যু। আতাউর রহমান পাকিস্তানকে মুসলিম। রাষ্ট্র বলার তীব্র নিন্দা করে বলেন, “এটি ব্যক্তি স্বাধীনতার বিরােধী সাম্রাজ্যবাদী মনােভাব।” তিনি গণপরিষদের বাংলা ভাষাবিরােধী সদস্যদের। পদত্যাগ দাবি করেন। সমগ্র মহকুমা ব্যাপী আন্দোলনের জন্য সর্বদলীয় কমিটি গঠিত হয়।
আন্দোলনের জন্য অনেকে সভাস্থলেই অর্থ দান করেন। এই ঘটনার প্রতিবাদে নাটোরে হরতাল পালিত হয়। রাজশাহীতে ভাষা আন্দোলনে এ সময় নেতৃত্ব দেন জনাব একরামুল হক, গােলাম রহমান, আবুল কাশেম চৌধুরী, জনাব গােলাম তাওয়াব (প্রাক্তন বিমানবাহিনী প্রধান) প্রমুখ। রাজশাহীতে ভাষা আন্দোলনের মিছিলের ওপর হামলাকে কেন্দ্র করে একটি উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। কারণ ভাষার দাবিতে যে মিছিল বের হয় তার ওপর গুণ্ডারা হামলা চালালে জনাব গােলাম তাওয়াব গুণ্ডাদের বিরুদ্ধে রুখে দাড়ান এবং এক পর্যায়ে মূল মিছিল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে তিনি গুণ্ডাদের দ্বারা ভীষণভাবে প্রহৃত হন। সুতরাং ভাষা। আন্দোলনকে বানচাল করার জন্যেও সংঘবদ্ধভাবে উর্দু সমর্থকরা সরকারি সমর্থনে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছিল। রাজশাহীতে নিখিল পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ এবং মুসলিম লীগের ভাড়াটিয়া গুণ্ডারা মিছিলের ওপর হামলা চালায়।
রাজশাহীতে ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্বদান সম্পর্কে আরাে তথ্যে জানা যায় যে, রাজশাহীতে বাংলা ভাষা আন্দোলনের পুরােভাগে ছাত্র নেতা ও কর্মীদের মধ্যে জনাব একরামুল হক, জনাব গােলাম রহমান, জনাব মােঃ হাবিবুর রহমান (শেলি) ও অধ্যাপক আবুল কাশেম প্রমুখের নাম স্মরণীয়। উল্লেখ্য যে, ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ-এর হরতাল প্রদেশব্যাপী সার্থকভাবে। সম্পন্ন হয়েছিল। দেশের অন্যান্য জায়গায় যেমন যশাের, চট্টগ্রাম, রংপুর ও রাজশাহীতে নিখিল পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ এবং মুসলিম লীগের ভাড়াটিয়ারা মিছিলের ওপর হামলা চালায়। কিন্তু রাজশাহীর হামলা ছিল একটু অন্য ধরনের অর্থাৎ রাজশাহীতে গুণ্ডা বাহিনী গজাল, লাঠি ও লােহার রড দিয়ে রাজশাহী হাই মাদ্রাসার সামনে ফায়ার ব্রিগেডের মােড়ে অতর্কিত হামলা চালায় এবং লাঠির আগায় লােহার গুল লাগানাে মারাত্মক অস্ত্র দিয়ে গােলাম রহমানের মাথায় আঘাত করে সঙ্গে সঙ্গে তার মাথা ফেটে যায় এবং দরদর করে অঝর ধারায় রক্ত পড়তে থাকে এবং রক্তে পথ ভিজে যায়, রাজপথ রঞ্জিত হয়। এই রক্ত ভাষার জন্য বাংলাদেশের প্রথম রক্তদান বলে রাজশাহীর ভাষা সৈনিকগণ। দাবী করেছেন। ১৯৪৮ সালে রাজশাহীর মাটিতে প্রথম রক্ত ঝরার বিষয়টি ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে স্মরণীয় অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হবে। রাজশাহীর ভাষা আন্দোলনে ১৯৪৮ সালে মুসলিম লীগের নেতাকর্মীরা ভাষা আন্দোলন কারীদের বিরুদ্ধে নানারূপ বানােয়াট গল্প বানিয়ে ভারতের চর, কমিউনিষ্ট ইত্যাদি নানা কথা বলে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি যেমন করেছে তেমনি কিছু সংখ্যক মুসলিম লীগের ছাপােষা দালাল বন্ধু সেজে পিছন থেকে ছুরিকাঘাত করার মতাে অনেক তথ্য ফাস করে দিয়েছে এবং পুলিশের সঙ্গে আঁতাত করে ভাষা সৈনিকদের ধরিয়ে দিয়েছে। ফলে আন্দোলনের গতি অনেক সময় স্তিমিত হয়েছে।
১৯৪৮-এর নভেম্বরের শেষভাগে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান যখন পূর্ববঙ্গ সফরে এসে রাজশাহী আগমন করেন এবং এক জনসভায় বক্তৃতা করেন সেই সময় ছাত্র বিক্ষোভ হয়। এ ছাত্র বিক্ষোভের জন্য ছাত্রদের ওপর পুলিশী নির্যাতন হয় এবং কলেজ কর্তৃপক্ষ ছাত্রদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক। ব্যবস্থা গ্রহণ করে। আবুল কাশেম চৌধুরীসহ কয়েকজন ছাত্রকে কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হয়। অন্যত্র দেখা যায়, মােহাম্মদ সুলতান এবং গােলাম রহমানের নেতৃত্বে লিয়াকত আলী খানের সভায় বিক্ষোভ প্রদর্শন করায় কলেজের (রাজশাহী কলেজ) ষােলজন ছাত্রকে বহিষ্কার করা হয়। এই ঘটনাকে কেন্দ্র। করে রাজশাহীর রাজনৈতিক অংগনে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। এবং সে বিষয়টি কেন্দ্রীয়ভাবে সমাধানের লক্ষ্যে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। রাজশাহীতে ছাত্র ফেডারেশনের আবুল কাশেম চৌধুরী এবং অন্য কয়েকজন ছাত্রের বহিষ্কার এবং ঢাকা ও প্রদেশের অন্যত্র বহু ছাত্রের ওপর নির্যাতনমূলক ব্যবস্থার প্রতিকারের উদ্দেশ্যে ৮ জানুয়ারি ১৯৪৯ জুলুম প্রতিরােধ দিবস উদযাপনের আহ্বান জানানাে হয়। ১৯৪৮ সালে রাজশাহীর ভাষা আন্দোলন মূলত রাজশাহী কলেজকেন্দ্রিক ছিল। ১১ মার্চের হরতালে বেশ কিছু অধ্যাপক ছাত্রদেরকে বিভিন্নভাবে সহযােগিতা করেন। এই শিক্ষকদের মধ্যে ছিলেন-প্রখ্যাত ধ্বনি বিজ্ঞানী পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষ মুহম্মদ আবদুল হাই। উল্লেখ্য যে, সেদিন রাজশাহী কলেজের সংগ্রামী ছাত্ররী আন্দোলনের গতিধারা। চিহ্নিত করতে এবং সঠিক নেতৃত্বের দ্বারা রাজশাহীর ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে বিশেষ অবদান বা ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছিল।
১৯৪৮ সালের শেষের দিকে ভাষা সৈনিক মুহম্মদ একরামুল হক গ্রেফতার হন এবং তার পূর্বেই আতাউর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়। পরবর্তকিালে কাশেম চৌধুরীও গ্রেফতার হয়। হাবিবুর রহমান শেলী ও মুহম্মদ সুলতান পড়াশুনার জন্য ১৯৪৯ সালে ঢাকায় চলে আসেন। ফলে ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্বে সাময়িক অসুবিধার সৃষ্টি হয়। কিন্তু সে অসুবিধা বেশি সময় স্থায়ী ছিল। ১৯৪৯ সালে নতুন নেতৃত্ব আসেন সর্বজনাব এস এ বারী, এ টি, গােলাম আরিফ টিপু, আহমদুল্লাহ চৌধুরী, মােহাম্মদ আনসার আলী, মহসীন প্রামাণিক, আবুল কালাম চৌধুরী, এস এম এ গাফফার, হাবিবুর রহমান প্রমুখ ব্যক্তিত্বের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে রাজশাহীতে ভাষা আন্দোলনের গতি অব্যাহত থাকে। ১৯৪৯/৫০/৫১ সালের দিনগুলােতে ভাষা আন্দোলনের গতি তীব্রতর ছিল বলেই ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে বাংলা ভাষার দাবী ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘বাংলা ভাষার রাষ্ট্র চাই’ শ্লোগানে সেদিন রাজশাহীর আকাশ-বাতাস। মুখরিত হয়ে উঠেছিল। এই সময়কালে ঢাকায় ১৯৪৭ সালের ২ সেপ্টেম্বর ইসলামী সাংস্কৃতিক সংগঠক পাকিস্তান তমদ্দুন মজলিস প্রতিষ্ঠিত হয় এবং রাজশাহীতেও তার শাখা খােলা হয়। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনকে ত্বরান্বিত করার ক্ষেত্রে এই সংগঠনের কর্মীরা মােহাম্মদ আনসার আলীর। (পরবর্তীতে হাইকোর্টের বিচারপতি) নেতৃত্বে উল্লেখযােগ্য ভূমিকা পালন করে।
২১ ফেব্রুয়ারির পূর্বেই অর্থাৎ ১৯৫২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি রাজশাহীর ভুবনমােহন পার্কে তমদুন মজলিশের রাজশাহী জেলা শাখার উদ্যোগে এক বিরাট জনসভা হয়। সভায় বলা হয়- “পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে চার কোটি মানুষ কথা বলে বাংলা ভাষায়। পাকিস্তানের শতকরা প্রায় ৬০ ভাগ জনতার ভাষা বাংলা রাষ্ট্রভাষা হবে কি-না গণতন্ত্রের মাপকাঠিতে তা ঠিক করবার ন্যায়সংগত দাবী ও নিয়মতান্ত্রিক অধিকার থেকে জনসাধারণকে বঞ্চিত করবার সকল অপকৌশল ও অপচেষ্টা ব্যর্থ করতে হবে। তা ছাড়াও রাজশাহীতে বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ, কেন্দ্রীয় অর্থ সাহায্য থেকে ডি জি ইন্ডাষ্ট্রিয়াল স্কুলের সম্প্রসারণ এবং মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম রাষ্ট্রগুলির ওপর সাম্রাজ্যবাদী বুলেটের জবাবে আমাদের কর্তব্য সম্পর্কে সকলের মতামত প্রয়ােজন। এই জনসভাও রাজশাহীর জনমনে বিশেষ প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছিল। উক্ত জনসভায় উর্দু প্রচলনের বিরুদ্ধে ও অন্যান্য বিষয়ে সভায় কতিপয় প্রস্তাব গৃহীত হয়। যথা- (১) বাংলাকে পূর্ববঙ্গের রাষ্ট্রভাষা করা, (২) আরবী হরফের প্রচলন বন্ধ করা, (৩) রাজশাহীতে অবিলম্বে বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ স্থাপন করা এবং বর্তমান বাজেট অধিবেশনে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিলটি সর্বপ্রথম গ্রহণ করার জন্য অনুরােধ, (৪) মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম রাষ্ট্রগুলির ওপর সাম্রাজ্যবাদের আক্রমণের তীব্র প্রতিবাদ, (৫) কেন্দ্রীয় অর্থ সাহায্য হতে ডি জি স্কুলের সমপ্রসারণ। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ও পরবর্তীতে রাজশাহীতে যেসব ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল তা ভাষা আন্দোলন ও পরবর্তীতে স্বাধীনতা সগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
২১ ফেব্রুয়ারি বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা মর্যাদাদানের দাবীতে সাধারণ ধর্মঘট হয়। বাজারের প্রত্যেকটি দোকান সম্পূর্ণভাবে বন্ধ থাকে। টমটম গাড়ি ও রিকশাওয়ালারা সম্পূর্ণভাবে ধর্মঘট পালন করে। শহরে সমস্ত দিন টহলদার বন্দুকধারী পুলিশ মােতায়েন রাখা হয়। বেলা ১১টার সময় রাজশাহী কলেজ প্রাঙ্গণ হতে এক হাজারের অধিক ছাত্র ও জনতার এক শােভাযাত্রা বের হয়ে শহরের প্রত্যেকটি রাস্তা প্রদক্ষিণ করে। পঁচশতেরও অধিক একটি ছাত্রদল নানা ধ্বনি দ্বারা শহর প্রদক্ষিণ করে এক সভায় মিলিত হন এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদাদানে প্রস্তাব গ্রহণ করেন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির শহিদদের আত্মার মাগফেরাত ও জনগণকে আরাে সচেতন, সংগ্রামী এবং বাংলা ভাষা প্রীতিতে উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্যে পরের দিনই অর্থাৎ ২২ ফেব্রুয়ারি সংগ্রাম পরিষদ আয়ােজিত ভুবনমােহন পার্কে প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। পরদিন চলে হরতাল, মিছিল এবং জনসভা। সকালে গােটা শহর পােস্টারে ছেয়ে যায়। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে ভাষার দাবি প্রতিষ্ঠিত করার জন্য যারা ঢাকায় শহিদ হয়েছিল, তাদের স্মৃতিকে জাগরুক রাখা, তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানাে এবং তাদের অবদানকে চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য ঢাকার সাথে রাজশাহীতেও সংগ্রামী ছাত্র-জনতা শহিদ স্মৃতিস্তম্ভ গড়ে তুলেছিলেন। রাজশাহীতে ২১ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যার খবর প্রচারিত হওয়ার পর রাত্রিতে কলেজ হােস্টেল প্রাঙ্গণে এক সভায় মেডিকেল স্কুলের ছাত্র এসএমএ গাফফারকে সভাপতি এবং হাবিবুর রহমান ও গােলাম আরিফ টিপুকে যুগ্ম-সম্পাদক করে একটি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। এই সগ্রাম পরিষদের কর্মকর্তারা মিটিং শেষে ২১ তারিখ রাত্রেই শহিদ স্মৃতিস্তম্ভের কাজ শুরু করেন।
ভাষা আন্দোলনের ঢেউ শুধু যে শহরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল তা নয়-গ্রামগ্রামান্তরেও বিদ্যুৎগতিতে ছড়িয়ে পড়েছিল। তার নমুনা পাওয়া যায় রাজশাহী জেলার একেবারে অজপাড়াগাঁ নাজীপুরের ছাত্রগণ ২১ ফেব্রুয়ারির দিনই হরতাল ও প্রতিবাদ সভায় মিলিত হয়। লক্ষণীয় যে, নাটোর-নওগানবাবগঞ্জসহ বৃহত্তর রাজশাহী জেলার সর্বত্রই রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে প্রবল আন্দোলন পরিলক্ষিত হয়। এক্ষেত্রে মহিলারাও তৎপর ছিলেন নাটোরের মহিলারা ভাষা আন্দোলন সমিতি গঠন করে এবং প্রতিবাদ সভা করে গুলিবর্ষণকারী দায়ী ব্যক্তিদের বিচার দাবি করে। ঢাকায় গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে নাটোর মহিলা ভাষা আন্দোলন সমিতির উদ্যোগে ২৯ ফেব্রুয়ারি এক বিরাট মিছিল বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে করতে সমস্ত শহর প্রদক্ষিণ করে। অতঃপর বেগম শামসুন্নাহার-এর সভানেত্রীত্বে চৌধুরী সাহেবের মাঠে এক সভা হয়। সভায় বক্তব্য প্রদানের পর গুলিবর্ষণ সম্পর্কে নিরপেক্ষ তদন্ত ও দায়ী ব্যক্তিদের বিচার এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদাদানের দাবী করা হয়। ১৯৭১-এর মার্চ মাসে গণআন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে প্রতিবাদ, প্রতিরােধ আর বিক্ষোভে রাজশাহীর সর্বস্তরের জনতা মুখর হয়ে উঠেছিল। মিছিলে মিছিলে উত্তপ্ত হয় রাজশাহী শহর সমুদ্রের তরঙ্গের মতাে ফুসে ওঠে ছাত্র ও যুব সমাজ। ন্যায্য দাবী আদায়ের অঙ্গীকারে সকলেই ঐক্যবদ্ধ। ৩ মার্চ মিছিলের শহরে পরিণত হয় রাজশাহী। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাজশাহী কোর্ট পর্যন্ত দীর্ঘ আট কিলােমিটার শহরে একটার পর একটা বিক্ষোভ মিছিল জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বাতিলের প্রতিবাদে গর্জে ওঠে। বেলা সাড়ে এগারােটার দিকে একটি বিক্ষোভ মিছিল সােনাদীঘির পাশ দিয়ে মালােপাড়া পুলিশ ফাঁড়ি পেরিয়ে পশ্চিম দিক থেকে রানীবাজারের দিকে যায়।
মিছিলটি মালােপাড়ার শেষ প্রান্তে টেলিফোন এক্সচেঞ্জের সামনে আসতেই টেলিফোন ভবনের ওপর থেকে মিছিলের ওপর অকস্মাৎ গুলিবর্ষণ শুরু করে পাহারাদার পাকিস্তানি সৈন্যরা। রাস্তার সব দোকান বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ হয়ে যায় রাস্তার পাশের সব বাড়ির দরজা। মানুষের পালাবার পথ নেই। হাজার হাজার মানুষ দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে পালাবার চেষ্টা করে। ক’জন গুলিবিদ্ধ হয়। রক্ত, আর্তনাদ আর চিৎকারে এক নারকীয় অবস্থার সৃষ্টি হয় সেখানে তারপর থেকে রাজপথ হয়ে ওঠে সগ্রামের পথ। রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে বেরিয়ে আসেন মুক্তিকামী মানুষ, বেরিয়ে আসে বৃটিশবিরােধী আন্দোলনের সিংহ পুরুষ কমিউনিষ্ট নেতা মণিসিংহ। গুলি চলে পথে পথে, পাড়ায় পাড়ায় ঢুকে অলিতে-গলিতেও পাকিস্তানি সৈন্যরা গুলি করে মানুষ মারতে শুরু করে। বেলদারপাড়ার ভেতরে গিয়ে তারা হত্যা করে নিরীহ দু’ব্যক্তিকে এদিকে জনতার প্রতিরােধ শক্তিশালী হয়ে ওঠে। প্রেক্ষাগৃহে পাকিস্তানের জাতীয় সঙ্গীতের পরিবর্তে ‘জয় বাংলা, বাংলার জয় সঙ্গীত বাজতে আমাদের প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। ছাত্ররা ঝাপিয়ে পড়েছে অত্যাচার আর শােষণের বিরুদ্ধে নিজেদের জীবন দিয়েছে অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে অন্যায়কে তারা মেনে নেয়নি। তারা দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলেছে ৬৯, ৭০ ও ৭১-এর আন্দোলনে ফলশ্রুতিতে অনেক ছাত্র এখানে শহিদ হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা যে যেখানে ছিল সেখান থেকেই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়। নিজেদের জীবন দিয়ে ছাত্ররা মুক্ত করে দেশকে। ১৯৭১-এর মার্চ মাসে ইয়াহিয়া সরকারের বিরুদ্ধে রাজশাহীর সর্বদলীয় ছাত্র সমাজ ১-৩ মার্চ জঙ্গী। মিছিল শহরে ও ক্যাম্পাসে বের করে মিছিলে পুলিশ লাঠিচার্জ, টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ এবং গুলিবর্ষণ করে। সেদিন বাটার মােড়ে পুলিশের গুলিতে নিহত হয়।
একজন ছাত্র পরিস্থিতি ক্রমান্বয়ে অবনতির দিকে যেতে থাকে। শহর ও ক্যাম্পাসের পরিস্থিতি অশান্ত হয়ে ওঠে। এ সময় প্রতিটি আন্দোলনে যারা সবচেয়ে বেশি সক্রিয় ছিলেন তাঁরা হলেন রাকসুর ভিপি মীর শওকত, নূরুল ইসলাম ঠান্ডু, তাহমিলুর রহমান কাজল, ফজলুর রহমান পটল, শামসুর রহমান প্রমুখ। তা ছাড়া তৎকালীন ছাত্রলীগের নেতৃত্বে নানা সংগ্রামী কর্মসূচিও পরিচালিত হয়। মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহিদ মিনারের পাদদেশে প্রথম কলাভবনের সামনে এক বিরাট সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সেদিনের এ সমাবেশে প্রায় ৭/৮ হাজার ছাত্র-ছাত্রী, শ্রমিক-জনতা ও আশপাশের সর্বস্তরের লােক এক জমায়েতে উপস্থিত হয়। এ সভায় সভাপতিত্ব করেন মীর শওকত। সভা পরিচালনা করেন শামসুর রহমান। বিভিন্ন নেতৃবৃন্দ বক্তৃতায় পশ্চিমা শাসকদের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা ও অসন্তোষ প্রকাশ করে। সভা চলাকালে জনতা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং নানা শ্লোগানে ক্যাম্পাস প্রকম্পিত করে। অবশেষে আনুষ্ঠানিকভাবে জনতা পাকিস্তানি পতাকা। পুড়িয়ে দেয় অবস্থা আস্তে আস্তে উত্তপ্ত হতে থাকে।
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান -ষষ্ঠ খন্ড