You dont have javascript enabled! Please enable it! গােকুলের যুদ্ধ (ফাদ) - সংগ্রামের নোটবুক
গােকুলের যুদ্ধ (ফাদ)
ভূমিকা
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে গােকুল ইউনিয়নের সরলপুর গ্রামে মুক্তিবাহিনী একটি শত্রুপক্ষের অগ্রাভিযানকে প্রতিহত করে। অতি অল্পসংখ্যক জনবল নিয়ে একটি বিশাল শত্রুবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে মুক্তিবাহিনী গােকুলে এক দুঃসাহসিক ইতিহাসের সৃষ্টি করেছিল। সরলপুর গ্রামের ঈদগাহটি সে ইতিহাসের স্বাক্ষর আজও বহন করে আসছে। যুদ্ধের পটভূমি গােকুলের মধ্য দিয়ে যে সড়কটি চলে গেছে, সেটি ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর বগুড়ার সাথে যােগাযােগের একটি অন্যতম মাধ্যম। হিলি সীমান্ত থেকে গােকুলের উপর দিয়েও পাকিস্তানি বাহিনী বগুড়ায় প্রবেশ করতাে। তাই এ যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন করার লক্ষ্যে মুক্তিবাহিনী শত্রুর এ অগ্রাভিযানকে প্রতিহত করেছিল।
ভূমির পরিচিতি
গােকুল বগুড়া জেলা সদর থানার অন্তর্গত, বগুড়া শহর থেকে ৪-৫ কিলােমিটার উত্তরে অবস্থিত। গােকুলের পশ্চিমে দুপচাচিয়া থানা, দক্ষিণে বগুড়া শহর, পূর্বে সােনাতলা, সারিয়াকান্দি এবং উত্তরে মহাস্থানগড় ও মােকামতলা অবস্থিত। গােকুল ইউনিয়নের ভিতর দিয়ে রংপুর, বগুড়া, রাজশাহী মহাসড়ক, যা। যাতায়াত ব্যবস্থায় উল্লেখযােগ্য অবদান রাখে। গােকুল ইউনিয়নের একটি ছােটো গ্রাম সরলপুর, যা বড়াে সরলপুর ও ছােটো সরলপুর ২ ভাগে বিভক্ত। এ গ্রামের পশ্চিমে সাদনা, দক্ষিণে বড়টেংরা, রজাকপুর এবং দক্ষিণ-পূর্বে নুনগােলা গ্রাম অবস্থিত। যুদ্ধের সংগঠন। যুদ্ধের সংগঠন নিম্নরূপ:
ক. পাকিস্তানি বাহিনী: ১ কোম্পানি।
খ. মুক্তিবাহিনী: ৭ নম্বর সেক্টরের ৫০-৬০জন মুক্তিযােদ্ধা। শত্রুপক্ষের অবস্থান সরলপুর গ্রাম, গােকুল নুনগােলা সড়ক। যুদ্ধের বর্ণনা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে গােকুল ইউনিয়নের সরলপুর গ্রামে ১৯৭১ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রাণ বিসর্জন দিতে হয় মুক্তিযােদ্ধা হাফিজার ও বাবলুকে। মুক্তিবাহিনী ঐ দিন অবস্থান করছিল সরলপুর গ্রাম থেকে প্রায় ৩ কিলােমিটার দক্ষিণে রজাকপুর নামের একটি গ্রামে। গােয়েন্দা সূত্রে তারা খবর পায় যে, পাকিস্তানি বাহিনীর ১টি বিশাল দল জয়পুরহাট-নুনগােলার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এ দল হিলি-জয়পুরহাট সীমান্তে মিত্রবাহিনীর হাতে পরাজিত হওয়ার পর পিছু হটে বগুড়া শহরে তাদের সদর দপ্তরের উদ্দেশ্যে অগ্রাভিযান করছিল। মুক্তিবাহিনী রজাকপুর থেকে বের হওয়ার পূর্বে তাদের ১টি রেকি দল পাঠায়। পাকিস্তানি। বাহিনীর অগ্রগামী দলের সংখ্যা জানার জন্য রেকি দলের সংবাদ অনুযায়ী শত্রুর সংখ্যা ২ কোম্পানির অধিক হওয়ায় মাে. ইসরাইল হােসেন, এ টি এম জাকারিয়া প্রমুখ অধিনায়করা সিদ্ধান্ত নেন যে, এত বিশাল বাহিনীর সাথে। হালকা অস্ত্রে সজ্জিত তাদের এ ৫০-৬০জনের দল পেরে উঠবে না, তাই পাকিস্তানি বাহিনীকে ছত্রভঙ্গ করাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। পরিকল্পনা মােতাবেক মুক্তিবাহিনী বড়টেংরা গ্রামের উত্তরে প্রধান সড়কের পিছনে বিভিন্ন বাঁশঝাড়গুলােতে অ্যামবুশ স্থাপন করে। 
পাকিস্তানি বাহিনীর বিশাল দলটি যখন তাদের অ্যামবুশ সাইটে প্রবেশ করে আনুমানিক দুপুর সােয়া ১২টায় মুক্তিবাহিনী তাদের কাছে থাকা এসএমজি ও এসএলআর দিয়ে শত্রুর উপর গুলিবর্ষণ করে। আকস্মিক আক্রমণে পাকিস্তানিরাও পাল্টা গুলিবর্ষণ করে এবং ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। কিন্তু নিজস্ব বাহিনী। সংখ্যায় কম হওয়ায় পাকিস্তানি বাহিনীর বেশির ভাগ অংশই নিরাপদ দূরত্বে চলে যেতে সক্ষম হয়। শুধু একটিমাত্র সেকশন অবস্থান নেয় ঈদগাহে। মুক্তিবাহিনী তাদেরও আক্রমণের চেষ্টা চালায়। তারা রাস্তা পার হয়ে। ধানক্ষেতের মধ্য দিয়ে ক্রলিং করে উত্তর পূর্ব দিক থেকে আবারও গােলাবর্ষণ। শুরু করে পাকিস্তানি বাহিনীর উপর । কিন্তু মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন মুক্তিযােদ্ধা হাফিজার ও বাবলু। প্রায় ৪০ মিনিট গুলিবিনিময়ের পর অবশেষে পাকিস্তানি। বাহিনীরা পালাতে বাধ্য হয়। তারা বিচ্ছিন্নভাবে সাদনা, রাজাপুর গ্রামগুলাের মধ্য দিয়ে বগুড়া শহরের উদ্দেশ্যে পালিয়ে যায়। বিশ্লেষণ ও পর্যালােচনা মুক্তিবাহিনীর সাফল্যের কারণ এ অ্যামবুশে আংশিক সাফল্যের মূল কারণগুলাে নিম্নরূপ:
ক, কঠিন সাহসিকতা ও দৃঢ় মনােবল।
খ. বিভিন্ন দলের মধ্যে সঠিক সমন্বয়। পাকিস্তানি বাহিনীর ব্যর্থতার কারণ যেহেতু মুক্তিবাহিনী কেবল শত্রুপক্ষের অগ্রাভিযানে সামান্য প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পেরেছিল এবং শক্রর অধিকাংশই মুক্তিবাহিনীর অ্যামবুশ থেকে রেহাই
পেয়েছিল, তাই এটা একটা ব্যর্থ অভিযান বলেই প্রতীয়মান হয়। এর পিছনে প্রধান কারণগুলাে নিম্নরূপ:
ক. শত্রু সম্পর্কে পূর্ব থেকে তথ্য সংগ্রহের অভাব।
খ, যুদ্ধের পূর্বপরিকল্পনার অভাব।
গ. অস্ত্র ও জনবলের অভাব শিক্ষণীয় বিষয় এ যুদ্ধের শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে পূর্বপরিকল্পনা, যা তথ্য, জনবল, প্রশিক্ষণ সবকিছুকেই বুঝায়। যে-কোনাে যুদ্ধে যেতে হলে শক্রর ক্ষমতা সম্পর্কে অবশ্যই জানতে হবে এবং সে অনুযায়ী যুদ্ধের জন্য সঠিক তথ্য সংগ্রহ এবং পূর্বপরিকল্পনার মাধ্যমে অভিযানের জন্য অগ্রসর হতে হবে। উপসংহার। শহিদ হাফিজার ও শহিদ বাবলুর কবর গােকুল এলাকায় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। হয়ে রয়েছে। তাদের বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধ এবং দুঃসাহসিকতার জন্যই মুক্তিযােদ্ধারা। পাকিস্তানি বাহিনীকে দেশছাড়া করতে সক্ষম হয়েছেন। সে জন্যই এ দুই। শহিদের কথা গােকুলবাসী আজও গর্বের সাথে দেশবাসীকে জানাতে পারে।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান -ষষ্ঠ খন্ড