ভেলুরপাড়া যুদ্ধ
ভূমিকা
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ছিল জাতির মহান আত্মত্যাগ এবং বিজয় ছিল ছােটো-বড়াে অনেক বীরত্বে গাথা যুদ্ধের ফসল। মরিয়া হয়ে উঠেছিল বাংলার দামাল ছেলেরা। প্রতিশােধের আগুন জ্বলে উঠেছিল সবার মনে। ভেলুরপাড়া রেল স্টেশনের (রেইড) এমনি এক প্রতিশােধের আগুন ঝলসে ওঠা বাঙালির গর্ব, পাকিস্তানি বাহিনীর হাত থেকে ভেলুরপাড়া এলাকাবাসীর পরিত্রাণ।
যুদ্ধের পটভূমি
শুরু থেকেই পাকিস্তানি বাহিনী এলাকার গবাদিপশু লুট ও মুক্তিযােদ্ধা পরিবারগুলাের উপর অত্যাচার করে আসছিল। শান্তিপ্রিয় ভেলুরপাড়াবাসী সবকিছু মুখ বুজে সহ্য করে যাচ্ছিল। কিন্তু রেল স্টেশনে অবস্থানরত পাকিস্তানি বাহিনীর অত্যাচারের মাত্রা দিন দিন চরমে উঠতে লাগল। মুক্তিযােদ্ধা খাজা নাজিমুদ্দিনের বাবা কসিম উদ্দিন প্রামাণিককে তারা ধরে নিয়ে যায় এবং অমানুষিক নির্যাতন চালিয়ে প্রায় পঙ্গু অবস্থায় তাকে ফেরত দেয়। এর পর আজিজুল ইসলাম নামের এক মুক্তিযােদ্ধাকে তারা ধরে নিয়ে যায়। সেখান থেকেই এলাকাবাসী তেতে উঠতে থাকে। একদিন হঠাৎ করে পাকিস্তানি বাহিনী চড়াও হয় গ্রামে এবং নরপিশাচের মতাে তুলে নিয়ে যায় এক তরুণীকে। অস্ত্রের মুখে কেউ এগিয়ে আসতে পারেনি। তরুণীর ভয়ার্ত আর্তচিকারে ভেলুরপাড়া গ্রামের আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। কেঁপে ওঠে প্রকৃতি। অসহায় প্রকৃতি আবার নিশ্ৰুপ হয়ে যায়। কষ্টের তীব্রতায় পাথর হয়ে থেমে যায়। তরুণীটির কান্না। অনেক হয়েছে, আর নয়। দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া এলাকাবাসী ঘুরে দাঁড়ায়। আশপাশে লুকিয়ে থাকা মুক্তিযােদ্ধারা জড়াে হতে থাকেন ভেলুরপাড়া গ্রামে। প্রতিটি মানুষের চোখে জ্বলতে থাকে প্রতিশােধের লেলিহান শিখা। অনিবার্য হয়ে ওঠে ভেলুরপাড়া যুদ্ধ (রেইড)। ‘হঠাও শত্রু, বাঁচাও দেশ’ এ ব্রত নিয়ে তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে শত্রুর উপর।
ভূমির পরিচিতি
বগুড়া জেলার সােনাতলা উপজেলার অন্তর্গত ছােটো একটি ইউনিয়ন ভেলুরপাড়া। বগুড়া জেলার সদর থেকে ১৬ কিলােমিটার উত্তরে এবং সােনাতলা উপজেলা সদর থেকে ১৪ কিলােমিটার দক্ষিণে অবস্থিত। এর ৩-৪ কিলােমিটার দক্ষিণে সুখানপুকুর সবচেয়ে নিকটবর্তী ইউনিয়ন। এখানে একটি রেল স্টেশন আছে, যা ভেলুরপাড়া রেল স্টেশন নামে পরিচিত। এ স্টেশন থেকে উত্তরে সােনাতলা হয়ে সান্তাহার এবং দক্ষিণে সুখানপুকুর হয়ে বগুড়ার সাথে রেল যােগাযােগ বিদ্যমান। এর পূর্বে যমুনা নদী। এ এলাকা প্রধানত সমতল এবং ঘন গাছপালায় পরিবেষ্টিত, যা যে-কোনাে চলাচলকে ভূমি ও আকাশ পর্যবেক্ষণ থেকে পর্যাপ্ত আড় দেয়। এলাকার ভূমি খুবই উর্বর। এখানকার প্রধান ফসলের মধ্যে ধান, পাট ও কলা বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। বর্ষা মৌসুমে খােলা ভূমিতে পানি জমে যা পায়ে হেঁটে চলাচলে বিঘ্নতার সৃষ্টি করে। যুদ্ধের সংগঠন যুদ্ধের সংগঠন নিম্নরূপ: ক. পাকিস্তানি বাহিনী: ১জন হাবিলদারের নেতৃত্বে ১ প্লাটুন (-) এবং ২০জন রাজাকার। | খ. মুক্তিবাহিনী: অধিনায়ক খাজা নাজিম উদ্দিনের নেতৃত্বে ২ প্লাটুন (-) এবং ২০জন স্বেচ্ছাসেবক। যুদ্ধের বিবরণ ক্ষিপ্ত ও মরিয়া মুক্তিযােদ্ধারা ৮ ডিসেম্বর গভীর রাতে অধিনায়ক খাজা নাজিম উদ্দিনের নেতৃত্বে দীঘলকান্দি নামক স্থানে দানেশ মাস্টারের বাড়িতে রেইড পরিকল্পনার জন্য সমবেত হয়। সর্বসম্মতিক্রমে আক্রমণের রণকৌশলগত পরিকল্পনা এবং বিভিন্ন পার্টি অধিনায়কদের এ বৈঠকে নিযুক্ত করা হয়। পরিকল্পনামাফিক ১০ ডিসেম্বর আক্রমণকারী দল আনুমানিক রাত ২টায় নিমেরপাড়ায় সমবেত হয় এবং নিমেরপাড়ায় কভারিং পার্টি রেখে অ্যাকশন পার্টি ২ দলে বিভক্ত হয়ে যথাক্রমে শিচারপাড়া গ্রামের দক্ষিণ-পশ্চিম ও পূর্ব দিকে অবস্থান নেয়। অন্যদিকে, কাট অফ পার্টি-১, ২ ও রিজার্ভ পার্টি পর্যায়ক্রমে চকচকিয়া ব্রিজ, রােড বেন্ড ও শিচারপাড়া গ্রামে অবস্থান নেয়।
রাত আনুমানিক ২টা ৩০ মিনিটে শুরু হয় তুমুল যুদ্ধ। শত শত গুলির শব্দে আকাশ-বাতাস কেঁপে ওঠে। পাকিস্তানি বাহিনীও পাল্টা গুলি চালায়। তাদের এলএমজি ফায়ারে চকচকিয়া ব্রিজ কাট অফ পাটি-১-এর মুক্তিযােদ্ধা আব্দুল ওয়াহেদ বুলেটবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন এবং ঘটনাস্থলেই শহিদ হন। আব্দুল ওয়াহেদ শহিদ হওয়ায় কাট অফ পার্টি-১ তাদের স্থান ত্যাগ করে দোরগাছা ইউনিয়নে গিয়ে অবস্থান নেন। এ সুযােগে পাকিস্তানি বাহিনী রেললাইন ধরে দক্ষিণ দিকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। স্টেশন দখল করার পর দেখা যায় যে, শত্রুর ১জন সৈনিক নিহত হয়েছে এবং ১জন সৈনিককে জীবিত অবস্থায় ধরা হয়েছে। আটক মুক্তিযােদ্ধা আজিজুল ইসলামকেও উদ্ধার করা হয়। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ক. পাকিস্তানি বাহিনী: ১জন সৈনিক নিহত এবং ১জন সৈনিক যুদ্ধবন্দি।। খ. মুক্তিবাহিনী: মুক্তিযােদ্ধা আব্দুল ওয়াহেদ শহিদ হন এবং মুক্তিযােদ্ধা আজিজুল ইসলামকে উদ্ধার করা হয়। বিশ্লেষণ ও পর্যালােচনা মুক্তিবাহিনীর বিজয়ের কারণ এ যুদ্ধ পর্যালােচনা করে দেখা যায়, বাঙালিদের বিজয়ের কারণগুলাে ছিল নিম্নরূপ:
ক, সংখ্যাধিক্য: পাকিস্তানি বাহিনীর তুলনায় মুক্তিবাহিনীর সংখ্যা বেশি থাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর হার মানা ছাড়া কোনাে উপায়ই ছিল না। খ. আকস্মিকতা: মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে নিতান্তই আকস্মিক। যার ফলে ঘুরে দাঁড়ানাের মতাে কোনাে সুযােগই তাদের ছিল না। গ. মনােবল: প্রকৃতিগত কারণেই অত্যাচারী পাকিস্তানি বাহিনীর মনােবল ছিল দুর্বল। তা ছাড়া প্রতিশােধের নেশায় মাতাল মুক্তিবাহিনীর মনােবল ছিল অত্যন্ত উঁচু। ঘ. স্থানীয় সমর্থন: যুক্তিসংগত কারণেই স্থানীয় গ্রামবাসীর পূর্ণ সমর্থন পেয়েছিল মুক্তিযােদ্ধারা। দুদু মাস্টার ও চান মিয়া এ আক্রমণের প্রস্তুতিপর্ব থেকে শুরু করে আক্রমণের শেষ পর্যন্ত ২ দিন পুরাে মুক্তিবাহিনীর দলটিকে লুকিয়ে থাকতে সাহায্য করেন এবং খাবার সরবরাহ করেন। পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয়ের কারণ এ যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনী যে কারণে পরাজিত হয়েছিল, তার মধ্যে উল্লেখ্যযােগ্য কয়েকটি কারণ ছিল: ক. মুক্তিবাহিনীকে দুর্বল মনে করা: পাকিস্তানিদের মনে একটা অহংকার হয়েছিল বাঙালিদের বিরুদ্ধে। মুক্তিবাহিনীকে দুর্বল মনে করার কারণে তারা কোনাে নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থাই গ্রহণ করেনি, যার ফলে মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে তারা দাঁড়াতেই পারে নি।
খ, দ্রুত সাহায্য ও শক্তি বৃদ্ধির অভাব: পাকিস্তানিরা প্রয়ােজনের তুলনায় অনেক স্বল্প জনবল ও সরঞ্জামাদি নিয়ে অবস্থান করায় তাদের নানা ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। বিভিন্ন প্রশাসনিক জটিলতা তাদের দেখা দিত, যা তাৎক্ষণিকভাবে মেটানাে সম্ভব হতাে না। ভেলুরপাড়ার সাহায্য পৌছানাের জন্য নিকটবর্তী সাহায্যকারী ক্যাম্প ছিল সােনাতলা সদর ও বগুড়া সদরে। যার দূরত্ব ছিল বেশি এবং যােগাযােগ ছিল শুধু রেলপথ। এ কারণেই ভেলুরপাড়া ক্যাম্পে দ্রুত সাহায্য ও শক্তি বৃদ্ধি করা পাকিস্তানি বাহিনীর জন্য কঠিন ছিল। গ, স্থানীয় সমর্থন না থাকা: স্থানীয় লােকজনের সাথে পাকিস্তানি বাহিনীর যে আচরণ ছিল, তাতে করে স্থানীয় সমর্থন পাওয়ার কোনাে আশাই পাকিস্তানি বাহিনীর ছিল না। শিক্ষণীয় বিষয় ক. স্থানীয় জনগণের সমর্থন: স্থানীয় জনগণের উপর অত্যাচার আর নিপীড়ন করলে কখনােই স্থানীয় সমর্থন পাওয়া সম্ভব নয়। দ্রুত সাহায্য ও শক্তি বৃদ্ধি: দ্রুত সাহায্য ও শক্তি বৃদ্ধির ক্ষমতা যেকোনাে বাহিনীর জন্যই অপরিহার্য একটি অংশ। আদেশ ব্যতীত স্থান ত্যাগ করা: মুক্তিবাহিনীর কাট অফ পার্টি-১-এর আদেশ ব্যতীত স্থান ত্যাগ করাতেই পাকিস্তানি বাহিনী পালিয়ে যেতে সমর্থ হয়। নচেৎ পুরাে পাকিস্তানি বাহিনীকেই ধ্বংস করা সম্ভব ।
উপসংহার
ভেলুরপাড়ার যুদ্ধ (রেইড) এলাকাবাসীকে মুক্ত করেছিল। স্বজনহারা মানুষের মুখে ফুটেছিল হাসি বাস্তবায়িত হয়েছিল একটি মুক্তির স্বপ্ন। এ যুদ্ধের বিজয় অন্যত্র যুদ্ধরত মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে জাগিয়েছিল আরও উদ্দীপনা তরান্বিত করেছিল আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধকে এটি ছিল বহু আকাঙ্ক্ষিত বাঙালির স্বাধীনতা।
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান -ষষ্ঠ খন্ড