You dont have javascript enabled! Please enable it!
পাগলা দেওয়ান যুদ্ধ
ভূমিকা
১৯৭১ সালে সংঘটিত মুক্তিযুদ্ধে জয়পুরহাট এলাকায় যে কয়টি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র যুদ্ধ পাকিস্তানি ও মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে সংঘটিত হয়েছিল সেগুলাের মধ্যে পাগলা দেওয়ান যুদ্ধ উল্লেখযােগ্য। পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ বাঙালি নিপীড়নের অভিযান দীর্ঘায়িত হবে, এ কথাটি বুঝতে পেরে তাদের প্রতিরক্ষা অবস্থান সম্প্রসারিত করে। ১৯৭১ সালের মে মাসের মধ্যেই দখলদার বাহিনী জয়পুরহাটের বিভিন্ন। এলাকায় প্রতিরক্ষা বা ক্যাম্প স্থাপন করে। ফলে এলাকার সাধারণ জনগণ ভীত হয়ে ভারতে পালাতে থাকে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর সম্ভবত ১৯৭১ সালের  জুন মাসের পর পাগলা দেওয়ান ক্যাম্পটিতে কয়েকবার মুক্তিযােদ্ধারা আক্রমণ পরিচালনা করেন। প্রতিটি আক্রমণই পরিচালিত হতাে সীমান্তের ওপার থেকে। আক্রমণগুলাের মধ্যে একটিমাত্র আক্রমণের সঠিক তারিখ ছাড়া অন্য আক্রমণের কোনাে তারিখ ও বিশদ বর্ণনা পাওয়া যায় নি। শুধু ১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর পাগলা দেওয়ান ক্যাম্পে মুক্তিযােদ্ধাদের আক্রমণের উপর সংক্ষিপ্ত তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে।
পটভূমি
পাগলা দেওয়ান ক্যাম্পটি কখন, কীভাবে স্থাপন করা হয়, সে সম্বন্ধে সুনির্দিষ্ট কোনাে তথ্য সংরক্ষিত নেই। পাগলা দেওয়ান ক্যাম্প স্থাপনের পর থেকে পাকিস্তানি বাহিনী পলায়নরত বাংলাদেশিদের ধরে এনে পাগলা দেওয়ান গ্রামের পূর্ব-দক্ষিণ পাশের মাঠে হত্যার পর একই স্থানে গণকবর দিত। এ পাগলা দেওয়ান বধ্যভূমিতে কত লােককে অমানবিক ও পৈশাচিকভাবে হত্যা করা হয়েছে, তার সঠিক হিসাব দেওয়া সম্ভব নয়। প্রায় প্রতিদিনই কিছু কিছু স্বাধীনতাকামী বাংলাদেশি পাকিস্তানি সেনা সদস্যদের হাতে ধৃত হয়ে মৃত্যুবরণ করতাে। এ হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধাদের জিঘাংসার ফলে পাগলা। দেওয়ান ক্যাম্পটি মুক্তিবাহিনীর তালিকায় অগ্রগণ্যতায় স্থান পায়।
ভূমির পরিচিতি
পাগলা দেওয়ান গ্রামটি জয়পুরহাট ও নওগাঁ জেলার সংযােগ সীমান্তে অবস্থিত। সীমান্ত থেকে গ্রামটি ২-৩ কিলােমিটার দক্ষিণে অবস্থিত। জয়পুরহাট থেকে ধামুইরহাট যাওয়ার পাকা সড়কটি এ গ্রামের পাশ দিয়ে অতিক্রম করেছে। জয়পুরহাট থেকে ১৫-১৬ কিলােমিটার পশ্চিমে সীমান্তের কাছে অবস্থিত পাগলা দেওয়ান ক্যাম্প। ভারতে গমনের জন্য সাধারণত জয়পুরহাট থেকে ধামুইরহাটের রাস্তা ধরে পাগলা দেওয়ান গ্রামের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত কাচা রাস্তাটিই সহজ ও নিকটতম দূরত্ব হিসেবে বহুল পরিমাণে ব্যবহৃত হতাে। সীমান্তের সন্নিকটে অবস্থিত হওয়ার কারণে মুক্তিযােদ্ধারা সহজেই এ রাস্তায়। সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন অপারেশন করে আবার ভারতে ফেরত যেতেন। যুদ্ধের সংগঠন যুদ্ধের সংগঠন নিম্নরূপ: ক. পাকিস্তানি বাহিনী: পাগলা দেওয়ান ক্যাম্পটি শুরুতে ২৫-৩০জন পাকিস্তানি সৈন্য নিয়ে গঠিত হলেও মুক্তিবাহিনী কর্তৃক উপর্যুপরি আক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে সদস্যসংখ্যা বৃদ্ধি করা হয় এবং রাজাকার নিয়ােগের মাধ্যমে প্রায় ১ কোম্পানিতে উন্নীত করা হয়। খ, মিত্রবাহিনী: ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র যুদ্ধগুলাে ২০-২৫জনের জনবল নিয়ে সম্পাদন করা হলেও এ অভিযানে মুক্তিযােদ্ধাদের সর্বমােট সংখ্যা আনুমানিক ৭০-৮০-এর অধিক ছিল বলে জানা যায়। এ ছাড়া ১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বরের যুদ্ধে ভারতীয় আর্টিলারি প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা করে। শত্রুবাহিনীর অবস্থান জয়পুরহাট থেকে ধামুইরহাট গমনের রাস্তাটিতে নিয়মিত টহলের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং আউটার পেরিমিটার প্রতিরক্ষার অংশ হিসেবে পাকিস্তানি বাহিনী পাগলা দেওয়ানে অবস্থিত মাদ্রাসাটি দখল করে প্রতিরক্ষা অবস্থান জোরদার করে। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রথম দিকে এটি পাকিস্তানি প্লাটুন অবস্থান ছিল। পরবর্তী সময় জনবল বৃদ্ধির মাধ্যমে প্লাটুনটির অবস্থান আরও বিস্তৃত করা।
যুদ্ধের বিবরণ
পাগলা দেওয়ান গ্রামের ১ কিলােমিটার পশ্চিমে উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে। প্রবাহিত ঘাগরা নদীর পশ্চিম পাড়ে মুক্তিযােদ্ধাদের মর্টার পজিশন স্থাপন করা। হয়। সম্ভবত সীমান্তের ওপার থেকে ভারতীয় বাহিনী আর্টিলারি ফায়ারের মাধ্যমে মুক্তিযােদ্ধাদের এ আক্রমণকে সহায়তা প্রদান করা হয়। রাত আনুমানিক ৩টার দিকে প্রথমে আর্টিলারি ও মর্টার দ্বারা পাগলা দেওয়ান ক্যাম্পের উপর আক্রমণ-পূর্ব (প্রি এইচ আওয়ার বােম্বার্টমেন্ট) গােলাবর্ষণ শুরু করা হয়। আর্টিলারি ও মটর ফায়ারের আড় গ্রহণ করে মূল দল উত্তর দিক।
থেকে আক্রমণ রচনা করে। পাগলা দেওয়ান এলাকার বিভিন্ন জনগণ থেকে জানা যায় যে, স্বল্প শিক্ষিত বিভিন্ন পেশার লােকবল নিয়ে গঠিত ও হালকা অস্ত্রে সজ্জিত মুক্তিযােদ্ধাদের আক্রমণ প্রশিক্ষিত পাকিস্তানি সেনাদের প্রতিরক্ষায় উল্লেখযােগ্য ফলাফল অর্জন করতে ব্যর্থ হয়। পূর্ব প্রস্তুতকৃত প্রতিরক্ষা অবস্থান থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রচণ্ড পাল্টা গােলাগুলির মুখে মুক্তিযােদ্ধাদের আক্রমণ পাগলা দেওয়ান ক্যাম্পে পৌছাতে পারেনি। আক্রমণের ব্যর্থতা বুঝতে পেরে মুক্তিযােদ্ধারা একপর্যায়ে নিজেদের মটার পজিশনের সঙ্গে যােগ দিয়ে পাগলা দেওয়ান ক্যাম্পে অনবরত গুলিবর্ষণ করতে থাকেন। দিনের আলাে উদ্ভাসিত হওয়ার সাথে সাথে পাকিস্তানি সেনারা নিজেদের প্রতিরক্ষার পরিখা থেকে উঠে ফায়ার অ্যান্ড মুভ কৌশলের মাধ্যমে মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থানের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। এদিকে মুক্তিযােদ্ধাদের গােলাবারুদ শেষ হওয়ার উপক্রম হওয়ায় তারা যুদ্ধে ক্ষান্ত দিয়ে ভারতের দিকে পালিয়ে যায়। জয়পুরহাট এলাকার মুক্তিযােদ্ধা ও জনগণের মাধ্যমে জানা যায় যে, এ যুদ্ধে কমপক্ষে ৩জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। মুক্তিযােদ্ধাদের কয়েকজন সামান্য আহত হলেও কেউ নিহত হন নি। এ আক্রমণ রচনার পূর্বে একইভাবে মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে বেশ কয়েকবার মুক্তিযােদ্ধারা এ ক্যাম্পে আক্রমণ পরিচালনা করেছিলেন, যার সঠিক দিন ও তারিখ সংগ্রহ করা সম্ভব হয় নি। বিশ্লেষণ ও পর্যালােচনা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জয়ের কারণ পাকিস্তানি বাহিনী সুশিক্ষিত ও প্রশিক্ষত একটি নিয়মিত বাহিনী। পাগলা দেওয়ানে প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণের পর পর্যায়ক্রমে এ অবস্থানকে একটি শক্ত ঘাটিতে রূপান্তরিত করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ সময় ধরে পাকিস্তানি বাহিনী। প্রচুর পরিমাণে অস্ত্র, গােলাবারুদ ও সরঞ্জামাদি প্রতিরক্ষা অবস্থানের ভিতর মজুদ করেছিল। এ ছাড়া দেশীয় রাজাকারদের সহযােগিতায় গােয়েন্দা তথ্য পেতে তাদের বেগ পেতে হতাে না। এসব কারণেই পাগলা দেওয়ান যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাজিত করা সম্ভব হয় নি। মুক্তিবাহিনীর পরাজয়ের কারণ পাগলা দেওয়ান যুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধাদের পরাজয়ের কারণ নিচে উল্লেখ করা হলাে: ক. স্বল্প শিক্ষিত, স্বল্প প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও স্বল্প সময়ে গঠিত অনিয়মিত বাহিনী। খ, অস্ত্র, গােলাবারুদ ও প্রশাসনিক সমর্থনের অভাব। গ. অপর্যাপ্ত গােয়েন্দা তথ্য।
শিক্ষণীয় বিষয়
শত্রুবাহিনীর প্রকৃত অবস্থা, শক্তি, প্রস্তুতি ইত্যাদি সম্বন্ধে যথাযথভাবে অবগত ও নিশ্চিত না হয়ে যুদ্ধ পরিকল্পনা করে কার্য সম্পাদন ফলপ্রসূ হয় না। পাগলা দেওয়ান যুদ্ধের ফলাফল এটাই শিক্ষা দেয়।
উপসংহার
পাগলা দেওয়ান গ্রামটি সীমান্তসংলগ্ন হওয়ায় কৌশলগত দিক দিয়ে এর গুরুত্ব উভয় বাহিনীর কাছে সমমূল্যমানের ছিল। এখানে প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণের পর থেকে পাকিস্তানি বাহিনী নিয়মিত টহল ও অপারেশনের মাধ্যমে অসংখ্য নিরস্ত্র সাধারণ জনগণের উপর অবর্ণনীয় নির্যাতন চালায়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাগলা দেওয়ানের মাঠ ও শস্যক্ষেতে শহিদদের অসংখ্য কঙ্কালের সন্ধান পাওয়া গেছে। স্থানীয় জনগণের কাছ থেকে জানা যায় যে, ১৯৭২ সালের প্রথম দিকে জমি চাষের সময় লাঙলের ফলার সঙ্গে মৃত মানুষের অসংখ্য কঙ্কালের সন্ধান পাওয়া গেছে। এসব কঙ্কাল একত্র করে পাগলা দেওয়ান গ্রামের পাশে গণকবরে সমাহিত করার মাধ্যমে সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। পাকিস্তানি বাহিনীর এ নির্মম অত্যাচারের কাহিনী এ দেশের জনগণ কখনােই ভুলবে না।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান -ষষ্ঠ খন্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!