You dont have javascript enabled! Please enable it!
মাঝিড়ার অভিযান (অ্যামবুশ)
ভূমিকা
মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে মুক্তিবাহিনীর সাহসিকতা ও বীরত্বপূর্ণ অভিযানে পাকিস্তানি বাহিনী দিশেহারা হয়ে পড়ে। দুর্দমনীয় মুক্তিযােদ্ধাদের মুহুর্মুহু আঘাতে বিপর্যস্ত পাকিস্তানি বাহিনী আরেকটি আঘাত পায় মাঝিড়ায়। যুগপৎ মুক্তিযােদ্ধাদের ২টি সফল অভিযানে প্রভূত ক্ষতির সম্মুখীন হয় পাকিস্তানি সেনারা।
যুদ্ধের পটভূমি
মাঝিড়ার উপর দিয়ে চলে যাওয়া ঢাকা-বগুড়া মহাসড়কটি ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর প্রধান সরবরাহ রাস্তা। এ রাস্তা দিয়ে মূলত উত্তরবঙ্গের সাথে পাকিস্তানি বাহিনীর যােগাযােগ রক্ষা হতাে। পাকিস্তানি বাহিনী বিভিন্ন সময় এ রাস্তা দিয়ে উত্তরবঙ্গে তাদের বিভিন্ন রকমের রসদ সরবরাহ করতাে। মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি বাহিনীর এ যােগাযােগ ব্যবস্থাকে সংকটময় করার জন্য এ অভিযানের পরিকল্পনা করে। ভূমির পরিচিতি মাঝিড়া বগুড়া শহর থেকে আনুমানিক ৮-৯ কিলােমিটার দক্ষিণে অবস্থিত। মাঝিড়ার পশ্চিমে ডােমন পুকুর, দক্ষিণে সেনানিবাস এবং পূর্বে দুবলাগাড়ি অবস্থিত। শুষ্ক মৌসুমে এলাকার রাস্তা দিয়ে সব ধরনের যানবাহন চলাচল করতে পারে। এলাকাটি প্রচুর গাছপালা পরিবেষ্টিত এবং তা সব ধরনের আড় প্রদান করে। মাঝিড়ার মাঝ দিয়ে চলে যাওয়া বগুড়া-ঢাকা মহাসড়কটি উত্তরাঞ্চলের সাথে ঢাকার যােগাযােগ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মাঝিড়ার পূর্ব দিক দিয়ে করতােয়া নদী, যা দিয়ে ছােটো নৌযান চলাচলে সক্ষম। যুদ্ধের সংগঠন যুদ্ধের সংগঠন নিম্নরূপ: ক. পাকিস্তানি বাহিনী: ১টি পর্যবেক্ষণ টহল দল এবং ১টি গাড়ির বহর। খ. মুক্তিবাহিনী: ৭ নম্বর সেক্টরের ৩টি মুক্তিযােদ্ধা গ্রুপ।
যুদ্ধের বর্ণনা
১৯৭১ সালের ২ ডিসেম্বর ৯টায় বগুড়া সদর থেকে পাকিস্তানি সেনাদের ১টি পর্যবেক্ষণ টহল দল পায়ে হেঁটে মাঝিড়ার দিকে আসছিল। এ সময় মাে. জহুরুল ইসলামের নেতৃত্বে ১টি মুক্তিযােদ্ধা দল দুবলাগাড়ি হাটের উত্তরে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অবস্থান করছিল। স্থানীয় একজন লােকের কাছে পাকিস্তানি সেনাদের আগমন সংবাদ পেয়ে মুক্তিযােদ্ধা অধিনায়ক জহুরুল ইসলাম ১০১২জন মুক্তিযােদ্ধা নিয়ে মাঝিড়া মহাসড়কের পূর্ব পাশে মাঝিড়া বাজারের ৮০০ গজ উত্তরে অবস্থান নেন। পাকিস্তানি সেনারা ২০০ গজের মধ্যে এসে পড়লে মুক্তিযােদ্ধারা গুলিবর্ষণ শুরু করেন। প্রাথমিক গােলাবর্ষণে পাকিস্তানি সেনাদের কেউ গুলিবিদ্ধ হয় নি। গুলিবর্ষণ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা পশ্চিম দিকে দৌড়ে পালাতে শুরু করলে। মুক্তিযােদ্ধারা তাদের পিছু ধাওয়া করেন। সম্মুখযুদ্ধের একপর্যায়ে ৯জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। পরদিন ৩ ডিসেম্বর আনুমানিক বেলা ১০টায় একই স্থানে বগুড়া থেকে ঢাকাগামী ১টি পাকিস্তানি সেনাবাহী গাড়ির উপর জহুরুল ইসলাম, এ এফ এম ফজল ও নজীবর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযােদ্ধাদের ৩টি দল অ্যামবুশ পাতে লক্ষ্যবস্তু অ্যামবুশ এলাকায় প্রবেশ করলে মুক্তিযােদ্ধারা গুলিবর্ষণ করেন।
ফলে অজ্ঞাতসংখ্যক পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। গাড়ির ভিতর থেকে পাকিস্তানি সেনাদের গুলিবর্ষণে শ্রীধীরেন কুমার নামে ১জন মুক্তিযােদ্ধা নিহত হন। সাফল্যের কারণ মুক্তিবাহিনীর অভিযানটি হঠাৎ পরিকল্পিত এবং দ্রুত পরিচালিত হলেও তা অবিসংবাদিতভাবে সফল হয়েছিল। একটি ক্ষুদ্র দল নিয়েও মুক্তিযােদ্ধা অধিনায়ক অত্যন্ত সাহসিকতা ও বীরত্ব প্রদর্শন করে একটি সতর্ক শত্রু সেনার টহল দলকে নির্মূল করতে সক্ষম হয়েছিল। এ অভিযানে সফলতার কারণগুলাে নিচে উল্লেখ করা হলাে: ক. পাকিস্তানি সেনাদের চলাচলের সঠিক তথ্য যথাসময়ে পাওয়া। খ, অভূতপূর্ব সাহসিকতা ও বীরত্ব প্রদর্শন করে হঠাৎ আগত শত্রুকে  ধ্বংসের দৃঢ় সংকল্প। গ, ত্বরিত কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ। শিক্ষণীয় বিষয়। অভিযানটির সার্বিক বিশ্লেষণে নিমলিখিত শিক্ষণীয় বিষয়গুলাে পাওয়া যায়:
ক. জনসমর্থন গেরিলাযুদ্ধে জয়লাভের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।
খ, এলাকা সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান থাকা যুদ্ধ জয়ের পূর্বশর্ত।
গ, যুদ্ধজয়ের জন্য পর্যাপ্ত জনবল ও যুদ্ধাস্ত্রের প্রয়ােজনীয়তা অনস্বীকার্য।
উপসংহার
মাঝিড়ার এ ক্ষুদ্র ২টি অ্যামবুশের মাধ্যমে মুক্তিযােদ্ধারা পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে এ সড়কটিকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছিল। যদিও সংঘর্ষটি তেমন বিরাট আকারের নয়, তবু মুক্তিযােদ্ধারা যে জালের মতাে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিলেন এবং তাদের দৃঢ়তা ও সাহসিকতা যে কোনাে অংশেই কম ছিল না, মাঝিড়ার এ অ্যামবুশ অভিযানের মাধ্যমে সেটাই প্রতীয়মান হয়।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান -ষষ্ঠ খন্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!