সান্তাহারের অভিযান (অ্যামবুশ)
ভূমিকা
সান্তাহার শহরটি দখলে রাখার জন্য পাকিস্তানি বাহিনী শহরস্থিত একটি ওয়ার্কশপে তাদের ক্যাম্প স্থাপন করে। এ ক্যাম্পটির অবস্থান শহরের প্রাণকেন্দ্রে হওয়ায় গােটা শহর তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকতাে। তা ছাড়া আশপাশের গ্রামগুলােয় বিভিন্ন অভিযান পরিচালনা এ ক্যাম্প থেকেই করা হতাে। মুক্তিযুদ্ধের সময় সান্তাহারে পাকিস্তানি সেনাদের সাথে মুক্তিবাহিনীর প্রায়ই ছােটো ছােটো সংঘর্ষ হতাে, যার ফলে প্রাণ দিতে হয়েছিল বেশ কয়েকজন মুক্তিযােদ্ধাকে। সুজিত কুমার ছিলেন তাদেরই একজন, যিনি এ বিশেষ। অভিযানে প্রাণ হারান। তার কথা সান্তাহারে বসবাসরত প্রতিটি মানুষ আজও স্মরণ করে সশ্রদ্ধচিত্তে। তাঁর স্মরণেই যুদ্ধের পর সান্তাহার রেল স্টেশনের পাশের রেলগেটটির নামকরণ করা হয় সুজিত রেলগেট।
যুদ্ধের পটভূমি
ওয়ার্কশপে অবস্থিত ক্যাম্পটিতে বিভিন্ন রকমের রসদ সরবরাহ, জনবল প্রতিস্থাপন এবং তথ্য সংগ্রহের জন্য পাকিস্তানি সেনারা প্রায়ই রেলপথে বগুড়া থেকে সান্তাহারে যাতায়াত করতাে। সান্তাহারের পাকিস্তানি সেনাদের বগুড়া থেকে সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন করার জন্যই মুক্তিবাহিনী অ্যামবুশের মাধ্যমে বগুড়াসান্তাহার রেল যােগাযােগসহ পাকিস্তানি সেনাদের ধ্বংসের পরিকল্পনা করে।
ভূমির পরিচিতি
বগুড়া শহর থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে আনুমানিক ৭০ কিলােমিটার দূরে সান্তাহার অবস্থিত। সান্তাহার রেলসড়কটি বগুড়া-সান্তাহার মহাসড়কের পাশ দিয়েই চলে। গেছে। স্বাধীনতার পূর্ব থেকেই সান্তাহার বড়াে একটি শহর হিসেবে পরিচিত। এবং এখানে বেশ কিছু কলকারখানা অবস্থিত। রেললাইন ও সড়কের পার্শ্ববর্তী। এলাকায় হালকা গাছপালা রয়েছে, যা সীমিত আড় প্রদানে সক্ষম। যুদ্ধের সংগঠন যুদ্ধের সংগঠন নিমরূপ: ক. পাকিস্তানি বাহিনী: ১ প্লাটুন। খ, মুক্তিবাহিনী: ৭ নম্বর সেক্টরের ২০-২৫জন মুক্তিযােদ্ধা।
যুদ্ধের বিবরণ
সান্তাহারের আশপাশে অবস্থানকারী মুক্তিযােদ্ধারা পাকিস্তানি বাহিনীর রেল যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন ও তাদের ক্ষতিসাধনের জন্য পরিকল্পনা করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী তাদের কয়েকটি ছােটো দল একত্র হয়। তারা বিভিন্ন সূত্র থেকে সংবাদ পায় যে, ১৯৭১ সালের ১ ডিসেম্বর বেশ কিছু পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্য রসদ নিয়ে ট্রেনযােগে সান্তাহার যাবে এমতাবস্থায় মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা। সান্তাহারে পাকিস্তানি সেনাদের বর্বরতার সমুচিত জবাব দেওয়ার জন্য একটি দুঃসাহসিক অ্যামবুশের পরিকল্পনা করে। এ অভিযানের নেতৃত্ব দেন। মােজাফফর হােসেন, মাে. আব্দুল আলীম সরদার ও মাে. আব্দুস সাত্তার। এ পরিকল্পনা অনুযায়ী মুক্তিযােদ্ধারা সান্তাহার রেল স্টেশন থেকে ৩০০ গজ পূর্বে রেললাইনের মাঝে বিস্ফোরক পেতে রাখে এবং রেললাইনের উত্তর প্রান্তে। গ্রামের আড়ে ছােটো ছােটো দলে ভাগ হয়ে ৮টার মধ্যে অবস্থান নেয়। আনুমানিক ১০টায় সান্তাহারগামী ট্রেনটি তাদের অ্যামবুশ এলাকায় প্রবেশ করা মাত্রই মুক্তিবাহিনী তাদের বিস্ফোরকের বিস্ফোরণ ঘটায়। বিস্ফোরণের ফলে ট্রেনের সামনের ২টি বগি লাইন থেকে নিচে পড়ে যায়। সামনের বগিতে থাকা। পাকিস্তানি সেনারা ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারায়।
পিছনের বগিতে থাকা ৩জন পাকিস্তানি সেনা পালাতে চেষ্টা করলে মুক্তিবাহিনী তাদের উপর গুলি চালালে তারা প্রাণ হারায়। পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে গুলিবিনিময়ের একপর্যায়ে। মুক্তিযােদ্ধা সুজিত গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারান। মুক্তিযােদ্ধাদের এ সফল অভিযানের ফলে সান্তাহারের সাথে পাকিস্তানি বাহিনীর যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সাফল্যের কারণ এ অ্যামবুশে মুক্তিবাহিনীর সফলতার কারণগুলাে নিম্নরূপ:
ক. যথাসময়ে তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছিল।
খ, ছােটো ছােটো দলের মধ্যে সঠিক সমন্বয়।
গ. আকস্মিকতা অর্জন।
ঘ. বিস্ফোরকের সফল ব্যবহার। ঙ. সঠিক নেতৃত্ব, সাহসিকতা ও দৃঢ় মনােবল ।
শিক্ষণীয় বিষয়
মুক্তিবাহিনীর এ সফল অভিযানটির মাধ্যমে নিম্নলিখিত শিক্ষণীয় বিষয়গুলাে উল্লেখ্য: ক. যে-কোনাে গেরিলাযুদ্ধে সমন্বয় সাধন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। খ, শক্রসম্পর্কিত সঠিক তথ্য সময়মতাে পেলে যুদ্ধে জয়লাভ সহজ হয়। উপসংহার সান্তাহারের এ অভিযানটি ছিল একটি সফল অভিযান। অ্যামবুশ অভিযানের একটি উল্লেখযােগ্য উদাহরণ হিসেবে এটি আমাদের সবার কাছেই চিরস্মরণীয়। হয়ে থাকবে।
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান -ষষ্ঠ খন্ড