জামালগঞ্জ রেলস্টেশন আক্রমণ
ভূমিকা
মুক্তিযুদ্ধের সময় জামালগঞ্জ রেল স্টেশন একটি কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ রেল স্টেশন হিসেবে ব্যবহৃত হতাে। এলাকার বিভিন্ন পাকিস্তানি ক্যাম্পে প্রশাসনিক কার্যাদি সম্পন্ন করার জন্য পাকিস্তান সামরিক বাহিনী জামালগঞ্জ রেল স্টেশনটি ব্যবহার করতাে। এ ছাড়া যােগাযােগের ক্ষেত্রে রেল মাধ্যমই ছিল এ এলাকার অধিক নির্ভরযােগ্য মাধ্যম। সে কারণে জামালগঞ্জ রেল স্টেশন ছিল উভয় বাহিনীর কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থাপনা। জামালগঞ্জ রেল স্টেশনটি আশপাশের পাকিস্তানি বাহিনীর জন্য লাইফ লাইন হিসেবে ব্যবহৃত হতাে।
পটভূমি
আক্কেলপুর, জামালগঞ্জ, জয়পুরহাটসহ আশপাশের পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্পে শক্তি বৃদ্ধি ও সরবরাহগুলাে পৌছানাের জন্য তথা সামগ্রিকভাবে প্রশাসনিক ব্যবস্থা পরিচালনার জন্য পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী জামালগঞ্জ রেল স্টেশনে পাকিস্তানি সেনাদের সরবরাহসামগ্রী প্রায় সব সময়ই স্থূপীকৃত ও গুদামজাত করে রাখতাে। এ সামগ্রীগুলোর সার্বক্ষণিক পাহারা তথা নিরাপত্তা বিধানে নিয়ােজিত সৈন্যদের মধ্যে অধিকাংশই ছিল রাজাকার, তবে এ প্রহরী দলের। সাথে খুব অল্পসংখ্যক পাকিস্তানি সেনা মাঝে মাঝে অবস্থান করতাে। বিভিন্ন সূত্রের মাধ্যমে জানা যায় যে, সম্ভবত একজন মেজর পদবির কর্মকর্তা স্টেশন এলাকার সামগ্রিক সরবরাহ ব্যবস্থা তদারকির জন্য অবস্থান করতেন। সহজেই অনুমেয় যে, পাকিস্তানি বাহিনীর রসদসামগ্রী ও যুদ্ধসরঞ্জাম ধ্বংস করার উদ্দেশ্যেই আক্রমণটি পরিচালিত হয়েছিল। তবে এলাকার জনগণের কাছ থেকে জানা যায় যে, মুক্তিযােদ্ধারা পূর্বেও বেশ কয়েকবার জামালগঞ্জ রেল স্টেশন। আক্রমণ করেছিলেন, যার সঠিক দিন ও তারিখ সংগ্রহ করা সম্ভব হয় নি।
ভূমির পরিচিতি
জামালগঞ্জ রেল স্টেশনটি জয়পুরহাট ও আক্কেলপুরের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত। আক্কেলপুর, জামালগঞ্জ ও জয়পুরহাট এসব শহরগুলাের মধ্যে রেললাইনই ছিল। যােগাযােগের প্রধান মাধ্যম। তবে সব ঋতুতে সড়কপথেও চলাচল সম্ভব ছিল। স্টেশন এলাকাটিতে কিছু দোকান ও কয়েকটি কাঁচা-পাকা বাড়ি ছিল। এ ছাড়া রেল কর্মচারীদের কিছু সরকারি পাকা আবাস ছিল। জামালগঞ্জ শহরটিতে বেশ কিছুসংখ্যক অবাঙালির বসবাস থাকায় এলাকাটি ছিল সাধারণ জনগণের কাছে আতঙ্কস্বরূপ। জনবসতি স্টেশন থেকে ২৫০-৩০০ গজ দূরে অবস্থিত ছিল। স্টেশনের দক্ষিণে ৭০০ গজ দূরে একটি রেলওয়ে কালভার্ট ছিল।
যুদ্ধের সংগঠন
যুদ্ধের সংগঠন নিম্নরূপ: ক, পাকিস্তানি বাহিনী: বিভিন্ন তথ্যের ভিত্তিতে অনুমেয় যে, জামালগঞ্জ রেল স্টেশনে পাকিস্তানি বাহিনীর স্বল্পসংখ্যক সৈন্য এবং ১ প্লাটুন জনবলের রাজাকার জামালগঞ্জ স্টেশনের নিরাপত্তার জন্য নিয়ােজিত ছিল। তবে সঠিক জনবলের হিসাব বিভিন্ন মাধ্যমে অনুসন্ধান করেও জানা সম্ভব হয় নি। মুক্তিবাহিনী: ভারতের অভ্যন্তরে অবস্থিত মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প তরঙ্গপাড়া থেকে জামালগঞ্জ নিবাসী মুক্তিযােদ্ধা দেলােয়ারের নেতৃত্বাধীনে প্রায় ৫০জন মুক্তিবাহিনীর সদস্য। শত্রুপক্ষের বিন্যাস জামালগঞ্জ রেল স্টেশনের প্লাটফর্মে সব সময়ের জন্যই বিভিন্ন ধরনের রসদসামগ্রী ও যুদ্ধসরঞ্জাম স্তৃপীকৃত থাকতাে। এসব রসদসামগ্রী ও যুদ্ধসরঞ্জামের নিরাপত্তার জন্য স্টেশনের দক্ষিণ ও উত্তর প্রান্তে দুজন করে রাজাকার ও মধ্যবর্তী স্থানে মূল দল অবস্থান করতাে।। যুদ্ধের বিবরণ সম্ভবত এ আক্রমণটি পরিচালিত হয়েছিল নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসের কোনাে এক সময়। আক্রমণ পরিচালনা করা হয়েছিল রেল স্টেশনের উত্তর দিক থেকে। রেল স্টেশনের অবস্থান, শক্রর জনবল এবং বিভিন্ন পজিশন বিবেচনা করে প্রথমে স্টেশনের দক্ষিণে অবস্থিত রেলওয়ে কালভার্টে বিস্ফোরণ ঘটানাের মাধ্যমেই কর্তব্যরত পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা এবং তারপর স্টেশনের উত্তর দিক থেকে মূল আক্রমণ পরিচালনা করার পরিকল্পনা। গ্রহণ করা হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী মুক্তিবাহিনীর দলটি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। একটি অংশ স্টেশনের অদূরে দক্ষিণ পাশের ব্রিজটি বিস্ফোরকের মাধ্যমে উড়িয়ে দেয়। ফলে বিস্ফোরণের মাধ্যমে আক্রমণের আকস্মিকতা অর্জিত হয়।
একই সাথে শক্রর মনােযােগ ভিন্ন দিকে আকর্ষণপূর্বক শক্রকে দ্বিধান্বিত করার মাধ্যমে রাজাকার ও পাকিস্তানি বাহিনীকে বিশৃঙ্খল করে দেওয়া হয়। ফলে মুক্তিবাহিনীর অ্যাকশন দল আক্রমণ পরিচালনা করে প্রহরীদের নিরস্ত্র করে। প্লাটফর্ম দখল করে নেয় এবং সরবরাহের বড়াে একটা অংশ কুরিত ধ্বংস করে দ্রুত পশ্চাদপসরণ করে। কার্যসম্পাদনকালে নিজ অধিনায়ক দেলােয়ার আহত হলে মুক্তিযােদ্ধাদের একটি অংশ আহত অধিনায়ককে নিয়ে মধুপুর ইউনিয়নের নহেলা গ্রামে আশ্রয় নেয়। পরবর্তী সময় তারা সবাই একজন একজন করে নিজ ক্যাম্পে তরঙ্গপুরে ফেরত যান। এ যুদ্ধে ১জন অবাঙালি রাজাকার নিহত হয়।
বিশ্লেষণ ও পর্যালােচনা
মুক্তিবাহিনীর জয়ের কারণ ক, মুক্তিযােদ্ধাদের উদ্দেশ্য ছিল অত্যন্ত স্বচ্ছ ও সাধারণ অর্থাৎ পাকিস্তানি বাহিনীকে নাজেহাল ও তাদের রসদসামগ্রী ধ্বংস করা। সে কারণে। তাদের উদ্দেশ্য সফল হয়। খ. আকস্মিকতা অর্জনের মাধ্যমে বিশৃঙ্খল শত্রুর উপর পরিকল্পিত আক্রমণ। গ. সহজ আক্রমণ পরিকল্পনা। ঘ. শক্র সংগঠনের বড়াে অংশ অল্প শিক্ষিত রাজাকার নিয়ে গঠিত। পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয়ের কারণ ক. পাকিস্তানি বাহিনীর জনবলের স্বল্পতা। খ. রাজাকারের প্রাধান্যে প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ। গ, মুক্তিযােদ্ধার সংখ্যাধিক্য। ঘ. সীমান্তের কাছে থাকায় মুক্তিবাহিনীর নিশ্চিত পশ্চাদপসরণের সুবিধা।ঙ. ভূমি বিন্যাসের উপর মুক্তিযােদ্ধাদের অধিক ভালাে ধারণা। শিক্ষণীয় উদ্দেশ্য অনুযায়ী পরিকল্পনা এবং সে পরিকল্পনার সফল কার্যসম্পাদন অভিযানকে সার্থক ও ফলপ্রসূ করে তুলতে সক্ষম। প্রতিপক্ষ অপেক্ষা নিজস্ব বাহিনী শক্তির দিক দিয়ে দুর্বল হলেও আকস্মিকতা অর্জনের মাধ্যমে সাফল্য অর্জন সম্ভব।
উপসংহার মুক্তিবাহিনী কর্তৃক জামালগঞ্জ রেল স্টেশনের আক্রমণটি একটি সম্যক ও। পরিপূর্ণ অভিযান হিসেবে চিহ্নিত না হলেও পাকিস্তানি বাহিনীকে ব্যতিব্যস্ত ও নাজেহাল করার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে পরিগণিত। জামালগঞ্জ রেল স্টেশনে রক্ষিত পাকিস্তানি হানাদারদের রসদ ও যুদ্ধসামগ্রী ধ্বংসের জন্য মুক্তিযােদ্ধাদের বারবার আক্রমণ পাকিস্তানি বাহিনীর মনােবল ও শক্তিকে দুর্বল করে দিয়েছে। স্থানীয় অবাঙালিরাও মুক্তিযােদ্ধাদের আক্রমণের আশঙ্কায় সব সময়ই আতঙ্কগ্রস্ত থাকতাে। ফলে পাকিস্তানি বাহিনীর সামগ্রিক কার্যক্রম একের। পর এক বাধাগ্রস্ত হতে থাকে, যা মুক্তিযােদ্ধাদের মনােবল বৃদ্ধিতে সহায়ক ছিল। মুক্তিযােদ্ধাদের এ রকম ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সফল আক্রমণের পরিসমাপ্তিই হচ্ছে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের বিজয়।
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান -ষষ্ঠ খন্ড