You dont have javascript enabled! Please enable it! হিলির যুদ্ধ - সংগ্রামের নোটবুক
হিলির যুদ্ধ
ভূমিকা
মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাথায় মহিমান্বিত এ হিলির যুদ্ধ। এটাকে বৃহত্তর বগুড়ার সবচেয়ে ভয়ংকর যুদ্ধও বলা যেতে পারে। এ ছাড়া হিলির যুদ্ধ হাতে-গােনা। কয়েকটি প্রচলিত (Conventional) ও সুসংগঠিত যুদ্ধের মধ্যেও অন্যতম একটি। মিত্রবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত মুষ্টিমেয় কয়েকটি যুদ্ধের অন্যতম এটি। একটি সুসংগঠিত শক্রর প্রতিরক্ষাব্যুহের উপর আক্রমণ রচনা করে এক দুঃসাহসিক ইতিহাসের সৃষ্টি করেছিল এ যুদ্ধ। অন্যান্য জায়গায় একটি যুদ্ধের মাধ্যমে জয়-পরাজয় নির্ধারিত হলেও হিলির জয় সুনিশ্চিত করতে ২টি যুদ্ধের প্রয়ােজন হয়। এর প্রথমটি ২২-২৩ নভেম্বর এবং দ্বিতীয়টি ৯-১১ ডিসেম্বরে সংঘটিত হয়। পাকিস্তানি ও ভারতীয় বাহিনীর জন্য এটি সম্মান তথা গৌরব প্রতিষ্ঠার যুদ্ধ। তাই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের পাতায় হিলির যুদ্ধ চিরভাস্বর হয়ে থাকবে।
যুদ্ধের পটভূমি
হিলি বাংলাদেশের উত্তরের একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর ও অন্যতম যােগাযােগকেন্দ্র। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে অবস্থানের কারণে এর গুরুত্ব অনেক। বাংলাদেশ ও ভারতের স্বল্প দূরত্বে এবং সরাসরি প্রবেশদ্বারে হিলি অবস্থিত। পাকিস্তানিরা ভারতীয় সৈন্যের বাংলাদেশে প্রবেশ রােধকল্পে এ গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান বেছে নেয়। এবং দুর্গ গড়ে তােলে। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকেই বাংলাদেশের প্রবেশদ্বারে শত্রুর এ দুর্গ গুড়িয়ে দেওয়ার প্রেক্ষাপটেই হিলির আক্রমণ রচিত হয়। ভূমির পরিচিতি হিলি বাংলাদেশের উত্তরের একটি সীমান্ত শহর যা জয়পুরহাট জেলার অন্তর্গত বাংলাদেশ ও ভারত দুই অংশেই এর বিস্তৃতি। বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি মহাসড়ক হিলির অবস্থান তাই এটাকে বাংলাদেশের গেটওয়ে বলা যায়। উত্তর-পশ্চিম সেক্টরের এ গেটওয়ে সরাসরি ঘােড়াঘাট ও গাইবান্ধাকে সংযােগ করে। হিলির প্রাণকেন্দ্র দিয়ে বগুড়া, ঘােড়াঘাট, চরকাই এবং অন্যান্য সড়ক অতিক্রম করেছে। এ ছাড়া একটি ব্রডগেজ রেললাইন হিলির মধ্য দিয়ে অতিক্রম করেছে, যা পার্বতীপুর থেকে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের মধ্যে সংযােগ স্থাপন করেছে। এ ছাড়া হিলির চতুর্দিকে ৪০০-৬০০ মিটার দূরত্বে অনেক গ্রাম ছিল, যার মধ্যে আবার অনেক পাড়বিশিষ্ট পুকুরও ছিল। গ্রামের মধ্যে খােলা ধানক্ষেত ও মাঠ ছিল, যা সুন্দর ফিল্ড অব ফায়ার সুবিধা দেয়। কাঁচা ও পাকা দালান, পুকুর, সরু রাস্তা ও ধানক্ষেত – সব মিলিয়ে প্রতিরক্ষা গ্রহণের এক আদর্শ ভূমি রচনা করেছিল পাকিস্তানি বাহিনী। যুদ্ধের সংগঠন যুদ্ধের সংগঠন নিম্নরূপ: ক. পাকিস্তানি বাহিনী: ১. প্রথম যুদ্ধ (২২-২৩ নভেম্বর): ৬ কোম্পানি সৈন্য (ফোর্স।
ফ্রন্টিয়ার রাইফেলস), ১টি ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারি, ১টি মর্টার ব্যাটারি ও কিছু শ্যাফি ট্যাংক। ২. দ্বিতীয় যুদ্ধ: প্রথম যুদ্ধের অনুরূপ। খ, মিত্রবাহিনী: ১. প্রথম যুদ্ধ: ২০২ মাউন্টেন ব্রিগেডের ৩টি রেজিমেন্ট, ১ স্কোয়াড্রন ট্যাংক, ১টি মিডিয়াম রেজিমেন্ট আর্টিলারি, ২টি মাউন্টেন রেজিমেন্ট ও ১টি লাইট ব্যাটারি। ২. ২য় যুদ্ধ: ২০২ মাউন্টেন ব্রিগেডের ৩টি ব্যাটালিয়ন, ১টি কম্পােজিট ট্যাংক স্কোয়াড্রন, ১টি মাউন্টেন রেজিমেন্ট, ১টি আর্টিলারি ইউনিট ও ১টি মিডিয়াম ব্যাটারি এবং ১টি ইঞ্জিনিয়ার রেজিমেন্ট। শত্রুর বিন্যাস পাকিস্তানি বাহিনী ভূমির গুরুত্ব অনুধাবনপূর্বক প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করে। তারা দীর্ঘ সময় নিয়ে প্রতিরক্ষাব্যুহকে দুর্গ হিসেবে গড়ে তােলে। এ প্রতিরক্ষা অবস্থানের সামনে তারা ১ প্লাটুন সৈন্য দিয়ে স্ক্রিন অর্থাৎ আবরণী বা বেষ্টনী তৈরি করে, যা রেললাইনের পাশে বিস্তৃত গ্রাম যথা: নােয়াপাড়া, বাসুদেবপুর বিওপি, চান্দিপুর ও হিলি বিওপি’র সমন্বয়ে গঠিত। তারা প্রতিটি গ্রামকে শত্রুর ঘাঁটি হিসেবে রূপান্তর করে। গ্রামে ঢােকার পথে মাইন ফিল্ড পেতে দেয়। শ্যাফি ট্যাংকগুলাে এ ঘাঁটিতে বিন্যস্ত করা হয়। প্রতিটি ঘাঁটির মধ্যে যােগাযােগের জন্য ট্রেঞ্চ খনন করে। এ ছাড়া প্রতিটি অস্ত্রের বাংকারের জন্য ২ স্তরবিশিষ্ট ওভারহেড প্রােটেকশন স্থাপন করা হয়। এ শত্রু ঘাটির গভীরে গড়ে তােলা হয় শক্তিশালী মূল প্রতিরক্ষা অবস্থান।
যুদ্ধের বর্ণনা
প্রথম যুদ্ধ (২২-২৩ নভেম্বর, ১৯৭১) এটাকে মােরাপাড়া ও বাসুদেবপুরের যুদ্ধও বলা যায়। এ যুদ্ধে হেলিকপ্টারের মাধ্যমে রেকি করা হয়। ১৯৭১ সালের ২২ নভেম্বর ৮ গার্ডস কর্তৃক প্রথমে। নােয়াপাড়া ও পরের পর্বে মেরাপাড়া আক্রমণের পরিকল্পনা করা হয় সে অনুযায়ী ৮ গার্ডস ঘাসুরিয়ায় ফার্ম বেইস স্থাপন করে। গুড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির মধ্যে অতি সন্তর্পণে ‘সি’ কোম্পানি নােয়াপাড়া আক্রমণ করে রাত ৮টায়। অনেক জলাশয়, পুকুর এবং কর্দমাক্ত ও সিক্ত ভূমি পেরিয়ে এ আক্রমণ সার্থক হয়। রাতের অন্ধকারে নােয়াপাড়া শত্রুর পজিশন অক্ষত থাকে। এর পর ‘এ’ ও ‘বি’ কোম্পানি রাত দেড়টায় মােরাপাড়া আক্রমণ করে। বিন্যাস এলাকা অতিক্রমের পর পরই তারা আর্টিলারি ফায়ারসহ সব প্রতিরক্ষা ঘাঁটি থেকে ফায়ারের সম্মুখীন হয়। মন্থর হয়ে যায় আক্রমণের গতি এবং নিহতের সংখ্যা বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে ‘এ’ কোম্পানির অধিনায়ক ও উপ-অধিনায়ক শহিদ হন। কোম্পানির মাত্র ৫০জন দক্ষিণ ও পশ্চিম মােরপাড়ায় প্রতিরক্ষা অবস্থানে সম্মুখসমরে (Close combat) পৌছে। ‘বি’ কোম্পানি উত্তর-পূর্ব দিক থেকে আক্রমণে অনুরূপ বাধাপ্রাপ্ত হয়। কোম্পানি দক্ষিণ-পূর্ব পার্শ্ব দখল করলেও গ্রাম শত্রুমুক্ত হয় না। এ পর্যায়ে ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক চতুর্থ কোম্পানিকে গ্রাম শত্রুমুক্ত করার জন্য আক্রমণে তলব করে। দ্রুতগতিতে ভয়ংকর এক যুদ্ধ শেষে ‘এ’ কোম্পানি উত্তর ও পশ্চিমে কিছু জায়গা দখল করলেও ফলাফল আসে না। ভােররাতে সম্মুখসমরে ‘এ’ কোম্পানি অধিনায়কও শহিদ হন। এ পর্যায়ে ব্রিগেড অধিনায়ক ৫ গারওয়ালের ১টি কোম্পানি প্রেরণ করেন বাসুদেবপুর। বিওপি দখলের জন্য।
এদিকে মােরাপাড়া পরিস্থিতির কোনাে উন্নতি হয় না। দিনের আলােয় আক্রমণকারীদের সাহায্যের জন্য প্রেরিত ট্যাংক স্কোয়াড্রন। সিক্ত, কর্দমাক্ত ও নরম ভূমির জন্য অগ্রসর হতে পারে না। এ পর্যায়ে ৫ গরওয়াল ও গার্ড শক্রর ব্যাপারে আরও তথ্য সংগ্রহের জন্য প্যাট্রলিং পরিচালনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং তারা মােরাপাড়াস্থ কোম্পানির সাথে। সংযােগ স্থাপন করে। অধিনায়ক দ্রুততার সাথে এ সাফল্যকে কাজে লাগিয়ে। মােরাপাড়া দখল করে নেয়। ইতােমধ্যে পাকিস্তানি ১টি কোম্পানি পাল্টা। আক্রমণ রচনার জন্য মেরাপাড়ার দিকে অগ্রসর হয়। ভারতীয় ট্যাংক ও আর্টিলারির মুহুর্মুহু ফায়ারে সবাই হতবিহ্বল হয়ে দৌড়ে পালায়। দ্বিতীয় যুদ্ধ প্রথম যুদ্ধের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার আলােকে দুই বাহিনীই যুদ্ধের কূটকৌশল প্রয়ােগ অব্যাহত রাখে। ভারতীয় বাহিনী তাদের আক্রমণাত্মক প্যাট্রলিং বাড়িয়ে দেয়। অন্যদিকে, মােরাপাড়া ও নােয়াপাড়ার চারপাশে পাকিস্তানিরা প্রতিরক্ষা। অবস্থানকে আরও সুসংহত ও সুদৃঢ় করতে থাকে। দুই রাত পূর্ণাঙ্গ রেকির মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ অব্যাহত রাখে ভারতীয় বাহিনী। অতঃপর শুরু হয়। অনুপ্রবেশ ও রেইডের সংমিশ্রণে ভয়ংকর যুদ্ধ। ৯ ডিসেম্বর সন্ধ্যার পর ২২ মারাঠা মিত্রবাহিনী দুররা আক্রমণ করে এবং দখল করে। সন্ধ্যার পর পরই বারাঞ্চ গ্রাম দখল করে নেয় ২২ মারাঠা ।
শত্রুর শক্তি এবং ভূমির কথা চিন্তা করে ১০ ডিসেম্বর বিসাপাড়া আক্রমণ পরিচালনা করা হয় দিনের আলােয়। এদিকে ট্যাংক দ্বারা আউট ফ্ল্যাংকিং অপারেশন পরিচালনা করা হয়। সবশেষে অনেক কষ্টে বিসাপাড়া দখল হয়। একই ইউনিট দ্রুতগতিতে বাইগ্রাম আক্রমণ করে দখল করে নেয়। একই সময় ৮ গার্ডের ২টি কোম্পানি চান্দিপুরে রেইড পরিচালনা করে এবং ১১ ডিসেম্বর ভােরে শক্রমুক্ত করে। একইসাথে ২টি কোম্পানি আখক্ষেত, পাটক্ষেত ও ধানক্ষেতের মধ্য দিয়ে সেকশনে অনুপ্রবেশ করে উত্তর, দক্ষিণ ও পশ্চিম দিক দিয়ে দাঙ্গাপাড়াকে রেইড করে। এভাবে আখ, পাট ও ধানক্ষেতের মধ্য দিয়ে কোম্পানি সদর ঘিরে ফেলার পর পাকিস্তানিরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। ২টি কোম্পানি হাকিমপুরের দিকে অগ্রসর হতে দেখে এবং তাদের ফায়ারে টিকতে না পেরে শত্রু হাকিমপুর থেকে পশ্চাদপসরণ করে। সম্মুখযুদ্ধ শেষে দাঙ্গাপাড়া দখল করতে ১১ ডিসেম্বর দুপুর হয়ে যায়। দাঙ্গাপাড়া দখলের সাথে সাথে পাকিস্তানি প্রতিরক্ষার। যবনিকাপাত ঘটে। অবশেষে ১১ ডিসেম্বর ভােররাতে হিলি যুদ্ধের সমাপ্তি হয়। এবং ঘােড়াঘাট সড়ক উন্মুক্ত হয়।
বিশ্লেষণ ও পর্যালােচনা
মিত্রবাহিনীর বিজয়ের কারণ হিলির যুদ্ধে মিত্রবাহিনীর বিজয়ের কারণগুলাে নিম্নরূপ: ক. স্থানীয় সমর্থন: স্থানীয় সমর্থন যে দলে থাকে, তাদের জন্য বিজয় সহজ হয়। সমগ্র বাংলাদেশের অধিকাংশ জনগণ মুক্তিযােদ্ধাদের পক্ষে এবং পাকিস্তানিদের বিপক্ষে থাকায় এটি মুক্তিযােদ্ধাদের বিজয়ের কারণ। খ, যুদ্ধের যৌক্তিকতা: পাকিস্তানিদের যুদ্ধের কোনাে যৌক্তিকতা ছিল না। পক্ষান্তরে মুক্তিযােদ্ধারা স্বদেশের স্বাধীনতার জন্য জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেন, তাই এ যুদ্ধে মিত্রবাহিনীর বিজয় ত্বরান্বিত হয়। গ. নতুন রণকৌশলের ব্যবহার: হিলির দ্বিতীয় যুদ্ধ ছিল মূলত একটি রেইড, যা কোম্পানি শক্তির সৈন্যের দ্বারা করা হয়েছিল। রেইড যুদ্ধের সাধারণ কলাকৌশলের বাইরে এতে শত্রু এলাকায় গােপন অনুপ্রবেশ ও পরিচালনা করা হয়, যার আকস্মিকতা পাকিস্তানি সেনাদের হতবিহ্বল করে দেয়। যুদ্ধে জুনিয়র লিডারদের উদ্দীপনা: যুদ্ধে ভারতীয় সেনা দলের জুনিয়র লিডাররা পূর্ণ উদ্দীপনা প্রদর্শন করতে সক্ষম হন এবং উৎসাহ নিয়ে যুদ্ধ পরিচালনায় অংশ নেন, যা যুদ্ধের ক্রান্তিলগ্নের বিজয় ছিনিয়ে আনতে সাহায্য করে।
ঙ. সঠিক রণপরিকল্পনা: হিলি এলাকায় কঠিন প্রতিরােধ গড়ে তােলার মেধা ও সামর্থ্য পাকিস্তানিদের ছিল, যা বিবেচনায় রেখে অধিনায়ক ২০২ ব্রিগেড সরাসরি হিলিতে শত্রুর শক্ত অবস্থানে আঘাত না হেনে পরােক্ষভাবে হিলি আক্রমণের পরিকল্পনা করেন। এরই অংশ হিসেবে নােয়াপাড়া ও বাসুদেবপুর দখল করা হয়, যা মােরাপাড়ার মতাে একটি শক্ত অবস্থানকে আক্রমণের জন্য অনেক পথ উন্মুক্ত করে। আকস্মিকতা: অভিযান পরিচালনার পূর্বে শুধু ধোকা দেওয়ার উদ্দেশ্যে কোনােপ্রকার নিয়মিত বাহিনীর ব্যবহার না করে মুক্তিযােদ্ধাদের দ্বারা তথ্য সংগ্রহের কাজটি করা হয়েছিল। এতে পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিযােদ্ধাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্পর্কে বিভ্রান্ত হয়, ফলে আক্রমণের সময় ও দিক সম্পর্কে পূর্ণ রণকৌশলগত আকস্মিকতা অর্জন সম্ভব পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয়ের কারণ হিলির যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয়ের কারণগুলাে নিমরূপ:
ক. স্থানীয় সমর্থন না থাকা: বাংলাদেশের স্থানীয় জনগণ পাকিস্তান। সেনাবাহিনীর বিপক্ষে ছিল যা পাকিস্তানিদের টহল কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করে তুলেছিল। পক্ষান্তরে জনসমর্থন মিত্রবাহিনীকে পাকিস্তানি অবস্থানগুলাের কাছাকাছি পৌছে তাদেরকে ধ্বংস করতে সাহায্য করেছিল।
খ. আগাম সতর্কতার অভাব; অভিযান শুরু হওয়ার সময় পাকিস্তান। সেনাবাহিনী মূলত পিলবক্স পদ্ধতি, প্রতিরক্ষা অবস্থান নিয়েছিল, যাতে পর্যাপ্ত আগাম সতর্কীকরণ পদ্ধতি ছিল না। ফলে পাকিস্তানি বাহিনী। সঠিক সময়ে শক্তি বৃদ্ধি করতে ব্যর্থ হয় এবং সম্মিলিত বাহিনী। নিঃশব্দে তাদের কাছাকাছি এসে পাকিস্তানি বাহিনীকে ধ্বংস করে। সময়মতাে সঠিক সিদ্ধান্তের অভাব: মােরাপাড়ায় সময়মতাে শক্তি বৃদ্ধি করা সম্ভব হয় নি বলেই অবস্থানটি খুব দ্রুত মিত্রবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে যায়।
অন্যদিকে, দাঙ্গাপাড়া এলাকা থেকে ১ কোম্পানি সৈন্য সরিয়ে নিয়ে হাকিমপুরে প্রতি-আক্রমণ পরিচালনার জন্য পাঠানাে হয়, যা দাঙ্গাপাড়ার পাকিস্তানি অবস্থানটিকে দুর্বল করে দেয়। ৮ গার্ড রেজিমেন্ট এ সুযােগের সদ্ব্যবহার করে। মনােবলের অভাব: পাকিস্তান সেনাবাহিনী লুটপাট, ধর্ষণ এবং অসহায় বাঙালিদের হত্যার মতাে অসৈনিকসুলভ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছিল। ফলে স্বাভাবিকভাবেই তাদের শৃঙ্খলার মান কমে গিয়ে সেনাবাহিনীর মনােবল ও যুদ্ধস্পৃহা ভেঙে পড়ছিল। দেখা গেছে, অধিকাংশ স্থানে। যুদ্ধের জটিল সময়ে পাকিস্তানি বাহিনী রুখে না দাঁড়িয়ে মনােবলহীনতার কারণে অবস্থান ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার মতাে ঘটনা ঘটেছে। ঙ. প্রতিরক্ষা অবস্থানে আক্রমণাত্মক ভাবভঙ্গির অভাব: পাকিস্তানি বাহিনী। নিজেদের প্রতিরক্ষা অবস্থানের সামনে টহল বা প্রতিরক্ষামূলক গােলাগুলির কার্যক্রম পরিচালনা না করায় মিত্রবাহিনী পাকিস্তানি বাহিনীর মূল অবস্থানে নতুন সৈন্যদল দ্বারা আক্রমণ করতে সমর্থ হয়।
উপসংহার
তুমুল সংঘর্ষপূর্ণ ও রক্তক্ষয়ী এ যুদ্ধে উভয় বাহিনীই অত্যন্ত বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে। এ জন্যই এ যুদ্ধে উভয় বাহিনীর উল্লেখযােগ্যসংখ্যক যােদ্ধা বীরত্বের খেতাবে ভূষিত হয়। এ যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর জানমালের প্রভূত ক্ষতি। হয়, ফলে তাদের মনােবল ভেঙে যায়। উত্তরের সেক্টরে এ সাফল্যের ধারাবাহিকতায় মিত্রবাহিনী চূড়ান্ত বিজয়ের দিকে একধাপ এগিয়ে যায়।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান -ষষ্ঠ খন্ড