সুখানপুকুরের যুদ্ধ (অ্যামবুশ)
ভূমিকা
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় যখন মুক্তিযােদ্ধারা মুক্তির নেশায় উন্মত্ত তখন দেশের সর্বত্র অবস্থানরত পাকিস্তানি বাহিনী যত্রতত্র মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের শিকার হতে থাকে। পাকিস্তানি বাহিনীর সরবরাহব্যবস্থাকে ভেঙে দেওয়ার পদক্ষেপ নেন মুক্তিবাহিনী। তারই একটি অংশ হিসেবে সুখানপুকুর রেল স্টেশনের অদূরে ফাঁদ পাতেন স্থানীয় মুক্তিযােদ্ধারা।
যুদ্ধের কারণ ও পটভূমি
বগুড়া শহরে তখন পাকিস্তানি বাহিনীর ২০৫ পদাতিক ব্রিগেড অবস্থান করছিল। এ ব্রিগেডের ২টি কোম্পানি সােনাতলা প্রাথমিক স্কুল প্রশিক্ষণকেন্দ্রে অবস্থান নিয়েছিল। এ ২ কোম্পানির অধীনে সৈন্যদল সােনাতলা থানার বিভিন্ন ইউনিয়ন ও গ্রামের দখল নিয়েছিল এবং গ্রামবাসীর উপর চালাচ্ছিল অবর্ণনীয় নির্যাতন। পাকিস্তানি বাহিনীর এসব ক্ষুদ্র দলগুলাের একমাত্র যােগাযােগ মাধ্যম ছিল রেলপথ। বগুড়া সদর থেকে খাদ্য সরবরাহ বােঝাই ট্রেনকে সােনাতলার সাথে বিচ্ছিন্ন করার প্রয়াস নিয়েই সুখানপুকুর রেল স্টেশনে মুক্তিবাহিনী কর্তৃক অ্যামবুশ পাতা হয়। ফলে সােনাতলা এলাকার আশপাশের গ্রামগুলােয় অবস্থিত পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্পগুলােয় সব ধরনের সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়।
ভূমির পরিচিতি
বগুড়া জেলার সােনাতলা উপজেলার অন্তর্গত ছােটো একটি ইউনিয়ন সুখানপুকুর। বগুড়া জেলার সদর থেকে ১২ কিলােমিটার উত্তরে এবং সােনাতলা উপজেলা সদর থেকে ১৮ কিলােমিটার দক্ষিণে অবস্থিত। এর ৩-৪ কিলােমিটার উত্তরে ভেলুরপাড়া সবচেয়ে নিকটবর্তী ইউনিয়ন। এখানে একটি রেল স্টেশন। আছে যা কলেজ স্টেশন নামে পরিচিত। এ স্টেশন থেকে উত্তরে ভেলুরপাড়াসােনাতলা হয়ে সান্তাহার এবং দক্ষিণে গাবতলী হয়ে বগুড়ার সাথে রেল যােগাযােগ বিদ্যমান। এর পূর্বে যমুনা নদী। এ এলাকা প্রধানত সমতল এবং ঘন গাছপালায় পরিবেষ্টিত, যা যে-কোনাে চলাচলকে ভূমি ও আকাশ পর্যবেক্ষণ। থেকে পর্যাপ্ত আড় দেয়। এলাকার ভূমি খুবই উর্বর এখানকার প্রধান ফসলের মধ্যে ধান, পাট ও কলা বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। বর্ষা মৌসুমে খােলা ভূমিতে পানি জমে, যা পায়ে হেঁটে চলাচলের জন্য বিঘ্নতার সৃষ্টি করে।
যুদ্ধের সংগঠন
যুদ্ধের সংগঠন নিম্নরূপ: ক. পাকিস্তানি বাহিনী: ১জন হাবিলদারসহ ২০-২৫জন। খ. মুক্তিবাহিনী: অধিনায়ক রুহুল আমিন বাবলুসহ ২০জন। যুদ্ধের বর্ণনা। ১৯৭১ সালের শেষ দিকে মুক্তিযােদ্ধা অধিনায়ক রুহুল আমিন বাবলু ৮ নম্বর সেক্টর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল কাজী নুরুজ্জামানের কাছ থেকে যেকোনাে উপায়ে নভেম্বর মাসের মধ্যে বগুড়া-সােনাতলা রেল যােগাযােগ ধ্বংস করার আদেশ পান। ১০ নভেম্বর তিনি গােপন সাের্স মারফত খবর পান যে, ১৩ নভেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর খুব বড়াে একটা রসদ সরবরাহ হতে যাচ্ছে রেলপথের মাধ্যমে। এ ব্যাপারে নুরুল ইসলাম গােপন খবর দেওয়ার ব্যাপারে খুব বড়াে ভূমিকা রাখেন। পরিকল্পনামাফিক ১৩ নভেম্বর দিনের বেলায় তারা সুখানপুকুর রেল স্টেশনের উত্তরে ফাদ পেতে শত্রুর অপেক্ষা করতে থাকেন। কাট অফ পাটি-১ স্টেশনের দক্ষিণে রেলক্রসিংয়ের কাছে এবং কাট অফ পার্টি-২ স্টেশনের উত্তরে হাই স্কুলের দক্ষিণে অবস্থান নেয়। অ্যাকশন পাটি অবস্থান নেয় নওয়াপাড়ায়। যেহেতু শত্রুর ট্রেন রাতে চলাচল করতাে না, তাই দিনের বেলাতেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা লাইনের উপর প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভ পুঁতে রেখে শত্রুর রসদ সরবরাহের ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। আনুমানিক দুপুর আড়াইটার দিকে বগুড়া থেকে সােনাতলামুখী ট্রেনটি অ্যামবুশ সাইটের মধ্যে প্রবেশের সাথে সাথে অধিনায়ক রুহুল আমিন নিজ হাতে ইলেকট্রিক ডেটনেটরের মাধ্যমে এক্সপ্লোসিভ বিস্ফোরণ ঘটান।
বিকট শব্দে আকাশ-বাতাস কাপিয়ে ইঞ্জিনসহ। ৩টি বগি বিধ্বস্ত হয়ে খাদে পড়ে যায়। যােগাযােগ মাধ্যম বিকল হয়ে পড়ে। সে খাদটি আজও আছে। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ।
ক, পাকিস্তানি বাহিনী: ট্রেনের ইঞ্জিনসহ মােট ৩টি বগি বিধ্বস্ত ও লাইনচ্যুত হয় এবং রেলপথের যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
খ. মুক্তিবাহিনী: কোনাে ক্ষয়ক্ষতি হয় নি।
বিশ্লেষণ ও পর্যালােচনা
মুক্তিবাহিনীর বিজয়ের কারণ এ যুদ্ধ পর্যালােচনায় দেখা যায়, মুক্তিবাহিনীর বিজয়ের কারণগুলাে নিমরূপ: ক, ঠিক সংবাদ সংগ্রহ: সঠিক সময়ে পাকিস্তানি বাহিনীর রসদ সরবরাহের গােয়েন্দা তথ্য সঠিক পদক্ষেপ নিতে সাহায্য করে। খ. স্থানীয় ভূমি সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান ও পরিচিতি: কোনাে জায়গায় অ্যামবুশ পাতলে নিরাপদ দূরত্ব থেকে ব্যাপক ক্ষতিসাধন সম্ভব, তা স্থানীয় ভূমি সম্পর্কে সঠিক জ্ঞানের দ্বারাই সম্ভব হয়েছিল।
গ. সঠিক রেকি: মুক্তিবাহিনীর রেকি ও দীর্ঘ পরিকল্পনা ছিল সঠিক । তাই মুক্তিযােদ্ধাদের জয় হয়েছিল। ঘ. সাহসিকতা ও দৃঢ় মনােবল: মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর ছিল অফুরন্ত মনােবল, যা তাদের জুগিয়েছিল দৃঢ় সাহসিকতা। তাই জয় ছিল নিশ্চিত। পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয়ের কারণ এ যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনী যে কারণে পরাজিত হয়েছিল, তার মধ্যে উল্লেখ্যযােগ্য হলাে: ক, ভূমি সম্পর্কে অজ্ঞতা: অজ্ঞতার কারণে তারা কোথায় কাঁদের মধ্যে পড়তে পারে, সে সম্পর্কে অবগত ছিল না। যার ফলে কোনােপ্রকার নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নিতে পারে নি। মুক্তিবাহিনীকে দুর্বল মনে করা: পাকিস্তানিদের মনে একটা অহংকার জাগ্রত হয়েছিল বাঙালিদের বিরুদ্ধে মুক্তিবাহিনীকে দুর্বল মনে করার কারণে তারা কোনাে নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থাই গ্রহণ করে নি, যার ফলে মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে তারা দাঁড়াতেই পারে নি। গ. স্থানীয় সমর্থনের অভাব: পাকিস্তানিদের ছিল না কোনাে স্থানীয় সহযােগিতা।
শিক্ষণীয় বিষয়
প্রতিটি যুদ্ধ ভবিষ্যতের জন্য কিছু না কিছু শিক্ষণীয় বিষয় রেখে যায়, যা ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় সহায়তা করে। এ যুদ্ধেও নিমােক্ত শিক্ষণীয় বিষয়গুলি ছিল: ক, সঠিক ও তাৎক্ষণিক সংবাদ প্রবাহ: সঠিক সময়ে সংবাদ যে-কোনাে ধরনের আক্রমণাত্মক পদক্ষেপ নিতে সহায়তা করে। খ, ভূমি সম্পর্কে জ্ঞান: ভূমি সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান থাকলে আকস্মিকতা অর্জন সম্ভব। একইভাবে নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করাও সম্ভব। গ, প্রতিপক্ষকে দুর্বল মনে না করা: যুদ্ধে প্রতিপক্ষকে দুর্বল মনে করা অনেক সময় পরাজয়ের কারণ হয়ে দেখা দেয়। সুতরাং, প্রতিপক্ষকে দুর্বল মনে করা উচিত নয়।
উপসংহার
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে দেশব্যাপী মুক্তিযােদ্ধাদের উপর্যুপরি ঝটিকা আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থা বেহাল হয়ে পড়েছিল। যেহেতু রসদ সরবরাহ সেনাবাহিনীর একটি প্রধান কার্যক্রম, তাই সুখানপুকুরের ফাদের গুরুত্ব কতখানি অপরিসীম, তা সহজেই অনুমেয়। এ ফাদে পতিত হয়ে সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সােনাতলায় অবস্থিত পাকিস্তানি বাহিনীর টিকে থাকাই প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে পড়েছিল।
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান -ষষ্ঠ খন্ড