You dont have javascript enabled! Please enable it!
পুরাতন আযিযুল হক কলেজ আক্রমণ
ভূমিকা
মুক্তিযােদ্ধারা বগুড়া শহরের অন্যান্য জায়গায় পাকিস্তানি সেনাদের অবস্থান। দুর্বিষহ করে তােলার পর অবশেষে নভেম্বর মাসে আঘাত হানে আযিযুল হক। কলেজে। এটি ছিল তাদের একটি বড়াে ধরনের অভিযান। মূলত এটি ছিল শত্রুপক্ষের নিয়ন্ত্রণকেন্দ্র। এ ক্যাম্পের মাধ্যমে শহরের ভিতর মুক্তিযােদ্ধাদের প্রবেশ রােধ করা হতাে। পাশাপাশি শহরের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের অপারেশন পরিচালনা এ ক্যাম্প থেকেই করা হতাে। পাকিস্তানি বাহিনীর বেশ কিছু উচ্চপদবির অফিসার এ ক্যাম্পে অবস্থান করতাে।
যুদ্ধের পটভূমি
কলেজটির অবস্থানগত কারণে পাকিস্তানি বাহিনী এ এলাকায় সুবিধাজনক অবস্থানে ছিল। কলেজের পূর্ব পাশে করতােয়া নদীর তীরে পাকিস্তানি বাহিনী। তাদের শক্ত প্রতিরক্ষাব্যুহ গড়ে তুলেছিল। তাই শহরের মধ্যে পূর্ব পাশ থেকে মুক্তিবাহিনীর প্রবেশ দুঃসাধ্য ছিল। এ এলাকাটিতে মুক্তিবাহিনী প্রথম থেকেই বেশ কিছু অভিযান পরিচালনা করে আসছিল। কিন্তু তেমন কোনাে সাফল্য অর্জন করতে পারেনি। বরং মুক্তিবাহিনীর ৩২জন মুক্তিযােদ্ধা পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে বিভিন্ন সংঘর্ষে নিহত হয়েছিল। পরবর্তী সময় নভেম্বর মাসের শেষে যখন মিত্রবাহিনী মুক্তিবাহিনীর সাথে যােগ দেয়, তখন মুক্তিবাহিনীর মনােবল আরও বৃদ্ধি পায় এবং আবারও ক্যাম্পটি আক্রমণের পরিকল্পনা করে।
ভূমির পরিচিতি
পুরাতন আযিযুল হক কলেজটি বগুড়া শহরের সাতমাথা থেকে ৩ কিলােমিটার উত্তরে অবস্থিত। তকালীন কলেজের পার্শ্ববর্তী এলাকায় অনেক উল্লেখযােগ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও স্থাপনা ছিল। এগুলাের মধ্যে একটি বড়াে এতিমখানা ও একটি মহিলা কলেজ উল্লেখযােগ্য। কলেজের পশ্চিমে মহাস্থানগড়-সাতমাথা সড়ক ভারি যানবাহন চলাচলের উপযােগী। এ ছাড়া শহরের বাকি রাস্তাঘাটগুলােও বেশ উন্নত। কলেজের পূর্ব পাশ দিয়ে করতােয়া নদী বহমান। তবে বর্ষাকাল ছাড়া এ নদীতে পানি খুব কম থাকে। যুদ্ধের সংগঠন যুদ্ধের সংগঠন নিম্নরূপ: ক. পাকিস্তানি বাহিনী: ২০৫ পদাতিক ব্রিগেডের আনুমানিক ১টি ব্যাটালিয়ন।
খ. মুক্তিবাহিনী: ৭ নম্বর সেক্টরের ৮০-৯০জন মুক্তিযােদ্ধা। গ. মিত্রবাহিনী: ২০২ মাউন্টেন ব্রিগেডের অংশ। যুদ্ধের বর্ণনা কলেজের পার্শ্বস্থিত এতিমখানাটি অনেক বড়াে জায়গা জুড়ে থাকায় এ এলাকাটি পাকিস্তানি বাহিনীর সদর দপ্তর হিসেবে ব্যবহৃত হতাে। তারা এখানে ২টি হেলিপ্যাডও নির্মাণ করেছিল। আযিযুল হক কলেজ ও মহিলা কলেজটিতে ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর বিশাল ক্যাম্প এবং এখানে প্রচুরসংখ্যক সৈন্য অবস্থান। করতাে। আযিযুল হক কলেজের পূর্ব পাশে করতােয়া নদীর তীর ঘেঁষে ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর শক্ত প্রতিরক্ষা অবস্থান। মুক্তিবাহিনী প্রথম থেকেই এ ক্যাম্পের আশপাশে ছােটো ছােটো অভিযান পরিচালনা করে আসছিল। কিন্তু উল্লেখযােগ্য কোনাে সফলতা অর্জন করতে পারে নি। বরং তাদের বেশ কিছু সদস্য অভিযানগুলােয় নিহত হন। যুদ্ধের শেষ দিকে মিত্রবাহিনী মুক্তিবাহিনীর সাথে যােগ দিলে মুক্তিবাহিনীর মনােবল আরও বৃদ্ধি পায়। তারা মিত্রবাহিনীর সহায়তায় নভেম্বর মাসের শেষ দিকে এ ক্যাম্প আক্রমণের পরিকল্পনা করে। মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প আযিযুল হক কলেজ থেকে ৪ কিলােমিটার উত্তরে বাঘােপাড়ায় ছিল।
২৫ নভেম্বর মুক্তিবাহিনী রাতের আঁধারে নিজস্ব অবস্থান থেকে মধ্যবর্তী গ্রামের আড় নিয়ে ২টি গ্রুপে ভাগ হয়ে আক্রমণের উদ্দেশ্যে রাজাপুর ও সাপগ্রাম নামক ২টি স্থানে অবস্থান গ্রহণ করে। পরিকল্পনা অনুযায়ী মিত্র বিমানবাহিনী লক্ষ্যবস্তুতে গােলাবর্ষণ শুরু করে। যৌথবাহিনীর মর্টার এবং অন্যান্য ভারি অস্ত্রের অবস্থান ছিল সাপগ্রামে এবং মূল আক্রমণ দল রাজাপুরে অবস্থান করছিল। শক্তি বৃদ্ধির জন্য আক্রমণ দলে ৯টি ট্যাংক যােগ দেয়। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী যৌথবাহিনী ট্যাংকসহ করতােয়া নদী পার হয়ে আযিযুল। হক কলেজ ও মহিলা কলেজে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনাদের উপর আক্রমণ করে। আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনী সম্পূর্ণরূপে পর্যদস্ত হয়। মিত্র বিমানবাহিনীর গােলাবর্ষণে এতিমখানার একটি বিল্ডিং ধসে পড়ে এবং পাকিস্তানি বাহিনীর প্রচুর সৈন্য প্রাণ হারায়। এ আক্রমণে যৌথবাহিনী ২জন পাকিস্তানি অধিনায়ক এবং প্রায় ১৬জন পাকিস্তানি সেনাকে আটক করতে সক্ষম হয়। এ ছাড়া মুক্তিবাহিনী ঐ ক্যাম্প থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গােলাবারুদ উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। সাফল্যের কারণ। পুরাতন আযিযুল হক কলেজ আক্রমণে মুক্তিবাহিনীর সাফল্যের পিছনে যে । কারণগুলাে মুখ্য ভূমিকা পালন করে, তা হলাে: ক. প্রথাগত যুদ্ধের কৌশল অবলম্বন। খ. সঠিক সময়ে আক্রমণ পরিচালনা।
গ, মিত্রবাহিনীর সহায়তা। ঘ, মুক্তিবাহিনীর দৃঢ় মনােবল ও দুঃসাহসিকতা। শিক্ষণীয় বিষয়। মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে মিত্রবাহিনীর সমর্থনপুষ্ট মুক্তিবাহিনীর পুনঃপুন আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত পাকিস্তানি বাহিনীর মনােবল ভেঙে যায়। ফলে তারা প্রায় ক্ষেত্রে পরাজয় স্বীকার করে পিছু হটতে বাধ্য হচ্ছিল। এ যুদ্ধ থেকে শিক্ষণীয় বিষয় হিসেবে যা গ্রহণ করা যেতে পারে, তা নিম্নরূপ:
ক. যুদ্ধে মনােবল একটি বড়াে ভূমিকা পালন করে।
খ. প্রয়ােজনীয় জনবল ও আধুনিক অস্ত্র থাকলে দুর্দমনীয় মনােবলে
বলীয়ান যে-কোনাে সুপ্রশিক্ষিত বাহিনী যুদ্ধে জয়লাভ করতে পারে।
উপসংহার
মুক্তিযােদ্ধাদের দ্বারা পুরাতন আযিযুল হক কলেজ আক্রমণটি ছিল একটি পরিপূর্ণ আক্রমণ, যেখানে একটি প্রশিক্ষিত নিয়মিত বাহিনীর সব ধরনের কৌশলই অবলম্বন করা হয়েছিল। সে জন্যই মিত্রবাহিনীর সহায়তায় মুক্তিযােদ্ধারা খুব সহজেই সাফল্য অর্জন করতে পেরেছিল।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান -ষষ্ঠ খন্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!