হাটফুলবাড়ি যুদ্ধক্ষেত্র (অ্যামবুশ)
ভূমিকা
স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বগুড়া এলাকার যুদ্ধ ছিল মূলত খণ্ড খণ্ড আক্রমণ এবং পাল্টা আক্রমণের মধ্যে সীমাবদ্ধ। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে মুক্তিবাহিনী শত্রুর উপর এ ধরনের আক্রমণ পরিচালনা করে তার মধ্যে হাটফুলবাড়ির প্রতিরােধ। যুদ্ধ বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য কারণ, এ প্রতিরােধ যুদ্ধের মাধ্যমে শত্রুর জনবল, রসদ ও গােলাবারুদের বড়াে ধরনের ক্ষতি করা হয়েছিল। বগুড়া থেকে সারিয়াকান্দি পৌছাতে পাকিস্তানি বাহিনী যে রাস্তা ব্যবহার করতাে হাটফুলবাড়ি ছিল সে প্রধান সড়কের পাশেই। সারিয়াকান্দি পৌছাতে এ প্রধান সড়কের কোনাে বিকল্প রাস্তা খুঁজে পাওয়া ছিল খুবই মুশকিল। সে কারণে হাটফুলবাড়ির যুদ্ধ কৌশলগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
পটভূমি
পাকিস্তানি বাহিনী যাতে বগুড়া থেকে সারিয়াকান্দি নির্বিঘ্নে পৌছাতে না পারে সে কারণে মুক্তিবাহিনী বগুড়া ও সারিয়াকান্দির মাঝামাঝি স্থানে হাটফুলবাড়িতে প্রতিরােধ গড়ে তােলে পাকিস্তানি বাহিনীর জনবল, রসদ ও গােলাবারুদের ক্ষতিসাধন করার জন্য হাটফুলবাড়িতে ফাঁদ পেতে আক্রমণ করা হয়েছিল।
ভূমির পরিচিতি
বগুড়া-সারিয়াকান্দি মহাসড়কের পাশে বগুড়া জেলা থেকে প্রায় ৩৫ কিলােমিটার উত্তর-পূর্বে হাটফুলবাড়ি অবস্থিত। বগুড়া-সারিয়াকান্দি, হাটফুলবাড়ি-বালিয়াতাড়ই সড়ক সব ঋতুতে সব ধরনের যানবাহন চলাচলের উপযােগী। এলাকায় বিস্তৃত খােলা ভূমি আছে। রেলপথে পশ্চিমে বগুড়া, পূর্বে সারিয়াকান্দি এবং দক্ষিণ-পূর্বে জলপথে বিভিন্ন এলাকার সাথে যােগাযােগ স্থাপন করা যায়। এলাকার ভূমি শুষ্ক মৌসুমে যে-কোনাে বড়াে ধরনের সৈন্য চলাচলের উপযােগী ছিল।
যুদ্ধের বিবরণ
অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে মুক্তিবাহিনীর ২টি দল বালিয়াড়ই ও হাটফুলবাড়ি গ্রামে অবস্থান করছিল। বালিয়াতাড়ই গ্রামে অবস্থিত দলটির অধিনায়ক রেজাউল করিম মন্টু অপারেশন বিষয়ক পরামর্শের জন্য হাটফুলবাড়ি আসেন। তারা গােয়েন্দা মারফত খবর পান যে পাকিস্তানি সেনাদের ৫জনের ১টি ক্ষুদ্র দল গরুর গাড়িতে করে রসদ নিয়ে হাটফুলবাড়ি হয়ে সারিয়াকান্দি যাবে। খবর পেয়ে তৎক্ষণাৎ ২৫জনের ১টি মুক্তিযােদ্ধা দল বিকাল ৫টায় হাটফুলবাড়ি নদীর। ঘাটে এসে পশ্চিম তীরে অবস্থান নেয়। ততক্ষণে পাকিস্তানি সেনারা নৌকায় চড়ে নদীর প্রায় পূর্ব পাড়ে পৌছে গেছে। মুক্তিযােদ্ধা দীপু ও মন্টুর দল এদের উদ্দেশ্য করে এলএমজি দিয়ে গুলিবর্ষণ করে। এতে সঙ্গে সঙ্গে ৩জন পাকিস্তানি সেনা গুলিবিদ্ধ হয়ে নদীতে পড়ে যায় এবং অপর ২জন নদীর ওপারে ধানক্ষেতে লাফিয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ গুলিবর্ষণের পর মুক্তিযােদ্ধারা অবশিষ্ট ২জনকে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানালে তারা হাত তুলে আত্মসমর্পণ করে এবং পরে গ্রামবাসী তাদের পিটিয়ে হত্যা করে। এখানে মুক্তিযােদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাদের সব অস্ত্র উদ্ধার করেন। এটি ছিল একটি সফল অভিযান বিশ্লেষণ ও পর্যালােচনা মুক্তিবাহিনীর বিজয়ের কারণ হাটফুলবাড়ির ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে, পাকিস্তানি সেনারা শেষ পর্যন্ত পরাজিত হয়েছিল এবং বাঙালি মুক্তিযােদ্ধারা বিজয়ী হয়েছিলেন বাঙালিদের বিজয়ের কারণগুলাে ছিল নিম্নরূপ: ক, অধিক শক্তি: ৫জন পাকিস্তানি সেনার বিরুদ্ধে ২৫জনের ১টি দলের যুদ্ধ পরিচালনা, অন্যদিকে পাকিস্তানি সেনাদের শক্তির স্বল্পতা, অসতর্কতা এবং সবাই একসঙ্গে নৌকায় পার হওয়ার চেষ্টা এ সুযােগে বাঙালি মুক্তিযােদ্ধাদের সঠিক পদক্ষেপ এ যুদ্ধের বিজয়ের কারণ। খ, স্থানীয় সাহায্য: হাটফুলবাড়ি যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী স্থানীয় অধিবাসী কর্তৃক পেয়েছিল ব্যাপক সাহায্য ও সহযােগিতা, যেটা ছিল জয়ের জন্য অন্যতম কারণ। স্থানীয় লােকজন পাকিস্তানি বাহিনীর চলাচল জেনে মুক্তিবাহিনীকে অবহিত করতাে এবং তারা পাকিস্তানি বাহিনীর উপর আক্রমণ করত।
এভাবে স্থানীয় সাহায্য পাওয়ার ফলে মুক্তিবাহিনীর বিজয় নিশ্চিত হয়েছিল। স্থানীয় ভূমির সঙ্গে পরিচিতি: হাটফুলবাড়ি যুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধারা এমন। ভূমিতে যুদ্ধ করেছে, যা ছিল তাদের পূর্বপরিচিতি। এ পরিচিতি তাদের সব কর্মকাণ্ডে সহায়তা করেছিল। অন্যদিকে, পাকিস্তানিদের। কাছে এটা ছিল একটা অপরিচিত ভূমি, যেখানে যুদ্ধ করতে স্বভাবতই তাদের অসুবিধা হয়েছিল। এটাও মুক্তিযােদ্ধাদের জয়ের একটা বড়াে কারণ হিসেবে কাজ করেছিল। গুপ্তবার্তা প্রবাহ: মুক্তিবাহিনীর ছিল সঠিক গুপ্তবার্তা বাহক। যে-কোনাে। স্থান থেকে পাকিস্তানি বাহিনী রওনা হলেই মুক্তিবাহিনী দ্রুত সংবাদ পেত এবং সে অনুযায়ী তাদের উপর ঝাপিয়ে পড়ত। এভাবে অনেক ধ্বংস সাধিত হয়েছিল পাকিস্তানিদের আর মুক্তিযােদ্ধাদের বিজয় সম্ভব হয়েছিল। পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয়ের কারণ হাটফুলবাড়ির যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয় যে কারণে হয়েছিল, তার মধ্যে উল্লেখযােগ্য কারণ হচ্ছে: ক. স্বল্প শক্তি: হাটফুলবাড়ির যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনী ছিল স্বল্প শক্তিসম্পন্ন, কারণ এটি ছিল মূলত রসদ সরবরাহকারী দল তা ছাড়া তারা একসঙ্গে নৌকায় চড়ে পার হচ্ছিল এবং অসতর্ক অবস্থায় ছিল, আর বাঙালিরা সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল। স্থানীয় সমর্থন না থাকা: পাকিস্তানিদের কোনাে স্থানীয় সহযােগিতা ছিল না, কিছুসংখ্যক স্বাধীনতাবিরােধী রাজাকার ব্যতীত সবাই ছিল তাদের বিপক্ষে।
কাজেই তাদের যে-কোনাে ধরনের চলাচল পরিকল্পনা মুক্তিবাহিনী আগেই জেনে যেত। স্থানীয় লােকদের সহায়তা না পাওয়ায় তাদের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। শিক্ষণীয় বিষয় ইতিহাসের প্রতিটি যুদ্ধই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কিছু না কিছু শিক্ষণীয় বিষয় রেখে যায়, যা ভবিষ্যতের পরিকল্পনায় সহায়তা করে। তেমনি হাটফুলবাড়ি যুদ্ধে কিছু না কিছু শিক্ষণীয় বিষয় ছিল, যা নিমরূপ: ক, স্থানীয় সহায়তা: স্থানীয় সহায়তা ছাড়া যুদ্ধে জয়লাভ করা বড়ই দুরূহ ব্যাপার। পাকিস্তানিদের ছিল না কোনাে স্থানীয় সমর্থন; অন্যদিকে, মুক্তিবাহিনীর ছিল সর্বপ্রকার স্থানীয় সাহায্য। তাই যুদ্ধে জয়লাভ সহজ হয়েছিল। এলাকা পরিচিতি: কোথাও যুদ্ধে যাত্রার পূর্বে সে এলাকা সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা থাকা অত্যাবশ্যক। অন্যথায় যুদ্ধে জয়লাভ কষ্টসাধ্য। পাকিস্তানিদের হাটফুলবাড়ি এলাকা সম্পর্কে ধারণা ছিল কম, অন্যদিকে মুক্তিবাহিনী এর প্রতিটি এলাকা বিস্তারিত চিনতাে, ফলে তাদের যুদ্ধে জয়লাভ সহজতর হয়েছিল। প্রতিপক্ষকে দুর্বল মনে না করা: যুদ্ধে প্রতিপক্ষকে দুর্বল মনে করায় অনেক সময় পরাজয়ের কারণ হিসেবে দেখা দেয়। সুতরাং, প্রতিপক্ষকে কখনােই দুর্বল মনে করা উচিত নয়।
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান -ষষ্ঠ খন্ড