গুনাহার আক্রমণ ও রেইড
ভূমিকা
স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বগুড়া এলাকায় যুদ্ধ ছিল মূলত খণ্ড খণ্ড আক্রমণ এবং পাল্টা আক্রমণের মধ্যে সীমাবদ্ধ। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে মুক্তিবাহিনী শত্রুর উপর এ ধরনের আক্রমণ পরিচালনা করে। তার মধ্যে দুপচাচিয়া থানার গুনাহার গ্রামে আকস্মিক আক্রমণ (রেইড) বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। কারণ, গুনাহার যুদ্ধে শক্রর জনবল, অস্ত্র ও গােলাবারুদের ব্যাপক ক্ষতি করা হয়েছিল। বাঙালি মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য গুনাহার যুদ্ধ কৌশলগত দিক থেকে ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ।
পটভূমি
পাকিস্তানি বাহিনী দুপচাঁচিয়া থেকে নির্বিঘ্নে কোথাও যেন যেতে না পারে এবং কোনাে অপারেশন পরিচালনা করতে না পারে, সে জন্য গুনাহার গ্রামে রেইড পরিচালনা করে। পাকিস্তানি সেনাদের গ্রাম থেকে বিতাড়ন, ক্ষতিসাধন ও মনােবল ভেঙে দেওয়ার জন্য গুনাহারে রেইড করা হয়েছিল। ভূমির পরিচিতি বগুড়া জেলার দুপচাচিয়া-গােপীনাথপুর প্রধান সড়কের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত গুনাহার গ্রাম। দুপচাচিয়া থানা থেকে প্রায় ৬ কিলােমিটার পশ্চিমে অবস্থিত এ গ্রাম। বগুড়া-দুপচাচিয়া প্রধান সড়কে সব ঋতুতে সব ধরনের যানবাহন চলাচলের উপযােগী এটা রণকৌশলগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ একটি ভূমি। এর চারদিকে বিস্তীর্ণ খােলা চাষের জমি রয়েছে। এলাকার শুদ্ধ ভূমি যেকোনাে বড়াে ধরনের সৈন্য চলাচলে সহায়তা করে।
যুদ্ধের বিবরণ
১৯৭১ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর দুপচাচিয়া থানা সদরে অবস্থিত পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্প থেকে ক্যাপ্টেন আরিফের নেতৃত্বে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারসহ আনুমানিক ১০০জনের ১টি দল গুনাহার ইউনিয়নের অর্জুনগাড়ি গ্রামের চারপাশে অবস্থান নেয়। তাদের কাছে তথ্য ছিল যে, অর্জুনগাড়ি গ্রামে মুক্তিযােদ্ধাদের ১টি দল অবস্থান করছে। দলটির দলনেতা মাে. মাহবুবুর রহমান তালুকদার (মুকুল) তার দল নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনী আসার পূর্বেই গ্রাম থেকে বেরিয়ে আসেন। তারপর পাশের গ্রামের আরও ২টি দল নিয়ে ভােররাতে পাকিস্তানি বাহিনীকে তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলে। ঐ ২টি দলের অধিনায়ক ছিলেন যথাক্রমে খন্দকার দেলােয়ার হােসেন ও খন্দকার ফরহাদ হােসেন। পাকিস্তানি সেনারা তাদের অবস্থান টের পাওয়ার পূর্বেই মুক্তিবাহিনী তাদের উপর তুমুল গুলিবর্ষণ শুরু করে। পাকিস্তানি সেনারা কিছুক্ষণ পাল্টা গুলিবর্ষণ করে এবং আস্তে আস্তে দক্ষিণ দিকে পিছু হটে (নশরৎপুর) মুরইল হয়ে সদরের দিকে চলে যায়।
এ যুদ্ধে ১জন পাকিস্তানি সেনা ও ২জন রাজাকার নিহত হয়। মুক্তিযােদ্ধাদের পক্ষে কেউ হতাহত হন নি। এ যুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধারা এলএমজি, সেনগান, এসএলআর, রাইফেল ইত্যাদি অস্ত্র ব্যবহার করেন। উদ্দেশ্যের দিক থেকে এটি ছিল একটি সফল অভিযান। বিশ্লেষণ ও পর্যালােচনা বিজয়ের কারণ গুনাহার যুদ্ধের ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে, বাঙালিদের বিজয় অর্জনের কারণগুলাে নিম্নরূপ: ক, সুষ্ঠু পরিকল্পনা: যে-কোনাে যুদ্ধের পরিকল্পনা বিজয় অর্জনের মূল। চাবিকাঠি। গুনাহার যুদ্ধে বাঙালি মুক্তিযােদ্ধাদের সুকৌশলগত পরিকল্পনার ফলে বিজয় অর্জন সহজতর হয়। অদম্য মনােবল: গুনাহার যুদ্ধে প্রাথমিকভাবে মুক্তিবাহিনীর সাথে পাকিস্তানি বাহিনীর তুমুল সংঘর্ষ হয়, কিন্তু মুক্তিবাহিনী মনােবল না হারিয়ে তাদের চেষ্টা চালিয়ে যায় এবং মুক্তিযােদ্ধাদের প্রাণপণ প্রচেষ্টার ফলে বিজয় অর্জন সম্ভব হয়েছিল। স্থানীয় সাহায্য: গুনাহার যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী স্থানীয় অধিবাসী কর্তৃক প্রচুর সাহায্য ও সহযােগিতা পায়, পক্ষান্তরে পাকিস্তানি বাহিনীর। চলাচল সম্পর্কে মুক্তিবাহিনীকে তথ্য প্রদান করে এভাবে স্থানীয় সাহায্য পাওয়ার ফলে মুক্তিবাহিনীর বিজয় নিশ্চিত হয়েছিল, যেটা জয়ের জন্য অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়। স্থানীয় ভূমির সঙ্গে পরিচিতি: গুনাহার যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী এমন ভূমিতে যুদ্ধ করেছে, যা ছিল তাদের পূর্বপরিচিতি এ পরিচিতি তাদের সফল কর্মকাণ্ডে সহায়তা করেছিল। অন্যদিকে, পাকিস্তানিদের কাছে ছিল অপরিচিতি ভূমি, যেখানে যুদ্ধ করতে স্বভাবতই তাদের অসুবিধা হয়েছিল। এটা জয়ের একটা বড়াে কারণ হিসেবে কাজ করেছিল। পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয়ের কারণ পাকিস্তানি বাহিনী যে স্থানে অবস্থান করছিল, সেখানে তাদের ব্যাপক ধ্বংস হয়েছিল। আর যেসব কারণে পরাজয় হয়েছিল, সেগুলাের কারণগুলাে নিম্নরূপ: ক. অসতর্কতা: কোনাে স্থানে যুদ্ধ চলাকালে যদি কোনাে বাহিনী অসতর্কভাবে অবস্থান করে, তাহলে সেখানে নিশ্চিত আক্রমণ হবে।
এবং পরাজয় অনিবার্য। সুতরাং, পাকিস্তানি বাহিনীর অসতর্কতা গুনাহার যুদ্ধে পরাজয়ের অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়। স্থানীয় এলাকা সম্পর্কে ধারণা না থাকা: পাকিস্তানিরা এলাকার যুদ্ধ বিন্যাস সম্পর্কে সম্যক অবহিত ছিল না। এলাকা ছিল তাদের অপরিচিত, যা তাদের বিভিন্ন পরিকল্পনায় ব্যাঘাত ঘটাতাে। এটা তাদের পরাজয়ের কারণ হতে পারে। স্থানীয় সমর্থন না থাকা: কিছুসংখ্যক স্বাধীনতাবিরােধী রাজাকার ব্যতীত পাকিস্তানি বাহিনীর কোনাে স্থানীয় সহযােগিতা ছিল না। অপর দিকে মুক্তিবাহিনী স্থানীয় লােকদের সহায়তায় পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয়কে নিশ্চিত করেছিল। শিক্ষণীয় বিষয়। ইতিহাসের প্রতিটি যুদ্ধই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কিছু না কিছু শিক্ষণীয় বিষয় রেখে যায়, যা ভবিষ্যতের পরিকল্পনায় সহায়তা করে। তেমনি গুনাহার যুদ্ধেও কিছু কিছু শিক্ষণীয় বিষয় ছিল, যা নিম্নরূপ: ক, সুষ্ঠু পরিকল্পনা: যে-কোনাে যুদ্ধের নিখুঁত পরিকল্পনা যুদ্ধ জয়ের চাবিকাঠি হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। আর নিখুঁত পরিকল্পনার ফলে গুনাহার আক্রমণ করে সফলতা অর্জন করা সম্ভব হয়েছিল। স্থানীয় সহায়তা: স্থানীয় সহায়তা ব্যতীত যুদ্ধে জয়লাভ করা কষ্টকর। ব্যাপার। পাকিস্তানিদের কোনাে স্থানীয় সহায়তা ছিল না; অন্যদিকে, মুক্তিবাহিনীর ছিল সব ধরনের স্থানীয় সমর্থন ও সহযােগিতা। স্থানীয় ভূমির সাথে পরিচিতি: কোথাও যুদ্ধযাত্রার পূর্বে সে এলাকা সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা থাকা অত্যাবশ্যক। অন্যথায় যুদ্ধে জয়লাভ কষ্টসাধ্য। পাকিস্তানিদের গুনাহার এলাকা সম্পর্কে তেমন কোনাে ধারণা ছিল না। অন্যদিকে, মুক্তিবাহিনী প্রতিটি এলাকা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতাে, ফলে তাদের যুদ্ধে জয়লাভ সহজতর হয়েছিল।
উপসংহার
মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের সবচেয়ে গৌরবােজ্জ্বল ইতিহাস, যার বিনিময়ে আজ আমরা স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের নাগরিক। আজ আমরা বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছি। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এবং বিভিন্ন স্মৃতি সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করে রাখা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। আর এ উদ্যোগ এখনই নেয়া হলে আগামী প্রজন্ম হয়ত খুঁজে পাবে না আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বীরত্ব, গৌরব আর বেদনাময় স্মৃতিগুলােকে। শুধু তা-ই নয়, তারা এ জন্য দায়ী করবে। বর্তমান প্রজন্মকে। কাজেই আমাদের সবার স্বার্থেই মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকে সংরক্ষণ করে রাখা একান্ত আবশ্যক।
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান -ষষ্ঠ খন্ড