বালিয়াদিঘির অভিযান ও অ্যামবুশ
ভূমিকা
মুক্তিবাহিনী যুদ্ধের শুরু থেকেই পাকিস্তানি সেনাদের বিভিন্ন স্থাপনাগুলােয় অভিযানের মাধ্যমে ক্ষতিসাধন করে শত্রুর মনােবলকে দুর্বল করে ফেলছিল। জনবলের স্বল্পতা নিয়ে কম অস্ত্রে সজ্জিত মুক্তিবাহিনীর পক্ষে একটি শক্তিশালী নিয়মিত বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখসমরে অবতীর্ণ হওয়া সম্ভব হয় নি। তাই তারা সর্বদা গেরিলাযুদ্ধের কৌশল অবলম্বন করতাে। মাঝে মাঝেই তারা পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্পের উপর হয়রানিমূলক ফায়ার করে তাদের ব্যস্ত রাখতাে। মুক্তিবাহিনী ছিল সুযােগসন্ধানী। সুযােগ পাওয়া মাত্রই তারা পাকিস্তানি সেনাদের হয়রানি ও ক্ষতিগ্রস্ত করার চেষ্টা চালিয়েছে। যুদ্ধের পটভূমি বালিয়াদিঘি এলাকা ছিল মুক্তিবাহিনীর একটি নিরাপদ আশ্রয়স্থল। এ গ্রামে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে উল্লেখযােগ্যসংখ্যক মুক্তিযােদ্ধা অবস্থান করতাে। পাকিস্তানি সেনারা প্রায়ই সন্দেহের বশবর্তী হয়ে মুক্তিযােদ্ধাদের সন্ধানে নিকটস্থ তরণীরহাট এলাকায় আগমন করতাে মূলত তারা মুক্তিবাহিনীর অবস্থান সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করতেই এখানে আসতাে। ভূমির পরিচিতি বালিয়াদিঘির অন্তর্গত তরণীরহাট মূলত একটি ব্যস্ত এলাকা এখানে বেশ কিছু দোকান, হাসপাতাল এবং কয়েকটি ছােটো বিদ্যালয় রয়েছে।
তরণীরহাটের প্রধান সড়কটি পাকা, যা পূর্বে গাবতলী এবং পশ্চিমে ধুনটের দিকে চলে গেছে। তরণীরহাটের দক্ষিণে রয়েছে তরণীর বিল যেখানে নৌকার মাধ্যমে খেয়া পারাপার হয়। তরণীরহাটের আশপাশের গ্রামগুলাে মােটামুটি জনবসতিপূর্ণ। যুদ্ধের সংগঠন যুদ্ধের সংগঠন নিম্নরূপ: ক, পাকিস্তানি বাহিনী: ৩০-৪০জন পাকিস্তানি সদস্যের ১টি গাড়ির বহর। খ, মুক্তিবাহিনী: ৭ নম্বর সেক্টরের ২ প্লাটুন মুক্তিযােদ্ধা শত্রুপক্ষের অবস্থান তরণীরহাট। যুদ্ধের বর্ণনা পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিবাহিনীর অবস্থান সম্পর্কে বালিয়াদিঘি এলাকায় খোঁজখবর নিতে আসতাে দুঃসাহসী গ্রামবাসীর সার্বিক সহায়তায় মুক্তিযােদ্ধারা গ্রামে নিরাপদ আশ্রয়ে অবস্থান করতাে অবশ্য তারা কখনাে এক জায়গায় বেশি দিন অবস্থান করতাে না। পাকিস্তানি সেনারা তথ্য সংগ্রহে ব্যর্থ হয়ে। অসহায় মানুষের উপর নির্যাতন চালাতাে আবার কখনাে গ্রামের নিরীহ মানুষকে সন্দেহভাজনভাবে ক্যাম্পে আটকিয়ে রাখতাে। বালিয়াদিঘিতে মুক্তিবাহিনীর নিরাপদ অবস্থান সম্পর্কে পাকিস্তানি বাহিনীর সন্দেহের উদ্রেক হয়। প্রায়ই তরণীরহাটে পাকিস্তানি বাহিনীর আগমনের ব্যাপারটি লক্ষ্য করে মুক্তিযােদ্ধারা অ্যামবুশ পেতে তাদের ধ্বংসের পরিকল্পনা করেন অন্যান্য দিনের মতাে পাকিস্তানি সেনারা ৩-৪ সেপ্টেম্বরে তথ্য সংগ্রহের জন্য তরণীরহাটে আগমন করে। গােপন সূত্রে খবর পেয়ে মুক্তিযােদ্ধারা কামালপুরস্থিত তাদের অস্থায়ী। ক্যাম্প থেকে কয়েকটি ক্ষুদ্র দলে ভাগ হয়ে তরণীর খালের পূর্ব পার্শ্বে অবস্থান গ্রহণ করেন। আনুমানিক ১১টার দিকে ৩০-৪০জন পাকিস্তানি সেনা ৪টি ৩ টনি ট্রাক এবং ১টি জিপে করে তরণীরহাটে প্রবেশ করে।
হাটের মধ্যে অগ্রসর হতেই পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিবাহিনীর গুলিবর্ষণের সম্মুখীন হয়। মুক্তিবাহিনী খাল অতিক্রম না করেই খালের ওপার থেকেই পাকিস্তানি সেনাদের উপর গুলিবর্ষণ করতে থাকে মুক্তিবাহিনীর গুলির মুখে পাকিস্তানি সেনারা আর। অগ্রসর হতে না পেরে পার্শ্ববর্তী ভেলাবাড়ি গ্রামে আগুন লাগিয়ে দিয়ে পিছু হটতে বাধ্য হয়। এ অভিযানে পাকিস্তানি বাহিনীর কোনাে হতাহতের খবর পাওয়া যায় নি। যুদ্ধের বিশ্লেষণ ব্যর্থ এ অভিযানের মাধ্যমে মুক্তিবাহিনী যেহেতু পাকিস্তানি বাহিনীর কোনাে ক্ষতিসাধন করতে পারেনি, সেহেতু এটাকে সফল অভিযান বলা যাবে না। এ অভিযানে ব্যর্থতার কারণগুলাে নিম্নরূপ: ক. মুক্তিযােদ্ধারা সাহসিকতার সাথে পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেননি। খ, সঠিক পরিকল্পনার অভাব। গ, প্রথাগত প্রশিক্ষণের অভাব শিক্ষণীয় বিষয় যে-কোনাে অভিযানে জয়লাভ করতে হলে অত্যন্ত সাহসী ও বীরত্বপূর্ণ মানসিকতা দরকার মুক্তিবাহিনী যদি বিলের অপর প্রান্তে অবস্থান না নিয়ে শত্রুর কাছে এসে অ্যামবুশ পরিচালনা করতাে, তবে তাদের সফলতা অর্জনের সুযােগ ছিল।
উপসংহার
এ অভিযানটি যদিও তেমন একটি সফল অভিযান ছিল না তবুও নিরীহ গ্রামবাসীদের কাছে ছিল বিরাট এক বিজয়। কেননা এ অভিযানের মাধ্যমেই গ্রামবাসীরা পাকিস্তানি বাহিনীর অত্যাচার থেকে রক্ষা পেয়েছিল এবং তরণীরহাটের সাধারণ জনজীবনে স্বস্তি ফিরে এসেছিল।
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান -ষষ্ঠ খন্ড