You dont have javascript enabled! Please enable it!
সালপাড়ার যুদ্ধ
ভূমিকা
তদানীন্তন সময় সালপাড়া বাজারটি জয়পুরহাট জেলার একটি উল্লেখযােগ্য ব্যবসায়িক এলাকা হিসেবে পরিচিত ছিল। ভারতে পলায়নের জন্য সালপাড়া এলাকাটি ছিল অধিক উপযােগী এ ছাড়া মুক্তিযােদ্ধারা ভারত থেকে সীমানা পার হয়ে সালপাড়া বাজার হয়ে সহজেই পাঁচবিবি ও জয়পুরহাট পৌছাতে পারতেন। এসব বিষয় বিবেচনা করে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আউটার পেরিমিটার প্রতিরক্ষার একটি অবস্থান হিসেবে সালপাড়া বাজারকে নির্বাচন করে। বাজার এলাকাটির অবস্থানগত গুরুত্বের কথা বিবেচনা করে এবং ব্যবহারিক মূল্যায়নের ভিত্তিতে মুক্তিযােদ্ধারা সালপাড়া পাকিস্তানি ক্যাম্প আক্রমণের পরিকল্পনা করে। মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন সময় মুক্তিযােদ্ধারা সালপাড়া। ক্যাম্পে অনেক ছােটো ছােটো আক্রমণ পরিচালনা করলেও সেগুলাের অধিকাংশেরই কোনাে নির্ভরযােগ্য তথ্য বা বর্ণনা সংগ্রহ করা সম্ভব হয় নি।
পটভূমি
সালপাড়া বাজার এলাকায় পাকিস্তানি প্রতিরক্ষা ক্যাম্প স্থাপনের পর থেকে এ এলাকায় মুক্তিযােদ্ধা ও মুক্তিকামী সাধারণ জনগণের চলাচল বিশেষভাবে বাধাগ্রস্ত থেকে থাকে। ফলে মুক্তিযােদ্ধাদের সার্বিক কার্যক্রম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এসব কারণে মুক্তিযােদ্ধারা সালপাড়ার পাকিস্তানি ক্যাম্প ধ্বংসের চিন্তাভাবনা। শুরু করে। সালপাড়ায় পাকিস্তানি সেনা প্রতিরক্ষায় মুক্তিযােদ্ধাদের স্বল্পসংখ্যক সদস্য প্রায়ই অতর্কিত হামলা চালিয়ে কিছু ক্ষতিসাধন করেই দ্রুত পশ্চাদপসরণ করতাে। এ ধরনের ক্ষুদ্র ও অনুল্লেখযােগ্য বিচ্ছিন্ন অনেকগুলাে আক্রমণ মুক্তিযােদ্ধারা পরিচালনা করেছেন, যার কোনাে একত্রীভূত তথ্য পাওয়া সম্ভব হয় নি। তবে সম্ভবত ১৯৭১ সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসের কোনাে একদিন মুক্তিযােদ্ধারা জানতে পারেন যে, সালপাড়া পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্পের অধিকসংখ্যক সদস্যকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। সেখানে শুধু ১টি সেকশন অনুরূপ স্বল্পসংখ্যক পাকিস্তানি সেনার সাথে রাজাকারের ১টি দল প্রতিরক্ষায় আছে। পাকিস্তানি সেনাদের প্রতিরক্ষার এ দুর্বলতার সুযােগ গ্রহণ করে মুক্তিযােদ্ধারা সালপাড়া পাকিস্তানি ক্যাম্প আক্রমণ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন।
ভূমির পরিচিতি
সালপাড়া জয়পুরহাট জেলার একটি ছােটো বাজার, যা সীমান্ত থেকে ২-৩ কিলােমিটার পূর্বে এবং পাঁচবিবি থেকে পশ্চিমে অবস্থিত। সালপাড়া বাজার থেকে পাঁচবিবির দূরত্ব ৪-৫ কিলােমিটার এবং জয়পুরহাটের দূরত্ব ১০-১১ কিলােমিটার। সালপাড়া বাজার থেকে সহজেই পাঁচবিবি ও জয়পুরহাট যাতায়াত করা যায়। যােগাযােগ সুবিধার জন্য এ এলাকা দিয়ে ভারতে পলায়ন করা ছিল নিরাপদ ও সহজতর সালপাড়া বাজারের প্রায় ১ কিলােমিটার দক্ষিণে একটি তিন রাস্তার সংযােগস্থল, যার নাম বেলতলী বাজার সালপাড়া বাজার আর বেলতলী মােড়ের মধ্যবর্তী স্থানটি ছিল ভারতে পার হওয়ার জন্য সহজ ও দূরত্বের দিক দিয়ে নিকটতম। যুদ্ধের সংগঠন যুদ্ধের সংগঠন নিম্নরূপ: ক. পাকিস্তানি বাহিনী: প্রাথমিক তথ্যানুযায়ী পাকিস্তানি সেনাসদস্যদের শক্তি ১ প্লাটুন হলেও পরবর্তী সময় তা কোম্পানিতে উন্নীত করা হয়। রাজাকারদের কমপক্ষে ১টি সেকশন পাকিস্তানি বাহিনীর সংখ্যা বৃদ্ধি করে। পরিকল্পিত আক্রমণের দিন পাগলা দেওয়ান ও কড়িয়া। ক্যাম্পের পাকিস্তানি সেনারা সালপাড়া ক্যাম্পের সদস্যদের সাথে যােগ দেওয়ায় তা কোম্পানির অধিক জনবলে রূপ নেয়। খ, মুক্তিবাহিনী: জয়পুরহাট এলাকার মুক্তিযােদ্ধা এবং সালপাড়া এলাকার জনগণের কাছে থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী মুক্তিযােদ্ধাদের জনবল আনুমানিক ২ সেকশনের অধিক ছিল।
শত্রুপক্ষের বিন্যাস পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মূল ক্যাম্পটির অবস্থান ছিল সালপাড়া বাজারের উপর  বিভিন্ন সূত্রের মাধ্যমে জানা যায় যে, ১জন মেজর পদবির পাকিস্তানি অফিসার এ ক্যাম্পটির দায়িত্বে নিয়ােজিত ছিলেন। ফলে অনুমান করা যায় যে, সালপাড়া বাজার ছিল কোম্পানি সদর দপ্তর। এ কোম্পানির ১টি প্লাটুন বেলতলী মােড়ে অবস্থান নিয়েছিল। সম্ভবত সৈন্যস্বল্পতার কারণে পাকিস্তানি সৈন্যদের সাথে এ ক্যাম্পে কিছু রাজাকারও নিয়ােজিত ছিল। যুদ্ধের বিবরণ মুক্তিযােদ্ধারা শিয়ালা সীমান্ত অতিক্রম করে ধলাহার গ্রামের ভিতর দিয়ে সরাসরি সালপাড়া প্রতিরক্ষায় আক্রমণ রচনা করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। মেঘলা আবহাওয়ায় টিপ টিপ বৃষ্টির মধ্যে দিনের বেলায় মুক্তিবাহিনী সীমান্ত অতিক্রম করে সীমান্তবর্তী ধলাহার গ্রামে পৌছায়। অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী হয়ে সকাল ৯টায় আনুমানিক ২০-৩০জন মুক্তিযােদ্ধা সালপাড়া প্রতিরক্ষার ১০০১৫০ গজের মধ্যে এসে থিপু গ্রামের সামনে প্রতিরক্ষার মুখােমুখি অবস্থান গ্রহণ করেন। মুক্তিযােদ্ধাদের ধারণা ছিল, সামান্য কিছু গােলাগুলি বিনিময়ের পরই রাজাকাররা প্রথমে আত্মসমর্পণ করবে এবং তার পরই স্বল্পসংখক পাকিস্তানি সেনাকে ঘায়েল করা তেমন কঠিন ব্যাপার হবে না। এ ধারণার বশবর্তী হয়ে। পাকিস্তানি প্রতিরক্ষার মুখােমুখি অবস্থান থেকে মুক্তিযােদ্ধারা ২টি গ্রেনেড ছােড়েন অতঃপর শুরু হয় তুমুল যুদ্ধ।
যুদ্ধরত মুক্তিযােদ্ধাদের ধারণা সম্পূর্ণ মিথ্যায় পর্যবসিত করে প্রায় কয়েক সেকশন পাকিস্তানি সেনা সালপাড়া ও বেলতলী বাজারের পরিখা পরিত্যাগ করে মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থানের দিকে ফায়ার অ্যান্ড মুভ কৌশলের মাধ্যমে অগ্রসর থেকে থাকে। সালপাড়া প্রতিরক্ষার সামনেই মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থান হওয়ায় সালপাড়া বাজার থেকে পাকিস্তানি সেনারা বেশি দূর অগ্রসর হতে পারেনি। পরিখা ত্যাগ করার সাথে সাথেই মুক্তিযােদ্ধাদের গুলিতে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার নিহত হওয়ায় পাকিস্তানি সেনা অধিনায়ক বেলতলী বাজারের সেকশন দ্বারা মুক্তিযােদ্ধাদের উপর আক্রমণ রচনা করে।  পাকিস্তানি সেনা দল বেলতলী বাজার থেকে থিপু গ্রামের পিছনের দিকে অগ্রসর থেকে থাকে মুক্তিযােদ্ধারা পরিস্থিতি বিবেচনা করে থিপু গ্রামের দক্ষিণে তাদের অবস্থান পরিবর্তন করে পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণ প্রতিহত করার প্রচেষ্টা চালাতে থাকেন। আক্রমণ ও প্রতি-আক্রমণ প্রায় দেড় ঘণ্টা যাবত চলে এ সময়ের মধ্যে নিকটবর্তী কড়িয়া ও পাগলা দেওয়ান ক্যাম্প থেকে পাকিস্তানি বাহিনী তাদের যুদ্ধরত বাহিনীর শক্তি বৃদ্ধি করে প্রশিক্ষিত পাকিস্তানি সেনাদের জনবল ও শক্তি বৃদ্ধিতে ক্রমান্বয়ে পরিস্থিতি মুক্তিযােদ্ধাদের প্রতিকূলে যেতে থাকে প্রায় ঘণ্টা দুয়েক উভয় পক্ষের অনবরত গুলিবিনিময়ের পর পরিস্থিতি মুক্তিবাহিনীর প্রতিকূলে যাওয়ায় তারা ধীরে ধীরে পশ্চাদপসরণ করতে থাকে এবং একই সীমান্ত এলাকা দিয়ে ভারতীয় এলাকায় প্রবেশ করে যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটায়।
এ যুদ্ধে প্রকৃত হতাহতের সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে জয়পুরহাট জেলার মুক্তিযােদ্ধা জাকির হােসেনের বক্তব্য অনুযায়ী বেশ কিছু পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার নিহত এবং ১জন মুক্তিযােদ্ধা আহত হয়েছিলেন। বলে জানা যায়। বিশ্লেষণ ও পর্যালােচনা পাকিস্তানি বাহিনীর জয়ের কারণ
ক. প্রতিরক্ষা বিষয়ে গােপনীয়তা রক্ষা। খ. জনবল, অস্ত্র ও সরঞ্জামের আধিক্য। গ. সঠিক সময়ে পার্শ্ববর্তী ক্যাম্প থেকে শক্তি বৃদ্ধি। ঘ, আক্রমণকারী মুক্তিযােদ্ধাদের চেয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর শক্তি। তুলনামূলকভাবে অধিক ছিল। ৬. মুক্তিযােদ্ধাদের দুর্বল আক্রমণ পরিকল্পনা। জমার মায়ের কারণ। ক, ভুল তথ্যের ভিত্তিতে পরিকল্পনা ও কার্যসম্পাদন। খ. মুক্তিবাহিনীর জনবলের স্বল্পতা ও প্রশিক্ষণের অভাব। গ. মুক্তিবাহিনীর গােলাবারুদ ও অস্ত্রের স্বল্পতা। ঘ, প্রতি-আক্রমণ সম্বন্ধে প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতার অভাব। শিক্ষণীয় এ যুদ্ধে শিক্ষণীয় বিষয় নিম্নরূপ: ক. প্রতিপক্ষের অবস্থান ও কার্যাবলির বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ ব্যতিরেকে স্থূল পরিকল্পনার মাধ্যমে অভিযান পরিচালনা পরাজয়েরই নামান্তর। খ, সঠিক সময় যুদ্ধক্ষেত্রে জনবল ও শক্তি বৃদ্ধির মাধ্যমে প্রতিরক্ষা অবস্থানকে আগ্রাসী প্রতিরক্ষায় রূপান্তর সম্ভব, যা শত্রুকে পশ্চাদ্ধাবনেও বাধ্য করে।
উপসংহার
সালপাড়া যুদ্ধটি মুক্তিযুদ্ধে জয়পুরহাটের ইতিহাসে একটি উল্লেখযােগ্য যুদ্ধ। মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তানি বাহিনীর উভয়ের হতাহতের সংখ্যা নগণ্য হলেও উল্লেখযােগ্য। এ যুদ্ধের ফলে মুক্তিবাহিনী তাদের ভবিষ্যৎ অভিযানগুলাে পরিকল্পনা ও পরিচালনায় অধিক সতর্কতা অবলম্বন করে। ফলে পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিযােদ্ধাদের মনােবল, সাহস ও আক্রমণের তীব্রতা অনুভব করতে শুরু করে, যা পরবর্তী সময় পাকিস্তানি বাহিনীর সামগ্রিক পরাজয়ের ও আত্মসমর্পণের সহায়ক হিসেবে কাজ করে।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান -ষষ্ঠ খন্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!