You dont have javascript enabled! Please enable it!
ধুনট পুলিশ স্টেশন রেইড
ভূমিকা
স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বগুড়া এলাকায় যুদ্ধ ছিল মূলত খণ্ড খণ্ড আক্রমণ এবং পাল্টা আক্রমণের মধ্যে সীমাবদ্ধ। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে মুক্তিবাহিনী শত্রুর উপর এ ধরনের আক্রমণ পরিচালনা করে। তার মধ্যে ধুনট থানা আক্রমণ রেইড বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। কারণ, এ যুদ্ধের মাধ্যমে শক্রর জনবল, রসদ, অস্ত্র ও গােলাবারুদের ব্যাপক ক্ষতি করা হয়েছিল। শেরপুর থেকে ধুনট পর্যন্ত পৌছাতে পাকিস্তানি বাহিনী যে রাস্তা ব্যবহার করতাে সেই রাস্তায় ধুনট থানা সদরে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থান ছিল এবং শেরপুর-বগুড়া ও শেরপুরসিরাজগঞ্জ পৌছাতে এ প্রধান সড়কের বিকল্প রাস্তা খুঁজে পাওয়া ছিল মুশকিল। তাই কৌশলগত দিক থেকে ধুনট যুদ্ধ ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
পটভূমি
পাকিস্তানি বাহিনী যাতে থানা সদর থেকে নির্বিঘ্নে কোথাও চলাচল এবং কোনাে অপারেশন পরিচালনা করতে না পারে, সে জন্য মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি সেনাদের উপর রেইড পরিচালনা করে। পাকিস্তানি বাহিনীর জনবল, অস্ত্র ও গােলাবারুদের ক্ষতিসাধন করার জন্য ধুনট পুলিশ স্টেশনে হানা দেওয়া হয়েছিল।
ভূমির পরিচিতি
বগুড়া-শেরপুর প্রধান সড়কের এক প্রান্তে সারিয়াকান্দি থানার অবস্থান। বগুড়া শহর থেকে প্রায় ৫০ কিলােমিটার দক্ষিণ-পূর্ব দিকে অবস্থান। থানা সদর থেকে পূর্ব দিকে ইছামতি নদী। ধুনট থেকে বিভিন্ন পাকা ও কাঁচা রাস্তার মাধ্যমে অন্যান্য শহরের সাথে যােগাযােগ রয়েছে। বগুড়া-শেরপুর-ধুনট প্রধান সড়কে সব ঋতুতে সব ধরনের যানবাহন চলাচলের উপযােগী। এলাকার পূর্ব-পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিমে কিছু খােলা ও চাষের জমি লক্ষ্য করা যায়। এলাকার ভূমি শুষ্ক, তাই যে-কোনাে মৌসুমে বড়াে ধরনের সৈন্য চলাচলে সহায়তা করে। যুদ্ধের বিবরণ ধুনট থানা সদরের পুলিশ স্টেশনে পাকিস্তানি সেনাদের ১জন মেজরের নেতৃত্বে ৭-৮জন পাকিস্তানি সেনা, ২৮জন পুলিশ এবং ১৫-১৬জন রাজাকার অবস্থান করছিল। মুক্তিবাহিনী থানাটিতে রেইডের পরিকল্পনা নেয়। রেইড পরিচালনার ২ দিন পূর্বে তারা কালাই আটা স্কুলে অবস্থান নেয়। ২ দিন রেকি করার পর ১৫ জুন পুলিশ স্টেশনের উত্তর, পূর্ব ও দক্ষিণ দিকে ৩টি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে অবস্থান নেয়। রেইড দলটিতে মােট ৩১জন সদস্য ছিল। পুরাে দলটির নেতৃত্বে ছিলেন- 
মাে, আ. হান্নান এবং উপ-অধিনায়ক ছিলেন ডা. মাে. আ. করিম। এলএমজি, এসএলআর, রাইফেল, রকেট লঞ্চার, ৩ ইঞ্চি মটার এবং হ্যান্ড গ্রেনেড ইত্যাদি অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে রাত ২টা ৩০ মিনিটে অবস্থান নেয়। মুক্তিবাহিনীর পরিকল্পনা ছিল ভাের ৪টায় আক্রমণ শুরু করবে। কিন্তু রাত ৩টার দিকে নড়াচড়ার শব্দে ১জন রাজাকার মুক্তিবাহিনীর অবস্থান টের পেয়ে যায়। তারপর সে চিৎকার করে ক্যাম্পের সবাইকে জাগিয়ে তােলে সঙ্গে সঙ্গেই পাহারারত সৈন্যরা ক্যাম্পের পূর্ব দিকে গুলিবর্ষণ শুরু করে। তাৎক্ষণিকভাবে মুক্তিযােদ্ধারা তিন দিক থেকেই তুমুল গুলিবর্ষণ শুরু করেন। পাকিস্তানি সেনারা প্রথম দিকে মােটামুটি প্রতিরােধ গড়ে তুললেও মুক্তিযােদ্ধারা রকেট লঞ্চার ও মর্টার ব্যবহার শুরু করলে পুলিশ ও রাজাকার সদস্যরা পূর্ব দিকে সরে এসে আত্মসমর্পণ করে। পাকিস্তানি সেনাদের কয়েকজন সদস্য বাংকার থেকে গুলিবর্ষণ অব্যাহত রাখে এবং অবশেষে সকাল ৭টা ৩০ মিনিটে ৪জন পাকিস্তানি সেনা আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে ক্যাম্পটির পতন ঘটে। পাকিস্তানি সেনাদের ৩ জন পুলিশ এবং ৬ জন রাজাকার নিহত হয়। মুক্তিবাহিনীর পক্ষে ৩ জন গুরুতর আহত হয়। এটি ছিল একটি সফল অভিযান বিশ্লেষণ ও পর্যালােচনা মুক্তিবাহিনীর বিজয়ের কারণ ধুনট যুদ্ধের ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে, বাঙালি মুক্তিযােদ্ধাদের বিজয় অর্জন করার কারণগুলাে নিম্নরূপ:
নিখুঁত পরিকল্পনা:
যে-কোনাে যুদ্ধের সঠিক পরিকল্পনা বিজয় অর্জনের মূল চাবিকাঠি ধুনট যুদ্ধে বাঙালি মুক্তিযােদ্ধাদের সুষ্ঠু পরিকল্পনার ফলে বিজয় অর্জন সহজতর হয়।
অদম্য মনােবল:
ধুনট যুদ্ধে প্রাথমিকভাবে মুক্তিবাহিনীর সাথে পাকিস্তানি বাহিনীর তুমুল সংঘর্ষ হয়, কিন্তু মুক্তিবাহিনী মনােবল না হারিয়ে তাদের আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যায় এবং মরণপণ যুদ্ধ করে বিজয় অর্জন করেছিলেন। মুক্তিযােদ্ধাদের অদম্য মনােবলের ফলে এটা সম্ভব হয়েছিল।
পর্যাপ্ত শক্তি:
ধুনট যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর তুলনামুলকভাবে শক্তি ছিল প্রচুর তথাপি পাকিস্তানি বাহিনীর আধুনিক অস্ত্র ও গােলাবারুদের বিরুদ্ধে পর্যাপ্ত শক্তিকে সঠিকভাবে কাজে লাগিয়েছিল, ফলে বিজয় অর্জন সম্ভব হয়েছিল।
নিজেদের দুর্বল মনে না করা:
ধুনট যুদ্ধে বাঙালি মুক্তিযােদ্ধারা প্রাথমিকভাবে পাকিস্তানি বাহিনীর পাল্টা আক্রমণের ভিতরে পড়লেও মুক্তিযােদ্ধারা নিজেদের দুর্বল মনে না করে যুদ্ধ চালিয়ে যান এবং পাকিস্তানি বাহিনীকে পর্যুদস্ত করেন। ফলে সফলতা অর্জন সম্ভব হয়।
স্থানীয় সাহায্য:
ধুনট যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী স্থানীয় অধিবাসী কর্তৃক ব্যাপক সাহায্য ও সহযােগিতা পায় এবং পাকিস্তানি বাহিনীর চলাচল সম্পর্কে মুক্তিবাহিনীকে তথ্য প্রদান করে। এভাবে স্থানীয় সাহায্য পাওয়ার ফলে মুক্তিবাহিনীর বিজয় নিশ্চিত হয়েছিল, যেটা জয়ের জন্য অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়।
স্থানীয় ভূমির সঙ্গে পরিচিতি:
ধুনট যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী এমন ভূমিতে যুদ্ধ করেছে, যা ছিল তাদের পূর্বপরিচিতি। এ পরিচিতি তাদের সফল কর্মকাণ্ডে সহায়তা করেছিল। অন্যদিকে পাকিস্তানিদের কাছে ছিল। অপরিচিতি ভূমি, যেখানে যুদ্ধ করতে স্বভাবতই তাদের অসুবিধা হয়েছিল। এটা জয়ের একটা বড়াে কারণ হিসেবে কাজ করেছিল।
গুপ্তবার্তা প্রবাহ:
মুক্তিবাহিনীর সঠিক গুপ্তবার্তা প্রবাহ ছিল পাকিস্তানি বাহিনী যে-কোনাে স্থানে রওনা হলে মুক্তিবাহিনী দ্রুত সংবাদ পেত এবং সে অনুযায়ী তাদের উপর আক্রমণ করেছিল। এর ফলে পাকিস্তানিদের ব্যাপক ধ্বংস সাধিত হয় এবং মুক্তিবাহিনীর বিজয় অর্জন সহজ হয়। পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয়ের কারণ পাকিস্তানি বাহিনী যে স্থানে অবস্থান করছিল, সেখানে তাদের অস্ত্রসামগ্রী ব্যাপক ধ্বংস হয়েছিল।
আর যেসব কারণে তারা পরাজিত হয়েছিল, সেগুলাে নিম্নরূপ
ক. অসতর্কতা:
কোনাে স্থানে যুদ্ধ চলাকালে যদি কোনাে বাহিনী অসতর্কভাবে অবস্থান করে, তাহলে সেখানে নিশ্চিত আক্রমণ হবে। এবং পরাজয় অনিবার্য। সুতরাং, পাকিস্তানি বাহিনীর অসতর্কতা ধুনট যুদ্ধে পরাজয়ের অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়।
খ. দুর্বল প্রতিরক্ষা:
ধুনট যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনী যেখানে অবস্থান করছিল, সেখানে দুর্বল প্রতিরক্ষা লক্ষ্য করা যায় এ দুর্বল প্রতিরক্ষার সুযােগ কাজে লাগিয়ে মুক্তিযােদ্ধারা সহজেই বিজয় অর্জন করেন এবং পাকিস্তানি বাহিনীর বিজয় অর্জন অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।
গ, মানসিক দিক থেকে দুর্বল:
যে-কোনাে যুদ্ধের মনােবল হচ্ছে বিজয় অর্জনের চাবিকাঠি, কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনী ধুনট যুদ্ধে মানসিকভাবে। ছিল খুবই দুর্বল, ফলে তারা পরাজয় বরণ করতে বাধ্য হয়।
ঘ, স্থানীয় এলাকা সম্পর্কে ধারণা না থাকা:
পাকিস্তানিরা এ এলাকার যুদ্ধ বিন্যাস সম্পর্কে সম্যক অবহিত ছিল না। এলাকা ছিল তাদের অপরিচিত, যা তাদের বিভিন্ন পরিকল্পনার ব্যাঘাত ঘটাতাে এ কারণে তাদের পরাজয় বরণ করতে হয়েছিল। 
স্থানীয় সমর্থন না থাকা:
কিছুসংখ্যক স্বাধীনতাবিরােধী রাজাকার ব্যতীত পাকিস্তানি বাহিনীর কোনাে স্থানীয় সহযােগিতা ছিল না। অন্যদিকে, মুক্তিবাহিনী স্থানীয় লােকদের সহায়তায় পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয়কে করেছিল নিশ্চিত।
শিক্ষণীয় বিষয় ইতিহাসের প্রতিটি যুদ্ধই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কিছু না কিছু শিক্ষণীয় বিষয় রেখে যায়, যা ভবিষ্যতের পরিকল্পনায় সহায়তা করে। তেমনি ধুনট যুদ্ধেও কিছু কিছু শিক্ষণীয় বিষয় ছিল, যা নিম্নরূপ:
ক, নিখুঁত পরিকল্পনা:
যে-কোনাে যুদ্ধের নিখুঁত পরিকল্পনা যুদ্ধ জয়ের চাবিকাঠি হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। আর নিখুঁত পরিকল্পনার ফলে ধুনট আক্রমণ করে সফলতা অর্জন করা সম্ভব হয়েছিল।
অদম্য মনােবল:
ধুনট যুদ্ধে প্রাথমিকভাবে মুক্তিবাহিনীর সাথে পাকিস্ত নি বাহিনীর তুমুল সংঘর্ষ হয়, কিন্তু মুক্তিবাহিনী মনােবল না হারিয়ে তাদের আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যায় এবং মরণপণ যুদ্ধ করে বিজয় অর্জন করেছিল। মুক্তিযােদ্ধাদের অদম্য মনােবলের ফলে এটা সম্ভব হয়েছিল।
গ. স্থানীয় সহায়তা:
স্থানীয় সহায়তা ব্যতীত যুদ্ধে জয়লাভ করা কষ্টকর ব্যাপার পাকিস্তানিদের ছিল না কোনাে স্থানীয় সহায়তা অন্যদিকে, মুক্তিবাহিনীর ছিল সব ধরনের স্থানীয় সমর্থন ও সহযােগিতা স্থানীয় ভূমির সাথে পরিচিতি: কোথাও যুদ্ধে যাত্রার পূর্বে সে এলাকা সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা থাকা অত্যাবশ্যক অন্যথায় যুদ্ধে জয়লাভ কষ্টসাধ্য পাকিস্তানিদের ধুনট এলাকা সম্পর্কে তেমন কোনাে ধারণা ছিল না। অন্যদিকে, মুক্তিবাহিনী প্রতিটি এলাকা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতাে ফলে তাদের যুদ্ধে জয়লাভ সহজতর হয়েছিল। প্রতিপক্ষকে দুর্বল মনে করা: যে-কোনাে যুদ্ধে কিংবা কর্মকাণ্ডে প্রতিপক্ষকে দুর্বল মনে করা যাবে না। যদি এমন কোনাে ধারণা কারাে মনে জন্ম নেয়, তাহলে জয়লাভ করা খুব দুরূহ কাজ মুক্তিবাহিনী সর্বস্ব দিয়ে আক্রমণ করে, আর অন্যদিকে পাকিস্তানিদের মধ্যে ছিল। অহংকার ফলে তাদের পরাজয় নিশ্চিত হয়েছিল।
উপসংহার
মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের সবচেয়ে গৌরবােজ্জ্বল ইতিহাস। যার বিনিময়ে আজ আমরা স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের নাগরিক আজ আমরা বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছি। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এবং বিভিন্ন স্মৃতি সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করে রাখা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ধুনট পুলিশ স্টেশন রেইড একটি গুরুত্বপূর্ণ অপারেশন। এ অপারেশন পাঠে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে কিছুটা হলেও ধারণা পাবে বলে আশা করা যায়।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান -ষষ্ঠ খন্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!