এই কথা বলেই তিনি বঙ্গবন্ধুকে লাল ফোনে টেলিফোন করলেন। বললেন, ‘আপনার সাথে আমার কতগুলাে খুবই জরুরী বিষয়ে আলােচনা করা দরকার বলে আমি মনে করি। আপনার ওখানে আপনি লােকজন দিয়ে এত পরিবৃত থাকেন যে সেখানে বসে আপনার সাথে কথা বলার সুযােগ হবে না বা সে রকম পরিবেশও নেই। সুতরাং আপনার সাথে কথা বলার জন্য আমি লাল টেলিফোনটাই বেছে নিলাম। আপনি একদলীয় শাসনব্যবস্থা করতে যাচ্ছেন, কিন্তু আপনাকে আমি অনেকবারই বলেছি আমার দ্বিমতের কথা, আর আজ আমার চূড়ান্ত মতামত দিচ্ছি। আমি আপনার এই একদলীয় শাসনের সাথে একমত নই। আপনি আমাকে বলুন, কেন আপনাকে এই পথে যেতে হবে ?’ এটুকু বলে তাজউদ্দীন সাহেব থামলেন, তখন নিশ্চয়ই বঙ্গবন্ধু কিছু বললেন। এরপর তাজউদ্দীন সাহেব বললেন, ‘এক নম্বর কথা, আমি আপনার যুক্তিতে কনভিন্সড না। দুই নম্বর কথা—এটা প্রশ্ন না, এটা আমার স্টেটমেন্ট। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আপনার হাতে এতই ক্ষমতা দেয়া আছে যে সেই ক্ষমতাবলে দেশে একদলীয় ব্যবস্থা বা আর কোন পরিবর্তনের প্রয়ােজন আছে বলে আমি মনে করি না। আপনার হাতেই তাে সমস্ত ক্ষমতা আছে, কাজেই একদলীয় ব্যবস্থার পক্ষে আপনি যা বলছেন আমার কাছে এর কোন যৌক্তিকতা নেই। তৃতীয় কথা, আমি আর আপনি বাংলাদেশ স্বাধীন হবার আগের ২৪-২৫ টা বছর একসাথে বাংলাদেশের এমন কোন মাঠ-ময়দান নেই যেখানে যাইনি। আমরা বক্তৃতায় সব সময় বলেছি একটি সুখী সমৃদ্ধিশালী দেশের কথা, যার ভিত্তি হবে গণতন্ত্র। যে গণতন্ত্রের গুণগান করেছি আমরা সব সময়, আজকে আপনি একটি কলমের খোচায় সেই গণতন্ত্রকে শেষ করে দিয়ে দেশে একদলীয় শাসনব্যবস্থা করতে যাচ্ছেন। আপনার এই সিদ্ধান্তে আমি অত্যন্ত জোরের সাথে দ্বিমত পােষণ করছি।’ এরপর আরাে দু-চারটি এমনই কথাবার্তা হল। সবশেষে তিনি যে কথাটি বললেন সেটি ছিল প্রফেটিক কথা। তিনি ইংরেজিতে বললেন, ‘বাই টেকিং দিস স্টেপ ইউ আর ক্লোজিং অল দা ডােরস্ টু রিমুভ ইউ পিসফুলি ফ্রম ইওর পজিশন। এই কথাটি আমি আমার সমস্ত জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। মানুষের কিন্তু গত্যন্তর থাকবে না। ভবিষ্যতে আপনাকে কেউ ক্ষমতা থেকে সরাতে চাইলে সেই সরাবার জন্য গণতান্ত্রিক কোন পথ আপনি খােলা রাখছেন না। তখন একটাই পথ খােলা থাকবে আপনাকে সরাবার – আর সেটা হচ্ছে বন্দুক।’ মনে হল বঙ্গবন্ধু ফোনের ওই প্রান্তে রেগে গেছেন, তার চিৎকারের শব্দ টেলিফোনের বাইরেও ভেসে আসছিল। তাজউদ্দীন সাহেব বললেন, ‘কিন্তু মুজিব ভাই, সবচাইতে দুভার্গ্যজনক ঘটনা কী ঘটবে জানেন? আপনাকে এত নিষেধের পরেও আপনার সাথে ওই বন্দুকের গুলিতে আমরাও মারা যাব। আপনি তাে শুধু মারা যাবেন না। দেশটারও ভয়ানক ক্ষতি হয়ে যাবে।’
এর কিছুদিন পরে তাজউদ্দীন সাহেবকে আমি বলেই ফেললাম, “স্যার, এই অবস্থায় আপনি তাে বলছেন আর আপনি থাকতে পারছেন না বা থাকতে চাইছেন না, তবে আপনি কেন বঙ্গবন্ধুকে বলছেন না যে আপনি থাকবেন না ?’ তিনি বললেন, ‘চৌধুরী সাহেব, এই ব্যাপারে এইভাবে মুজিব ভাইকে বলায় আমার একটা অসুবিধা আছে, আপনারা সেটা জানেন না। আমি বললাম, ‘স্যার, কী অসুবিধা আমাকে বলেন। তিনি বললেন, ‘স্বাধীনতার আগের দীর্ঘ সময়ে হয়ত আমি তার পাশে গেছি, নয়ত তিনি আমার পাশে এসেছেন। শুধুমাত্র যখন কারাগারে বন্দি থাকতাম তখন আমরা দুজন বিচ্ছিন্ন থাকতাম। এই যে একটা গভীর সম্পর্ক এ থেকে তাঁর প্রতি আমার একটা বিশ্বস্ততা গড়ে উঠেছে। এখন তিনি যদি আমাকে চলে যেতে বলেন আমি বেরিয়ে যাব, কিন্তু তাকে আমি সরাসরি বলব এই বিষয়টি আমার যেন কেমন মনে হয়, যদিও আমি মনেপ্রাণে চাচ্ছি আমি থাকব না।’
এর পরের কয়েকটা দিন দেখতেই পাচ্ছিলাম খুব অনিশ্চিত একটা অবস্থা। অক্টোবরের ২৬ তারিখ সকালবেলা তাজউদ্দীন সাহেব যখন সচিবালয়ে এলেন দেখলাম তিনি খুব উফুল্ল মেজাজে আছেন। পরে বুঝেছিলাম তিনি জানতেন কী ঘটতে যাচ্ছে। যাই হােক আমাকে ডেকে বললেন, “আজ আমি কারাে সাথে দেখা করব না। যে সমস্ত প্রােগ্রাম আছে সেগুলাে বাতিল করে সবাইকে জানিয়ে দিন। আমি নূরুল ইসলামের (ডেপুটি চেয়ারম্যান, পরিকল্পনা কমিশন) রুমে যাচ্ছি। আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা থেকে ফোন আসবে, তখন আমাকে একটু খবর দেয়ার ব্যবস্থা করবেন।’ কিছুক্ষণের মধ্যে দেখি মন্ত্রিপরিষদ সচিব তওফিক ইমাম এবং যুগ্মসচিব হাবিবুল হক এসেছেন। দু’জনেরই চেহারা খুব মলিন, হাতে দুটো খাম। তওফিক ইমাম সাহেব বললেন, ‘তাজউদ্দীন সাহেব কোথায় ? আমি বললাম, তিনি নিচে নূরুল ইসলাম সাহেবের রুমে আছেন। খুব জরুরী বিষয় নাকি ?
তিনি বললেন, ‘ভীষণ জরুরী। আমি আবার বললাম, ‘কী এত জরুরী ? তিনি বললেন, ‘কিছুক্ষণের মধ্যেই জানতে পারবেন। আপনি আমাদের মুখ থেকে নাই বা শুনলেন।’ তাঁরা দু’জনে নূরুল ইসলাম সাহেবের রুমে চলে গেলেন। ১০ মিনিটের মধ্যে তাজউদ্দীন সাহেব তার অফিসরুমে চলে এলেন। আমাকে ডেকে বললেন সচিব কফিলউদ্দিন মাহমুদ সাহেবকে ডাকতে। কফিলউদ্দিন মাহমুদ সাহেব এলে তাঁর দিকে তিনি একটি চিঠি এগিয়ে দিলেন। প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে এসেছে অর্থমন্ত্রীর জন্য ছােট একটি চিঠি। লেখাটা ছিল অনেকটা এমন শুভেচ্ছা নেবেন। বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে আপনার মন্ত্রী পদে থাকা ঠিক হবে না। তাই আপনাকে ইস্তফা দেবার জন্য বলা হচ্ছে—বা এই রকম কিছু আর এইসাথে পদত্যাগপত্র পাঠানাে হল স্বাক্ষরের জন্য। ইতি—শেখ মুজিবুর রহমান। কফিল উদ্দিন মাহমুদ সাহেব পড়লেন এবং পড়া শেষ করে চিঠিটি আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে একদম কেঁদে ফেললেন। চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি পড়তে লাগল। তিনি দু-তিনবার শুধু বললেন, ইয়া আল্লাহ্, ইয়া আল্লাহ্। এরপর তাজউদ্দীন সাহেব টাইপ করে পাঠানাে পদত্যাগপত্রে সই করে দিলেন। পদত্যাগপত্রটা হাতে নিয়ে সচিব এবং যুগ্মসচিব বললেন, স্যার, কিছু মনে করবেন না, আমাদেরকে এরকম একটি অপ্রিয় কাজ করতে হল। বঙ্গবন্ধু সাংবাদিক সম্মেলন করবেন। সমস্ত মন্ত্রীরা বসা এবং প্রেস বসা। গুরুত্বপূর্ণ অফিশিয়ালদেরও তিনি ডেকেছেন। পদত্যাগপত্র নিয়ে এই দু’জন চলে গেলেন। তারপর তাজউদ্দীন সাহেব জানালেন, তিনি খবর পেয়েছেন আর্মি এবং পুলিশকে সতর্ক করে রাখা হয়েছে। বলা হয়েছে, তাজউদ্দীনের গতিবিধির ওপর কড়া দৃষ্টি রাখুন। এমনকি আর্মিরা সচিবালয়ের চারপাশ ঘিরে রেখেছে। তাজউদ্দীন সাহেব বললেন, আমি এখন একবার মন্ত্রণালয়ে সবার সাথে দেখা করে বাসায় ফিরে যাব।’ মাযহারকে বললেন, “আরহাম সিদ্দিকীকে (তার বন্ধু) ফোন করে বলুন তাঁর গাড়িটা পাঠাতে। আমি আর সরকারি গাড়ি ব্যবহার করব না।’
সচিবালয় ছেড়ে চলে যাবার মুহূর্তে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘স্যার আপনি এখন কী করবেন? আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী? তিনি পরিষ্কার জবাব দিলেন, আমার প্রিন্সিপল কখনও বদল হয় না। আর যেখানে আমার বিন্দুমাত্র কোন পদক্ষেপে, কোন কথাতে মুজিব ভাইয়ের ক্ষতি হতে পারে তেমন কোন অ্যাকশান আমি নেব না।’ সেই সময় সংবাদ সংস্থা বিএসএস-এর চীফ ছিলেন জাওয়াদুল করিম সাহেব। তিনি আমার আত্মীয় হন। তিনি আমাকে পরে বলেছিলেন, সাইদ, একটা ব্যাপার দেখলাম তাজউদ্দীন সাহেবের পদত্যাগের দিন, বঙ্গবন্ধু একটা সাংবাদিক সম্মেলন ডেকেছিলেন, সেখানে দেখলাম তিনি অত্যন্ত দুঃখভারাক্রান্ত। তাঁর চেহারায় একটা দুঃখের ভাব ফুটে উঠেছে। কিন্তু একমাত্র খন্দকার মােশতাককে দেখলাম যার মুখে একটা ক্রুর হাসি। এমন একটা ভাব যে, হয়ে গেছে ব্যাপার, যা চেয়েছিলাম আমি করে ফেলেছি। এই জিনিসটা খুব লক্ষণীয় ছিল। খন্দকার মােশতাকের চেহারাটা এমন যে, সম্ভব হলে আনন্দে তিনি সবার সাথে কোলাকুলি করেন। মুখে ক্রুর একটা হাসি নিয়ে তিনি খুশি হয়ে ছুটোছুটি করছিলেন। আমাদেরকে প্রায় জড়িয়ে ধরছিলেন। জাওয়াদুল করিম আমাকে বলেছিলেন, তাজউদ্দীন সাহেবের সাথে বঙ্গবন্ধুর যে দ্বন্দ্ব, এটা তৈরি করেছে খন্দকার মােশতাক। এই লোেকটা কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে ধ্বংস করবে। ‘৭৫-এর ১৫ অগাস্ট সকালে আমি তাজউদ্দীন সাহেবকে ফোন করেছিলাম। তিনি বলেছিলেন, ‘চৌধুরী সাহেব, আমার জন্য সবচাইতে দুঃখের ব্যাপার কি জানেন, মুজিব ভাই হয়ত মনে করে গেলেন আমিই এই ঘটনা ঘটিয়েছি। তিনি জেনেও গেলেন না তার কত ঘনিস্ট লােক এই কাজটি করল।’
Source:
আবু সাইদ চৌধুরী, গ্রন্থ – তাজউদ্দীন আহমদ – আলোকের অনন্তধারা
মন্তব্য – (দুর্বলচিত্ত কিছু পাঠকের মন্তব্যের প্রেক্ষিতে)
বঙ্গবন্ধুর মতের বিরুদ্ধে গেলেই সে বঙ্গবন্ধু-বিরোধী তা নয়। সব সময় বঙ্গবন্ধুর পক্ষে মাথা নাড়া মানেও সে খুব বঙ্গবন্ধু-ভক্ত তা নয়। বঙ্গবন্ধুর অন্যতম কাছের মানুষ হিসেবে তাঁর মতের ব্যাপারে দ্বিমত হলে তাঁকে জানানো অপরাধ নয়। সেই কাজটাই তাজউদ্দীন করেছেন। হোক তা ভুল বা সঠিক। তাজউদ্দীনের বিরুদ্ধে তখনো অনেকে ছিলেন – এখনো আছে। তবে, প্রথমত – তাজউদ্দীন বিরোধিতা মানে আওয়ামী লীগ বিরোধিতা। দ্বিতীয়ত – তাজউদ্দীন বিরোধিতা কোন বঙ্গবন্ধু-প্রেমী হবার প্রমাণ নয়। তৃতীয়ত, তাজউদ্দীন বিরোধীদের কেউই বঙ্গবন্ধু-প্রেমী হিসেবে নিজেকে দাঁড় করাতে পারেনি।