You dont have javascript enabled! Please enable it!
আড়িয়াবাজার যুদ্ধ বা রেইড
ভূমিকা
স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে দেশের অন্যান্য এলাকার মতাে বগুড়া অঞ্চলেও পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে মুক্তিযােদ্ধাদের যুদ্ধ হয়েছিল। এর মধ্যে আড়িয়াবাজারের রেইড বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য ঢাকা-বগুড়া মহাসড়ক সংলগ্ন আড়িয়াবাজারে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ১টি অ্যামুনিশন ডাম্পসহ ক্যাম্প স্থাপন করে। মুক্তিযােদ্ধারা এ ক্যাম্প আক্রমণ করে পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করেন। ভূমির বর্ণনা আড়িয়াবাজার বগুড়া শহর থেকে আনুমানিক ১২ কিলােমিটার দক্ষিণে অবস্থিত। আড়িয়াবাজারের উত্তরে বগুড়া সেনানিবাস, পূর্বে করতােয়া নদী, দক্ষিণে শেরপুর উপজেলা এবং পশ্চিমে নন্দিগ্রাম উপজেলা অবস্থিত আড়িয়াবাজারের ভিতর দিয়ে বগুড়া-ঢাকা মহাসড়ক চলে গেছে, যা সব ধরনের যানবাহন চলাচলের উপযােগী। আড়িয়াবাজার ইউনিয়ন খােলা ভূমি ও হালকা গাছপালায় পরিবেষ্টিত। শুষ্ক মৌসুমে যে কোনাে বড়াে ধরনের সৈন্য চলাচলে সহায়তা। করে। এলাকার ভূমি খুব উর্বর এবং প্রধান ফসলের মধ্যে আখ, ধান ও পাট উল্লেখযােগ্য। বর্ষা মৌসুমে ভূমিতে পানি জমে থাকে, যা চলাচলে বাধার সৃষ্টি করে। আড়িয়াবাজার ইউনিয়নে করতােয়া একটি উল্লেখযােগ্য নদী, যা বর্ষার। মৌসুমে নৌচলাচলে উপযােগী থাকে। যুদ্ধের সংগঠন যুদ্ধের সংগঠন নিম্নরূপ: ক. পাকিস্তানি বাহিনী: ১টি প্লাটুন (১জন ক্যাপ্টেন, ২৩জন জেসিও/ ওআর)। মুক্তিবাহিনী: ১১০জন মুক্তিযােদ্ধা (১জন নায়েব সুবেদার, ৩৯জন ইপিআর, ৫০জন পুলিশ, ২০জন মুক্তিযােদ্ধা)। যুদ্ধের বিবরণ।
নওগাঁস্থ তদানীন্তন ইপিআর উইংয়ের অধিনায়ক ক্যাপ্টেন গিয়াসের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের ২৯-৩০ মার্চ রাতে বগুড়া শহরের মাটিডালী এলাকায় পাকিস্তানি সেনাদের উপর সফল অ্যামবুশ পরিচালনা করা হয়। অতঃপর ক্যাপ্টেন গিয়াস
নওগাঁ ফিরে যান। পাকিস্তানি সেনাদের এ পরাজয়ের ফলে বগুড়া অঞ্চলে তাদের আধিপত্য হ্রাস পায়। ক্যাপ্টেন গিয়াসের নির্দেশনায় ১ এপ্রিল নায়েব সুবেদার আলী আকবরের নেতৃত্বে মুক্তিযােদ্ধারা আড়িয়াবাজারে অবস্থিত অ্যামুনিশন ডাম্প আক্রমণ করেন। অ্যামুনিশন ডাম্পের উত্তর ও দক্ষিণ পার্শ্বে কাট অফ পাটি রেখে পশ্চিম দিক থেকে করতােয়া নদীকে লক্ষ্যবস্তুর পিছনে রেখে আক্রমণ পরিচালনা করা হয়। এ যুদ্ধ প্রায় আড়াই ঘণ্টা স্থায়ী হয় এবং ইপিআর, পুলিশ ও বেসামরিক ব্যক্তিদের সমন্বয়ে মুক্তিযােদ্ধারা অসীম সাহস ও বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেন যুদ্ধ চলা অবস্থায় পাকিস্তানি জঙ্গিবিমান মুক্তিযােদ্ধাদের উপর হামলা চালালেও মুক্তিযোদ্ধারা তাদের আক্রমণ অব্যাহত রাখেন। আড়িয়াবাজারে লক্ষ্যস্থল পর্যন্ত পৌছাতে মুক্তিবাহিনীকে একটা ফাঁকা মাঠ পাড়ি দিতে হয়েছিল। সেদিন ছিল দক্ষিণের ঝড়াে হাওয়া। মুক্তিযােদ্ধারা গ্রামবাসীকে অনুরােধ জানালেন যে, তারা লক্ষ্যবস্তুর দক্ষিণ দিক থেকে মরিচের গুড়া ছড়াতে পারবেন কি না। তারপর কোথা থেকে এত মরিচের গুড়া ভেসে। এলাে তা বলা কঠিন। সেনা ক্যাম্পে থাকা সবার চোখ-মুখ জ্বলতে লাগলাে। বেলা তখন আড়াইটা। আড়িয়াবাজার ক্যাম্পে সাদা পতাকা উড়লাে। বগুড়ার তদানীন্তন প্রখ্যাত ডাক্তার টি আহমেদের কিশাের পুত্র মাসুদ এ লড়াইয়ে সক্রিয় অংশ নিয়েছিলেন। সাদা পতাকা দেখার সঙ্গে সঙ্গে মাসুদ সারেন্ডার, সারেন্ডার’ চিৎকার করে রাইফেল হাতে এগিয়ে এলেন।
কিন্তু মুহূর্তে একটি গুলি মাসুদের মস্তিষ্ক বিদীর্ণ করলাে। শহিদ হলেন নির্ভীক এক বীর সেনানী শেষ পর্যন্ত ক্যাম্প অধিনায়ক ক্যাপ্টেন নুর ২৩জন পাকিস্তানি সৈন্য নিয়ে মুক্তিযােদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করলাে।  যুদ্ধের পর মুক্তিবাহিনী বন্দি সেনাদের এবং উদ্ধারকৃত ট্রাকভর্তি অ্যামুনিশন। বগুড়া শহরে নিয়ে যান। ২৪জন পাকিস্তানি সৈন্য ও তাদের পরিবারবর্গ এবং মাসুদের লাশ সঙ্গে নিয়ে সবাই বগুড়া শহর প্রদক্ষিণ করে। বগুড়া জেলে প্রথমে সৈন্যদের পরিবারবর্গকে ঢােকানাে হলাে। রাতে ২১টি গান স্যালুটের মাধ্যমে শহিদ মাসুদকে কবরে সমাহিত করা হয়। তারপর ঘটে গেল এক দুঃখজনক ঘটনা। জনতার কুদ্ধ আক্রমণের হাত থেকে এদের রক্ষা করা যায়নি। তারা জেলখানার তালা ভেঙে বন্দিদের বের করে কুড়াল ও বঁটি দিয়ে হত্যা করে। আড়িয়াবাজার ক্যাম্পে উদ্ধারকৃত দ্রব্যাদির মধ্যে কিছু চাইনিজ রাইফেল ও গুলি। পাওয়া যায়। এ ছাড়া ৫৮টি ট্রাকভর্তি অ্যামুনিশন পাওয়া যায়, কিন্তু তা ব্যবহারযােগ্য ছিল না। অস্ত্র বিশেষজ্ঞরা বলেছিলেন, সেগুলাে ছিল ১০৫ মি.মি. গান এবং আরআর-এর অ্যামুনিশন।
বিশ্লেষণ ও পর্যালােচনা
মুক্তিবাহিনীর বিজয়ের কারণ আড়িয়াবাজারের যুদ্ধ পর্যালােচনা করে দেখা যায়, বাঙালিদের বিজয়ের কারণগুলাে ছিল নিম্নরূপ: ক, স্থানীয় জনগণের সমর্থন ও সহায়তা: আড়িয়াবাজারের যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী স্থানীয় অধিবাসী কর্তৃক ব্যাপক সাহায্য ও সহযােগিতা পেয়েছিলেন। গ্রামবাসী পাকিস্তানিদের অবস্থান ও গতিবিধি জেনে মুক্তিবাহিনীকে গােপনে অবহিত করতাে। এভাবে জনসাধারণের সাহায্য পাওয়ার ফলে আড়িয়াবাজারে মুক্তিবাহিনীর বিজয় নিশ্চিত হয়েছিল। ভূমি সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান ও পরিচিতি: মুক্তিযােদ্ধারা আড়িয়াবাজারের পরিচিত ভূমিতে যুদ্ধ করেছেন। স্থানীয় রাস্তাঘাট, নদীনালা সবই ছিল তাদের পরিচিত। এ পরিচিতি তাদের সব কর্মকাণ্ডে সহায়তা করেছিল। আবহাওয়ার প্রভাব: মুক্তিবাহিনী এখানকার আবহাওয়ার সাথে পরিচিত ছিল। তাই মুক্তিযােদ্ধাদের জয় হয়েছিল সহজতর। এ অপারেশনের সময় আড়িয়াবাজার এলাকায় দক্ষিণা বাতাস বইছিল। মুক্তিযােদ্ধাদের আহ্বানে সে সময় গ্রামবাসী কয়েক মণ মরিচের গুড়া দক্ষিণ দিক থেকে ছেড়ে দেয়। ফলে পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষে। পরিষ্কারভাবে দেখা কষ্টকর হয়ে পড়ে। ঘ. সাহসিকতা ও দৃঢ় মনােবল: ক্যাপ্টেন গিয়াসের নেতৃত্বে মাটিডালীর অপারেশনে মুক্তিযােদ্ধারা জয়ী হন। ফলে আড়িয়াবাজার যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী যােদ্ধাদের মনােবল ছিল অত্যন্ত উঁচু পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয়ের কারণ আড়িয়াবাজারের যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনী যে কারণে পরাজিত হয়েছিল, তার মধ্যে উল্লেখযােগ্য কয়েকটি কারণ হচ্ছে ক. এলাকা সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞানের অভাব: পাকিস্তানিরা আড়িয়াবাজার এলাকা সম্পর্কে ভালােভাবে অবহিত হয়নি। ফলে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের দিক, সময় ও স্থানীয় জনগণের সহায়তা সম্বন্ধে আগে থেকে তাদের তেমন ধারণা ছিল না।
দ্রুত সাহায্য ও শক্তিবৃদ্ধির অভাব: আড়িয়াবাজার যুদ্ধের পূর্বে পাকিস্তানি বাহিনী মহাস্থানগড় এলাকা থেকে দক্ষিণে বগুড়া শহরে প্রবেশের চেষ্টা করলে স্থানীয় জনগণ ও মুক্তিযােদ্ধাদের প্রবল প্রতিরােধের মুখে ব্যর্থ হয়। আড়িয়াবাজারে আক্রমণ চলাকালে পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষে বগুড়া শহর অতিক্রম করে অতিরিক্ত শক্তি প্রেরণের সুযােগ ছিল না। গ, দুর্বল নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা: আড়িয়াবাজারে পাকিস্তানি বাহিনীর অ্যামুনিশন ডাম্প ও ক্যাম্প পাহারা দেওয়ার জন্য ১জন ক্যাপ্টেনের নেতৃত্বে ১ প্লাটুন সেনা মােতায়েন করা হয়, যার নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল দুর্বল। উপসংহার বগুড়ার অকুতােভয় মুক্তিযােদ্ধারা বিভিন্ন অঞ্চলে পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে সীমিত সামর্থ্য ও শক্তি এবং অদম্য মনােবল নিয়ে লড়াই করেছেন। আড়িয়াবাজার যুদ্ধ এসবের মধ্যে অন্যতম। এ যুদ্ধে সাফল্যের ফলে পাকিস্তানি। বাহিনীর মনােবল যেমন ভেঙে যায়, তেমনি মুক্তিবাহিনীর জয় হয় দ্রুত ও সুনিশ্চিত।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান -ষষ্ঠ খন্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!