You dont have javascript enabled! Please enable it!
বৃহত্তর বগুড়া জেলার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
রাজশাহী বিভাগের কেন্দ্রস্থলে উত্তর বাংলার সমৃদ্ধ এক জনপদ বগুড়া জেলা। পাহাড়ী ঝর্ণা থেকে প্রবাহিত করতােয়া নদীর ২৯২২ বর্গকিলােমিটার সমতল এলাকা জুড়ে বিস্তৃত উত্তরবঙ্গের শিল্প, সংস্কৃতি, ব্যবসা-বাণিজ্য ও যােগাযােগের কেন্দ্র বিন্দু বগুড়া। বাংলাদেশের মানচিত্রে ২৪°৫৫ হতে ২৫°০৯ পর্যন্ত উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৯° হতে ৮৯°৭৫ পর্যন্ত পূর্ব দ্রাঘিমাংশে এই জেলার অবস্থান। এই জেলার উত্তরে জয়পুরহাট ও গাইবান্ধা, দক্ষিণে সিরাজগঞ্জ, পূর্বে জামালপুর এবং পশ্চিমে নওগাঁ ও নাটোর জেলা।  ১২৭৯ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ১২৮২ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবনের পুত্র বােরা বাংলার এই অঞ্চলের শাসনকর্তা ছিলেন। বােগরা খানের নাম অনুসারে এ জেলার নাম রাখা হয়েছে। বােরা শব্দের অপভ্রংশ হচ্ছে বগুড়া ইংরেজ আমলে ১৮২১ খ্রীষ্টাব্দে বগুড়াকে জেলা ঘােষণা করা হয়। প্রাচীন সভ্যতার লীলাভূমি হিসেবে এই জনপদ বিখ্যাত। বগুড়া জেলা প্রাচীন পুন্ড্রবর্ধন রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। পুণ্ড্রবর্ধন রাজ্যের রাজধানী এই জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার মহাস্থানগড়ে অবস্থিত। মহাস্থানগড় পুণ্ড নগরের পুরাকীর্তিকে ধারণ করে আছে।
বহু প্রখ্যাত সুফী ও পীর আউলিয়ার পুণ্য স্মৃতি বিজড়িত এই বগুড়া জেলা। এদের মধ্যে হযরত শাহ সুলতান মাহমুদ বলখী মাহী সাওয়ার (রহঃ) ও হযরত ফতেহ্ আলী (রহঃ) নাম বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য বগুড়ার বুকে জন্মগ্রহণ করেছেন নবাব মােহাম্মদ আলীর মত উপমহাদেশ খ্যাত রাজনীতিক এবং লেফটেন্যান্ট জেনারেল ও রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। এছাড়া যাদের জন্য বগুড়ার মাটি ধন্য তারা হলেন, ভাষা সৈনিক গাজীউল হক, এম আর আখতার মুকুল, নাজিরুল ইসলাম, মােঃ আবু সুফিয়ান, সা’দত আলী আকন্দ, কবি কে এম শমসের আলী, কবি মহাদেব সাহা, কবি রােস্তম আলী, মাফরুহা চৌধুরী, মুস্তাফা নূর-উল ইসলাম, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, খালিকুজ্জামান ইলিয়াস, রােমেনা আফাজ, কবি ফারুক সিদ্দিকী, কবি রেজাউল করিম চৌধুরী, বজলুল করিম বাহার এবং অধ্যাপিকা হােসনেআরা প্রমুখ। স্বাধীনতার লাল সূর্যকে ছিনিয়ে আনতে শহিদ হয়েছেন এই বগুড়ার বীর সন্তান বুদ্ধিজীবী আব্দুল জব্বার, অধ্যক্ষ মহসীন আলী দেওয়ান, আফজাল, মনসুর রহমান, টিটু, চান্দু, খােকন, মান্নান, হিটলু, আজাদ প্রমুখ। বগুড়া উত্তরবঙ্গের প্রাণকেন্দ্র এবং দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যকেন্দ্র ও শিল্প শহর পর্যটন কেন্দ্র হিসেবেও বগুড়ার যথেষ্ট খ্যাতি রয়েছে। বৌদ্ধ ও মুসলমান শাসন আমলের পুরাকীর্তি মহাস্থানগড়, হযরত শাহ সুলতান মাহমুদ। বলুখী মাহী সাওয়ার (রহঃ)-এর মাযার এবং মরহুম শিল্পী আমিনুল করিম দুলালের হাতে গড়া কারুপলী ও নবাববাড়ী পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে থাকে বগুড়া জেলার উত্তরাংশের ভূমি লাল মাটিতে সৃমদ্ধ এবং উচ্চ ভূমি বর্তমানে এ জেলা কৃষিপণ্যে উদ্বৃত্ত জেলা। শান্তিপ্রিয় বগুড়াবাসী এই জেলার সুনাম অক্ষুন্ন রেখে আরও সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য সচেষ্ট রয়েছেন। জেলা প্রশাসনের সকল বিভাগ এ ব্যাপারে জনগণকে সার্বিক সহযােগিতা প্রদান। করে যাচ্ছে।
গণআন্দোলন ও অসহযােগ আন্দোলনে বগুড়া
১৯৭১-এ সমগ্র বাংলাদেশব্যাপী এক ইতিহাস সৃষ্টিকারী অসহযােগ আন্দোলন শুরু হয়। পৃথিবীর ইতিহাসে যার কোনাে নজির নাই। এই আন্দোলনে স্কুল, কলেজ, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত সরকারি-বেসরকারি কর্মচারীরাও অফিস বর্জন করে।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে স্বাধীনতার ডাক দেন তার পরিপ্রেক্ষিতে দলমত নির্বিশেষে বগুড়া অঞ্চলের মানুষ দেশকে মুক্ত। করার আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়েন। আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ ও কর্মীগণ যারা এই আন্দোলনে বিশেষভাবে অংশগ্রহণ করেন তাদের মধ্যে সর্বজনাব এ কে মজিবর রহমান, মাহমুদুল হাসান খান, ডা, জাহেদুর রহমান, আকবর আলী খান চৌধুরী, মরহুম মজিবর রহমান (আক্কেলপুর), হাসেন আলী সরকার, মােজাফফর হােসেন, ডা. গােলাম সারওয়ার, সিরাজুল ইসলাম সুরুজ, আমান উলাহ খান, মােস্তাফিজার রহমান পটল, হাসেম আলী খান জায়েদী, হাসেন আলী তালুকদার, কছিম উদ্দীন আহম্মদ, আবুল হাসানা চৌধুরী, ডক্টর মফিজ চৌধুরী, কবিরাজ শেখ আবদুল আজিজ, মােজাম্মেল হােসেন খান, মােল্লা মজিবর রহমান, মন্তেজার রহমান মণ্ডল, আব্দুর রহিম তালুকদার, আলী। হােসেন, সৈয়দ নূরুল হুদা, চিত্ত রঞ্জন সরকার, গােলাম রহমান সরকার, অছিতুলাহ আহম্মদ, আয়েন উদ্দীন আহম্মদ, আজাহার আলী মণ্ডল, প্রফেসর রফিকুল ইসলাম, আবু খাদেম খান প্রমুখ নেতা ও কর্মীবৃন্দ। ন্যাপ নেতা ও কর্মীবৃন্দের মধ্য সর্বজনাব গাজিউল হক, সিরাজুল ইসলাম, মােশাররফ হােসেন মণ্ডল, হারুনুর রশিদ, সাদেক আলী আহম্মদ, মকলেছুর রহমান, মীর ইকবাল হােসেন, দুর্গাদাশ মুখার্জী, আব্দুল লতিফ, আবদুর রাজ্জাক, গােলাম মােস্তফা খান, ডা. আবদুল কাদের চৌধুরী, মীর শহীদ মণ্ডল উল্লেখযােগ্য।
এই আন্দোলনে বগুড়ার মহিলাদের ভূমিকা কম গুরুত্বের নয়। দেশমাতৃকার মুক্তির ডাকে মা-বােনেরাও সেদিন রাস্তায় নেমে বিক্ষোভে ফেটে পড়েন এবং স্বাধীনতার স্বপক্ষে মিছিল, সভা ও পাড়ায় পাড়ায় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন। যে সমস্ত মহিলা আন্দোলনকে জোরদার করে তােলেন তাদের মধ্যে বেগম জহুরা ইয়াছিন, জহরা খানম, জাহানারা রহমান, আনােয়ারা হামিদ, শেফালী রহমান, গােলে আফরুজা বেগম, বেগম লতিফা সরকার, আমেনা রইছ, মরহুম হিমায়েতন নেছা, সেলিমা বেগম, আনােয়ারা রহমান জনা, খালেদা হানুম, আবেদা গণি, ছুরাইয়া বেগম, মিনু রহমান, রওশন আরা, আনােয়ারা রহমান, সামছুন নাহার, রােমেনা আফাজ, মাহমুদা খান, মােমেনা চোধুরী, আয়েশা আশরাফ, মাজেদা হােসেন, রওনক মহল দিলরুবা, বেগম জিন্নাতুন নেছা প্রমুখ।  মরহুম হিমায়েতন নেছার আহ্বানে বাংলাদেশ মহিলা সংগ্রাম পরিষদ মাসুদ মিলনায়তনে (সাবেক জিন্নাহ হল) এক বিরাট মহিলা সভা অনুষ্ঠিত হয়। ঐ সভার নেতৃত্বে ছিলেন খালেদা হানুম। সভার শেষে হিমায়েতন নেছার নেতৃত্বে একটি বিরাট মিছিল বাহির হয় এবং সমস্ত শহর প্রদক্ষিণ করে। দেশকে মুক্ত করতে হলে সশস্ত্র সংগ্রামে নামতে হবে। ছাত্ররা এই সত্যটিকে ভালােভাবেই উপলব্ধি করতে পেরেছিল। ৭ মার্চের পর থেকেই জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি মমতাজ উদ্দীনকে আহ্বায়ক ও সাধারণ সম্পাদক মকবুল হােসেনকে সম্পাদক, বগুড়া শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আ ক ম আমিনুল ইসলাম মিটুকে ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক করে ১৯ সদস্যের সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। শহরের পাড়ায় পাড়ায় ও শহরতলীতে সামরিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খুলে সশস্ত্র বিপবের প্রস্তুতি নেয়া শুরু হয়। ছাত্রলীগের মমতাজ উদ্দীন, আবদুস সালাম, খাদেমুল ইসলাম, আমিনুল ইসলাম মিটু, সামছুর রহমান, সাইদুল ইসলাম, আমিনুল ইসলাম পিন্টু, আবদুর রাজ্জাক মিল্লাত, ফেরদৌস জামান মুকুল, রেজাউল বাকী, রেজাউল করিম রেজা, মাহবুবুর রহমান রাজা, মকবুল হােসেন প্রমুখ ছাত্রকর্মী উল্লেখযােগ্য ভূমিকা পালন করেন।
ছাত্রলীগের সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে বগুড়া শহরের অ্যাডওয়ার্ড পার্ক, সেন্ট্রাল স্কুল প্রমুখ স্থানে সামরিক ট্রেনিং ক্যাম্প খােলা হয়। এছাড়া ছাত্র ইউনিয়নের হায়দার আলী, স্বপন গুহ রায়, রফিকুল ইসলাম লাল, নূরুল আনােয়ার বাদশা, মনােজদাশ গুপ্ত, বদিউল আলম, মাছুদার রহমান হেলাল প্রমুখ ছাত্রকর্মী এই আন্দোলনকে জোরদার করে তােলেন। ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির নির্দেশ অনুযায়ী ও জেলা কমিটির সিদ্ধান্ত অনুসারে মাছুদার রহমান হেলালের অধিনায়কত্বে ছাত্র ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করে জেলা স্কুল মাঠে রাইফেল ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা করেন। মােস্তাফিজার রহমান। পটলকে প্রধান করে আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠিত হয়। এমনকি বন্দর সােনাতলায় আওয়ামী লীগের নেতা সৈয়দ নুরুল হুদার নেতৃত্বে একটি সামরিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খােলা হয়। এছাড়াও জেলার বিভিন্ন স্থানে বাংলাদেশ মুক্তিফ্রন্ট গড়ে ওঠে। অসহযােগ আন্দোলন চলাকালীন এসব বাহিনী প্রতিরােধের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে এই সময় মুজিব-ইয়াহিয়ার আলােচনা চলছিল। আলােচনার ফলাফল কি হবে এ নিয়ে জনগণের উকণ্ঠা এবং ছাত্রদের প্রতিরােধ প্রস্তুতি অব্যাহত থাকে ।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান -ষষ্ঠ খন্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!