You dont have javascript enabled! Please enable it! 1947.08.11 | মূল রাষ্ট্রীয় নীতিমালা ব্যাখ্যা করে মোঃ আলী জিন্নাহ’র গণপরিষদে প্রথম বক্তৃতা - সংগ্রামের নোটবুক

শিরোনামঃ মূল রাষ্ট্রীয় নীতিমালা ব্যাখ্যা করে মোঃ আলী জিন্নাহ’র গণপরিষদে প্রথম বক্তৃতা
সুত্রঃ কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহঃ স্পিচেজ এজ গভর্নর জেনারেল অব পাকিস্তান, ১৯৪৭-৪৮ পৃষ্ঠা-৬
তারিখঃ ১১ই আগস্ট, ১৯৪৭

১৯৪৭
প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসেবে ১১ ই আগস্ট ১৯৪৭ এ পাকিস্তানের গণপরিষদে কায়েদ-এ-আজম এর উদ্বোধনী ভাষণঃ

মিঃ প্রেসিডেন্ট, সুধীবৃন্দ,
আমি বিনীতভাবে পরম আন্তরিকতার সাথে ধন্যবাদ জানাচ্ছি, আপনাদের প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসেবে আমাকে নির্বাচিত করে যে সম্মানে আমাকে ভূষিত করা হয়েছে, সে সম্মান এই সার্বভৌম পরিষদের সবচেয়ে বড় সম্মান। আমি সেইসব নেতাদেরও ধন্যবাদ জানাই যারা আমার সেবার কদর করেছেন এবং ব্যাক্তিগত মতামত জানিয়েছেন। আমি আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করি যে, আপনাদের সমর্থন ও সহযোগিতায় এই গণপরষদকে আমরা বিশ্বে দৃষ্টান্তরূপে উপস্থাপন করতে পারবো। এই গণপরিষদ দুইটি প্রধান কাজ করবে। প্রথম কষ্টদায়ক ও দয়িত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে আমাদের ভবিষ্যত সংবিধান প্রণয়নএবং দ্বিতীয় পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় আইনসভা হিসেবে সম্পূর্ণরূপে সার্বভৌম অঙ্গ হিসেবে কাজ করা। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় আইনসভার জন্য প্রাথমিক সংবিধান প্রণয়নে আমাদের সর্বাত্মক চেষ্টা করতে হবে। আপনারা জানেন যে শুধু আমরাই না, আমি মনে করি, এই উপমহাদেশে দুইটি স্বাধীন সার্বভৌম রাজত্ব সৃষ্টি ও প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা যে অভূতপূর্ব বিপ্লব এনেছে তাতে পুরো বিশ্বই আশ্চর্যান্বিত হচ্ছে। এটি এমন যে, বিশ্বের ইতিহাসে এমন কোন নজির নেই। এই মহৎ উপমহাদেশ তার সকল প্রকার অধিবাসীদের নিয়ে এক বিরাট, অজ্ঞাত, অনুপম পরিকল্পনার মধ্যে চলে এসেছে । আর এই সম্বন্ধে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল যে আমরা এটি শান্তিপূর্নভাবে এবং সর্বাধিক সম্ভাব্য উপায়ের বিবির্তনের দ্বারা অর্জন করেছি।

এই পরিষদে প্রথম কার্যক্রম নিয়ে এই মূহুর্তে আমি কোন সুবিবেচিত ঘোষনা করতে পারবো না, তাও আমি কিছু বলবো যেহেতু আমার সাথে এগুলো সম্পর্কিত। প্রথম এবং সর্বাগ্রে যে জিনিষের উপর আমি গুরুত্ব আরোপ করবো, সেটি হলো আপনারা এখন যে একটি সার্বভৌম সংস্থা এবং সকল ক্ষমতার অধিকারী সেটি মনে রাখা। সুতরাং, আপনারা কিভাবে সিদ্বান্ত নিবেন তা নিয়ে আপনাদের উপর গুরু দায়িত্ব এসে পড়ে। আমার প্রথম পর্যবেক্ষনঃ আপনারা আমার সাথে একমত হবেন যে , সরকারের সর্বপ্রথম কাজই হচ্ছে আইনের প্রতিষ্ঠা যাতে করে নাগরিকদের জান-মাল ও ধর্মীয় বিশ্বাস রাষ্ট্র দ্বারা সংরক্ষিত থাকবে।
দ্বিতীয়ত, সবচেয়ে বড় অভিশাপ যা ভারত ভোগ করছে তা হল ঘুষ ও দুর্নীতি, যদিও আমি বলছিনা যে অন্য দেশগুলো এর থেকে মুক্ত, কিন্তু আমাদের অবস্থা খুবই সঙ্গিন। এটি আসলেই বিষের মত। আমাদের শক্ত হাতে এগুলোর দমন করতে হবে এবং আমি আশা করছি যে এরকমটি করতে এই গণপরিষদের জন্য আপনারা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।

কালোবাজারি হলো আরেকটি শাপ। আমি জানি কালোবাজারিরা প্রতিনিয়তই ধরা পরছে ও শাস্তি পাচ্ছে। বিচার করে কারাদন্দ হচ্ছে অথবা অনেক সময় শুধু মাত্র জরিমানা হচ্ছে। আমাদের এই বৈরীতাকে সামলাতে হবে যেটি আমাদের এই পীড়িত অবস্থায় যখন প্রতিনিয়ত অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের মত মৌলিক চাহিদাগুলোর ঘাটতিতে ভুগছি, আমাদের সমাজের বিরুদ্ধে প্রকান্ড অপরাধস্বরূপ। একজন নাগরিক যে চোরাকারবারি করেন, তিনি যেই অপরাধ করেছেন তা জঘন্যতম অপরাধের চেয়েও নিকৃষ্টতম। যারা কালোবাজারির সাথে জড়িত তারা বেশিরভাগই পরিচিত, বুদ্ধিমান ও সাধারণভাবে দায়িত্ববান হিসেবে পরিচিত, তারা যখন এই অপরাধে জড়িয়ে পড়ে, আমি মনে করি তাদের অবশ্যই কঠোরভাবে শাস্তি দেওয়া দরকার। কারণ তারা নিত্যপণ্য ও খাদ্য সামগ্রীর নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনার পুরো সিস্টেমেরই পতন সাধন করেন এবং অনাহার, চাহিদা এমনকি মৃত্যুরও কারন হয়ে দাঁড়ায়।

আরেকটি বিষয়ঃ এটি আমাদের উত্তরাধিকার সূত্রেই পাওয়া। আরো অনেক কিছুর সাথে, ভালো কি মন্দের সাথে, স্বজনপ্রীতি ও দালালির মতো অশুভ জিনিষগুলো আমাদের মধ্যে চলে এসেছে। এই অশুভ শক্তির সাথে নিরলসভাবে লড়াই করতে হবে । আমি বলে দিচ্ছি, আমি কোন দালালি, স্বজনপ্রীতি কিংবা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোন প্রভাবই বরদাস্ত করবো না। কোথাও যদি দেখি প্রথায় পরিণত হচ্ছে বা এই রেওয়াজ চালু হচ্ছে, কম কি বেশি, আমি কখনোই সমর্থন করবোনা।

আমি জানি অনেকেই আছে যারা ভারতের ভাঙ্গন বা বাংলা ও পাঞ্জাবের বিভাজন কে সমর্থন করেন না। অনেকেই এর বিরুদ্ধে বলেছেন, কিন্তু এখন যখন সবাই মেনে নিয়েছে, আমাদের সবার দায়িত্ব এর প্রতি অনুগত থাকা এবং যেই চুক্তি এখন চূড়ান্ত ও বাধ্যতামূলক সেই চুক্তি মোতাবেক আচরণ করা। আপনারা অবশ্যই মনে রাখবেন যেমনটি আমি আগেই বলেছি যে এই বিপ্লব সত্যিই অভুতপূর্ব। যে কেউ এই দুইটি সম্প্রদায়ের মধ্যে বিদ্যমান অনুভূতি বেশ বুঝতে পারবে হোক সে সংখ্যা গরিষ্ঠ কিংবা সংখ্যা লঘু। কিন্তু প্রশ্ন হলো যা হয়েছে তার অন্যথা কি সম্ভব ছিল। বিভাজন তো হতেই হত। হিন্দুস্তান ও পাকিস্তান , উভয়পাশেই, কিছু অংশ মানুষ হয়তো একে সমর্থন করছে না, একে পছন্দ করছেনা, কিন্তু আমার মতে আর কোন সমাধান নেই এবং আমি নিশ্চিত ভবিষ্যত ইতিহাস এর পক্ষেই রায় দিবে। এবং সামনে বাস্তব অভিজ্ঞতার মাধ্যমেই প্রমাণিত হবে যে এটিই ভারতের সাংবিধানিক সমস্যার একমাত্র সমাধান। সংযুক্ত ভারতের ধারণা কখনোই ফল্প্রসু হত না, আর আমার মতে তাতে এক ভয়ঙ্কর দুর্যোগ সৃষ্টি হত। হয়ত সেই ধারনা সঠিক ছিল অথবা ছিল না , তা এখনও দেখার আছে। তদসত্বেও, এই বিভাজনের ফলে সংখ্যালঘুরা কোন রাজ্যে যাবে সেই প্রশ্ন এড়ানো অসম্ভব ছিল। এখন এটি অনিবার্য ছিল। আর কোন উপায় ছিল না। তো এখন আমরা কি করব? এখন আমরা যদি এই পাকিস্তানের মহান রাজ্যকে খুশি ও সমৃদ্ধ করতে চাই, আমাদের সম্পূর্ণভাবে মানুষের বিশেষত জনসাধারণ ও দরিদ্রদের মঙ্গলের উপর মনযোগ দিতে হবে। আপনারা যদি অতীত ভুলে, মনোমালিন্য দূর করে একত্রে কাজ করতে পারেন তাহলে অবশ্যই সফল হতে পারবেন। আপনাদের সাফল্য অটুত থাকবে যদি আপনারা অতীত পরিবর্তন করে একসাথে কাজ করেন, এই উদ্দীপনায় যে আপনাদের মধ্যে সকলে, সে যেই সম্প্রদায়েরই হোক না কেন, অতীতে যে সম্পর্কই তাদের মধ্যে থাকুক না কেন, যে বর্ণ-গোত্র-ধর্মেরই হোক না কেন, সবাই এই রাষ্ট্রের নাগরিক যাদের সকলের সমান অধিকার ও বাধ্যবাধকতা আছে।

আমি এতে আর জোর দিতে পারছিনা। আমাদের এই উদ্দীপনা নিয়ে কাজ শুরু করে দিতে হবে এবং সময়ের সাথে সাথে সংখ্যাগরিষ্ঠ ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের – হিন্দু সম্প্রদায় ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে সকল জটিলতা দূর হবে কারন মুসলমান্দের মধ্যেও পাঠান, পাঞ্জাবি, শিয়া, সুন্নী ইত্যাদি গোষ্ঠী আছে আবার হিন্দুদের মধ্যেও বাহ্মণ, বৈষ্ণব, ক্ষত্রিয়, আবার বাঙ্গালী , মাদ্রাজী প্রভৃতি রয়েছে। এমনকি, ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা এটিই ছিল। নাহলে আরো অনেক আগেই আমরা মুক্ত হতে পারতাম। কোন শক্তিই একটি জাতিকে ধরে রাখতে পারে না, বিশেষত ৪০০ মিলিয়ন মানুষের একটি জাতিকে বশীভূত করতে পারে না, কেউ আপনাদের জয় করতে পারত না, যদি করত ও , এতদিন পর্যন্ত কেউ কর্তৃত্ব বজায় রাখতে পারত না।

এর থেকে আমরা একটি শিক্ষা পেয়েছি। আপনারা মুক্ত, আপনারা কোন মন্দিরেও যেতে পারবেন, কোন মসজিদেও যেতে পারবেন অথবা এই পাকিস্তানে যে কোন আরাধনার জায়গায়ই যেতে পারবেন। আপনি যে কোন ধর্ম বা গোত্রেরই হন না কেন তার রাষ্ট্রের সাথে কোন সম্পর্ক নেই। আপনারা যেমনটি জানেন, ইতিহাস সাক্ষী , কিছুদিন আগেও ব্রিটিশদের, ভারতে এখন যে অবস্থা এর থেকে অনেক খারাপ অবস্থা ছিল। রোমান ক্যাথলিক ও প্রোটেস্ট্যান্টরা একে অপরকে তাড়া করে বেড়াত। এখনো কিছু রাজ্য আছেযেখানে শ্রেনী বৈষম্য বিদ্যমান এমনকি কিছু বিশেষ শ্রেনীর উপর নিষেধাজ্ঞাও রয়েছে। উপরওয়ালাকে শুকরিয়া যে আমাদের সেই অবস্থায় শুরু করতে হচ্ছে না। আমরা এমন দিনে শুরু করছি যখন এক সম্প্রদায়ের সাথে অন্য সম্প্রদায়ের , কিংবা এক গোত্রের সাথে অন্য গোত্রের বিভেদ- বৈষম্য নেই। আমরা সকলেই রাষ্ট্রের সমান নাগরিক এই মূলনীতিতেই আমরা শুরু করেছি। কালক্রমে ইংল্যান্ডের মানুষদের বাস্তবিকতার সম্মুখীন হতে হয়েছে, এবং তাদের সরকার দ্বারা তাদের উপর দায়িত্বের যে বোঝা অর্পিত হয়েছে তা থেকে ভারমুক্ত হতে হয়েছে। তাদের ধাপে ধাপে এই অগ্নিপরিক্ষা পেরোতে হয়েছে। আজ আপনারা ন্যায়ের সাথে বলতে পারবেন যে কোন রোমান ক্যাথলিক বা কোন প্রোটেস্ট্যান্ট নেই, যারা আছে সবাই যুক্ত্রাজ্যের নাগরিক যাদের সকল ক্ষেত্রে সমান অধিকার আছে।

আমরা এখন এটিকে আমাদের সামনে আদর্শ হিসেবে রাখবো, এবং দেখবেন সময়ের সাথে, ধর্মীয় অর্থে না কারন এটি যার যার নিজস্ব ব্যাপার, রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে রাজনৈতিক অর্থে হিন্দুরা হিন্দু হওয়া থেকে, মুসলমানেরা মুসলমান হওয়া থেকে ক্ষান্তি দিবে ।
তো ঠিক আছে সুধীবৃন্দ, আমি আর আপনাদের সময় নিবোনা। আবারো আপনাদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি এই সম্মানের জন্য যা আমাকে আপনারা দিয়েছেন। আমি সর্বদাই ন্যায়ের আদর্শে পরিচালিত হব, এবং রাজনৈতিক ভাষায় যেমন বলে, কোন কুসংস্কার বা বৈরিতা ছাড়া, অন্য কথায় কোন পক্ষপাতিত্ব ছাড়াই ন্যায়বিচার করবো। আমার পথপদর্শক নীতি হবে, ন্যায় ও সম্পূর্ণ নিরপেক্ষতা, এবং আমি নিশ্চিত আপনাদের সহযোগিতায় ও সমর্থনে পাকিস্তান কে এক মহৎ জাতিতে পরিণত করতে পারবো।

আমি যুক্তরাষ্ট্র হতে একটি বার্তা পেয়েছি যা হচ্ছেঃ
“আমি পাকিস্তানের গণপরিষদের সভাপতি হিসেবে আপনাকে যোগাযোগ করার সম্মান লাভ করেছি। নিম্নলিখিত বার্তাটি আমি এই মাত্র যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হতে পেয়েছিঃ
“পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম বৈঠক উপলক্ষে, আমি আপনাকে এবং পরিষদের সদস্যদের যুক্তরাষ্ট্রের সরকার ও জনগণের পক্ষ থেকে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাচ্ছি যেন আপনি যেই মহান দায়িত্ব হাতে নিয়েছেন তাতে সফল হন। ”