দ্যা গার্ডিয়ান, লন্ডন, ৩১ মার্চ ১৯৭১
সম্পাদকীয়
পাকিস্তানে হত্যাকাণ্ড
“এখন আমরা খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারছি পাকিস্তান কীভাবে এক ভয়াল ত্রাসকে লালন করছে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান প্রবলভাবে এসবের মদত দিয়ে যাচ্ছেন। তার মিথ্যাচারে ভারী হয়ে গেছে বাতাস, বিদেশী সাংবাদিকদের তিনি বিদেয় হতে বাধ্য করেছেন। তবে কিছু সাহসী সাংবাদিক তার এই জালে আটকা পড়েন নি। তারা সত্য কথাটা বলে যাচ্ছেন, বলে যাচ্ছেন বিদ্যমান ভয়াবহ অবস্থার কথা। তারা লিখছেন নির্বিচারে মেশিনগান দ্বারা গুলিবর্ষণের কথা, ছাত্রনিবাসে গোলাঘাত এর কথা, ছোট্ট শহর এবং গ্রাম পুড়িয়ে, গুঁড়িয়ে দেয়ার কথা, লিখছেন নিজ বিছানায় নাগরিকদের মৃত্যুবরণের কাহিনী। আমরা এখনও জানি না পূর্ব প্রান্তের আটকদের পরিণতি কী হতে যাচ্ছে, কতটুকু প্রতিরোধ গড়তে সক্ষম তারা। শুধু জানি এই সত্য, হাজার হাজার নিরস্ত্র বাঙালি মারা পড়ছে ঝাঁকে ঝাঁকে।
এখন থেকে পুরো ঘটনাটির রূপ বদল হচ্ছে। সেনা নামার আগে অনেক নেতাই দায়িত্ব বন্টন করে শেখ মুজিবকে দুষেই ক্ষান্ত ছিলেন। কিন্তু ইয়াহিয়া খান এসবের তোয়াক্কাই করলেন না। হত্যাকে দিলেন বৈধতা। মুজিবের সাথে কথা বলার ছলে জেনারেলদের সুযোগ দিলেন এই ম্যাসাকার চালিয়ে যাওয়ার। তিনি ভাব দেখিয়েছিলেন যে গণতন্ত্রের প্রতি তার অখণ্ড আস্থা এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করাটাই তার দায়িত্ব। শিঘ্রই প্রকাশিত হলো তার মিথ্যা। অত:পর প্রতিষ্ঠিত হলো সামরিক একনায়কতন্ত্র। আরো অনেকের মত গার্ডিয়ানও ভেবেছিলো যে ভারসাম্যের সুবিধা পূর্ব পাকিস্তানে বজায় থাকবে। কিন্তু হত্যা আর ধবংস দিয়ে কি ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা যায়! পূর্ব পাকিস্তানের পরিচয় হয়ে রইল পশ্চিম পাকিস্তান অধ্যুষিত এবং শোষিত প্রদেশ হিসেবে। বাঙ্গালির অবিশ্বাস আর সন্দেহ ক্রমশ সত্য হিসেবে প্রকাশ পেতে লাগলো। একজন জাতীয় নেতা হয়েও ভুট্টো ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানালেন এই বিভৎস হত্যালীলার জন্যে। পাকিস্তানের বন্ধু হয়ে যারা মানবিকতা এবং দয়া প্রদর্শনের অনুরোধ জানালেন, তাদের কারো কথায় ইয়াহিয়া কর্ণপাত করলেন না।
কিন্তু তাকে শুনতেই হবে। বিয়াফ্রার সাথে তুলনা করলেই বোঝা যায় পূর্ব পাকিস্তানে কী ভুলটাই না করা হচ্ছে! আমেরিকা-যারা পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে মদত যোগাচ্ছে, তাদের অবশ্যই বুঝতে হবে যে তাদের সরবরাহকৃত অস্ত্র দিয়ে কী অনাচারটা ঘটছে। চিনা এবং সিংহলরা, যারা তাদের অভ্যন্তর দিয়ে পাকিস্তানী বাহিনীকে এগুতে দিচ্ছে, তাদের বুঝতে হবে, এই বাহিনী কী করতে যাচ্ছে! বৃটেন- যারা আত্ম অহমিকা এবং প্রভাবের দ্বন্দ্বে নিজেদের গুটিয়ে রেখেছে, তাদের মন খুলে এগিয়ে যেতে হবে, প্রয়োগ করতে হবে শক্তি! ঢাকার ভাগ্যে যে পরিণতি অপেক্ষা করছে, মানবতার বিরুদ্ধে যে অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে, মধুর ভাষা দিয়ে তা কখনই ঠেকানো যাবে না!”।