You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.04.03 | দ্যা টাইমস লন্ডন, এপ্রিল ৩, ১৯৭১ সম্পাদকীয় পূর্ব পাকিস্তানে হত্যালীলা - সংগ্রামের নোটবুক

দ্যা টাইমস লন্ডন, এপ্রিল ৩, ১৯৭১
সম্পাদকীয়
পূর্ব পাকিস্তানে হত্যালীলা

পূর্ব পাকিস্তান থেকে যত বেশী খবর সংগ্রহ করা হচ্ছে, তত বেশী তা আতংকজনক হয়ে উঠছে। নির্লজ্য হত্যাকাণ্ড ঐতিহাসিক নিষ্ঠুরতা এবং মৃত মানুষের স্তূপের মাঝে দিয়ে স্রোতেরমত ভেসে বেড়ানো কতটা নির্মম হতে পারে। দূরে থেকেও একজন এসব অনুধাবন করতে পারেন যদিও প্রচার হওয়া কিছু ঘটনার বিষয়ে পাকিস্তান সরকার আপত্তি জানিয়েছে।

প্রথম দিকে পাকিস্তানি আর্মিকে যখন শৃঙ্খলা রক্ষার নির্দেশ দেওয়া হয় তখন বলা যায় তাদের হাতে একটা সুযোগ ছিল। যখন নির্ভরযোগ্য সূত্রে কোন খবর পাওয়া যায়না তখন অসমর্থিত সূত্রে পাওয়া খবর প্রকাশের লোভ সামলানো কোঠিন। এবং যখন পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম, ব্রডকাস্ট এবং সংবাদপত্র বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের তথ্য সংগ্রহের মাধ্যম হয়ে ওঠে তখন আপত্তি আরও জোরদার হয়। প্রথম দিকে গুলি করে হত্যা করা মানুষের সংখ্যা যেকারও গণনা বা কল্পনার থেকে বেশী ছিল। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এবং শেখ মুজিবুর রহমানের মাঝে আলোচনা চলা কালে ঐক্যবদ্ধ পূর্ব বাংলার আশাছিল, কিন্তু অস্ত্রের ব্যাবহারে তা এখন যুদ্ধের দারে গিয়ে পৌছেছে যেখানে কিছুই আর অবশিষ্ট থাকেনা।

এখন এ অবস্থার ছবিটা আরও বেশী পরিষ্কার এবং অনেক বেশী অসস্তিকর। ঢাকা থেকে এবং অন্যান্য বড় শহর গুলো থেকে যথেষ্ট পরিমাণ প্রত্যক্ষ রিপোর্ট থেকে স্পষ্ট হয়েছে যে, যা ঘোটছে তা ধারণার থেকেও অনেক বেশী মর্মান্তিক। পূর্ব পাকিস্তান, কেন্দ্রীয় সরকারের সামরিক বাহিনীর সাথে স্বাধীনতার জন্য এখন যুদ্ধ করছে। প্রাপ্ত খবর গুলো থেকে যে ছবিটি ফুটে উঠছে তা শুধু ভারত ভাগের সময় হিন্দু মুসলমান দাঙ্গার হত্যাযজ্ঞের সাথেই মেলানো সম্ভব। আগুনের স্ফুলিঙ্গ একেরপর এক জ্বলে উঠছে। এখানে হত্যা হচ্ছে তো ওখানে প্রতিশোধের আগুণ জ্বলে উঠছে। এবং যখন একপক্ষে শৃঙ্খলা রক্ষার বাহিনী, মিলিটারি অথবা পুলিশ থাকে অথবা যারা অপর পক্ষের ঘৃণার বস্তু হয়ে ওঠে তখন ভয় এবং হত্যা মহামারী আকারে দেখা দেয়। এসবের পরেও কিছু দিক বিবেচনায় পূর্ব পাকিস্তানে চলমান হত্যাযজ্ঞকে নিকৃষ্টতম বলতে হবে। হিন্দু এবং মুসলমানেরা সব সময় আলাদা আলাদা কমিউনিটিতে বাস করত, কারণ তারা একে অপরের থেকে ভিন্ন বলে বিবেচন করে। তাদের মাঝে সংঘাত শুরু হওয়া নতুন কিছু ছিলনা, হিন্দুরা যারাকিনা বর্তমান হত্যাযজ্ঞের শিকার হচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে তারা ছাড়া পাঞ্জাবী বা বাঙালির মাঝে ধর্মিয় অনুভূতিতে কোন পার্থক্য নেই। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে সেখানে এখন ভয় আর উত্তেজনার ভিত্তিতে পার্থক্য করা যাবে। সুতরাং কোন পশ্চিম পাকিস্তানী বাঙালিদের মাঝে এখন মারা পড়তে পারে। প্রতিশোধের আগুণ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে এবং কেউ জানেনা সে কখন এর শিকারে পরিণত হতে পারে।

এই অবস্থার জন্য পাকিস্তানী আর্মির উপর শৃঙ্খলা পুনর্বহালের নির্দেশকে কতটা দায়ী করা উচিৎ? ধারণা করা যাচ্ছে যে, এমন ভাবে নির্দেশ পালন করা হয়েছিল যেন তা সুপরিকল্পিত ভাবে সকল পক্ষের মাঝে ভয় এবং ঘৃণার জন্ম দেয়।

প্রাপ্ত প্রমাণাদি থেকে যে কেউ এই সিধান্তে উপনীত হতে পারবেন যে, লক্ষ্য ছিল আওয়ামীলীগের নেতৃত্ব সমূলে ধ্বংস করার, যেন কোন কার্যকরি নেতৃত্ব বিপ্লবী কার্যক্রম পরিচালনা করতে না পারে। শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং হয়ত পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তাঁর কতজন অনুসারীকে হত্যা করা হয়েছে তা বলা অসম্ভব। ধারণা করা যায়, ঢাকাতে ছাত্রদের গণহত্যা করা হয়েছে গেরিলা অপারেশনের সম্ভাব্য অর্গানাইজার হিসেবে। কেউ যদি এখন এই অবস্থা পরিবর্তনের চেষ্টা করে, অন্তত গণহত্যার বিস্তৃতি কমাতে, যে সকল নেতারা বাঙালিদের দিকের অবস্থা মডারেট করতে পারতেন তারা এখন সংখ্যায় অপ্রতুল হবেন। এতকিছুর পরেও পাকিস্তান রেডিও থেকে বারবার বলা হচ্ছে সব কিছু স্বাভাবিক আছে এবং সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রণে আছে। এমন কিছুই তারা বলছে না বা করছেনা যা শ্বাসরুদ্ধকর-ভীতিকর অবস্থা বন্ধে সহায়ক হবে। এই চলমান গণহত্যা এবং বিচ্ছিন্ন সংঘর্ষ চলতে দেওয়ার মত খারাপ আর কিছু হতে পারেনা।

পাকিস্তান সরকারের প্রচারণা মতে, ঢাকা স্বাভাবিক হয়ে এসেছে এবং সিভিল সার্ভিসের কর্মচারিরা কাজে যোগ দিচ্ছেন, দোকানপাট খুলছে এবং স্বাভাবিক জীবন যাত্রা পূণর্বহাল হচ্ছে, আসা করা হচ্ছে আর কিছু দিনের মাঝে পূর্ব বাংলার জনবহুল এলাকা গুলো নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে। অথচ পূর্ব পাকিস্তান থেকে প্রাপ্ত রিপোর্ট সমূহ বলছে, পাকিস্তান আর্মির পক্ষে প্রধান শহর গুলোছাড়া এমন অবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য যথেষ্ট লোকবল নেই। এছাড়া জনপ্রিয় মুক্তিবাহিনী গ্রাম গুলো নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হবে, শহর এবং গ্রামের মাঝের বিস্তির্ণ এলাকা অঘোষিত নো ম্যান্স ল্যান্ড হয়ে যাবে। এটা হয়ত কোন রকমের একটা নিয়ন্ত্রিত অবস্থা হবে। কিন্তু এমন অবস্থার ভবিষ্যৎ কি হবে? গতবছরের নির্বাচনের পর থেকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কার্যক্রম তাকে পূর্ব পাকিস্তানের সর্বত্র কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য যোগ্য করে তোলেনি। অবশ্যই কোন এক সময়ে কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে পূর্ব পাকিস্তানের নেতাদের সংলাপ পুনরায় শুরু করতেই হবে। গত কিছুদিনের ভীতিকর অবস্থা বিবেচনায় এটা যত দ্রুত হয় ততই মঙ্গল।