দি গার্ডিয়ান সাপ্তাহিকী, ৪ঠা এপ্রিল, ১৯৭১
একটি সাহায্যের আবেদন
মার্টিন উললাকট কর্তৃক
দিন কে দিন বাংলাদেশের পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে, এবং এটি একটি মর্মস্পর্শী ও হৃদয়বিদারক দৃশ্য, কেননা বিংশ-শতাব্দীর এমন কোনো স্বাধীনতা আন্দোলন খুঁজে পাওয়া দুস্কর হবে যেটির প্রতি সর্বস্তরের জনগণের সর্বসম্মতি রয়েছে বলে দাবী করতে পারে, কিন্তু নিজেদের অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে এতটা অ-প্রস্তুত এবং সাজ-সরঞ্জামহীন অবস্থায় কখনো ছিল।
পূর্ব বঙ্গের অভ্যন্তরে ২০০-মাইল যাত্রার পর, গঙ্গার তীরে অবস্থিত ফরিদপুরে পৌঁছে, যেটি ভারতীয় সীমান্ত থেকে আনুমানিক ৯০ মাইল দূরে, মূল অনুভূতি হচ্ছে এই যে এই জনগোষ্ঠীর সবধরণের ন্যায্যতা থাকা সত্ত্বেও দুঃখজনক ভাবে সফল হবার খুব কম সম্ভাবনা নিয়ে, তারা খুব বেশী দেরী হয়ে যাবার আগেই আন্তর্জাতিক সাহায্যের জন্য আবেদন জানাচ্ছে। এবং সেটা, অন্তত যতক্ষণ পর্যন্ত স্বাধীনতা আন্দোলনের স্বল্প-মেয়াদী সম্ভাবনা সম্পর্কিত, হয়তো প্রকৃতপক্ষে অচিরেই ঘটতে পারে।
পাকিস্তানী সেনাবাহিনী, যার আনুমানিক শক্তি পাঁচটি ডিভিশনের চেয়ে বেশী, এই মুহূর্তে বর্ষা মৌসুম শুরু হয়ে যাওয়ার আগেই বাংলাদেশী বাহিনীর দখলে থাকা শহরগুলো উদ্ধার করতে দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে, এবং তারা এই লক্ষ্যে পৌঁছুতে সক্ষম হবে বলে মনে হচ্ছে।
তিন-দিন ব্যাপী সফরে বাংলাদেশের যেখানেই আমি গিয়েছি, সেখানেই আমি একই আবেদন শুনেছি – শহরগুলোর চত্বরে, প্রশাসকদের কার্যালয়ে, ব্যারাকগুলোতে, রাস্তার পাশের ফার্মেসী এবং দোকানগুলোতে; “বিশ্ববাসী আমাদেরকে সাহায্য করছে না কেন?”।
মাগুরাতে, যশোর এবং ফরিদপুরের মাঝখানে অবস্থিত, এক মধ্য-বয়সী আইনজীবী, মিঃ নাসির-উল-ইসলাম, যিনি কার্যত এই এলাকার প্রধান বেসামরিক প্রশাসক হয়ে উঠেছেন, চমৎকার আদর্শলিপিতে একটি দীর্ঘ “স্বাধীনতা প্রেমী মানবতার প্রতি আবেদন” লেখার ব্যপারে জোর দেন, যার শুরুটা এমন “আমরা মানবতার প্রতি আবেদন জানাচ্ছি আমাদের এই চরমতম বিপদের সময়ে আমাদের সাহাজ্জার্থে এগিয়ে আসতে যখন আমরা, পুরো বাংলাদেশের মানুষ হাতে অস্ত্র তুলে নিতে বাধ্য হয়েছি পাঞ্জাবী দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যারা আমাদের সভ্যতাকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দিতে যা কিছু করা দরকার তার সবই করার জন্য প্রস্তুত রয়েছে”।
কয়েকশ মানুষের সামনে, নিজেকে বুজরুক মনে হওয়াতে, আমি সারম্বরে এই লেখাটি আমার ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখি।
শিক্ষিত বাঙালীদের ফুলেল ভারতীয় ইংরেজী শুনে প্রাথমিকভাবে মজা পেলেও তা অচিরেই ভুলে যেতে হয় যখন দেখা যায় যে তারা আসলেই কতটা দুঃখজনক পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে। মাগুরার একপ্রান্তে একটি সেতু অতিক্রম করার পর আমাদের দেখা হয় সাদা পোশাকে সারিবদ্ধভাবে এগিয়ে চলা একদল তরুনের সাথে, .৩০৩ রাইফেল হাতে সশস্ত্র। তারা থেমে দাঁড়ায়, দেখেই বোঝা যাচ্ছে গর্বে তাদের বুক ফুলে আছে, অনুমোদিত ব্রিটিশ সামরিক কায়দায় তাদের পিঠ খাড়া, এবং তাদের স্যান্ডেল পড়া পা মাটিতে এমন ভাবে ঠুকেছে যা কিনা ভারী বুট পড়া সৈন্যদের জন্য অভিপ্রেত, যাতে করে আমার সাথে থাকা ডেনিশ সাংবাদিক তাদের ছবি তুলতে পারে।
মাগুরাতে অন্তত তাদের অর্ধেক কোম্পানিকে দেয়ার মতো রাইফেল আছে। আরো ভেতরের এক নদী তীরবর্তী শহরে, প্রতিরক্ষার দায়িত্বে থাকা প্রাক্তন পাকিস্তানী বিমানসেনা আমাকে জানান তাদের চারটি লী এনফিল্ড রাইফেল এবং দুটি নকল রাইফেল আছে।
ঝিনাইদহ এবং যশোরে সম্ভবত মুক্তি “বাহিনী”-এর সবচেয়ে বড় দলটি রয়েছে। এই দলটি সম্ভবত ৭৫০ লোক নিয়ে গঠিত যার মধ্যে মাত্র ২০০ জনের মতো প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সৈন্য রয়েছে যারা ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস এবং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে ছিল। বাকিরা অনিয়মিত বাহিনীর সদস্য এবং মুক্তি যোদ্ধা। জোড়াতালি দিয়ে তৈরী করা বাংলাদেশ প্রশাসনে বৈচিত্রের কোন অন্ত নেই। সর্বত্র বিদ্যমান প্রশাসনিক কর্মকর্তারা স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে একাত্বতা প্রকাশ করেন, এবং কিছু শহরে এখনো তাঁরা কার্যক্রম পরিচালনা করছেন।
অন্যান্য শহরগুলোতে স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি বা আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যরা দায়িত্বে রয়েছেন। ঝিনাইদহতে, এক সেচ প্রকল্পের সদরদপ্তরে, এক প্রাক্তন পুলিশ প্রধান সামরিক অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করছেন।
দীর্ঘদেহী, ডোরাকাটা শার্ট পরিহিত সুদর্শন এক পুরুষ, ওয়েবিং বেল্ট এবং কোমরে পিস্তল ঝোলানো, আমি যেদিন ওখানে ছিলাম সেদিনই তিনি যশোর “যুদ্ধক্ষেত্র” থেকে আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে ফিরে আসেন। “আমরা ওদেরকে ঘিরে ফেলেছি এবং ওরা বের হওয়ার চেষ্টা করা পর্যন্ত আমরা অপেক্ষা করবো। একটি ব্যাটালিয়ান সামলানোর মতো ক্ষমতা আমাদের থাকার কথা”, তিনি বলেন।
সন্ধ্যা নামার পর নীরবতায়, একটি প্রতিলিপি মেশিন চলার শব্দ শোনা যায়, যেটি ছেপে চলেছে মজুতদারি বন্ধ করার নির্দেশ, সরকারী এবং অন্যান্য কর্মকর্তাদের তাদের নির্ধারিত পদে ফিরে যাবার আদেশ, সকল ছাত্রদেরকে নিকটবর্তী অধিনায়কের সদরদপ্তরে সামরিক প্রশিক্ষণ এবং অন্যান্য কাজে যোগ দেয়ার জন্য অনুরোধ। উঠানে একটি লন্ঠন ঘিরে ক্যাপ্টেন মাহবুবুদ্দিন আহমেদ এবং তাঁর সহকারীরা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নিয়ে আলোচনা করছিলেন।
“আমাদের স্বাধীনতা অর্জন করতেই হবে, এমনকি সমাজতান্ত্রিক স্বাধীনতা কিন্তু চীনের মতো স্বাধীনতা নয় যেখানে সবার কথা বলার স্বাধীনতা নেই এবং সবকিছুই নিয়ন্ত্রিত”। আরেকজন বলেনঃ “আমরা যখন পাকিস্তানের অংশ ছিলাম তখন আমরা আমাদের বাঙালী সত্ত্বাকেই ভুলে গিয়েছিলাম। তুমি জানো, ওরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিষিদ্ধ করেছিল, যিনি কিনা বাংলা সাহিত্যের প্রাণপুরুষ, শুধুমাত্র তিনি হিন্দু বলে”।
নৃশংসতার গল্প বিরতিহীনভাবে প্রচারিত হচ্ছে, এবং ওগুলোর মধ্যে কিছু অবধারিতভাবেই সত্য ঘটনার বিবরণ। ফরিদপুর জেলার স্পোর্টস ক্লাবে, যেটি বর্তমানে শহরটির সামরিক সদরদপ্তরে পরিণত হয়েছে, খুলনার একজন তরুণ ম্যাজিস্ট্রেট আমাকে জানান যে “বিনা উস্কানিতে” প্রতিবাদ মিছিলের উপর মেশিন-গান দিয়ে গুলি চালাতে সে নিজে দেখেছে।
কোন সামরিক অফিসারের মাথা খারাপ হয়ে গেছে মনে করে, সে তাঁর জীপগাড়িতে করে দ্রুত জেলার সামরিক সদরদপ্তরে উপস্থিত হয় এবং পাঞ্জাবী কর্নেলের মুখোমুখি হয়। উক্ত কর্নেল বলে “আমার অভিযোগ ভিত্তিহীন, এবং এরপর যখনই জনগণের উপর গুলি চালানো হবে এই ম্যাজিস্ট্রেট আমিই সবার প্রথমে মারা পড়বো”।
এক তরুণকে আনা হয় যশোরে এক ক্যাথলিক মিশনারির মৃত্যুর স্মৃতিচারণ করতে কেননা বাঙালীদের মধ্যে এমন এক দুঃখজনক বিশ্বাস রয়েছে যে এধরণের মৃত্যু অনেক মুসলমানের মৃত্যুর চেয়েও বেশী গুরুত্ব বহন করে। উত্তেজিতভাবে, সে বর্ননা করে উক্ত পাদ্রীকে তাঁর মিশনেই গুলি করে হত্যা করা হয়, আরো কয়েকজন স্থানীয় খৃষ্টানদের সাথে, এবং পরবর্তীতে একজন পাঞ্জাবী বিগ্রেডিয়ার সেখানে আসে এবং ক্ষমা প্রার্থনা করে, এই বলে যে এটা একটা দুর্ঘটনা ছিল।
“অন্য আরেকজন পাদ্রী তাকে বলেন এটা কিভাবে দুর্ঘটনা হয় যেখানে মিশনের ছাদে রেড-ক্রস এর চিহ্ন আছে”, এই গল্পে সত্যের সুর রয়েছে।
মৃতের সংখ্যা নিয়ে ফোলানো-ফাঁপানো গল্প গুলো মেনে না নিলেও, এটুকু অনেক বেশী পরিস্কার যে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী যখন এগিয়ে আসবে তখন আরো অনেক মানুষ নিহত হবে, এবং তাদের মধ্যে শুধুমাত্র পথরোধ করে থাকা বা রাস্তার পাশের ঝোপের ভেতর নিজেদের তৈরি গর্তে লি এনফিল্ড রাইফেল নিয়ে ওঁত পেতে থাকা তরুণরাই থাকবে তা নয়।
এবং আগামীকাল যদি যুদ্ধ থেমেও যায় তাহলেও যারা যুদ্ধ করছিল তারা ছাড়াও আরো মৃত্যু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। খাবার, পেট্রোল এবং অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পন্যের সরবরাহ একেবারেই কমে গেছে, এবং পানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহে ব্যঘাত জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হয়ে উঠেছে।
কোলকাতায় রহস্যজনক উদ্দেশ্যে, অস্থায়ী সরকার গঠনের সাথে জড়িত, আগত একদল যুবকের সাথে ফরিদপুর থেকে চুয়াডাঙ্গা ফিরে আসার পথে আমরা পাকিস্তানী বাহিনীর শ্রেষ্ঠত্বের অত্যন্ত বাস্তব দৃষ্টান্তের সম্মুখীন হই। একটি ছোট নৌকায় করে গড়াই নদী পার হওয়ার সময় পাকিস্তানী বিমান বাহিনীর স্যাবর জেট বিমান থেকে আমাদের উপর গুলিবর্ষণ করা হয়। নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে নদীর তীরের ইটের স্তূপের পেছনে আড়াল নিতে গিয়ে, আমরা খুব স্পষ্টভাবেই বুঝতে পারি যে এধরণের আক্রমণের সাথে লি এনফিল্ড রাইফেল নিয়ে কখনই পাল্লা দেয়া যাবে না। প্রসঙ্গক্রমে, নদী পার হচ্ছে এরকম একটি দেশী নৌকাকে কোনোভাবেই সামরিক লক্ষ্যবস্তু হিসেবে গণ্য করা যায় না।
অনেক শহর অর্ধেক খালি হয়ে গেছে এবং গতকাল পাবনা শহরটি দখল হয়ে যাওয়াতে আরো অনেক শরনার্থি কুষ্টিয়া ও কুমারখালির দিকে রাস্তায় নেমে এসেছে। ঢাকার পথে মূল ফেরী পারাপারের মাত্র কয়েক মাইল দূরে অবস্থিত ফরিদপুর জেলাতেও মূলত যুবকেরা রয়ে গেছে কিছুটা নীতিগত কারণে আর কিছুটা এই জন্যে যে তারা এটা বন্ধ করতে পারেনি। মহিলা, শিশু এবং বয়স্করা শহর ছেড়ে তাদের গ্রামের বাড়িতে ছড়িয়ে পড়েছে। তারা সেখানে নিরাপদে থাকবে কিনা সেটা ভিন্ন বিষয়।
স্বাধীন এলাকার তুলনামুলক বাস্তববাদী নেতারা আশা করে আছে পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনীতি ভেঙ্গে পড়ার উপর। ফরিদপুরের এক তরুণ হিসাবরক্ষক, যে সাম্প্রতিককালে পাট চাষ না করে তার পরিবর্তে ধান চাষ করার পরিকল্পনা করে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছে, আমাকে জানায়ঃ “ওদের অর্থনীতি এই মাত্রার কার্যক্রম ছয় মাস বা এক বছরের বেশী চালিয়ে নিতে পারবে না। ওরা ভুলে গেছে যে ১০ দিনব্যাপী পাক-ভারত যুদ্ধে ওদের অর্থনীতি চুরমার হয়ে গিয়েছিল”।
কিন্তু সেটা করতে হলে, পশ্চিমা দেশগুলোকে পশ্চিম পাকিস্তানকে সাহায্য প্রদান করা বন্ধ করতে হবে এবং কাউকে একজন রাষ্ট্রদূতের মতো বা পুর্নক্ষমতা প্রাপ্ত কোনো একজন রাজদুতের মতো নিশ্চিত করতে হবে অন্তত যুক্তরাজ্য যাতে করে সাহায্য প্রদান করা বন্ধ করে।
সবচেয়ে সুদূরপ্রসারী অনুভূতি হচ্ছে এই যে বাঙালীরা ১৯৪৭ সালে একটি দুঃখজনক ভুল করেছিল যখন তারা পাকিস্তানের সাথে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। “আমরা সাম্প্রদায়িকতার আবেগে ভেসে গিয়েছিলাম”, মাগুরার মিঃ নাসির-উল-ইসলাম বলেন। “আমিও এই ভুল করেছিলাম। আমরা সবাই এই ভুল করেছিলামঃ এখন আমরা এর মূল্য পরিশোধ করছি”। যে মূল্য দিতে হয়েছে তা ইতিমধ্যেই অনেক বেশী, আর যদি না আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ বা অন্য কোনো অলৌকিক ঘটনায় বাঙালীরা রক্ষা পেয়ে যায়, তাহলে আগামী মাসগুলোতে এই মূল্য আরো বেশী দিতে হবে।