You dont have javascript enabled! Please enable it!
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি/গৌরবগাঁথা
রক্তঝণ
স্বাধীনতা যুদ্ধের উষা লগ্নে রচিত হয়েছিল যশাের অঞ্চলের ৮ নম্বর সেক্টরে মুক্তিযুদ্ধের এক বিরাট অধ্যায়। প্রতিবাদ ও প্রতিরােধে সংগ্রামী চেতনায় জেগে উঠেছিল কপােতাক্ষ বিধৌত অঞ্চল ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ যখন সারা বাংলাদেশের মাটিতে শুরু হয়েছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্মম হত্যাকাণ্ড, তখন যশাের সেনানিবাসে ১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে চারদিক দিয়ে ঘিরে বন্দি করে রাখা হয়েছিল সেনানিবাসের ইউনিট লাইনে। বাংলার মানুষ যখন পাকিস্তানি বাহিনীর পৈশাচিকতায় জর্জরিত, তখন ১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মুক্তিকামী সৈনিকেরা বন্দিদশায় স্থির থাকতে পারেন নি। ৩০ মার্চ তারা পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন। শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে করতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিলেন ১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অনেক বিদ্রোহী প্রাণ। পাকিস্তানি সৈন্যরা এসকল বাঙালি সৈনিকের মৃতদেহ ধর্মীয় নিয়ম না মেনে মনােহরপুরে গর্তের মধ্যে পুঁতে রাখে। পরবর্তী সময় যশাের সেনানিবাস সংলগ্ন মনােহরপুর গ্রামের লােকজন রাতের অন্ধকারে গণকবর থেকে ১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ১৭জন শহিদের লাশ তুলে নেয়। তারপর যথাযথ ধর্মীয় মর্যাদায় রাতের অন্ধকারে পাকিস্তানি বাহিনীর অগােচরে মনােহরপুর লেকের ধারে ঐ ১৭জন বীর বঙ্গ শার্দূলকে সারিবদ্ধভাবে সমাহিত করে। স্বাধীনতার পর মনােহরপুর গ্রামের জনগণের সহায়তায় ঐ ১৭জন বীর শহিদের কবর শনাক্ত করা হয়। ১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্যরা মনােহরপুরে শায়িত ১৭জন শহিদকেই শনাক্ত করেন। তৎকালীন কর্নেল এম এ মঞ্জুর, কমান্ডার ৫৫ পদাতিক ব্রিগেড ঐ ১৭টি কবরকে একটি করে ইট দিয়ে চিহ্নিত করে চারদিকে দেয়াল দিয়ে ঘিরে দেন।  স্বাধীনতা যুদ্ধে ১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ১৭জন শহিদসহ নাম-না-জানা আরও অনেকে শাহাদতবরণ করেন। তাদের স্মৃতি রক্ষার্থে ৫৫ পদাতিক ডিভিশনের জেনারেল অফিসার কমান্ডিং ও এরিয়া কমান্ডার মেজর জেনারেল মুহাম্মদ মুস্তাফিজুর রহমান বীরবিক্রম, এনডিসি, পিএসসি, সি (পরবর্তী সময় জেনারেল ও সেনাবাহিনী প্রধান) দেয়াল ঘেরা কবরস্থানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের পরিকল্পনা হাতে নেন।
১২ ইঞ্জিনিয়ার ব্যাটালিয়ন ১৯৯৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এ স্মৃতিস্তম্ভের নির্মাণকাজ সমাপ্ত করে। এ স্মৃতিসৌধের নামকরণ করা হয় রক্তঝণ’। রক্তঝণ আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের একটি ইতিহাস। ৮৮০ বর্গগজ এলাকা বিস্তৃত এ স্মৃতিসৌধটি ১০ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট ৪টি পিলারের উপর ১৬ ফুট ৮ ইঞ্চি ব্যাস বিশিষ্ট একটি হেলমেট শােভা পাচ্ছে। এর ভিত্তি ২ ফুট উঁচু এবং ৪৯ বর্গগজ আয়তন বিশিষ্ট। শহিদদের কবরগুলাে লম্বা ৮ ফুট ও চওড়া ৩ ফুট ৮ ইঞ্চি এবং উচ্চতা ৩.৫ ফুট। সাদা সিমেন্ট দিয়ে পাকা করে বাঁধানাে এ কবরগুলাে।
যশাের সেনানিবাসে অবস্থিত গৌরবাঙ্গনে প্রবেশ পথে সবুজ ঘাস পেরিয়ে প্রথমে যে চিত্রটি চোখে পড়বে, সেটা হলাে একটি নক্ষত্রের সন্ধানে। ৭টি খণ্ডে বিভক্ত এ তৈলচিত্রটি ১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের একটি পূর্ণাঙ্গ ছবি। প্রতিটি খণ্ডে এক একটি সত্য ঘটনা ফুটে আছে, যার শুরু হয়েছে দখলদার বাহিনীর বর্বরতা থেকে এবং শেষ হয়েছে স্বাধীনতার উদিত সূর্য ও উড়ন্ত জাতীয় পতাকার প্রতিচ্ছবিতে গৌরঙ্গনের ভিতরে এ রক্তঋণ অংশে রয়েছে স্বাধীনতা সংগ্রামের শুরুতে বিভিন্ন ঘটনাবলি ও আমদের রণ প্রস্তুতির ক্রমপর্যায় তা ছাড়া রয়েছে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরােচিত হত্যাকান্ডের করুণ কাহিনী মুক্তিযােদ্ধাদের ব্যবহৃত কিছু হাতিয়ার এবং তৎকালীন পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের খণ্ডাংশ এ অংশে শােভা পাচ্ছে স্মরণিকা এ কক্ষে স্মরণিকায় রয়েছে স্বাধীনতা যুদ্ধে সামরিক সংগঠনের বিবরণ। এখানে নকশার মাধ্যমে চিত্রায়িত আছে স্বাধীনতা সংগ্রামের শুরুতে ১, ২, ৩, ৪ ও ৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের তল্কালীন অবস্থান। আরও রয়েছে যুদ্ধের সময় ৮ ও ৯ নম্বর সেক্টরের বিস্তৃতি ও বিবরণ কুষ্টিয়া জেলায় মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় তৎকালীন বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের ঐতিহাসিক ছবিসহ আরও কয়েকজন বীর মুক্তিযােদ্ধার ছবিও এ কক্ষে রক্ষিত আছে। রণধ্বনি গৌরবাঙ্গনের এ কক্ষে রক্ষিত আছে স্বাধীনতা সংগ্রামে যশাের এলাকায় সংঘটিত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধের নকশা ও ছবি। এতে প্রতিফলিত হয়ে আছে যশােরে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা সেনাবাহিনী, তৎকালীন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস, পুলিশ, আনসার সদস্যসহ সর্বস্তরের জনগণের সম্মিলিত দুর্দম প্রতিরােধ। যুদ্ধের ঘটনাগুলাে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে সাজানাে আছে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ যেমন: জীবননগর যুদ্ধ, চৌগাছা যুদ্ধ, শিরােমণি যুদ্ধসহ আরও অনেক যুদ্ধের বিবরণ এ কক্ষে রক্ষিত আছে।
তা ছাড়া পাকিস্তানি বাহিনীর ব্যবহৃত কিছু সামরিক সরঞ্জামের উপস্থিতি এ কক্ষকে অর্থবহ করে তুলেছে। অপরাজেয় এ কক্ষে পরিচিতি রয়েছে আমাদের সেই ৭জন বীর শহিদদের, যারা বীরশ্রেষ্ঠ উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন। এঁদের মধ্যে ৫জনই এ যশাের সামরিক অঞ্চলের বীর সন্তান, যদিও তারা স্বাধীনতা যুদ্ধে বিভিন্ন সেক্টরে থেকে অংশগ্রহণ করেন। তা ছাড়া এখানে রয়েছে দখলদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের দলিল এবং বাংলাদেশের তৎকালীন ও বর্তমান জাতীয় পতাকা। স্মৃতি অম্লান সব শেষে রয়েছে ‘স্মৃতি অম্লান’, স্বাধীনতা যুদ্ধের উপর রচিত বিভিন্ন বই, পত্রিকা ও দলিলের একটি পূর্ণাঙ্গ পাঠাগার। এ পাঠাগারে রয়েছে অত্যন্ত মূল্যবান গ্রন্থাবলি এবং শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কক্ষে পড়ার সুব্যবস্থা। 
শহিদ সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট আনােয়ার বীর-উত্তমের স্মৃতিস্তম্ভ শহিদ সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট মােহাম্মদ আনােয়ার হােসেন, বীর-উত্তম ছিলেন ১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একজন নবীন অফিসার। স্বাধীনতা যুদ্ধের উষা লগ্নে ১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে চাকরিরত ৪জন বাঙালি অফিসারের মধ্যে তিনি ছিলেন একজন। ইউনিট তখন যশাের সেনানিবাসের অধীনে থাকলেও তাদেরকে ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে শীতকালীন যৌথ প্রশিক্ষণের নামে চৌগাছায় মােতায়েন করা হয়েছিল। তঙ্কালীন ১০৭ পদাতিক ব্রিগেডের আদেশক্রমে ২৯ মার্চ ইউনিটকে যশাের সেনানিবাসে ফেরত নিয়ে আসা হয়। পরবর্তী সময়। ব্রিগেড অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার আব্দুর রহিম দুররানী ১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের। সব অফিসার ও সৈনিকদের পাকিস্তানি ২২ ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের কাছে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন। ইউনিটের সব বাঙালি অফিসার ও সৈনিক। পাকিস্তানি বাহিনীর হীন মনােভাব বুঝতে পারেন এবং আত্মসমর্পণে অস্বীকার করেন।
১৯৭১ সালের ৩০ মার্চ পৌনে ১০টায় সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট আনােয়ার। হােসেন একটি হাতুড়ি দিয়ে অস্ত্রাগারের তালা ভেঙে ফেলেন এবং সাহসী। বাঙালি সৈনিকদের হাতে অস্ত্র তুলে দেন। সেই সাথে নিজে অস্ত্র নিয়ে সম্মুখযুদ্ধ। শুরু করেন। ফলে ১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ইউনিট অবস্থানের উপর। পাকিস্তানি বাহিনী প্রথমে আর্টিলারি ফায়ার এবং পরে (২২ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স ও ২৫ বালুচ রেজিমেন্ট) তিন দিক থেকে সরাসরি আক্রমণ করে। ম৮ ঘণ্টা যুদ্ধ চালিয়ে ১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকেরা সেনানিবাস থেকে বেরিয়ে আসার সময় যুদ্ধরত অবস্থায় পাকিস্তানি বাহিনীর গুলিতে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট আনােয়ার শাহাদতবরণ করেন। ৩০ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে যুদ্ধরত অবস্থায় নিজের জীবন বিসর্জন দিয়েও ইউনিটকে সেনানিবাস থেকে সরে যেতে সাহায্য করেন সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট আনােয়ার। দেশমাতৃকার স্বাধীনতা অর্জন এবং বাঙালি জাতির অস্তিত্ব রক্ষার্থে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করেছিলেন তিনি। জীবন বিসর্জন দিয়েছেন, কিন্তু পরাজয়কে বরণ করেন নি। শহিদের তালিকায় নাম লেখালেন আনােয়ার। তার এ সাহসিকতা ও বীরত্বের জন্য জাতি তাকে ‘বীর-উত্তম খেতাবে ভূষিত করে। যশাের এরিয়া অধিনায়কের নির্দেশনায় ১২ ইঞ্জিনিয়ার ব্যাটালিয়ন ১৯৯৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এ স্মৃতিস্তম্ভের নির্মাণকাজ সমাপ্ত করে। একই বছরের ২৬ মার্চ যশাের অঞ্চলের এরিয়া অধিনায়ক ও ৫৫ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল মুহাম্মদ মুস্তাফিজুর রহমান, বীরবিক্রম, এনডিসি, পিএসসি, সি এ স্মৃতিস্তম্ভের আনুষ্ঠানিক উদ্ববাধন করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের বীর শহিদদের স্মৃতিরক্ষা এবং তাদের প্রতি জাতির সম্মান প্রদর্শনের এক উজ্জ্বল নিদর্শন হলাে এ স্মৃতিস্তম্ভ।  সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট আনােয়ারকে যশাের সেনানিবাস থেকে ৪ কিলােমিটার উত্তরে হৈবতপুরে সমাধিস্থ করা হয়েছিল। এ বীর সৈনিকের কবরের উপর নির্মাণ করা হয় স্মৃতিস্তম্ভ। 

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – সপ্তম খন্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!