You dont have javascript enabled! Please enable it!

নম্বর ১৩১৮৭, বীরশ্রেষ্ঠ শহিদ ল্যান্স নায়েক মুন্সী আব্দুর রউফ মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরশ্রেষ্ঠ খেতাব প্রাপ্ত তৎকালীন ইপিআর (বর্তমানে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশবিজিবি)-এর অকুতােভয় সৈনিক। তিনি ১৯৪৩ সালের ৮ মে, শনিবার ফরিদপুর জেলার বােয়ালমারি থানার (বর্তমানে মধুখালী) সালামতপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মুন্সী মেহেদী হাসান এবং মাতার নাম মুকিদুন্নেসা। তার পিতা ছিলেন স্থানীয় মসজিদের ইমাম ও ধর্মীয় শিক্ষক পিতামাতার প্রিয় কনিষ্ঠ পুত্র ‘রব’ (তার ডাকনাম) আড়পাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছিলেন। ১৯৫৫ সালে পিতার মৃত্যুর পর তার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। মুন্সী আব্দুর রউফ ১৯৬৩ সালের ৮ মে তকালীন ইপিআর (বর্তমানে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবি)-এ সৈনিক হিসেবে যােগ দেন। চাকরির স্বার্থে তাঁর বয়স বাড়িয়ে ৩ বছর বেশি করা হয়। চুয়াডাঙ্গা ইপিআর ক্যাম্পে মৌলিক প্রশিক্ষণ এবং তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানে ৬ মাস প্রশিক্ষণ শেষে তিনি তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের কুমিল্লায় বদলি হন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের আগে তিনি চট্টগ্রামে ১১ উইংয়ে কর্মরত ছিলেন। যুদ্ধ শুরু হলে তিনি ৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাথে যুক্ত হন এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। পার্বত্য চট্টগ্রামে রাঙামাটি-মহালছড়ি জলপথ একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। এ পথে পাকিস্তান সশস্ত্রবাহিনীর চলাচল প্রতিরােধ করার জন্য ৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ১টি কোম্পানি ক্যাপটেন খালেকুজ্জামানের নেতৃত্বে বুড়িঘাট এলাকার চিংড়ি খালের দুই পাড়ে অবস্থান নিয়ে প্রতিরক্ষা ঘাঁটি গড়ে তােলে। ল্যান্স নায়েক মুন্সী আব্দুর রউফ এ কোম্পানির ১জন এলএমজি চালক ছিলেন।
১৯৭১ সালের ৮ এপ্রিল তিনি কোম্পানির মেশিনগানার হিসেবে রাঙামাটিমহালছড়ি নৌপথে প্রহরারত ছিলেন। সূর্য তখন পর্যন্ত পশ্চিম আকাশে হেলে পড়ে নি। তবে সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়েছে প্রায়। বুড়িঘাটের দিকে এগিয়ে আসছে ৭টি স্পিডবােট ও ২টি লঞ্চে আনুমানিক ২ কোম্পানি সৈন্য এরা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় কমান্ডাে ব্যাটালিয়নের সদস্য। এদের লক্ষ্য বুড়িঘাটের মুক্তিবাহিনীর নতুন প্রতিরক্ষা ঘাঁটি। সবচেয়ে আগে তীব্র গতিতে এগিয়ে আসছে ২টি লঞ্চ ও ২টি স্পিডবােট। এগুলাের মধ্যে বসানাে রয়েছে ৬টি ৩ ইঞ্চি মর্টার আর অনেকগুলাে মেশিনগান ও রাইফেল শেল আর গুলি ছুড়তে ছুড়তে প্রচণ্ড শব্দে আকাশ-বাতাস-মাটি প্রকম্পিত করে তারা এগিয়ে যাচ্ছে মহালছড়ির দিকে। উদ্দেশ্য রাঙামাটি-মহালছড়ির জলপথ থেকে মুক্তিযােদ্ধাদের উত্থাত করে নিজেদের অবস্থান প্রতিষ্ঠিত করা। বুড়িঘাট এলাকার চিংড়ি খালের পাশে মুক্তিযােদ্ধাদের যে প্রতিরক্ষা ঘাঁটি, তাতে লােকবল ছিল খুবই কম, অস্ত্রশস্ত্র ছিল না বললেই চলে। কিন্তু তাদের ছিল অসীম মনােবল ও দৃঢ় প্রত্যয়। নির্ভীক চিত্তে অবস্থান নেন মুক্তিযােদ্ধারা পাকিস্তানি সৈন্যরা প্রচণ্ড গুলি বর্ষণে মুক্তিযােদ্ধা প্রতিরক্ষা ঘাঁটিতে একসময় বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয় এবং মুক্তিযােদ্ধরা মৃত্যুর মুখােমুখি হয়ে পড়েন। ল্যান্স নায়েক রউফ দেখলেন, এভাবে চলতে থাকলে সবাই মারা পড়বেন। তিনি সৈনিকদের পশ্চাদপসরণের নির্দেশ দিলেন। সহযােদ্ধারা অস্ত্র নিয়ে পিছু হটলাে। শক্ররা তখন এগােচ্ছে। এবার মুন্সী আব্দুর রউফ নিজে পরিখায় দাড়িয়ে গেলেন।
মেশিনগানটি তুলে ফেললেন উঁচুতে। অনবরত গুলি করতে লাগলেন স্পিডবােট লক্ষ্য করে এভাবে শত্রু সৈন্যদের বিরুদ্ধে তিনি একাই লড়তে লাগলেন। তাঁর এ রকম দুর্দান্ত গুলি বর্ষণের ফলে শক্রর ৭টি স্পিডবােটই ডুবে যায়, বহু সংখ্যক পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। এ আকস্মিক ক্ষতিতে শত্রু সেনাদের মনােবল ভেঙে যায়। পিছনের লঞ্চ ২টি তখন। পশ্চাদপসরণ করে রউফের মেশিনগানের রেঞ্জের বাইরে চলে যায়। তারপর তারা নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান নিয়ে সমগ্র প্রতিরক্ষা এলাকার উপর মর্টারের গােলা বর্ষণ করতে থাকে এ সময় শক্রর একটি মর্টারের গােলা এসে সরাসরি। ল্যান্স নায়েক রউফের উপর পড়ায় ছিটকে পড়েন রউফ। স্তব্ধ হয়ে যায় এক অকুতােভয় মুক্তিযােদ্ধা আর নীরব হয়ে মেশিনগানটি পড়ে থাকে তারই পাশে বিশ্বাসী বন্ধুর মতাে বীরশ্রেষ্ঠ আব্দুর রউফের সমাধিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে রাঙামাটি জেলার নানিয়ারচর উপজেলার বুড়িঘাট নামক স্থানে চিংড়ি খাল সংলগ্ন একটি ছােটো টিলার উপর স্বাধীনতাপ্রিয় ও সৌন্দর্যপ্রিয় উভয় শ্রেণির মানুষের কাছেই এ সমাধিস্তম্ভটি আকর্ষণীয় ও স্মরণীয়। মুক্তিযুদ্ধে ল্যান্স নায়েক মুন্সী আব্দুর রউফের অবদান চির অমর এবং পরাধীন ও স্বাধীনতাকামী মানুষের চিরন্তন প্রেরণার উৎস। মুক্তিযুদ্ধে অগাধ দেশপ্রেম, অসীম সাহসিকতা, বিরল কর্তব্যপরায়ণতা এবং সহযােদ্ধাদের প্রতি দৃষ্টান্তমূলক সহমর্মিতার জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে সর্বোচ্চ বীরত্বসূচক ‘বীরশ্রেষ্ঠ খেতাবে ভূষিত করে। তাঁর সম্মানার্থে রাইফেলস পাবলিক স্কুল ও কলেজ পিলখানার নাম পরিবর্তন করে বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ পাবলিক স্কুল। ও কলেজ রাখা হয়েছে। তা ছাড়া তার প্রিয় জন্মভূমি কামারখালীতে তার নামে। কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে সরকার বীরশ্রেষ্ঠদের গ্রামের বাড়ির নাম পরিবর্তন করে তাদের নামে রাখার এবং একটি লাইব্রেরি নির্মাণের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – সপ্তম খন্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!