নম্বর ৬২০৬৬, বীরশ্রেষ্ঠ শহিদ মােহাম্মদ রুহুল আমিন ১৯৩৫ সালে নােয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ থানার বাগচাপড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মােহাম্মদ আজহার পাটোয়ারি এবং মাতার নাম জুলেখা খাতুন। পিতামাতার। সপ্তম সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন প্রথম। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বীর সন্তান হিসেবে তিনি অমর হয়ে আছেন বাঙালির হৃদয়ে। স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে তাঁর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি পেয়েছেন সর্বোচ্চ খেতাব ‘বীরশ্রেষ্ঠ’। স্থানীয় প্রাইমারি স্কুলে পড়া শেষ করে তিনি আমিষা পাড়া হাই স্কুলে ভর্তি হন। ১৯৪৯ সালে তিনি সােনাইমুড়ি উচ্চবিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সাথে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ম্যাট্রিক পাস করার পরই ১৯৫৩ সালে নাবিক হিসেবে পাকিস্তান নৌবাহিনীতে যােগ দেন এবং প্রশিক্ষণের জন্য করাচিতে যান। তখনকার মনােরা দ্বীপে অবস্থিত পাকিস্তান নৌবাহিনীর কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পিএনএস কারসাজে পেশাগত প্রশিক্ষণ শেষ করেন। ১৯৬৫ সালে রুহুল। আমিন উচ্চতর কারিগরি কোর্স সমাপ্ত করার পর আর্টিফিসার পদে নিযুক্ত হন। নৌবাহিনীতে চাকরিরত অবস্থায় তিনি বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কোর্সে কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। বিভিন্ন যুদ্ধজাহাজে কর্মরত অবস্থায় তিনি ব্রিটেন, ফ্রান্স, পশ্চিম জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশ সফরেরও সুযােগ পান। করাচিতে বিভিন্ন যুদ্ধজাহাজে চাকরির সময় বাঙালি ও পশ্চিম পাকিস্তানি বিশেষ করে পাঞ্জাব ও পাঠান নাবিকদের ভিতর যে আকাশপাতাল মনের অমিল এবং সাধারণ স্বার্থের ব্যাপারে বৈষম্য চোখে পড়ত, রুহুল আমিনকে তা দারুণভাবে ব্যথিত করত। ১৯৬৮ সালে তাঁকে পিএনএস।
বখতিয়ার নৌঘাটি চট্টগ্রামে বদলি করা হয়। স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরুতেই তিনি তার কর্মস্থল ত্যাগ করে গ্রামে ফিরে আসেন। তিনি গ্রামের ছাত্র-যুবক এবং সেনাবাহিনী ছেড়ে আসা সৈনিকদের সংগঠিত করে সামরিক প্রশিক্ষণ দিতে থাকেন। মে মাসে প্রায় ৫০০ ছাত্র-যুবকসহ তিনি মুক্তিবাহিনীর ৩ নম্বর সেক্টর সদর দপ্তরে গমন করেন এবং সেক্টর অধিনায়ক মেজর কে এম শফিকউল্লাহর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। পরে তিনি বাংলাদেশ নৌবাহিনীর জাহাজ পলাশে যােগদান করেন এবং একই সঙ্গে বাংলাদেশের রণতরি বিএনএস। পদ্মসহ উভয় জাহাজেরই স্কোয়াড্রন ইঞ্জিনিয়ারের দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। হিরণ পয়েন্ট, চালনা বন্দর এবং নৌঘাটি তিতুমীর দখল করার জন্য বাংলাদেশের যুদ্ধজাহাজ পদ্মা ও পলাশ এবং ভারতীয় গানবােট আইএনএস। পানভেল ৬ ডিসেম্বর ভারতের হলদিয়া বন্দর থেকে যাত্রা শুরু করে। ক্যাপটেন। এম এন আর সামন্ত আইএনএস পানভেলে অবস্থান করে এ নৌ অভিযানের অফিসার ইন টেকনিক্যাল কমান্ডাের (ওটিসি)-এর দায়িত্ব পালন করেন। রণতরিগুলাে ১৯৭১ সালের ৯ ডিসেম্বর হিরণ পয়েন্টে উপস্থিত হয় এবং ১০ ডিসেম্বর ভাের ৪টার দিকে মংলার উদ্দেশ্যে যাত্রা করে সকাল ৭টার দিকে জাহাজগুলাে একরকম বিনা বাধায় মংলা পৌছে। মংলা থেকে রণতরিগুলাে। আইএনএস পানভেল, পলাশ এবং পদ্মা, এ ক্রমানুসারে খুলনার উদ্দেশ্যে যাত্রা। করে। দুপুর প্রায় ১২টার দিকে রণতরিগুলাে খুলনা শিপইয়ার্ডের কাছে পৌঁছে। তখন ৩টি জঙ্গিবিমান জাহাজগুলাের উপর দিয়ে উড়ে যায়। শত্রু বিমান ভেবে পদ্মা ও পলাশ হতে বিমানগুলােকে আক্রমণের জন্য অনুমতি চাওয়া হলে।
ওটিসি বলেন, “Do not shoot the aircraft, they are friends,” কিন্তু। কিছুক্ষণ পরই বিমানগুলাে নিচু হয়ে দ্রুতগতিতে উড়ে এসে প্রথমে রণতরি। পদ্মার উপর বােমা বর্ষণ করে। এতে পদ্মার ইঞ্জিন বিকল হয়ে যায় । জঙ্গিবিমানগুলাে ভারতীয় Sea Harrier বিমান ছিল। গানবােট পলাশ ও পানভেল তখন পর্যন্ত সচল। এমন সময় পলাশের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কমান্ডার রায় চৌধুরী জাহাজ ত্যাগের আদেশ দেন। এ আদেশে তিনি ক্ষুব্ধ হন। এবং পরাজয় না মেনে জাহাজ চালিয়ে যেতে থাকেন। এ সময় পলাশের উপর। বােমা ফেলা হয়। জাহাজটি রক্ষার প্রচেষ্টা চালাতে গিয়ে রুহুল আমিন তার ডান হাতটি হারান। পদ্মা ও পলাশে আগুন ছড়িয়ে পড়লে আহত রুহুল আমিন নদীতে ঝাপিয়ে পড়েন। সাঁতার কেটে নদীর তীরে পৌছালে সেখানে অবস্থানরত পাকিস্তানি সৈন্য এবং রাজাকাররা তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। রুহুল আমিনের আত্মােৎসর্গের প্রতি সম্মান ও স্বীকৃতি হিসেবে তাকে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান বীরশ্রেষ্ঠ খেতাবে ভূষিত করা হয়। ক্ষতিগ্রস্ত রণতরি পলাশ রূপসায় অবস্থিত বীরশ্রেষ্ঠ শহিদ মােহাম্মদ রুহুল আমিন ইআরএ-১ ও শহিদ মহিবুল্লাহর বীরবিক্রমের সমাধি এবং রূপসা ফেরিঘাটের মধ্যবর্তী স্থানে অর্ধ নিমজ্জিত অবস্থায় এবং রণতরি পদ্মা জলমার চর নামক স্থানে গ্রাউন্ডেড অবস্থায় পরিত্যক্ত হয়েছিল তাঁর এ আত্মত্যাগ বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনী তথা জাতির ইতিহাসে সাহস ও বীরত্বের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্তস্বরূপ চির ভাস্বর হয়ে থাকবে।
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – সপ্তম খন্ড