আর্মি নম্বর ৩৯৩৭৭৯৮, বীরশ্রেষ্ঠ শহিদ সিপাহি মােহাম্মদ মােস্তফা ১৯৪৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর ভােলা জেলার দৌলতখান থানার পশ্চিম হাজিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ছিলেন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত একজন হাবিলদার। পিতার কর্মস্থল কুমিল্লা সেনানিবাসে তার বাল্যকালের অনেকটা সময়ই কেটেছে। সেনাবাহিনীর সুশৃঙ্খল এবং চাকচিক্যময় জীবন তাকে ভীষণভাবে আকৃষ্ট করত। ১৯৬৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর পারিবারিক নিষেধ অমান্য করে পালিয়ে তিনি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে সিপাহি পদে যােগ দেন। সেনাবাহিনীর প্রাথমিক প্রশিক্ষণ শেষে কুমিল্লায় ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে তাকে পােস্টিং দেওয়া হয়। সৈনিক জীবনে তিনি ছিলেন অত্যন্ত দুর্বার, বক্সিংয়ে ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ। ১৯৭১ সালে মার্চের মাঝামাঝি সময় কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে তাঁকে ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদর দপ্তর ব্রাহ্মণবাড়িয়া বদলি করা হয় এবং সেখান থেকেই তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে ঘিরে ৩টি প্রতিরক্ষা ঘাঁটি গড়ে তােলে আশুগঞ্জ, উজানীসর আর ব্রাহ্মণবাড়িয়া অ্যান্ডারসন খালের পাশে। কিন্তু এসব প্রতিরক্ষা ঘাঁটির উপর পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণ প্রচণ্ড আকার ধারণ করলে ৩টি প্রতিরক্ষা ঘাঁটির সৈন্যরা পশ্চাদপসরণ করে আখাউড়ায় এবং তিতাস নদীর তীরে আখাউড়ার দক্ষিণে গঙ্গাসাগর এবং তার উত্তরে দরুইন গ্রামে নতুন করে প্রতিরক্ষা গড়ে তােলে। দরুইনে পাঠানাে হয় ২ নম্বর প্ল্যাটুনকে সিপাহি মােস্তফা এ প্লাটুনের ১জন সদস্য ছিলেন। তাঁর সাহস, বুদ্ধি ও কর্মদক্ষতার কারণে মেজর শাফায়াত জামিল তাকে মৌখিকভাবে ল্যান্স নায়েক পদমর্যাদা দিয়ে ১টি সেকশনের দায়িত্ব প্রদান করেন। ১৬ এপ্রিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য কুমিল্লা-আখাউড়া রেললাইন ধরে উত্তর দিকে অগ্রসর হতে থাকে।
১৭ এপ্রিল সকাল থেকে তারা দরুইন গ্রামে ২ নম্বর প্লাটুনের প্রতিরক্ষার উপর মর্টার দিয়ে গােলা বর্ষণ শুরু করে। পরের দিন ভাের থেকেই পাকিস্তানি বাহিনী আর্টিলারি ও মর্টার ফায়ার শুরু করে দরুইনের প্রতিরক্ষা ঘাঁটির উপর দুপুরের পর থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণ তীব্রতর হয়। শত্রু অল্পক্ষণের মধ্যেই। পশ্চিম ও উত্তর দিক থেকে দরুইনে প্রতিরক্ষা ঘাটির দিকে অগ্রসর হতে থাকে এ রকম অবস্থায় কৌশলগত কারণে পশ্চাদপসরণ সুবিধাজনক বিধায় পশ্চাদপসরণে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সৈনিকেরা পশ্চাদপসরণ শুরু করলে তিনি সবাইকে স্থান ত্যাগ করে দ্রুত চলে যেতে বলেন এবং কভারিং ফায়ার দেওয়ার জন্য নিজে পরিখার ভিতর দাঁড়িয়ে থেকে হালকা মেশিনগান দিয়ে ক্রমাগত গুলি চালাতে থাকেন সবাই তাঁকে দৌড়ে চলে আসার জন্য অনুরােধ জানালেও তিনি তার অবস্থান থেকে সরেন নি। এভাবেই শত্রু দ্বারা ঘেরাও হয়েও আত্মসমর্পণ না করে জীবন বাজি রেখে তিনি প্লাটুনকে নিরাপদ স্থানে সরে যেতে সহায়তা করেন। একসময় শত্রুর গুলিতে তিনি আহত হন এবং পরবর্তীকালে পাকিস্তানি সৈন্যরা তাকে বেয়নেট চার্জ করে হত্যা করে ঐ গ্রামেই তাকে সমাহিত করা হয়। তার মৃত্যুর সময় একমাত্র ছেলের বয়স ছিল মাত্র দেড় মাস। তাঁর নির্ভীক আত্মদানের কারণে অন্যান্যরা নিরাপদে অন্য অবস্থানে সরে যেতে সক্ষম হন। আর এ কারণে অকুতােভয় এ সৈনিককে ভূষিত করা হয়েছে ‘বীরশ্রেষ্ঠ খেতাবে।
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – সপ্তম খন্ড