আর্মি নম্বর ৩৯৪৩০১৪, বীরশ্রেষ্ঠ শহিদ সিপাহি হামিদুর রহমান ১৯৫৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ঝিনাইদহ জেলার কালিগঞ্জ উপজেলার খদ্দ খালিশপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম আক্কাস আলী মণ্ডল এবং মাতার নাম। কায়েদুন্নেসা। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির ফলে আক্কাস আলী বাপ-দাদার বাস্তুভিটা, জমিজমা সবকিছু ফেলে স্ত্রীকে নিয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের যশাের জেলার (বর্তমানে ঝিনাইদহ) সীমান্তবর্তী গ্রাম খদ্দ খালিশপুরে আশ্রয় গ্রহণ করেন। তারপর চলে অবিরাম জীবনযাপনের সংগ্রাম। অবশেষে অনেক কষ্টে তাদের বর্তমান ভিটামাটি ক্রয় করা হয়। হামিদুর দুঃখদারিদ্রের মধ্যে মানুষ। পিতামাতার জ্যেষ্ঠ পুত্র হামিদুর পিতার সঙ্গে অন্যের জমিতে কাজ করতেন। সুতরাং লেখাপড়া তেমন করতে পারেন নি। প্রথমে খালিশপুর স্কুল এবং পরবর্তী সময় স্থানীয় নাইট স্কুলে ৬ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া শিখেছিলেন। হামিদ ছিলেন সুস্বাস্থ্যের অধিকারী, খেলাধুলায়ও তার সুনাম ছিল। তবে হাডুডুতে তিনি বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। তিনি আনসার ট্রেনিং করে অভিজ্ঞতা অর্জন করেন এবং পরে মুজাহিদ বাহিনীর সদস্যও হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন একজন সৎ কর্মী। সুতরাং তার কাজের অভাব ছিল না। সবাই তাকে আদর করত। তিনি রীতিমতাে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন। সমাজকর্মী হিসেবেও তাঁর সুনাম ছিল। বিশেষ করে আশপাশের কেউ মারা গেলে হামিদকে দেখা যেত সবার আগে দাফনের কাজে। ১৯৭১ সালের ২ ফেব্রুয়ারি তিনি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারে (ইবিআরসি) যােগ দেন এবং ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণকালীন তিনি সেনানিবাস ত্যাগ করে নিজ বাড়িতে চলে আসেন। সে সময় ১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট বিদ্রোহ করে যশাের সেনানিবাস থেকে বের হয়ে যশােরচৌগাছা সড়কে অবস্থান করছিল।
হামিদুর ১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাথে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। পরে তিনি সিলেট জেলার শ্রীমঙ্গল থানার দক্ষিণপূর্ব সীমান্তের ধলই নামক স্থানে ১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ‘সি’ কোম্পানির সাথে যুদ্ধে অংশ নেন। ধলই (স্থানীয়ভাবে দলই নামে পরিচিত) মৌলভীবাজার জেলার (বৃহত্তর সিলেট জেলা) শ্রীমঙ্গল উপজেলাধীন একটি এলাকা। এখানে ধলই নামে একটি চা-বাগান আছে চা-বাগানের পূর্ব দিকে ধলই বর্ডার আউট পােস্ট (বর্তমানে ৩১ রাইফেল ব্যাটালিয়ন) অবস্থিত, যা আন্তর্জাতিক সীমারেখা থেকে মাত্র ৪০০মিটার দূরে অবস্থিত স্বাধীনতা যুদ্ধে বীর মুক্তিযােদ্ধা বীরশ্রেষ্ঠ শহিদ সিপাহি হামিদুর রহমান ১৯৭১ সালে ধলই যুদ্ধে নিহত হন। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কাছে ধলই ছিল সামরিক দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থান। ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসে ‘জেড’ ফোর্সের অন্তর্গত ১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে ধলই দখল করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। ২৭ অক্টোবর রাত্রে মুক্তিযােদ্ধাদের ৩টি কোম্পানি অতি সন্তর্পণে ঘাটি অভিমুখে অগ্রসর হয়। ১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সি’ কোম্পানি অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কাইয়ুম চৌধুরী ২৮ অক্টোবর ভােররাতে ধলই আক্রমণ করেন। অন্যান্য কোম্পানি ধলইয়ের উত্তরে পাত্রখােলা চাবাগানে ব্লকিং পজিশন স্থাপন করে। শত্রুর ঘাটির কাছাকাছি এসে মুক্তিযােদ্ধারা যখন অতর্কিত আক্রমণের উদ্যোগ নেন, তখন অকস্মাৎ একটি মাইন বিস্ফোরণের শব্দে শত্রুপক্ষ সচকিত হয়ে এলােপাতাড়ি গুলি ছুড়তে শুরু করে। ১ ঘণ্টাব্যাপী দুই পক্ষের সংঘর্ষ চলে। ধলই বিওপি দক্ষিণ-পশ্চিম কোণের ২টি এলএমজি অবিশ্রান্ত গুলিবর্ষণ করে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ ঠেকিয়ে রাখে। যুদ্ধের এ অবস্থায় কোম্পানি অধিনায়ক ‘সি’ কোম্পানির এক সাহসী সৈনিক সিপাহি হামিদুর রহমানকে শক্রর মেশিনগান পােস্ট ২টি নিষ্ক্রিয় করার নির্দেশ দেন। নিশ্চিত মৃত্যু উপেক্ষা করে হামিদুর রহমান পর পর গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। শক্রর ২টি মেশিনগান পােস্ট ধ্বংস করতে সক্ষম হন। এর ফলে এক সময় স্তব্ধ হয় শত্রুর এমজি কিন্তু দ্বিতীয় মেশিনগান পােস্ট ধ্বংস করার সময় শত্রুর গুলিতে তিনি মৃত্যুর কোলে ঢরে পড়েন।
এই সুযােগে হামিদুরের সহযােদ্ধারা দ্রুত অগ্রসর হয়ে তার মৃতদেহ উদ্ধার করে ধলই থেকে ৩০ কিলােমিটার দক্ষিণে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের অন্তর্গত আম্বাসা শহরে নিয়ে যান এবং হাতিমারাছড়া গ্রামে দাফন করেন। ২৮ অক্টোবর রাতে ১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ধলইয়ের দক্ষিণ দিক থেকে আক্রমণ রচনা করে এবং পরবর্তীতে ১৯৭১ সালের ৩ নভেম্বর যৌথবাহিনী কর্তৃক ধলইয়ের পতন হয়। ধলই যুদ্ধে অসাধারণ সাহস প্রদর্শন করে নিজের জীবন উৎসর্গ করার জন্য সিপাহি হামিদুর রহমানকে স্বাধীনতা যুদ্ধের সর্বোচ্চ সম্মান বীরশ্রেষ্ঠ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। অকুতােভয় সাহসী ও দেশপ্রেমিক বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহি হামিদুর রহমানের স্মৃতি রক্ষার্থে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)-এর ধলই বিওপি’র সন্নিকটে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করে। ২০০৭ সালের ১১ ডিসেম্বর বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুরের দেহাবশেষ সসম্মানে বাংলাদেশের মাটিতে ফেরত আনা হয় এবং পূর্ণ সামরিক মর্যাদায় তাঁকে মিরপুরের মুক্তিযােদ্ধা কবরস্থানে দাফন করা হয়। তার দেহাবশেষ চিহ্নিতকরণ এবং বাংলাদেশে সসম্মানে ফেরত আনার বিষয়ে একটি জাতীয় কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সদস্য হিসেবে বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুরের সমাধি ভারতে চিহ্নিতকরণে লে. কর্নেল (অব.) কাজী সাজ্জাদ আলী জহির বীরপ্রতীক অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তিনি নিজে বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুরের কবর খনন করে। দেহাবশেষ উত্তোলন করেন।
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – সপ্তম খন্ড