দুলাল মুন্দিয়ার যুদ্ধ
ভৌগােলিক অবস্থান যশাের শহর থেকে মাত্র ২৬ কিলােমিটার দূরে অবস্থিত গ্রামের নাম দুলাল মুন্দিয়া, যার পূর্ব পাশ দিয়ে চলে গেছে যশাের-কালিগঞ্জ মহাসড়ক এবং পশ্চিম পাশ দিয়ে রেললাইন মহাসড়ক থেকে রেলপথের দূরত্ব মাত্র ১ কিলােমিটার পাকা রাস্তার উপর অবস্থিত দুলাল মুন্দিয়া বাজার। একটি কাঁচা সড়ক পূর্বপশ্চিম দিকে চলে গেছে, যা পূর্বে তাপরাইল বাজার থেকে মহাসড়কে মিলিত হয়ে পশ্চিম দিকে গিয়ে হাকিমপুর গ্রামে মিলিত হয়েছে। গ্রামটিতে রয়েছে অসংখ্য গাছ, পুকুর এবং কিছু কাঁচাপাকা বাড়ি। সড়কগুলাে ভূমি থেকে প্রায় ৫৬ ফুট উঁচু ভূমির গঠন প্রতিরক্ষা গ্রহণকারী সৈনিককে প্রত্যক্ষ ফায়ার থেকে নিরাপদে রাখে। যুদ্ধের সংগঠন ক. পাকিস্তানি বাহিনী: আনুমানিক ১ ব্যাটালিয়ন। খ. মুক্তিবাহিনী: আনুমানিক ২ কোম্পানি মুক্তিযােদ্ধা মান্দারতলার যুদ্ধে অংশ নেয়। দুলাল মুন্দিয়ায় মুক্তিযােদ্ধাদের সাথে ছিল ১টি ভারী। মেশিনগান এবং বেশ কিছু স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র যুদ্ধের অবস্থান ক, পাকিস্তানি বাহিনী: শত্রু সৈন্যরা মহাসড়কের পূর্ব পাশ দিয়ে মহাসড়কের দিকে অগ্রাভিযান পরিচালনা করে। ইতােমধ্যে শত্রু তাদের উপর অতর্কিত হামলা সম্পর্কে সজাগ হলেও মান্দারতলা যুদ্ধে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়। শত্রুরা মান্দারতলা যুদ্ধ শেষ করার পর অগ্রাভিযান চালিয়ে আনুমানিক বিকাল সাড়ে ৫টায় দুলাল মুন্দিয়ায় আসে। মুক্তিবাহিনী: দুলাল মুন্দিয়া বাজারের অর্ধ কিলােমিটার দূরে পূর্ব থেকে পশ্চিমে আরও ৩০০-৪০০ গজ পশ্চিম পর্যন্ত মুক্তিযােদ্ধারা দক্ষিণ দিকে মুখ করে কঁাচা সড়ক বরাবর অবস্থান নেন। যুদ্ধ পরিকল্পনা ক. পাকিস্তানি বাহিনী: আনুমানিক ১ ব্যাটালিয়ন সৈন্য যশাের-কালিগঞ্জ অক্ষ বরাবর অগ্রাভিযান পরিচালনা করে। দুলাল মুন্দিয়ায় মুক্তিবাহিনী
কর্তৃক বাধার বিষয়টি পাকিস্তানি সেনারা অবগত না থাকলেও তারা সতর্ক ছিল। মুক্তিবাহিনী: মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা মান্দারতলার যুদ্ধে টিকতে না পেরে পুনরায় দুলাল মুন্দিয়ায় শত্রুকে বাধা দেন এবং তাদের ধ্বংস। করার পরিকল্পনা নেন। যুদ্ধের বিবরণ নায়েব সুবেদার ফিরােজ মান্দারতলা থেকে দ্রুতবেগে গাড়িতে করে দুলাল মুন্দিয়া পৌঁছেন এবং মুক্তিযােদ্ধাদের নিয়ে পুনরায় পাকিস্তানি সৈন্য ধ্বংস করার জন্য অবস্থান নেন। ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল আনুমানিক বিকাল ৫টা ৫০ মিনিটে পাকিস্তানি সেনাদের সাথে মুক্তিযােদ্ধাদের লড়াই শুরু হয়। ৩০৩ রাইফেল সর্বস্ব মুক্তিযােদ্ধারা প্রাণপণে লড়াই করেন পাকিস্তানি সেনাদের সাথে । আনুমানিক ২ ঘণ্টা স্থায়ী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে বহু পাকিস্তানি সেনা নিহত বা আহত হয় এবং প্রায় ৩০-৪০জন মুক্তিযােদ্ধা শহিদ হন। তারপর মুক্তিবাহিনী পশ্চাদপসরণ করে বিষখালী নামক স্থানে। এ যুদ্ধে প্রায় ১০-১২জন নিরীহ লােক প্রাণ হারান। উপসংহার একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ কোনাে সুপরিকল্পিত ও সুসংগঠিত বিপ্লবী যুদ্ধ ছিল না। এটি ছিল একটি প্রতিরােধ আন্দোলন মাত্র। একাত্তরের প্রতিরােধ প্রাথমিক পর্যায়ে স্বতঃস্ফূর্ত ছিল এবং তা ক্রমান্বয়ে স্বাভাবিকভাবেই জনযুদ্ধের রূপ নিয়েছিল। প্রতিরােধের প্রকৃতি এমনই ছিল, যা ‘Countryside overwhelming the cities’-এর মতাে। একাত্তরের প্রতিরােধ কোনাে ব্যক্তি বা দলের সৃষ্টি নয়। আপামর জনগণই ছিল সশস্ত্র প্রতিরােধের স্রষ্টা। বহুদিনের শােষণ-নির্যাতনে যে সংগ্রামী চেতনার সঞ্চার হয়, তারই বহিঃপ্রকাশ ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধ।
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – সপ্তম খন্ড