You dont have javascript enabled! Please enable it!
বৈকারীর যুদ্ধ
ভৌগােলিক অবস্থান বৈকারী এলাকাটি সাতক্ষীরা জেলা শহর হতে ১৫ কিলােমিটার পশ্চিমে কুশখালী বিওপি’র ৪ কিলােমিটার দক্ষিণে এবং তালগাছা বিওপি’র ৫ কিলােমিটার উত্তরে ভারত-বাংলাদেশ সীমারেখায় অবস্থিত। বৈকারীর উত্তরে কেরাগাছি গ্রাম, দক্ষিণে দাঁতভাঙা বিল, পূর্বে কাকুণ্ডা খলিলনগর এবং পশ্চিমে সীমান্ত এলাকা গােবরডা গ্রাম (উত্তর ২৪ পরগনা জেলা) অবস্থিত। বৈকারী গ্রাম থেকে বাংলাদেশ-ভারত সীমারেখা মাত্র ২০০ মিটার পশ্চিমে অবস্থিত। বৈকারী গ্রামটি উত্তর-দক্ষিণে ৪ কিলােমিটার এবং পূর্ব-পশ্চিমে ৩ কিলােমিটার বিস্তৃত। এটা বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকার মতােই সমতল ও সবুজে ঘেরা গাছপালা ও কৃষিপ্রধান বসতি এলাকা। বৈকারী ভৌগােলিক দিক দিয়ে গুরুত্ব কম হলেও আশপাশের সব গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় চলাচলের জন্য রাস্তাগুলাের সংযােগ বৈকারীর মধ্য দিয়ে চলে গেছে। ইছামতি নদীর মুখে সােনাই নদী বৈকারীর পশ্চিমে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত বরাবর। বৈকারী এলাকার দক্ষিণে দাঁতভাঙা বিল ২ বর্গকিলােমিটার এলাকাব্যাপী বিস্তৃত একটি প্রতিবন্ধক হিসেবে চলাচলের সীমাবদ্ধতা সৃষ্টি করে। যুদ্ধের সংগঠন
ক. পাকিস্তানি বাহিনী: ১ কোম্পানি জনবল। সাথে ২৫-৩০জন রাজাকার।
খ. মুক্তিবাহিনী: আনুমানিক ২ কোম্পানি মুক্তিযােদ্ধা। যুদ্ধের অবস্থান
ক. পাকিস্তানি বাহিনী: পাকিস্তানি বাহিনীর ১ কোম্পানি জনবল প্রায় ২  কিলােমিটার এলাকাব্যাপী সীমান্ত চৌকি সংলগ্ন স্থানে প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করে। এ প্রতিরক্ষায় স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রশস্ত্র ছিল। মুক্তিবাহিনী: ক্যাপটেন শফিকউল্লাহর নেতৃত্বে প্রায় ১ কোম্পানি জনবল দাঁতভাঙা বিলের পার্শ্বে (বৈকারী বিওপি’র দক্ষিণ প্রান্ত) এবং ক্যাপটেন মাহবুব উদ্দিনের নেতৃত্বে প্রায় ১ কোম্পানি জনবলের মুক্তিযােদ্ধা দল বৈকারী ক্যাম্পের উত্তরে কইজুরী গ্রামে অবস্থান গ্রহণ করে।
বৈকারী বিওপি’র পশ্চিম পার্শ্বে সােনাই নদী বরাবর সীমান্তের অপর পার্শ্বে বটগাছের নিচে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র স্থাপন করা হয় যা ফায়ার বেইজ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। যুদ্ধের বিবরণ ১৯৭১ সালের মে মাসের মাঝামাঝি সময় দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী বর্তমান বৈকারী বিওপি সম্পূর্ণ দখলে নেয়। তাদের প্রায় ১ কোম্পানি বৈকারী বিওপির উত্তর-দক্ষিণে দীর্ঘ ২ কিলােমিটার এলাকাব্যাপী ত্রিমুখী প্রতিরক্ষা তৈরি করে। জুন মাসের প্রথম দিকে বৈকারী বিওপি আক্রমণ পরিকল্পনা করা হয়। জুন। মাসের মাঝামাঝি ক্যাপটেন মাহবুবের নেতৃত্বে ছােটো ১টি দল বৈকারী বিওপি’র প্রতিরক্ষা অবস্থানের সামনে রেকি করার উদ্দেশ্যে অনুপ্রবেশ করে। এবং বিওপি’র সন্নিকটে বটগাছের উপরে চুপিসারে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দেয়। বটগাছের আশপাশে অ্যান্টি-পার্সোনেল মাইন এবং বটগাছ থেকে বিওপি ফেরার পথে মাইন স্থাপন করা হয়। এ সময় বটগাছের কাছের মরিচায় কোনাে পাহারা না থাকায় এ কাজ অনায়াসে সম্পন্ন হয়। পতাকা লাগানাের পিছনে যে উদ্দেশ্য কাজ করে, তা হলাে মুক্তিবাহিনী দলের সাহস ও মনােবল দখলদার বাহিনীকে বুঝিয়ে দেওয়া এবং বটগাছটি সীমান্তের খুব কাছাকাছি হওয়ায় পতাকা নামানাের প্রচেষ্টাকালীন পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্যদের ঘায়েল করা। মুক্তিযােদ্ধাদের এ পরিকল্পনা কাজে লাগে এবং পাকিস্তানি সেনারা তাড়াতাড়ি করে পতাকা নামাতে গেলে সােনাই নদীর পশ্চিম পার্শ্বে ২০০ মিটার দূরত্বে গাছের নিচে স্থাপন করা মুক্তিযােদ্ধাদের এলএমজি গর্জে ওঠে। ফলশ্রুতিতে সাতজন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। ভীত সন্ত্রস্ত পাকিস্তানি সেনা দল বিওপিতে ফিরে যাওয়ার সময় মাইন বিস্ফোরিত হয়ে আরও কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। জুলাই মাসের শেষ দিকে এবং আগস্ট মাসে মুক্তিযােদ্ধাদের আরও জনবল বৃদ্ধি পায়।
এ সময় আবার বিওপি আক্রমণ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় । সেপটেম্বরের শেষের দিকে ক্যাপটেন শফিকউল্লাহর নেতৃত্বে ১টি রেকি পার্টি রাত ১০টার দিকে হাকিমপুর থেকে তালের ডিঙি নৌকা করে সােনাই নদী পার হন এবং কাতুন্দা খলিলনগর এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর টেলিফোন সংযােগের তার কেটে সাতক্ষীরা সদরের সাথে তাদের যােগাযােগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে দিতে সক্ষম হন। | ক্যাপটেন শফিকউল্লাহ তার দলসহ রেকি সম্পন্ন করে ইটিল্ডা ফিরে যান। প্রায় ১০-১৫ দিন পর (অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ) পূর্বপরিকল্পনা মােতাবেক ক্যাপটেন শফিকউল্লাহ মূল দল নিয়ে ইটি থেকে ইটি-বৈকারী রাস্তা ধরে অগ্রসর হয়ে বৈকারী সীমান্ত চৌকির দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে অবস্থান নেন। অপর দলটি ক্যাপটেন মাহবুবের নেতৃত্বে কইজুরী এলাকায় অবস্থান নেয় ও আক্রমণ পরিচালনার জন্য প্রস্তুতি নেয়। সীমান্তের পশ্চিম প্রান্তে সােনাই নদীর পশ্চিমে বটগাছের নিচে মুক্তিবাহিনীর স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র স্থাপন করা হয়। অবস্থান গ্রহণ সম্পন্ন করার পর আর্টিলারি ফায়ারের মাধ্যমে বৈকারী বিওপি’র প্রচণ্ড ক্ষতিসাধন করে। রাত প্রায় ১১টার দিকে আর্টিলারি ফায়ারের ছত্রচ্ছায়ায় কইজুরী গ্রাম এলাকা থেকে ক্যাপটেন মাহবুব এবং বৈকারী গ্রামের দক্ষিণপশ্চিম প্রান্ত থেকে ক্যাপটেন শফিকউল্লাহর দল এগিয়ে যায়। পাকিস্তানি বাহিনী পালটা ফায়ার করলে দুই দলের মধ্যে প্রচণ্ড গুলি বিনিময় হয়। পাকিস্তানি বাহিনী টিকতে না পেরে সীমান্ত চৌকি থেকে পশ্চাদপসরণ করে বৈকারী বিওপি পরের দিন মুক্তিবাহিনীর দখলে আসে। বৈকারী বিওপিতে দখলদার বাহিনীর ১০জনের মৃতদেহ পাওয়া যায়। বৈকারী বিওপি এ যুদ্ধের মাধ্যমে। শত্রুমুক্ত হয়। শিক্ষণীয় বিষয় ক. মনােবল: বৈকারী যুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিপক্ষকে মুক্তিবাহিনী দৃঢ় মনােবলের কারণে হারাতে সক্ষম হয়েছে। যে-কোনাে বাহিনীর জন্য শত্রুকে ঘায়েল করার লক্ষ্যে দৃঢ় মনােবল প্রয়ােজন। অন্যদিকে, পাকিস্তানি বাহিনীর মনােবল ভেঙে দিতে মুক্তিবাহিনী তাদের বিওপি সংলগ্ন বটগাছে পতাকা স্থাপন এবং পতাকা অপসারণের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্য নিহত হওয়ার ঘটনা তাদের মনােবল দুর্বল। করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
কমান্ড চ্যানেলে যােগাযােগের গুরুত্ব: মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি বাহিনীর কমান্ড চ্যানেলের সাথে লাইন যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন করার ফলে বৈকারী বিওপির সাথে সাতক্ষীরা সদর দপ্তরের রিয়ার লিংক বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ফলে সাময়িক সিদ্ধান্তহীনতা পাকিস্তানি বাহিনীর পিছু হটে যাওয়ার উপর যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে। তথ্যসংগ্রহ, নিরাপত্তা ও সতর্কতা: প্রতিরক্ষার নিরাপত্তা বিধান এবং শত্রুর আক্রমণ সম্পর্কে তথ্যসংগ্রহ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিবাহিনীর চলাচল সম্পর্কে তথ্যসংগ্রহে সফলতা অর্জন করতে পারে নি। প্রতিরক্ষার আশপাশের এলাকায় মুক্তিযােদ্ধাদের চলাচল ও প্রতিরক্ষা এলাকার কাছেই গাছের ওপর পতাকা স্থাপন এবং পাকিস্তানি সেনাদের হত্যা করা দখলদার বাহিনীর দুর্বল নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও অপ্রতুল সতর্কতামূলক ব্যবস্থার কারণ যা পরবর্তী সময় মূল আক্রমণ পরিকল্পনা ও সফলতা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। অপ্রচলিত যুদ্ধ কৌশল: মুক্তিবাহিনীর অপ্রচলিত যুদ্ধ নীতি অবলম্বন পাকিস্তানি বাহিনীর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ ভেঙে দিতে সক্ষম হয়। অপ্রচলিত যুদ্ধ কৌশল সাফল্যের অন্যতম প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। অপ্রচলিত যুদ্ধ কৌশল অবলম্বনের মাধ্যমে পাকিস্তানি বাহিনীর জনবল ও অস্ত্রের ক্ষতি ছাড়াও মনােবলের উপর বিরাট নেতিবাচক প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হয়।
error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!