বামনার যুদ্ধ
ভূমিকা
বামনা বরগুনা জেলার অন্তর্গত একটি থানা। বামনা থানার উত্তরে ঝালকাঠি। জেলা, দক্ষিণে বরগুনা সদর থানা, পূর্বে বেতাগী থানা এবং পশ্চিমে পিরােজপুর জেলা অবস্থিত। এ থানার উত্তর-পূর্ব দিক দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে বিষখালী নদী। নদীটি স্থানে স্থানে প্রায় ৪০০-৫০০ মিটার প্রস্থ এবং খুব গভীর ও খরস্রোতা। নদীটি বঙ্গোপসাগরের সাথে মিলিত হয়েছে। এ এলাকাটি দক্ষিণাঞ্চলের অন্যান্য এলাকার মতাে একই রকম। বরিশাল সদর হতে বামনায় যাওয়ার রাস্তা হলাে: ক, বরিশাল-গাবখান ব্রিজ-ভাণ্ডারিয়া-করখালি-মঠবাড়িয়া হয়ে বামনা (মােট দূরত্ব প্রায় ৮০ কিলােমিটার)। খ. বরিশাল-পটুয়াখালী-মির্জাগঞ্জ হয়ে বামনা (মােট দূরত্ব প্রায় ৯০ কিলােমিটার)। ভৌগােলিক গুরুত্ব ভৌগােলিক দিক থেকে বামনার অবস্থান বেশ গুরুত্বপূর্ণ। মুক্তিযুদ্ধকালীন এখানে যে লঞ্চঘাট ছিল, সেটা ছিল ঝালকাঠি ও মঠবাড়িয়ায় জলপথে প্রবেশের জন্য অপরিহার্য। মুক্তিযােদ্ধারা বামনা যুদ্ধজয়ের পর এ এলাকাটি ছিল তাদের একটি নিরাপদ ঘাঁটি। পরবর্তী সময় মুক্তিবাহিনী বামনা যুদ্ধজয়ের পর বামনাকে ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে আমতলী ও পাথরঘাটা থানার ওপর আক্রমণ পরিচালনা করে। যুদ্ধের সংগঠন যুদ্ধের সংগঠন নিম্নরূপ: ক, পাকিস্তানি বাহিনী: ২০জন পুলিশ যারা দীর্ঘদিন ধরে পাকিস্তানি বাহিনীকে সমর্থন করে আসছিল, আনসার ২০জন, রাজাকার ৩৫জন। খ, মুক্তিবাহিনী: জহির শাহ্ আলমগীরের নেতৃত্বে ৬০জন মুক্তিযােদ্ধা। যুদ্ধের অবস্থান মুক্তিবাহিনী বুকাবুনিয়া সাব-সেক্টর সদর দপ্তরে অনুষ্ঠিত মিটিংয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৯৭১ সালের ২০ নভেম্বর ভাের ৪টার মধ্যে ৬টি গ্রুপে ভাগ হয়ে। নিমােক্তভাবে নিজ নিজ অবস্থান গ্রহণ করে।
ক, অধিনায়ক সেলিম সরদার, গ্রুপ নম্বর ১ (অবস্থান: কলাগাছিয়া)। খ, অধিনায়ক ল্যান্স নায়েক মােবারক মল্লিক, গ্রুপ নম্বর ২ (অবস্থান: উত্তর সােনাখালী)। গ, অধিনায়ক ল্যান্স নায়েক এম এ লতিফ, গ্রুপ নম্বর ৩ (অবস্থান: দক্ষিণ সােনাখালী)। ঘ, অধিনায়ক হাবিলদার আবুল কালাম আজাদ ওরফে হাবিলদার জলফু, গ্রুপ নম্বর ৪ (অবস্থান: আমতলীর রাস্তার মােড়)। মূল দল নেতা জহির শাহ আলমগীর, রিজার্ভ ফোর্স অধিনায়ক গ্রুপ নম্বর ৫ (অবস্থান: পুরাতন বামনা নদীর পাড়)। চ, অধিনায়ক আনােয়ার হােসেন মজনু, রিজার্ভ ফোর্স গ্রুপ নম্বর ৬ (অবস্থান: রুহিতার চর)। যুদ্ধের পটভূমি। ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসের দিকে পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্যরা প্রায়ই বিষখালী নদীপথে তাদের প্রভাব বিস্তারের জন্য টহল পরিচালনা করত। পাকিস্তানি বাহিনী মাঝে মাঝে বামনা থানায় আগমন করত এবং সেখান থেকে পুলিশ, আনসার ও রাজাকারদের সহযােগিতায় হেঁটে টহল পরিচালনা করে আসছিল। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, পাকিস্তানি বাহিনী বামনা বাজারে টহল পরিচালনার সময় নিরীহ জনগণের ওপর অত্যাচার চালাত। পাকিস্তানি বাহিনীর ১টি সুসজ্জিত দল অক্টোবর মাসের পর থেকে গানবােটে করে বিষখালী নদীতে নিয়মিত টহল পরিচালনা করে মুক্তিবাহিনীর কার্যক্রমের উপর নজর রাখছিল। বামনার বুকাবুনিয়ার ল্যান্স নায়েক (পরবর্তী সময় হাবিলদার) লতিফের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর প্রশিক্ষণ পরিচালনা এবং ভারত থেকে কমান্ডার আনােয়ার হােসেন মঞ্জুর নেতৃত্বে কতিপয় প্রশিক্ষিত মুক্তিযােদ্ধার উপস্থিতির খবর পেয়ে পাকিস্তানি সেনারা নভেম্বর মাসে তাদের নৌ-টহল কার্যক্রম আরও জোরদার করে।
১৮ নভেম্বর পরিকল্পিত অবস্থান থেকে জহির শাহ আলমগীরের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর ১টি সুসজ্জিত দল বামনা থানা আক্রমণের জন্য রওনা হয়। একই দিন হঠাৎ মুক্তিবাহিনীর দলটি জানতে পারে যে, বিষখালী নদীপথে পাকিস্তানি বাহিনীর ১টি গানবােট অগ্রসর হচ্ছে। তখনই মুক্তিবাহিনীর অধিনায়ক জহির শাহ আলমগীর বামনা থানা আক্রমণের পরিকল্পনা কিছুটা পরিবর্তন করে খােলপটুয়া নামক স্থানে পাকিস্তানি গানবােটের উপর অ্যামবুশ পরিচালনা করেন। পাকিস্তানি সেনারা এ ধরনের একটি অতর্কিত আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিল না। অনুরূপভাবে ১৯ নভেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আরও ১টি গানবােটের উপর আক্রমণ করে তাদের সমূলে ধ্বংস করেন। বিষখালী নদীর খােলপটুয়া নামক স্থানের এ যুদ্ধটি বিষখালীর যুদ্ধ নামে পরিচিত। এ যুদ্ধের ফলে পাকিস্তানি বাহিনীর ২টি গানবােট সম্পূর্ণভাবে পানিতে নিমজ্জিত হয় এবং প্রায় ১২জন সদস্য নিহত হয়। অন্যদিকে, মুক্তিবাহিনীর কোনাে সদস্য হতাহত হন নি, ফলে জহির শাহ আলমগীরের নেতৃত্বাধীন মুক্তিবাহিনীর মনােবল আরও বেড়ে যায়। যুদ্ধের বিবরণ পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী ২০ নভেম্বর ভাের ৪টায় সব দল নিজ নিজ অবস্থান গ্রহণ করে। সকাল ৫টায় ১ নম্বর গ্রুপের অধিনায়ক সেলিম সরদার খালের উত্তর পার থেকে ফায়ার শুরু করে আক্রমণের সূচনা করেন অন্যান্য গ্রুপের ফায়ার শুরু করার জন্য এটাই ছিল সংকেত শুধু রিজার্ভ ফোর্স ব্যতীত সবাই। একই সাথে ফায়ার শুরু করেন। রিজার্ভ ফোর্স তখন অন্যান্য দলকে সহযােগিতা প্রদানের জন্য প্রস্তুত। প্রায় ৪৫ মিনিট পর ১ নম্বর গ্রুপ খাল পার হয়ে এবং অন্যান্য গ্রুপ এগিয়ে এসে থানার কাছে চলে আসে।
এ সময় ৩ নম্বর গ্রুপের আলতাফ এবং ৪ নম্বর গ্রুপের গেরিলা হাবীব শত্রুর কাছে চলে আসেন। এবং পর পর কয়েকটি গ্রেনেড নিক্ষেপ করেন। এতে বেশ কিছু সংখ্যক শত্রু নিহত হয়। এ গ্রেনেড নিক্ষেপই মূলত যুদ্ধের সময় কমিয়ে আনে। আনুমানিক সকাল ৬টায় সূর্য ওঠার পর পুলিশ ও আনসারের ২৫জন সদস্য আত্মসমর্পণ করে। এ যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী কর্তৃক ৩০টি রাইফেল, ২টি এলএমজি ও ২টি গ্রেনেড উদ্ধার করা হয়। শিক্ষণীয় বিষয় বামনা যুদ্ধের শিক্ষণীয় বিষয়সমূহ নিমরূপ: ক. সঠিক পরিকল্পনা: সঠিকভাবে যুদ্ধের পরিকল্পনা প্রণয়ন সাফল্যের চাবিকাঠি। চতুর্মুখী আক্রমণ ছিল বামনা যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর সাফল্যের মূল কারণ। যাতে কোনাে দিক দিয়ে শত্রু পালিয়ে যেতে না পারে, সে জন্য এভাবে আক্রমণ পরিকল্পনা করা হয়। সঠিক পরিকল্পনার কারণেই শত্রুকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করা সম্ভব হয়েছিল। জনগণের সহায়তা: যুদ্ধকালীন জনবিচ্ছিন্ন কোনাে বাহিনীই যুদ্ধে টিকে থাকতে পারে না। বামনা থানা এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে মুক্তিবাহিনী জনগণের সাথে মিশে ছিল। জনসাধারণও মুক্তিবাহিনী সম্পর্কে পাকিস্তানি বাহিনীকে তথ্য প্রদান থেকে বিরত থেকেছে। জনসাধারণের সহযােগিতা ছাড়া এ ধরনের একটি যুদ্ধ পরিচালনা করা সম্ভব ছিল না। মনোেবল: বামনায় অবস্থানরত পুলিশ বাহিনী মুক্তিযােদ্ধাদের চতুর্মুখী আক্রমণে পড়ে ছত্রভঙ্গ হওয়ার পর তাদের মনােবল ভেঙে যায়।
অন্যদিকে, স্বদেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ এবং বিষখালী যুদ্ধে জয়ের ফলে মুক্তিবাহিনীর মনােবল বেড়ে যায়। এ যুদ্ধে বিজয়ের ফলে পরবর্তী সময় তারা ২১ নভেম্বর সংঘটিত পাথরঘাটা থানার উপর এবং ২২ নভেম্বর পরিচালিত আমতলী থানার উপর আক্রমণে সফলতা অর্জন করে। সঠিক পর্যবেক্ষণ: মুক্তিবাহিনী তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী দলগুলাের অবস্থান সঠিকভাবে পর্যবেক্ষণ করে এবং তারপর সেখান থেকে সঠিকভাবে যুদ্ধ পরিচালনা করে। সঠিক পর্যবেক্ষণের ফলেই মুক্তিবাহিনীর জন্য যুদ্ধজয় সহজতর হয়। ঙ. আক্রমণাত্মক মনােভাব: এ যুদ্ধে বামনা থানায় অবস্থিত পুলিশ, আনসার ও রাজাকার কোনাে ধরনের আক্রমণাত্মক মনােভাব প্রদর্শন করতে পারে নি। অন্যদিকে, মুক্তিবাহিনী চতুর্মুখী আক্রমণের পাশাপাশি গ্রেনেড আক্রমণ করে শত্রুদের পর্যদস্ত করে। মুক্তিবাহিনীর আক্রমণাত্মক মনােভাবই যুদ্ধজয়ের অন্যতম কারণ। তাৎক্ষণিক পরিকল্পনা: বামনা যুদ্ধে যাত্রা শুরুর পর অধিনায়ক জহির শাহ আলমগীর জানতে পারেন যে, বিষখালী নদীপথে পাকিস্তানি বাহিনীর ১টি গানবােট অগ্রসর হচ্ছে। তৎক্ষণাৎ তিনি পরিকল্পনা পরিবর্তন করে বিষখালী নদীতে শত্রুর উপর অ্যামবুশ করেন। তাৎক্ষণিক পরিকল্পনার জন্য পাকিস্তানি বাহিনীর ২টি গানবােট ধ্বংস করা সম্ভব হয়।
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – সপ্তম খন্ড