You dont have javascript enabled! Please enable it! খানজিয়া বিওপি’র যুদ্ধ - সংগ্রামের নোটবুক
খানজিয়া বিওপি’র যুদ্ধ
ভৌগােলিক অবস্থান খানজিয়া বিওপি সাতক্ষীরা জেলার ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত রেখায় অবস্থিত ইছামতি নদীর পূর্ব তীরে এবং সাতক্ষীরা শহর থেকে ৩৩ কিলােমিটার দক্ষিণপশ্চিমে অবস্থিত। এলাকাটি বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকার মতাে খােলা ও সমতল। এ বিওপি’র আশপাশে পাকা বাড়ি রয়েছে। তা ছাড়া গ্রামের ভিতরে ইটের তৈরি রাস্তা ও কাঁচা রাস্তা রয়েছে। লােনা পানির দরুণ এ এলাকায় প্রচুর মাছের চাষ হয় বিধায় অনেক ঘের লক্ষ্য করা যায়। এলাকার রণকৌশলগত গুরুত্ব। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের টাকিতে মুক্তিযােদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হতাে। উল্লেখ্য, ৯ নম্বর সেক্টরের সদর দপ্তর টাকিতে অবস্থিত ছিল, যা ইছামতি নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত। বিস্তীর্ণ সমতল ভূমির দরুণ পাকিস্তানি বাহিনী খুব সহজেই খানজিয়া বিওপি থেকে মুক্তিযােদ্ধাদের কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করতে পারত তাই এ বিওপি দখল করা মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য জরুরি হয়ে পড়ে। খানজিয়া বিওপি নদীর তীরবর্তী বাঁধের উপর স্থাপিত ছিল বিধায় অন্যান্য সমতল এলাকা থেকে ১০-২০ ফুট উপরে অবস্থিত ছিল ফলে ঐ এলাকা। থেকে সহজেই শত্রুকে পর্যবেক্ষণ এবং ফায়ারের মাধ্যমে আধিপত্য বিস্তার করে ক্ষতিসাধন করা সম্ভব ছিল। তাই রণকৌশলগত দিক দিয়ে বিওপি’র গুরুত্ব ছিল অপরিসীম যুদ্ধের অবস্থান ক. পাকিস্তানি বাহিনী: পাকিস্তানি বাহিনী খানজিয়া বিওপিতে চতুর্মুখী প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান নেয়। বিওপিতে পাকিস্তানি সেনাদের শক্তি ছিল ২ প্লাটুন। পাকিস্তানি সেনারা বিওপি’র চারদিকে ৩-৪ ফুট উঁচু এবং ২-৩ ফুট পুরু মাটির ঢিবি বসিয়ে ক্ষুদ্রাস্ত্র ফায়ারের প্রতিরােধ গড়ে তােলে। বিওপিতে ৪টি এলএমজি এমনভাবে স্থাপন করা হয়, যাতে করে পারস্পরিক সহায়তায় প্রধান দায়িত্বপূর্ণ এলাকায় ফায়ার প্রদান করে শক্ত প্রতিরােধ গড়ে তােলা যায়। মুক্তিবাহিনী: ৯ নম্বর সেক্টরের সদর দপ্তর টাকি ছিল খানজিয়া বিওপি থেকে ৮ কিলােমিটার পশ্চিমে ইছামতি নদীর পশ্চিম তীরে। এ সেক্টরের হিঙ্গলগঞ্জ ও শমসেরনগর ছিল ২টি সাব-সেক্টর। সাব-সেক্টর ২টি খানজিয়া থেকে যথাক্রমে ১৫ ও ২০ কিলােমিটার উত্তর-পূর্বে অবস্থিত ছিল।
যুদ্ধ পরিকল্পনা
সেক্টর অধিনায়ক মেজর জলিলের পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রথম থেকেই মুক্তিযােদ্ধারা খানজিয়া বিওপিতে আক্রমণ চালান। মেজর জলিল খানজিয়া বিওপি দখলের জন্য ক্যাপটেন নুরুল হুদাকে অধিনায়কের দায়িত্ব দেন। পরে তিনি আক্রমণের ২-৩ দিন পূর্বে রেকি করার জন্য ১টি দল নিয়ে ইছামতি নদী পাড়ি দেন এবং খানজিয়া বিওপি’র বিস্তারিত তথ্যসংগ্রহ করেন। ক্যাপটেন হুদা খানজিয়া বিওপি আক্রমণের বিস্তারিত পরিকল্পনা নেন। মুক্তিবাহিনীর খানজিয়া বিওপি আক্রমণ ১৯৭১ সালের জুলাই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে কোনাে একদিনে মেজর জলিলের নির্দেশে ক্যাপটেন নুরুল হুদা ১৬০জন মুক্তিযােদ্ধা নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর ঘাটি খানজিয়া বিওপি আক্রমণ করেন। মুক্তিযােদ্ধারা টাকি হতে সন্ধ্যার পর ইছামতি নদীর পাড় দিয়ে দেবহাটা-দাদপুর হয়ে রাত ১০টার দিকে খানজিয়া প্রাইমারি স্কুল এলাকায় সমবেত হন। দলটিকে ৩টি ভাগে বিভক্ত করা হয়। তন্মধ্যে ২টি অ্যাকশন পার্টি এবং ১টি কাট অফ পার্টি ছিল। ডান দিকের অ্যাকশন পার্টির অধিনায়ক হিসেবে ক্যাপটেন হুদা নিজে এবং বাম দিকের অ্যাকশন পার্টির দায়িত্বে ছিলেন লেফটেন্যান্ট বেগ হাবিলদার সােবহানকে কাট অফ পার্টির অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। কাট অফ পার্টি খানজিয়া মসজিদে অবস্থান গ্রহণ করে এবং নায়েব সুবেদার গফুর ৩ ইঞ্চি মর্টার নিয়ে খানজিয়া বাজারে অবস্থান নেন। প্রথমে নায়েব সুবেদার গফুর ৩ ইঞ্চি মর্টারের সাহায্যে খানজিয়া বিওপিতে ৫ মিনিট গােলা নিক্ষেপ করেন। তারপর ক্যাপটেন হুদা ও লেফটেন্যান্ট বেগ দুই দিক থেকে পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণ করেন। ৩০ মিনিট ধরে এ সংঘর্ষ চলে।
প্রবল গােলাগুলির মুখে পাকিস্তানি সেনারা পিছু হটতে বাধ্য হয় এবং পালিয়ে সাতক্ষীরা ও পারুলিয়ায় পশ্চাদপসরণ করে। যুদ্ধে ক্ষয়ক্ষতি ৩০ মিনিটের এ সংঘর্ষে পাকিস্তানি বাহিনীর হতাহতের সঠিক তথ্য জানা যায়নি। তবে তাদের কাছ থেকে ২টি ২ ইঞ্চি মর্টার, কয়েকটি চায়নিজ এসএমজি ও রাইফেল এবং বেশ কিছু গােলাবারুদ ও রেশন সামগ্রী উদ্ধার করা হয়। জনগণের সহায়তায় আহত অবস্থায় ৪জন পাকিস্তানি সেনাকে বন্দি করা হয়।
শিক্ষণীয় বিষয় 
ক. পরিকল্পিত যুদ্ধ: খানজিয়ার যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর সাফল্যের মূল কারণ ছিল সঠিক যুদ্ধ পরিকল্পনা ও পরিচালনা। ক্যাপটেন হুদার সঠিক পরিচালনায় এবং উভয় দিক থেকে আক্রমণের ফলেই পাকিস্তানি সেনাদের এ শক্ত ঘাঁটি থেকে বিতাড়িত করা সম্ভব হয়। সঠিক পর্যবেক্ষণ: যে-কোনাে সামরিক অভিযান সঠিক পরিকল্পনার জন্য সঠিক রেকি অপরিহার্য ক্যাপটেন হুদা ও তার দল খানজিয়া বিওপিতে পূর্ব থেকেই বিস্তারিত পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে রণকৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি এবং শক্রর এলএমজি অবস্থান সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে সক্ষম হন পরিকল্পিত ফায়ার সহায়তা: যে-কোনাে আক্রমণের সাফল্যের প্রধান শর্তই হলাে পরিকল্পিত ফায়ার সহায়তা প্রদান করা অ্যাকশন পার্টির আঘাত হানার পূর্বেই নায়েব সুবেদার গফুরের পরিকল্পিত মটার ফায়ার পাকিস্তানি সেনার প্রতিরক্ষা অবস্থান দুর্বল করে দেয়। ফলে অ্যাকশন পার্টির উভয় দিক থেকে আক্রমণ করা সহজ হয়। জনগণের সহায়তা: পাকিস্তানি সেনারা প্রথম থেকেই এলাকার জনগণ থেকে ছিল সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। কাজেই জনগণের কাছ থেকে কোনােপ্রকার সহায়তা তারা পায় নি। অন্যদিকে, এ যুদ্ধে এলাকার জনগণ যুদ্ধের প্রস্তুতির পূর্ব হতে শেষ পর্যন্ত মুক্তিবাহিনীকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে তথ্য সরবরাহ করে, ফলে তাদের পক্ষে বিজয় ত্বরান্বিত করা সহজ হয়েছে। মনােবল: উচ্চমানের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পাকিস্তানি বাহিনী স্বল্প প্রশিক্ষিত মুক্তিযােদ্ধাদের দ্বারা ছত্রভঙ্গ হওয়ার পর তাদের মনােবল দুর্বল হয়ে। পড়ে। কাজেই মুক্তিবাহিনীর পক্ষে তাদের হটিয়ে দেওয়া সহজ হয়।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – সপ্তম খন্ড