You dont have javascript enabled! Please enable it!
শিরােমণির যুদ্ধ
 
ভৌগােলিক অবস্থান শিরােমণি খুলনা শহরের অন্তর্গত কলকারখানা সমৃদ্ধ একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। এলাকাটি জাহানাবাদ সেনানিবাসের নিকটবর্তী এবং দৌলতপুর থেকে ৪ কিলােমিটার উত্তরে অবস্থিত এ এলাকার ভিতর দিয়ে যশাের-খুলনা রেললাইন এবং যশাের-খুলনা মহাসড়ক চলে গেছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় শিরােমণি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি কৌশলগত স্থান। কারণসমূহ নিমরূপ: ক. যশাের থেকে সড়ক বা রেলপথে খুলনা যেতে হলে শিরােমণি অতিক্রম করতে হবে। শিরােমণির পূর্বে ভৈরব নদী ও ডাকাতিয়া বিলসহ অন্যান্য বিল বা হাওর থাকায় শিরােমণি এলাকাকে পার্শ্ব থেকে অতিক্রম করা সম্ভব নয়। রণকৌশলগতভাবে শিরােমণি একটি নােডাল পয়েন্ট (Nodal Point), যা নিষ্ক্রিয় না করা পর্যন্ত খুলনা শহরে পৌছানাে সম্ভব নয়। যুদ্ধের সংগঠন ক. পাকিস্তানি বাহিনী: ১৫ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্ট, রাজাকার (সংখ্যা অজানা)।  খ. মিত্র বাহিনী: ৯ পদাতিক ডিভিশনের ৩২ পদাতিক ব্রিগেড, ৪২ পদাতিক ব্রিগেড, ৩৫০ পদাতিক ব্রিগেড এবং মুক্তিবাহিনী। যুদ্ধের অবস্থান ক. পাকিস্তানি বাহিনী: যশাের সেনানিবাসে অবস্থানরত ১০৭ পদাতিক ব্রিগেডের অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার মালিক হায়াত খান সাজোয়াসহ তার সমস্ত শক্তি শিরােমণি এলাকায় নিয়ােজিত করেছিলেন। কারণ, প্রথমত খুলনা পৌছাতে হলে মিত্রবাহিনীকে শিরােমণি অতিক্রম করতে হবে। দ্বিতীয়ত যুদ্ধে পরাজিত হলে এ এলাকা হতে খুলনা হয়ে মংলা সমুদ্রবন্দর দিয়ে সহজে পাকিস্তানে প্রত্যাবর্তন করা যাবে।
পরিকল্পনা অনুযায়ী যশাের সেনানিবাসে অবস্থানরত সব পাকিস্তানি সেনা ভারী অস্ত্রসহ খুলনার উদ্দেশ্যে রওনা হয় এবং পথিমধ্যে মিত্র বাহিনীর সম্ভাব্য আক্রমণ বিবেচনা করে শিরােমণি নামক এলাকায় প্রতিরক্ষা অবস্থান নেয়। কৌশলগত দিক বিবেচনা করে পশ্চিমে বিল ডাকাতিয়া, পূর্বে ভৈরব নদী, দক্ষিণে খুলনাকে রেখে শিরােমণি এলাকায় মােতায়েন পরিকল্পনা করে। শিরােমণির টিঅ্যান্ডটি ক্যাবল ফ্যাক্টরিতে তাদের সদর দপ্তর স্থাপন করে ২-৩ কিলােমিটার এলাকা জুড়ে তৈরি করে শক্ত প্রতিরক্ষা ব্যুহ। খ. মিত্র বাহিনী: মিত্র বাহিনী শিরােমণির উত্তরে রূপদিয়া ও নােয়াপাড়া দখলের পর ফুলতলা এলাকায় ১৯৭১ সালের ১১ ডিসেম্বর অবস্থান গ্রহণ করে যুদ্ধের পরিকল্পনা। ক. পাকিস্তানি বাহিনী: মিত্র বাহিনীকে খুলনার দিকে অগ্রসরে বাধা দেওয়ার জন্য পাকিস্তানি বাহিনী শিরােমণি শিল্প এলাকার সব মিল, ফ্যাক্টরি, হাসপাতাল, অসামরিক পাকা বাড়ি এবং ২০ গজ অন্তর অন্ত র বাংকার খনন করে শক্ত প্রতিরক্ষা (Strong Defence) অবস্থান গ্রহণ। এলাকার বেসামরিক জনগণকে দিয়ে বলপূর্বক প্রতিরক্ষা অবস্থান তৈরি করে এবং বাংকার খননের পর শিরােমণি হতে অসামরিক জনগণকে সরিয়ে দেয়। এ দুর্ভেদ্য দুর্গে মিত্র বাহিনীকে সংকুচিত করে (Caralized) ধ্বংস করাই ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর মূল উদ্দেশ্য। মিত্র বাহিনী: শিরােমণি এলাকায় শক্রর অবস্থান দখলের জন্য ৩২ পদাতিক ব্রিগেডকে মূল ঘাঁটিতে রেখে দেওয়া হয়। ৪২ পদাতিক ব্রিগেডের মাধ্যমে শ্যামগঞ্জ ফেরি এলাকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়।
৩৫০ পদাতিক ব্রিগেড এবং ৪২ পদাতিক ব্রিগেডের কিছু অংশের সাহায্যে উত্তর দিক থেকে আক্রমণ করে শিরােমণি এলাকা দখলের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। যুদ্ধের বিবরণ ৪ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী ও মিত্র বাহিনীর ৯ পদাতিক ডিভিশন সীমান্ত হতে যশাের অভিমুখে অগ্রাভিযান করে এবং ৭ ডিসেম্বর যশোর পৌছে। তারা যশাের সেনানিবাসে পেীছে তা পরিত্যক্ত অবস্থায় দেখতে পায়। একই দিনে ৯ পদাতিক ডিভিশন যশাের-খুলনা অক্ষে অগ্রাভিযান শুরু করে। ১১ ডিসেম্বর মেজর আবুল মঞ্জুর মিত্র বাহিনীর বিরাট এক বহর নিয়ে পূর্বে উল্লিখিত রুটে গাইডের সাহায্য নিয়ে ফুলতলায় অবস্থানরত শিখ বাহিনীর সাথে মিলিত হয়। মুক্তিবাহিনীর একটা অংশ মিত্র বাহিনীর ইঞ্জিনিয়ার কোরের সাহায্যে ভারী অস্ত্র ও ট্যাংকসহ ভৈরব নদী পার হয়ে ব্যারাকপুর, লাকুহাটি, সিদ্দিপাশা ও ধুনল নামক গ্রামে ব্লকিং পজিশন স্থাপন করে, যাতে ভৈরব নদ অতিক্রম করে পাকিস্তানি সেনারা পলায়ন করতে না পারে। অনুরূপভাবে খুলনা-দৌলতপুরের পশ্চিম দিকেও মুক্তিবাহিনী ব্যাপক সৈন্যের সমাবেশ ঘটায়।
অন্যদিকে, ১২ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী ও মিত্র বাহিনী যৌথভাবে সাতক্ষীরা জেলার কলারােয়া এলাকা থেকে সাতক্ষীরা, চুকনগর দিয়ে খুলনার উদ্দেশ্যে সড়ক পথে রওনা হয়। পথিমধ্যে বিলের বিনেরপােতা ব্রিজ পাকিস্তানি সেনারা  ধ্বংস করে দেয়। মিত্র বাহিনীর ইঞ্জিনিয়ার কোর একটি ভাসমান ব্রিজ তৈরি করে। ভারী মেশিনগান, ট্যাংক বহর ও সাঁজোয়া গাড়িসহ ব্রিজ পার হয়ে ১টি শিখ রেজিমেন্ট পাটকেলঘাটা-চুকনগর-কেশবপুর-মণিরামপুর-রাজারহাটনােয়াপাড়া হয়ে ফুলতলা থানার ১৪ মাইল এলাকাব্যাপী একটি শক্তিশালী। প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করে। মিত্র বাহিনীকে পথ দেখিয়ে ফুলতলা এলাকায় আনার জন্য মেজর মঞ্জুর প্রয়ােজনীয় সংখ্যক গাইড তাদের সাথে দেন। একই দিন বিকাল ৩টায় ৪২ পদাতিক ব্রিগেড অগ্রাভিযান আরম্ভ করে এবং ১৩ ডিসেম্বর শ্যামগঞ্জ ফেরি এলাকা দখল করে নেয়। পাকিস্তানি বাহিনী পশ্চাদপসরণ করে খুলনার দিকে চলে গিয়েছে মনে করে ১৩ ডিসেম্বর মিত্র বাহিনীর ৩০-৩৫টি গাড়ির ১টি বহর মেজর গনি ও মেজর মহেন্দ্র সিংয়ের নেতৃত্বে যশাের হয়ে শিরােমণি এলাকায় প্রবেশ করে। কনভয়টি ইস্টার্ন, আলীম ও আফিল জুট মিল অতিক্রম করে বাদামতলা এলাকার চক্ষু হাসপাতালের নিকট আসা মাত্রই পাকিস্তানি সেনাদের ভারী অস্ত্রগুলাে প্রতিরক্ষা। অবস্থান হতে একযােগে কনভয়ের উপর গােলা বর্ষণ শুরু করে। ঐ ফায়ারে মিত্র বাহিনীর আনুমানিক ২৫০-৩০০জন সৈন্য নিহত হয়। 
১৪ ডিসেম্বর ৩৫০ পদাতিক ব্রিগেড কর্তৃক শিরােমণি এলাকা আক্রমণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় । নিম্নলিখিত ৩টি পর্বে এ আক্রমণ সংঘটিত হয়: ক, প্রথম পর্বে মাত্র ৪ ঘণ্টা যুদ্ধ করে ১৫ ডিসেম্বর সাঁজোয়া ও গােলন্দাজ  বাহিনীর সহায়তায় আক্রমণ পরিচালনা করে শ্যামগঞ্জ দখল করে। খ. দ্বিতীয় পর্বে ৪ শিখ রেজিমেন্ট পূর্ব শিরােমণি এলাকা দখল করে। গ. তৃতীয় পর্বে ১৬ ডিসেম্বর অন্য ১টি ব্যাটালিয়ন পশ্চিম শিরােমণি। এলাকা নিজ দখলে নেয়। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনী সমগ্র দেশে সমর্পণ করলেও খুলনায় ত্মসমর্পণ করে নি। ১৬ ডিসেম্বর রাতে মিত্র বাহিনী পুনরায় আক্রমণ করলে। পাকিস্তানি সেনারা আত্মসমর্পণে বাধ্য হয় এবং ১৭ ডিসেম্বর সকালে অস্ত্র পরিত্যাগ করে। ব্রিগেডিয়ার হায়াত আনুমানিক ৩৭০০জন সৈন্য নিয়ে মিত্র বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেন। এ সময় ৮ নম্বর সেক্টরের সেক্টর অধিনায়ক মেজর মঞ্জুর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে তাদের ব্যাংক ও ব্যাজ খুলে দিতে বললে পাকিস্তানি সেনারা কান্নায় ভেঙে পড়ে এবং র্যাংক ও ব্যাজ খুলে দেয়। এ যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর আনুমানিক ২০০জন নিহত, ২০০জন আহত ও ৪টি ট্যাংক। ধ্বংস হয় এবং ৪জন অফিসার, ১জন জেসিও ও ২৬জন বিভিন্ন পদবির সৈনিক যুদ্ধবন্দি হয়। অন্যদিকে, মিত্র বাহিনীর প্রায় ২৫০-৩০০জন শহিদ, ৩০০জন আহত এবং ২টি ট্যাংক ধ্বংস হয়। শিক্ষণীয় বিষয় ক, পরিকল্পিত যুদ্ধ: শিরােমণির যুদ্ধে মিত্র বাহিনীর সাফল্যের মূল কারণ ছিল সঠিক নেতৃত্বে পরিকল্পিতভাবে যুদ্ধ পরিচালনা।
পাকিস্তানি বাহিনী শক্ত প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করা সত্ত্বেও মিত্র বাহিনী কর্তৃক সময়গাপযােগী হামলা পরিচালনা করায় যুদ্ধে জয়লাভ সম্ভব হয়। জনগণের সহায়তা: যে-কোনাে যুদ্ধে এলাকার জনগণের প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষ সহায়তা যুদ্ধকে বহুলাংশে প্রভাবিত করে। পাকিস্তানি বাহিনী জোরপূর্বক এলাকার জনগণকে কাজে নিয়ােগ করে। কিন্তু জনগণের কাছ থেকে কোনাে ধরনের স্বতঃস্ফূর্ত সহায়তা তারা পায় নি। অন্যদিকে, এলাকার জনগণ যুদ্ধের প্রস্তুতির শুরু হতে শেষ পর্যন্ত। মুক্তিবাহিনীকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে তথ্য সরবরাহ থেকে শুরু করে সব ধরনের সহযােগিতা প্রদান করে, যা মুক্তিবাহিনীর বিজয়কে ত্বরান্বিত করে। মনােবল: উচ্চমানের প্রশিক্ষিত পাকিস্তানি বাহিনী স্বল্প প্রশিক্ষিত মুক্তিযােদ্ধাদের দ্বারা ছত্রভঙ্গ হওয়ায় তাদের মনোেবল যথেষ্ট ভেঙে পড়ে। এ যুদ্ধে বিজয়ের পর মুক্তিযােদ্ধাদের তথা এলাকার জনগণের সাহস, বিশ্বাস ও উদ্দীপনা আকাশচুম্বী রূপ গ্রহণ করে সঠিক পর্যবেক্ষণ: যে-কোনাে সামরিক অভিযান সঠিক ও সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য পূর্ব সংবাদ এবং সঠিক পর্যবেক্ষণ অপরিহার্য। ১৩ ডিসেম্বর মিত্র বাহিনীর কনভয় অধিনায়কদের নিকট পাকিস্তানি সেনাদের সঠিক অবস্থান ছিল অজ্ঞাত। আর এ কারণেই মিত্রবাহিনীর ২৫০-৩০০ সৈনিক প্রাণ হারায়। আক্রমণাত্মক মনােভাব: এ যুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনী কোনাে ধরনের আক্রমণাত্মক মনােভাব ছাড়াই প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করে। প্রতিরক্ষা এলাকার বাইরে অন্যান্য ক্ষুদ্র অভিযান পরিচালনার মাধ্যমে শক্রকে হেনস্তা করার কোনাে উদ্যোগ তারা গ্রহণ করে নি। ফলে মিত্র বাহিনী পাকিস্তানি বাহিনীকে চারদিক থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – সপ্তম খন্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!