You dont have javascript enabled! Please enable it! গৌড়পাড়ার যুদ্ধ - সংগ্রামের নোটবুক
গৌড়পাড়ার যুদ্ধ
ভৌগােলিক অবস্থান গৌড়পাড়া বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত জেলা যশােরের অন্তর্ভুক্ত শার্শা থানার নিজামপুর ইউনিয়নের একটি গ্রাম। বেশ ঘন গাছপালায় ঘেরা এ গ্রামটির ঠিক মাঝখান দিয়ে শার্শা-দীহি পাকা রাস্তা চলে গেছে। গ্রামটি মাঝারি বসতিপূর্ণ ঠিক মাঝামাঝি রাস্তার উপর গৌড়পাড়া বাজার অবস্থিত এলাকার উত্তর দিক দিয়ে বেতনা নদী পূর্ব-পশ্চিমে প্রবাহিত। ৯ কিলােমিটার দক্ষিণ। দিকে বেনাপােল-নাভারন সড়ক এবং রেললাইন চলে গেছে। পশ্চিমে রয়েছে সােনাদিয়া বাওড় বাওড়টির অবস্থান, আকার ও গঠন রণকৌশলগত দিক দিয়ে অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে। মুক্তিযুদ্ধে এলাকার গুরুত্ব মুক্তিযুদ্ধে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের সমস্ত সহায়তা আসে মূলত বেনাপােলস্থ বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত দিয়ে। যদি পাকিস্তানি বাহিনী বেনাপােলনাভারন তথা শার্শায় অবস্থান সুদৃঢ় করতে পারত, তাহলে মুক্তিযােদ্ধাদের পক্ষে মিত্র দেশ ভারতের সহায়তা নিয়ে যুদ্ধ পরিচালনা করতে বেগ পেতে হতাে। ১৮ এপ্রিল বেনাপােলে সেক্টর অধিনায়ক মেজর আবু ওসমান চৌধুরীর সদর দপ্তর স্থানান্তরিত হওয়ায় এটি ব্যবহৃত হতে পেরেছিল তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ ও ব্রিটিশ এমপি মি, ডগলাস ম্যানের আলােচনার কেন্দ্ররূপে। তা ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি কর্নেল এম এ জি ওসমানীও মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্তের জন্য সাহায্যকারী প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সাথে সমন্বয় কেন্দ্র হিসেবে বেনাপােলকেই ব্যবহার করতেন। এসব দিক বিচার করে পাকিস্তানি বাহিনী বেনাপােল সীমান্ত এলাকা আয়ত্তে আনার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করে কিন্তু মুক্তিযােদ্ধাদের প্রতিরােধের মুখে তা ব্যর্থ হয়।
যুদ্ধের অবস্থান ও সংগঠন ক. পাকিস্তানি বাহিনী: ১৯৭১ সালের ২৪ অক্টোবর পাকিস্তানি বাহিনীর ১টি কোম্পানি আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র এবং যােগাযোেগ সরঞ্জামে সজ্জিত হয়ে গৌড়পাড়ায় শার্শা সড়কের পূর্ব পার্শ্বে অবস্থান গ্রহণ করে। স্থানীয় মুক্তিযােদ্ধাদের সাথে আলাপ করে জানা যায় যে, পাকিস্তানি। বাহিনীর আনুমানিক জনবল ছিল ৬০-৬৫জন; অস্ত্র (এলএমজি, রাইফেল, ২-৩ ইঞ্চি মর্টার ও সিগন্যাল সরঞ্জাম)। ২৪ অক্টোবর পাকিস্তানি বাহিনী গৌড়পাড়ায় প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করে। তারা সােনাদিয়া বাওড় ঘিরে যে কাচা রাস্তাটি প্রধান সড়কের সাথে মিশে গেছে তার সংযােগ স্থলে একটি বাংকার তৈরি করে। ঐ অবস্থানে বর্তমানে গৌড়পাড়া পুলিশ ফাঁড়িটি অবস্থিত। অন্যদিকে, লক্ষণপুর গৌড়পাড়া সড়কের সংযােগ স্থলে আরও একটি বাংকার খনন করে তারা দিনে ও রাতে পাহারা দিতে থাকে। নিজেদের অবস্থানগুলাের মধ্যে তারা লাইন কমিউনিকেশন স্থাপন করে। পাকিস্তানি বাহিনীর প্রধান অবস্থান ছিল পাকা সড়কের পূর্ব পার্শ্বে। সব প্রস্তুতির পাশাপাশি পাকিস্তানি বাহিনীকে ২-১টি অবজারভেশন পােস্ট তৈরি করতেও দেখা যায়। মুক্তিবাহিনী: গৌড়পাড়া নিজামপুরের মুক্তিযােদ্ধারা পাকিস্তানি বাহিনীর আগমন বুঝতে পেরে সজাগ হয়ে ওঠে। তারা একত্র হয়ে প্রথমে সােনাদিয়া বাঁওড়ের মাঝামাঝি দ্বীপে অবস্থান নেন এবং এখান থেকেই। পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর নজরদারি করতে থাকে। আগেই বলা হয়েছে যে, সােনাদিয়া বাওড় এলাকা রণকৌশলগত দিক দিয়ে যুদ্ধ পরিচালনার ক্ষেত্রে খুবই উপযােগী ভূমি। ভূমিতে বাঁওড়টি গােলাকৃতি আকার ধারণ করেছে এবং এর পূর্ব দিকে কেবল একটি অংশ ভিতরের ভূমির (দ্বীপ) সাথে সংযুক্ত হয়েছে। চারদিকে পানি দ্বারা পরিবেষ্টিত এবং কেবল একটি দিক খােলা বলে মুক্তিবাহিনীর এ অবস্থানটি ছিল চারদিক থেকে সুরক্ষিত। মুক্তিযােদ্ধারা অস্ত্র ও গােলাবারুদের অপ্রতুলতার জন্য ২৪ অক্টোবরের পর থেকে প্রতিদিনই ‘হিট অ্যান্ড রান’ কৌশল অবলম্বন করে পাকিস্তানি সেনাদের অবস্থানকে নড়বড়ে করতে চেষ্টা করেন।
যুদ্ধের পরিকল্পনা পাকিস্তানি বাহিনী সােনাদিয়া বাঁওড় ও দ্বীপ এবং তার আশপাশের এলাকায় মুক্তিবাহিনীর অবস্থান বুঝতে পেরে ৩০ অক্টোবর থেকে মুক্তিযােদ্ধাদের উপর প্রচণ্ড শেলিং শুরু করে। পাশাপাশি নাভারণে অবস্থিত পাকিস্তানি বাহিনীর বিভিন্ন অবস্থান থেকেও তাদের উপর আর্টিলারি ফায়ার করা হয়। এ অবস্থায় মুক্তিবাহিনী টিকতে না পেরে সীমান্ত অতিক্রম করে ওপারে চলে যায় এবং বয়রা সাব-সেক্টর অধিনায়ক ক্যাপটেন খন্দকার নাজমুল হুদার সাথে মিলিত হয়। পাকিস্তানি বাহিনী সম্পর্কে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে ক্যাপটেন হুদা ৩১ অক্টোবর রাতে তাঁর নিজস্ব সৈন্য দল এবং মুক্তিযােদ্ধার সমন্বয়ে গঠিত ১টি কোম্পানি প্লাস সেনা দল নিয়ে গৌড়পাড়ার পশ্চিমে লক্ষ্মণপুর এলাকায় অবস্থান গ্রহণ করেন। ক্যাপটেন হুদার পরিকল্পনা অনুযায়ী ৩টি প্ল্যাটুনের অবস্থান ছিল নিম্নরূপ: ক. বামের প্ল্যাটুন: লক্ষণপুর থেকে প্রধান সড়কে আসা রাস্তাকে অন্তর্ভুক্ত করে বামে বেতনা নদী এবং ডানে গৌড়পাড়া। খ, মধ্যের প্লাটুন: সােনাদিয়া দ্বীপ।
গ, ডানের প্লাটুন: সােনাদিয়া গ্রাম থেকে প্রধান সড়কে আসা কাঁচা রাস্তা অন্তর্ভুক্ত করে বামে সােনাদিয়া বাওড় ও ডানে সােনাদিয়া গ্রাম। যুদ্ধের বিবরণ ৩১ অক্টোবর মাঝরাতের আগেই ক্যাপটেন হুদা তার রেকি শেষ করেন এবং ১ নভেম্বর ভাের ৫টার দিকে তার আদেশে শত্রুর প্রতিরক্ষা অবস্থানে আক্রমণ পরিচালনা করা হয়। এ ধরনের আকস্মিক আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনী দিশেহারা হয়ে পড়ে এবং পালটা এলােপাতাড়ি গুলি বর্ষণ শুরু করে। ক্যাপটেন হুদা বয়রায় অবস্থিত মিত্র বাহিনীর আর্টিলারি ফায়ার সাপাের্ট চেয়ে পাঠান এবং তা পাওয়াও যায় খুব অল্প সময়ে। এদিকে উত্তর দিকের প্রধান সড়ক ব্লক করে দেওয়া হয় এবং সেখান থেকেও ফায়ার চালানাে হয় পাকিস্তানি বাহিনীর উপর  প্রচণ্ড গােলাগুলি আর আর্টিলারি ফায়ারে টিকতে না পেরে পাকিস্তানি বাহিনী এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এ যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর ২০-২৫জন সৈন্য নিহত হয়। শিক্ষণীয় বিষয় ক, তথ্যসংগ্রহ: যে-কোনাে যুদ্ধ সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য শত্রুপক্ষের তথ্য সংগ্রহ অপরিহার্য। মুক্তিযােদ্ধারা গৌড়পাড়া এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থান সম্পর্কে সঠিক ও সময়ােপযােগী তথ্যসংগ্রহ করতে পেরেছিলেন বলেই ক্যাপটেন হুদা সঠিক যুদ্ধ পরিকল্পনা করতে সক্ষম হন। ফায়ার সাপাের্ট: যুদ্ধ চলাকালে ফায়ার সাপাের্ট মিত্রবাহিনীর সৈনিকদের মনােবল ও যুদ্ধস্পৃহা অনেক গুণ বাড়িয়ে দেয়। সঠিক সময় ফায়ার সাপাের্ট যুদ্ধের জয় ত্বরান্বিত ও নিশ্চিত করে গৌড়পাড়ার যুদ্ধে সঠিক সময় মিত্র বাহিনীর ফায়ার সাপাের্ট পাওয়া যায় বলেই যুদ্ধে জয় সহজ হয়ে যায়  অপর্যাপ্ত অস্ত্র ও গােলাবারুদ: গৌড়পাড়ার যুদ্ধের প্রথম দিকে মুক্তিযােদ্ধাদের পিছু হটার একটি অন্যতম কারণ হলাে নিজেদের আধুনিক এবং প্রয়ােজনীয় অস্ত্র ও গােলাবারুদের অভাব। সঠিক অবস্থান গ্রহণ: প্রতিটি যুদ্ধে রণকৌশলগত অবস্থান একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ভূমি ও রণকৌশলগত গুরুত্ব পর্যালােচনা করে। গৌড়পাড়ার যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর সঠিক অবস্থান গ্রহণ তাদের বিজয় নিশ্চিত করেছে।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – সপ্তম খন্ড