You dont have javascript enabled! Please enable it! গরিবপুরের (চৌগাছা) যুদ্ধ - সংগ্রামের নোটবুক
গরিবপুরের (চৌগাছা) যুদ্ধ
ভৌগােলিক অবস্থান ও গুরুত্ব যশাের সেনানিবাস থেকে ১১ কিলােমিটার পূর্বে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে অবস্থিত গরিবপুর একটি অখ্যাত গ্রাম। ভারতীয় সীমান্তের ৬ কিলােমিটারের মধ্যে এ গ্রামটি যশাের-চৌগাছা অক্ষের অতি নিকটে অবস্থিত। ভারতীয় সীমান্তের বয়রা থেকে গরিবপুর গ্রামের মধ্যবর্তী স্থানে বড় ধরনের প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতা বলতে শুধু কপােতাক্ষ নদ বিদ্যমান। গরিবপুর গ্রাম থেকে চৌগাছা-যশাের রাস্তা হয়ে অথবা গ্রামের ভিতর দিয়ে যশাের সেনানিবাস পর্যন্ত অগ্রাভিযান করা সহজ ছিল। গরিবপুর গ্রাম এবং এর নিকটবর্তী গ্রামগুলােয় সহজেই বিপুল পরিমাণ সৈন্যসমাবেশ করানাে সম্ভব। এর ফলে সম্ভাব্য সব অক্ষের পরিবর্তে বয়রা থেকে গরিবপুর গ্রাম হয়ে যশাের সেনানিবাস অনেক নিকটবর্তী হওয়ায় ১৯৭১ সালে এ গ্রামটি যৌথ বাহিনীর কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
যুদ্ধের সংগঠন
ক. পাকিস্তানি বাহিনী: ৯ পদাতিক ডিভিশন (মেজর জেনারেল আনসারী), ১০৭ ব্রিগেড (ব্রিগেডিয়ার মালিক হায়াত খান), ৬ ও ২১ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট, ১৫ ও ২২ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্ট। খ, যৌথ বাহিনী: ৯ মাউন্টেন ডিভিশন (মেজর জেনারেল দলবীর সিং), ৪২ ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেড (ব্রিগেডিয়ার রাজিন্দর নাথ), ১৪ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট, ১৯ মারাঠা লাইট ইনফ্যান্ট্রি, ২ শিখ লাইট ইনফ্যান্ট্রি, মুক্তিবাহিনী (সদস্য সংখ্যা অজানা)।
যুদ্ধের অবস্থান
ক. পাকিস্তানি বাহিনী: ১০৭ ব্রিগেড অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার মালিক হায়াত খান যশাের এলাকাকে ভারতীয় আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য তার ব্রিগেডের অধীনস্থ ইউনিটগুলােকে সম্ভাব্য সব অক্ষে মােতায়েন করেন। তার পরিকল্পনা অনুযায়ী বয়রা-চৌগাছা-যশাের অক্ষে আফ্রা নামক স্থানে ৬ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট, ঝিকরগাছা অক্ষে ২২ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্ট, সাতক্ষীরা অক্ষে ১৫ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্ট প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করে এবং ২১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টকে যশাের সেনানিবাসে রিজার্ভ হিসেবে রাখা হয়। ঘ. যৌথ বাহিনী: যৌথ বাহিনীর ৪২ ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেডের ১৪ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট ২০ নভেম্বর বয়রা সীমান্ত দিয়ে কপােতাক্ষ নদ অতিক্রম করে গরিবপুর এলাকায় প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করে।
যুদ্ধ পরিকল্পনা
ক. পাকিস্তানি বাহিনী: পাকিস্তান বাহিনীর ১০৭ ব্রিগেড অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার মালিক হায়াত খান গরিবপুর এলাকায় মুক্তিবাহিনীর ১টি কোম্পানি অবস্থানের কথা জানতে পেরে ২১ নভেম্বর ভােরে আক্রমণের মাধ্যমে গরিবপুর দখল করার পরিকল্পনা করেন। তার পরিকল্পনা অনুযায়ী ট্যাংক ও আর্টিলারির সহায়তায় ৬ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ২টি কোম্পানি চৌগাছা হতে প্রতিরক্ষার উত্তরে এবং ২১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ২টি কোম্পানি আফ্রা এলাকা হতে প্রতিরক্ষা অবস্থানের পূর্বে আক্রমণ করবে।
খ। যৌথ বাহিনী:
যৌথ বাহিনী যশাের অভিমুখে সম্ভাব্য সব অক্ষ পরিহার করে বয়রা থেকে গরিবপুর হয়ে আফ্রা পর্যন্ত অগ্রাভিযানের পরিকল্পনা করে। এর ফলে সংক্ষিপ্ত রাস্তায় যশাের পৌছানাে সম্ভব ছিল। উপরন্তু এ পথে কপােতাক্ষ নদ ব্যতীত অন্য কোনাে বড়াে ধরনের প্রতিবন্ধকতা ছিল না। তা ছাড়া আফ্রা পর্যন্ত দখল সম্ভব হলে চৌগাছায় অবস্থানরত পাকিস্তানি বাহিনী যশাের থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। তাই ৯ ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল দলবীর সিং মাউন্টেন ৪২ ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেডের সাহায্যে গরিবপুর দখলের মাধ্যমে তার অগ্রাভিযান পরিকল্পনা করেন।
যুদ্ধের বিবরণ
জিওসি ৯ মাউন্টেন ডিভিশন তার অধীনস্থ ৪২ ব্রিগেডকে ২০-২১ নভেম্বর রাতের মধ্যে গরিবপুর এলাকা দখল করে প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করার জন্য আদেশ দেন। ৪২ ব্রিগেডের ১৪ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট ২০ নভেম্বর সকাল সাড়ে ৭টায় বয়রা সীমান্ত দিয়ে ইঞ্জিনিয়ারের সহায়তায় কপােতাক্ষ নদ অতিক্রম করে। সন্ধ্যার কিছু পূর্বেই পিটি-৭৬ ট্যাংকসহ গরিবপুর এলাকায় অবস্থান গ্রহণ করে।। দিনের বেলায় রেকি করা সম্ভব ছিল না বিধায় রাতের অন্ধকারেই গরিবপুর-জগন্নাথপুর সংযােগকারী কাঁচা রাস্তার উভয় পার্শ্বে ১৪ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট লিনিয়ার’ প্রতিরক্ষা অবস্থান নেয়। ভাের সাড়ে ৫টায় প্রতিরক্ষায় অবস্থানকারী ১৪ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট সম্ভাব্য পাকিস্তানি আক্রমণের ব্যাপারে ব্রিগেড সদরকে জানায়। কিন্তু কুয়াশার কারণে দৃষ্টিসীমা ব্যাহত হওয়ায় আক্রমণের যথার্থতা এবং দিক সম্পর্কে তারা নিশ্চিতভাবে কিছু বলতে পারছিল না। 
অন্যদিকে, ২০ নভেম্বর পাকিস্তানি ১০৭ ব্রিগেডের ব্রিগেড অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার মালিক হায়াত খান গরিবপুর এলাকায় মুক্তিবাহিনীর একটি কোম্পানির প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণের খবর জানতে পারেন। ২১ নভেম্বর ভােরের মধ্যে আক্রমণের মাধ্যমে ঐ কোম্পানিকে গরিবপুর থেকে অপসারণের ব্যাপারে তিনি তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। গরিবপুরে যৌথ বাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থানের উত্তর এবং পূর্ব দিক থেকে ২১ নভেম্বর সকাল ৬টায় পাকিস্তানি বাহিনীর ২১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ২টি কোম্পানি আক্রমণ শুরু করে। কুয়াশার কারণে খুব অল্প সময়ে পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণকারী ট্যাংকগুলাে প্রতিরক্ষার প্রায় ১০০ গজ নিকটে পৌছে যায়। উভয় পক্ষের আর্টিলারি গানগুলাে তখন প্রত্যক্ষ সহায়তায় গােলা বর্ষণ করতে থাকে, কিন্তু কুয়াশার কারণে টার্গেট রেজিস্ট্রেশন সম্ভব ছিল না বলে। ফায়ার ততটা কার্যকর হয় নি। আক্রমণের এ পর্যায়ে কুয়াশার কারণে ২১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ২টি কোম্পানি আক্রমণের অগ্রভাগের ট্যাংকের সাথে সমন্বয় রাখতে না পেরে পিছিয়ে পড়ে। ফলে সহজেই যৌথ বাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থান থেকে পিটি-৭৬ ট্যাংক ও ট্যাংকবিধ্বংসী অস্ত্রের মাধ্যমে আক্রমণকারী পাকিস্তানি ট্যাংকগুলােকে ধ্বংস অথবা বিকল করে ফেলা সম্ভব হয়। ইতােমধ্যে পাকিস্তানি বাহিনীর ৬ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ২টি কোম্পানি চৌগাছা অক্ষে সংগঠিত হয়ে গরিবপুর প্রতিরক্ষার পশ্চিম দিক থেকে আক্রমণ শুরু করে। পাকিস্তানি বাহিনীর এ আক্রমণ আংশিক সফল হয় এবং তারা পশ্চিম দিক থেকে গরিবপুর গ্রামের। অভ্যন্তরে প্রবেশ করে।
এ আক্রমণে যৌথ বাহিনীর ১৪ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ‘সি’ কোম্পানির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় এবং তারা অবস্থান ত্যাগ করে পিছু হটে যায়। ইতােমধ্যে কুয়াশা কেটে যাওয়ায় পাকিস্তান বিমানবাহিনীর স্যাবর জেট আক্রমণের সহায়তায় বােমা বর্ষণ করে। কিন্তু এ বিমান সহায়তা ছিল অল্প সময়ের জন্য ট্যাংক ও আর্টিলারির প্রত্যক্ষ সহায়তা না থাকায় ৬ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট তাদের সফলতাকে ধরে রাখতে ব্যর্থ হয় এবং গরিবপুর গ্রামের অভ্যন্তরে ব্যাপক হাতাহাতি যুদ্ধের পর কোম্পানি ২টি পিছু হটতে বাধ্য হয়। এবং সকাল ১০টার মধ্যে সম্পূর্ণ গরিবপুর এলাকায় যৌথ বাহিনীর ১৪ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট পুনরায় তাদের অবস্থান সুদৃঢ় করে। গরিবপুরে পাকিস্তানি বাহিনী একটি শক্তিশালী আক্রমণ রচনা করেছিল। এ আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনী একই সঙ্গে ট্যাংক, আর্টিলারি ও বিমান সহায়তা ব্যবহার করে। কিন্তু এ ব্যর্থ আক্রমণে তাদের প্রায় ১টি ট্যাংক স্কোয়াড্রন (১১টি ট্যাংক) সম্পূর্ণ ধ্বংস হয় এবং হতাহত হয় অনেকেই তাদের নিহত কিংবা আহতদের সঠিক পরিসংখ্যান জানা সম্ভব হয় নি। যুদ্ধে যৌথ বাহিনীর ১৯জন নিহত, ৪৪জন আহত এবং ২টি ট্যাংক সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত হয়।
শিক্ষণীয় বিষয়গুলাে
ক. গােয়েন্দা তথ্য:
পাকিস্তানি বাহিনী গরিবপুরে যৌথ বাহিনীর অবস্থান সম্পর্কে সম্পূর্ণ ভুল তথ্য পেয়েছিল। তাদের গােয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী গরিবপুরে মুক্তিবাহিনীর ১টি কোম্পানি প্রতিরক্ষা অবস্থানে রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে ছিল ১টি রেজিমেন্ট। এর ফলে পাকিস্তানি বাহিনী একটি মাত্র রেজিমেন্ট নিয়ে আক্রমণ পরিচালনা করে এবং প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির স্বীকার হয়।
খ, ইনফ্যান্ট্রি ট্যাংক সমন্বয়:
আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনীর পদাতিক ও ট্যাংকগুলাের সঠিক সমন্বয় না থাকায় পদাতিক বাহিনীর অনেক পূর্বে ট্যাংক যৌথ বাহিনীর প্রতিরক্ষায় পৌছে যায়। ফলে খুব সহজেই ট্যাংকগুলােকে ঘায়েল করে ফেলা সম্ভব হয়। পরবর্তী সময় আক্রমণে ট্যাংকের সহায়তা না থাকায় তাদের পদাতিক বাহিনী আক্রমণে সফল হতে পারে নি।
আবহাওয়া:
আক্রমণের সময় কুয়াশার কারণে পাকিস্তানি বাহিনী তাদের পদাতিক, ট্যাংক ও আর্টিলারির সমন্বয় করতে পারে নি। ঘন কুয়াশার কারণে লক্ষ্যবস্তু সম্পর্কে আক্রমণকারী পাকিস্তানি বাহিনীর সঠিক ধারণা ছিল না।
জনগণের সমর্থন:
গরিবপুরে যৌথ বাহিনীর অবস্থান গ্রহণ, তাদের পথ প্রদর্শন, গােয়েন্দা কার্যক্রম, এমনকি প্রশাসনিক কাজেও স্থানীয় জনগণ স্বতঃস্ফূর্ত সহায়তা প্রদান করে। স্থানীয় জনগণের অসহযােগিতার কারণে পাকিস্তানি বাহিনী যৌথ বাহিনীর অবস্থান সম্পর্কে ভুল তথ্য পেয়েছিল।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – সপ্তম খন্ড