You dont have javascript enabled! Please enable it!
বর্ণী বিওপি’র যুদ্ধ
ভৌগােলিক অবস্থান। বর্ণী বিওপি সমতল এলাকায় অবস্থিত। এটি চৌগাছা থানা শহর থেকে আনুমানিক ১১ কিলােমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত। এর উত্তরে কাটগড়া বাওড় এবং পূর্বে কানকুড়িয়া বাঁওড় অবস্থিত। বর্ণীর সাথে চৌগাছা, মেহেরপুর ও কোটচাদপুরের যােগাযােগ রয়েছে। চারপাশে গাছপালায় ঘেরা এ এলাকার। মধ্যে অনেক কাচা রাস্তা রয়েছে। এসব রাস্তা ১০-১৫ ফুট চওড়া এবং ভূমি। থেকে ৫-৬ ফুট উঁচু বলে পর্যবেক্ষণ ও আড় থেকে ফায়ার প্রদান করা যায়। বর্ণী বিওপি’র অবস্থান কৌশলগত দিক দিয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের বাগদাহা এলাকা থেকে পােড়াপাড়া হয়ে একটি রাস্তা চৌগাছা পর্যন্ত চলে গেছে, যা দিয়ে কোম্পানি আকারের চেয়েও বড়াে ধরনের সেনা দলের অগ্রাভিযান। পরিচালনা করা সম্ভব। বর্ণী বিওপি বাগদাহা-পােড়পাড়া-চৌগাছা অক্ষের উপর অবস্থিত সুরক্ষিত অবস্থান এবং কৌশলগত দিক থেকে এ এলাকার বিওপি বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। যুদ্ধের সংগঠন ও অবস্থান ক, মুক্তিবাহিনী: ক্যাপটেন খন্দকার নাজমুল হুদার নেতৃত্বে ‘ডি’ কোম্পানি।
মােতায়েন ছিল ৮ নম্বর সেক্টরের বয়রা সাব-সেক্টরে। এতে আনুমানিক ৪০০জন মুক্তিযােদ্ধা মােতায়েন ছিল। বর্ণী বিওপি এলাকা। বয়রা সাব-সেক্টরের আওতাধীন ছিল। আনুমানিক ৯০জন মুক্তিযােদ্ধা ৩টি ভাগে বিভক্ত হয়ে ৩টি অবস্থান থেকে এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। জানা যায়, রাজাপুর এলাকায় আব্দুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে ছিল ১ সেকশন মুক্তিযােদ্ধা। রামকৃষ্ণপুর গ্রামে সৈয়দ গােলাম কবিরের নেতৃত্বে ছিল ১ সেকশন এবং ইউনিয়ন পরিষদ ভবন-পােড়াপাড়া রাস্তা বরাবর ২ প্ল্যাটুন মুক্তিযােদ্ধা ক্যাপটেন নাজমুল হুদার নেতৃত্বে ছিল। পাকিস্তানি বাহিনী: বর্ণী বিওপিতে ৭৫জন পাকিস্তানি সেনার একটি মজবুত ঘাঁটি ছিল। এ দলের অধিনায়ক ছিল ক্যাপটেন আব্বাস। বিওপি বিধায় চারদিকে পূর্ব থেকেই প্রস্তুতকৃত বাংকার ছিল এবং সেখানে ভারী অস্ত্র মােতায়েন ছিল। বিওপি’র উত্তর দিকে একটি বড়াে আকারের পুকুর ছিল। বিওপি থেকে ক্রল ট্রেঞ্চ পুকুর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল এবং পুকুরের পার্শ্বেও অস্ত্রের বাংকার ছিল। পুকুরের এক পার্শ্বে গাছের উপর একটি ওপি ছিল।
যুদ্ধের পরিকল্পনা ক. মুক্তিবাহিনী: বয়রা সাব-সেক্টরে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য লঞ্চিং প্যাডের প্রয়ােজন ছিল। বর্ণী বিওপিতে অবস্থিত পাকিস্তানি বাহিনীর এ শক্ত অবস্থানকে নিজেদের দখলে আনার লক্ষ্য ছিল বিস্তর পশ্চিম সীমান্ত এলাকা শত্রুমুক্ত করা। এর ফলে সেখান থেকে যুদ্ধ পরিচালনা সম্ভব হবে এবং তাতে নানাবিধ কৌশলগত সুবিধা পাওয়া যাবে। কাজেই বর্ণী বিওপি থেকে পাকিস্তানি বাহিনীকে হটানাে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য। খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল এবং পরিকল্পনা মাফিক মুক্তিবাহিনী এ বিওপি আক্রমণ করেছিল। পাকিস্তানি বাহিনী: পাকিস্তানি বাহিনীর পরিকল্পনা সম্পর্কে যথেষ্ট তথ্যসংগ্রহ করা সম্ভব হয় নি। তবে অনুমান করা যায়, বর্ণী বিওপি’র মতাে এরূপ কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান (যেখানে সীমান্তের অপর প্রান্ত থেকে আগত যে-কোনাে বাহিনীর অগ্রাভিযান প্রতিহত করা যায়) শক্তভাবে ধরে রাখার জন্য পাকিস্তানি বাহিনী যথেষ্ট সংকল্পবদ্ধ ছিল। মুক্তিযােদ্ধাদের আক্রমণ। ক্যাপটেন নাজমুল হুদা প্রায় ২ কোম্পানি মুক্তিযােদ্ধা নিয়ে ৫ আগস্ট বর্ণী। বিওপিতে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনাদের উপর আক্রমণ চালান। মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের মুখে পাকিস্তানি সেনারা তাদের ১৫জনের লাশ ফেলে রেখে চলে যায়। ফলে বর্ণী বিওপি থেকে ক্যাপটেন নাজমুল হুদা ও তাঁর যােদ্ধারা অস্ত্র ও গােলাবারুদ নিজেদের মূল ঘাটিতে নিতে শুরু করেন। এমতাবস্থায় পাকিস্তানি সেনারা পিছন থেকে অগ্রসর হয়ে মুক্তিবাহিনীর উপর পালটা আক্রমণ করে। মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি বাহিনীর এরূপ আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিল না। সংঘর্ষে মুক্তিবাহিনীর ৪জন মুক্তিযােদ্ধা শহিদ হন। কিন্তু ক্যাপটেন নাজমুল হুদা মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পান। ল্যান্স নায়েক নূর মােহাম্মদ শেখ (শহিদ হন এবং পরবর্তীকালে বীরশ্রেষ্ঠ খেতাব লাভ করেন) ও হাবিলদার আবুল হােসেনের সাহায্যে ক্যাপটেন নাজমুল হুদা খাল পার হয়ে অন্যদের নিয়ে নিরাপদ স্থানে ফিরে আসেন।
মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ ব্যর্থ হওয়ার কারণ মুক্তিবাহিনীর উদ্দেশ্য সফল না হওয়ার পিছনে বেশ কিছু কারণ ছিল, যার বিবরণ নিম্নে দেওয়া হলাে: ক. আর্টিলারির সহায়তা না থাকা: বর্ণী বিওপিতে অবস্থানরত শত্রুর শক্ত অবস্থানকে ধ্বংস করার জন্য প্রয়ােজনীয় আর্টিলারি বা মর্টারের সাপাের্ট ছিল না। ফলে ভারী অস্ত্রের ফায়ারের মাধ্যমে শত্রুকে দুর্বল করে আক্রমণ পরিচালনা করা সম্ভব হয়নি। বর্ণী বিওপি’র এ যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করলেও আর্টিলারি সহায়তা না থাকার ফলে তারা তাদের সাফল্য অর্জন করতে পারে নি। ফলে পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের মুখােমুখি হয়েও সুবিধাজনক অবস্থানে গিয়ে পালটা আক্রমণ করে এবং নিজেদের অবস্থান পুনর্দখল করে। কাজেই এরূপ আক্রমণের জন্য সব সময় ফায়ার সাপাের্টের সহায়তা থাকা প্রয়ােজন। আক্রমণে সাফল্যের পর শত্রুর পালটা আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য প্রস্তুত না থাকা: প্রাথমিক আক্রমণে পাকিস্তানি সেনাদের পিছু হটিয়ে। দিয়ে মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা পরাজিত সৈনিকদের অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহে ব্যস্ত ছিলেন। এ যুদ্ধের প্রাথমিক সাফল্য ছিল মুক্তিবাহিনীর জন্য অত্যন্ত। আশাব্যঞ্জক একটি ঘটনা। কিছু প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযােদ্ধা পাকিস্তানি বাহিনীর এ শক্ত ঘাঁটি দখল করতে পেরে তারা নিজেদের অস্ত্রে সুসংগঠিত করা এবং পরবর্তী সময় আরও সংগঠিত আক্রমণ পরিচালনার জন্য পাকিস্তানি বাহিনীর ফেলে যাওয়া অস্ত্র সংগ্রহে ব্যস্ত ছিল। শক্রর পালটা আক্রমণের বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হয় নি। তাই মুক্তিযােদ্ধাদের দখলকৃত অবস্থান আবার পাকিস্তানি সেনারা দখল করে নেয় পালটা আক্রমণের মাধ্যমে।
কাজেই শক্রর অবস্থান দখলের পর শত্রুর পালটা আক্রমণকে প্রতিহত করার জন্য অবশ্যই পূর্বপ্রস্তুতি গ্রহণ করা প্রয়ােজন। যুদ্ধে অর্জিত প্রাথমিক সাফল্য ধরে রাখতে ব্যর্থ হওয়া: যুদ্ধে অর্জিত প্রাথমিক সাফল্যকে ধরে রেখে সেটাকে পরবর্তী সাফল্যের জন্য ব্যবহার করা যুদ্ধের একটি অন্যতম দিক। মুক্তিবাহিনীর পক্ষে তাদের এ প্রাথমিক সাফল্য সঠিকভাবে সদ্ব্যবহার করা সম্ভব হয় নি বলে এ যুদ্ধে জয়লাভ করা সম্ভব হয় নি। পাকিস্তানি বাহিনীর সাফল্যের কারণ এ যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর সাফল্য লাভ করার কারণ নিম্নরূপ: ক, পালটা আক্রমণ: সাহসিকতার সাথে পালটা আক্রমণ করলে সাফল্য অর্জন করা সম্ভব। পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিবাহিনীর দুর্বল প্রতিরক্ষা অবস্থানের সুযােগ নিয়ে পালটা আক্রমণ চালায়। ফলে তারা সাফল্য। লাভ করে। সঠিক প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা: বর্ণী বিওপিতে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা ছিল সঠিক। তারা পূর্ব থেকেই পরিকল্পনায় রেখেছিল যে, যুদ্ধের সময় কোথায় তারা মূল প্রতিরক্ষা অবস্থান ও বিকল্প প্রতিরক্ষা অবস্থান নিবে, কোথায় কাউন্টার পেনিট্রেশন অবস্থান নিবে এবং কোন দিক থেকে পালটা আক্রমণ করবে। এরূপ প্রতিরক্ষা। পরিকল্পনার জন্য পাকিস্তানি বাহিনী নিজেদের অবস্থান পুনর্দখল করতে সমর্থ হয়।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – সপ্তম খন্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!